পথের ধারে দূর্বাফুল পর্ব -০৩

৩.

সন্ধ্যা বিদায় হয়ে সবে রাত নেমেছে বিশাল আকাশে। সোডিয়ামের আলোয় সেজেছে রাজপথ। হলুদ বর্ণা লাইট গুলো ভিজে রাস্তায় এক দারুন রং দিয়েছে। মোহনীয়, মায়াবী, লাজুক লাগছে রাজপথকে। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হওয়ার কারণে রাস্তা এখন প্রায় ফাঁকা। মাঝে মাঝে সাঁইসাঁই করে ছুটে যাচ্ছে বিশাল গাড়ি। পহেলা আষাঢ়ের মুগ্ধ রজনীতে মুখ ভার করে বসে আছে বর্ণ। গাড়ির হেডলাইট গুলো জ্বলছে। নিস্তব্ধ রাস্তায় এক আকাশ বিষন্নতা নিয়ে বসে থাকতে খারাপ লাগছে না তার। বরং অবসাদটা ভালো লাগছে। আজকাল তার মন আকাশ কালো করে মন খারাপ হয়। এ মন খারাপের কোনো কারণ নেই,ভিত্তি নেই। তবুও এ মন খারাপটা মনকে তৃপ্তি দেয়। আজকাল তার বিনা কারণে হাসি আসে আবার বিনা কারণেই বিষাদ নামে বুকে। আর তার জীবনের এহেন অদ্ভুত কর্মকান্ডের জন্য একজন দ্বায়ী। সে হলো- দূর্বাফুল! পথের ধারের অযন্তেন খু্ব দামী ফুল।

“নক,নক। গাড়ির স্বচ্ছ কাচ খানা কী একটু নামানো যাবে,ডাক্তার সাহেব?”

রিনেরিনে শব্দ কর্ণগোচর হতেই বর্ণের ধ্যান ভাঙলো। পাশ ফিরে জানালার দিকে তাকাতেই সে চমকে গেলো,থমকে গেলো। অজান্তেই শীতল হলো প্রেম পায়রা। অবাক কণ্ঠে রাজ্যের বিষ্ময় নিয়ে বললো,
“দূর্বাফুল, আপনি?”

কাচের বিপরীতে থাকা রমনী বর্নের মুখ ভঙ্গি দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ডান ভ্রু ক্ষানিকটা উঁচু করে বললো,
“চিনেছেন তবে?”

বর্ণ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে মিনমিন করে বললো,
“রাতের ঘুম হারাম করেছেন,আর আপনাকে চিনবো না!”

বর্ণ খুব ধীরে কথাটা বললেও রমনীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারে নি সে অভিব্যক্তি। রমনী আবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। ঠাট্টার স্বরে বললো,
“আহারে ডাক্তার সাহেব, মুখ চোখ এমন শুকিয়ে গেছে যে?”

“মুখ চোখ শুকানোর কারণ হয়ে ঠাট্টা করছেন, দূর্বাফুল?”

রমনী মুচকি হাসলো। সোডিয়ামের আলোতে কী দারুণ লাগছে সেই হাসি! ছাঁই রাঙা শাড়িটার আঁচল ক্ষাণিকটা লুটোপুটি খাচ্ছে রাজপথে। বর্ণ সেখানে দৃষ্টি দিয়ে শীতল কণ্ঠে বললো,
“আঁচল টা সামলে নিন। গড়াগড়ি খাচ্ছে যে! এই আঁচলেই তো বাঁধা পরেছি আমি।”

নীলাম্বরী সাথে সাথে আঁচলটা উঠিয়ে নিলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
“আজ কী হলো ডাক্তার সাহেবের? এত উন্মাদনা?”

বর্ণ এবার উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে চোখে জল গড়িয়ে পড়লো। ডান হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুলটা দিয়ে চোখের কোণে জলটা মুছে ঠাট্টার স্বরে বললো,
“আপনি আমাকে হুটহাট উন্মাদনা, মাদকতা ভরপুর কথা দিয়ে অস্বস্তিতে ফেলতে পারলে,আমি কেন পারবো না? আমিও একটু চেষ্টা করলাম আপনার মতন করার।”

“বাহ্ ডাক্তার সাহেব, বেশ উন্নতি হয়েছে তো আপনার। হঠাৎ এত রসিকতা ভর করেছে যে শরীরে?”

“কত আর বিষাদ নিয়ে থাকবো? পুরো জৈষ্ঠ্যমাস তো বিষাদ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো। এবার একটু রসিকতা করি। আপনি তো আবার আষাঢ়ে উধাও হয়ে পুরো মাসকে বিষন্নতায় ভরিয়ে দিবেন। আপনি আসেন কেনো বিষাদ দিতে? মন আকাশে রিক্ততা না দিলে হচ্ছিলো না আপনার?”

“এই যে এতক্ষণ শোক পালন করছিলেন আমি আজ আসি নি বলে,সেটা বুঝি আমি জানিনা! আপনার মন আকাশ যে আপনার বিরুদ্ধে গিয়েও দূর্বাফুলে আসক্ত হচ্ছে সে খবর রাখেন?”

বর্ণ কিছু বলবে তার আগেই ছোট্ট একটা ছেলে নীলাম্বরীর আঁচল ধরে টান দিলো। নীলাম্বরী সামান্য চমকে পিছে ফিরে তাকালো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“জি বাবা,বলুন?”

বর্ণ মুগ্ধ হলো রমনীর কথার ধরণে। এই বাচ্চা গুলোকে পথশিশু বলা হয়। তাদের সাধারণত মানুষ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, এত সুন্দর ব্যবহার করবে তো দূরের কথা ফিরেও তাকায় না। দূর্বাফুল কত সুন্দর করে বাচ্চাটাকে শুধালো! এ নারী মানেই যেন এক আকাশ মুগ্ধতা। এত মায়া কেন তার রিনরিনে শব্দগুচ্ছে!

এই শীতল পরিবেশে পোশাক বিহীন ছেলেটা ভাঙা কর্কশ গলায় বললো,
“আমার অনেক ক্ষুধা লাগছে। আমারে কিছু টেহা দেন না।”

ভিজে রাস্তায় দিক বেদিক ভুলে নীলাম্বরী বসে পরলো। আদুরে হাতে বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“আজ খান নি বুঝি কিছু? আর শীত করছে না? এত ঠান্ডার মাঝেও আপনি পোশাক ছাড়া ঘুরছেন যে!”

“আমার জামাডা ভিইজা গেছে। একটা জামা তো। ভিজার কারণে আম্মা কইছে খুইলা রাখতে।”

রমনী আর কিছু শুধালো না। বা’পাশের বাহুতে ঝুলে থাকা ব্যাগটা থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করে বাচ্চাটার হাতে ধরিয়ে দিলো। বাচ্চাটার খুশিতে মুখটা চিলিক দিয়ে উঠলো। উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,
“আপনে ম্যালা ভালা,আপা। আপনে ম্যালা ভালা।”

বর্ণ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো রমনীর পানে। কি অবলীলায় মেয়েটা মিশে গেছে এই পথশিশুটার সাথে! এই রমনী কোনো জাদু জানে। মন ভালো করার জাদু। এই যে একটু আগে বর্ণের মন আকাশ জুড়ে যেই ভয়াবহ মন খারাপের দুর্যোগ টা ছিলো,এখন তার একাংশও নেই।

“আপনার নাম কী, বাবা?”

“তুলতুল।”

নীলাম্বরীর প্রশ্নের বিপরীতে ছেলেটা কী সুন্দর করে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে উত্তরটা দিয়ে দিলো! নীলাম্বরী তার ব্যাগে আবার হাত দিলো। খচখচ শব্দ করে একটা প্যাকেট বের করলো। বর্ণ কেবল নিশ্চুপ দেখে যাচ্ছে রমনীর কার্যকলাপ।

নীলাম্বরী এবার প্যাকেট টা থেকে একটা শার্ট বের করলো। বেশ বড়সড় মাপের শার্ট। শার্টের বোতাম গুলো খুব যত্নের সাথে বাচ্চাটার গায়ে জড়িয়ে দিলো। আবার খুব যত্ন সহকারে লাগিয়ে দিলো বোতাম গুলো।

শুকনো কঙ্কালসার দেহটায় সাদা ঝলমলে শার্টটা কেমন অদ্ভুত দেখালো। একদম ঢোলা। নীলাম্বরী নিজেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। বাচ্চাটার গাল টেনে বললো,
“বাবা,এটা আমি আরেকজনের জন্য কিনে ছিলাম। কিন্তু এখন এটা আপনাকেই ভালো মানাচ্ছে। এই ঠান্ডার মাঝে খালি গায়ে না থেকে আপনি বরং এটা পরে থাকুন। কেমন!”

বাচ্চা টা অনবরত মাথা নাড়ালো। উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো,
“কী আরাম জামাটাতে।”

নীলাম্বরী বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলাতেই বাচ্চাটা ছুটে চলে গেলো৷ বর্ণ এতক্ষণ সবটা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলো। বাচ্চা টা চলে যেতেই সে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“আমার জন্য ছিলো শার্ট টা,তাই না?”

নীলাম্বরী ভারি অবাক হলো। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“আপনি কীভাবে জানলেন?”

“আপনার সাথে থাকতে থাকতে, সামান্য জাদু আমিও শিখেছি, দূর্বাফুল। সেই জাদুবিদ্যা দিয়েই জেনেছি।”

বর্ণের কথার ধরণে নীলাম্বরী আবারও হাসলো। মেয়েটার বোধহয় কথায় কথায় হাসার স্বভাব। কারণে অকারণে হাসে। মানবকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ না করালে যেন তার চলেই না।

“জানেন,আজ তুমুল বৃষ্টি হবে। চা খাবেন এক কাপ?”

নীলাম্বরীর সহজ সরল প্রস্তাবে নাকচ করলো ডাক্তার সাহেব। চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
“সেদিন তো চায়ের কাপ সংগ্রহ করার জন্য চা খেয়েছিলেন। আজ উদ্দেশ্য কী?”

“আপনার সাথে একটু সময় কাটানোই মূল উদ্দেশ্য। বাকি গুলো তো রঙচঙে, জাঁকজমক অজুহাত।”

“তবে চলুন ফুটপাত দিয়ে হাঁটি।”

বর্ণ কথাটা বলার সাথে সাথে তুমুল বর্ষণ শুরু হলো পরিবেশে। ডাক্তার সাহেব বাহবা দিয়ে বললো,
“বাহ্ দূর্বাফুল,দারুণ জানেন তো আবহাওয়া সম্পর্কে। সত্যিই তো বৃষ্টি নামলো।”

নীলাম্বরী কিছু বলার আগেই তার কাঙ্খিত বাস এলো। নীলাম্বরী ছুটে বাসে উঠে গেলো। জানালার পাশে সিট টাতে বসে হতভম্ব বর্ণের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে বললো,
“আজ পথটিকে ধন্য করে হলো না হাঁটা,
পাশাপাশি নিশ্চুপ থেকে হলো অনুভূতির ঘনঘটা,,
আমি এক অযত্নের পরে থাকা ফুল
কেনো হও প্রিয়, ভীষণ আকুল?
আবারও দেখা হবে প্রিয়,
তখনো যত্নে আগলে নিও,
বিষাদ টুকু আমায় দিও।”

গাড়ি চলে গেলো তার আপন গতিতে। বর্ণ তাকিয়ে রইলো সেদিকে নিষ্পলক। দীর্ঘ শব্দে বজ্রপাত হলো আকাশে। বর্ণের চোখের পাতা পড়লো। মনিটা এদিক ওদিক নড়ে উঠলো। নোনা অশ্রুকণা ধুয়ে গেলো বৃষ্টির জলে। এক বিষন্ন মাখা হাসি দিয়ে ডাক্তার সাহেব বলে উঠলো,
“মাস খানেকের বিষন্নতা দিলেন, দু-হাত উজাড় করে,
এভাবে হৃদয়ের প্রেম পায়রা,বিষাদে যায় যে ঝরে।
আপনি আমার না বলা অনুভূতির দামী ফুল,,
তাইতো ধীরে ধীরে হচ্ছি আকুল।”

#পথের_ধারে_দূর্বাফুল
©মম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here