পথের ধারে দূর্বাফুল পর্ব -০৪

#পথের_ধারে_দূর্বাফুল
#মম_সাহা

৪.

“ওহে প্রেম,তোমার দহন বেশি
বুকে আঁকো বিষাদ
অমৃতও তুমি দান করো দু’হাতে
প্রেমের কী র*ক্তা’ক্ত স্বাদ!”

টেবিলের উপর শুভ্র রাঙা কাগজ খানায় জ্বলজ্বল করছে চার লাইনের এই কবিতা খানা। রুমের আকাশী রাঙা অবগুণ্ঠন গুলো উড়ে যাচ্ছে শ্রাবণ মাসের ঝড়ো বাতাসে। পরিবেশ, আকাশ আর প্রেমিক পুরুষের মনে দা*নবীয় তা*ন্ডব চালাচ্ছে ঝড়। রোগীর আপাতত ভীড় কম। এমন ঝড়ো হাওয়ায় খুব বেশি প্রয়োজন না হলে তো মানুষ ঘর থেকে বের হয় না, হসপিটালে আসা তো পরের ব্যাপার।

আজ দোসরা শ্রাবণ। সকাল হতেই প্রকৃতি বেশ গুমোট হয়ে আছে। অথচ বর্ণ আজ উত্তেজিত। তার হুট করেই মনে হচ্ছে আজ বিশেষ কিছু হবে। যেই বিশেষ কিছুর জন্য সে পুরো একটা মাস অপেক্ষা করে থাকে। শরীরে আজ শোভিত হয়েছে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। বা’হাতে কালো ঘড়ি। চুল গুলো কিঞ্চিৎ এলোমেলো, মুখ ভর্তি চাপদাড়ি যা একমাসের অনাদরে ক্ষানিক বড় হয়েছে। যে কেউ এক দেখাতে তাকে সুপুরুষ বলতে বাধ্য। গায়ের চামড়া অব্দি বিশুদ্ধ উজ্জ্বল রাঙা। দশজনের মাঝে দাঁড়ালে অনায়াসে সে নজর কাড়তে সক্ষম।

হসপিটালের বরাদ্দ করা নিজের ব্যাক্তিগত রুমটাতে মন বসলো না আজ ডাক্তার সাহেবের। ছটফটিয়ে উঠছে হৃদয় আঙ্গিনা। চোখের পলকে পলকে ঘড়ির কাটায় দৃষ্টি বুলায়, কখন বিকেল হবে সে আশাতে। মন অধৈর্য হয়, চিত্ত রুষ্ট হয়, আজ যেন সময় কাটতেই চাচ্ছে না। অদ্ভুত!

অবশেষে ঘড়ির কাটা টিংটিং করে জানান দিলো পরিবেশে অপরাহ্নের আগমন ঘটেছে। সাথে সাথেই আরাম কেদারা হতে ধপ করে উঠে দাঁড়ালো সে, ধুপধাপ পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।

বৃষ্টির বেগ কমেছে, চিপ চিপে কাঁদায় রাস্তাঘাট মাখো-মাখো অবস্থা। সেই চিপ চিপে কাঁদা দিয়ে ডাক্তার সাহেব মনের আনন্দে হেঁটে হেঁটে শাহবাগের ফুলের দোকান গুলোর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হরেক রকমের ফুলের গন্ধে মন মোহিত হয়ে পড়লো, কিছু ভ্রম জাগালো মস্তিষ্কে। হঠাৎ করেই জীবনটা ভীষণ মিষ্টি লাগতে শুরু করলো। একটা মানুষের আগমনে হুট করেই সবটা কত অসাধারণ মনে হচ্ছে! এমনটা বুঝি প্রেমে পড়লেই ঘটে।

ফুলের দাম বরাবরই একটু বেশি। তবে বর্ণের কাছে ফুলের দাম বেশি হওয়াটাই যেন যুক্তিযুক্ত। প্রেমের প্রতীক ফুল, ভালোবাসার শুভারম্ভ ফুল, আর সেই ফুল বড্ড সস্তা হলে কেমন বেমানান লাগবে না?

অবশেষে কাঠগোলাপের একটা থোঁকা খুঁজে বের করে ক্রয় করেই ক্ষান্ত হলো প্রেমিক। বেশ মানাবে মেয়েটাকে কাঠগোলাপে। অবশ্য মেয়েটা নিজেই তো একটা ফুল, দূর্বাফুল। ভীষণ অযত্নের দামী ফুল!

আকাশ কাঁপিয়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। নতুন উদ্যমে শুরু হলো বৃষ্টি। বর্ন নিজের হাত ঘড়িটায় একটু চোখ বুলিয়ে নেয়, সময়টা ঠিক পাঁচটা পয়তাল্লিশ মিনিট। এই ভয়ঙ্কর বৃষ্টিতে পথ চলাটা নিত্যান্তই বোকামি ছাড়া কিছু নয় ভেবেই একটা টিনের নড়বড়ে ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ায় বর্ণ। মিনিটে মিনিটে বৃষ্টির ছাট বাড়ছে বৈ কমছে না। বর্ণ এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো সেই বৃষ্টির পানে। আচ্ছা, সে যে এত যত্ন করে আজ বিশেষ সাজগোজ করলো, ফুল কিনলো, যদি সবটাকে বৃথা করে দিয়ে সেই মানবী আজ না আসে তাহলে কী হবে? ভীষণ অভিমান জমবে বুকে। চোখ-মুখ ফুলিয়ে কয়েকদিন কথা বন্ধ করে রাখার মতন অভিমান। বর্ণের মন হঠাৎ বিদ্রোহ ঘোষণা করলো, না না এটা হতেই পারে না। অবশ্যই আজ মানবী আসবে।

ভাবনার মাঝেই বর্ণের বা’হাতটা বেশ শক্ত করে কেউ আঁকড়ে ধরলো। তুলতুলে, নরম,ছোট হাতের ছোঁয়া পেতেই চমকে উঠলো বর্ণ। ভাবনার রাজ্যে বেশ হোঁচট খেলো। বুকের মাঝে হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক গতিতেই লাফাতে শুরু করলো। শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হলো। এইতো কাঙ্খিত সময়, কাঙ্খিত মানুষ এসে পড়েছে।

কানে ঝংকার তুললো নারীর রিনরিনে কণ্ঠ,
“বৃষ্টিময় মিষ্টি অপরাহ্নের শুভেচ্ছা, ডাক্তার সাহেব। ভালো আছেন?”

পলক পড়লো, ক্ষানিক নড়লো ডাক্তার সাহেব। পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকালো ব্যাক্তিগত অঙ্গনার পানে। অক্ষিকূট কিঞ্চিৎ কেঁপে ঠাঁই তাকিয়ে রইলো চিরপরিচিত, কাঙ্খিত নারীটার দিকে। কণ্ঠ ধ্বনিতে শব্দগুচ্ছ আ*ন্দো*লন শুরু করলো কণ্ঠধ্বনি ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য কিন্তু বর্ণ বের হতে দিলো না তাদের। থাক না কিছুটা সময় একান্তই বোবা, শব্দ বিহীন, হোক না কিছু অনুভূতির নিশ্চুপ আনাগোনা।

বর্ণের বেহাল দশা দেখে হাসলো নীলাম্বরী। খিলখিল করে অষ্টাদশীর হাসি। গোল গাল মুখে দোল খেয়ে গেলো আনন্দের ঝিলিক। মাঝ সিঁথিকাটা চুল গুলো হতে কিছু অবাধ্য চুলের গুচ্ছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো নাক-মুখে। সৌন্দর্য যেন আরও বাড়লো। যতটা বাড়লে প্রেমিক পুরুষ শ্বাস নিতে ভুলে যায়, ঠিক ততটা বাড়লো।

নীলাম্বরী ঠাট্টার স্বরে শুধালো,
“শব্দ হারালেন নাকি? উত্তর দিচ্ছেন না যে?”

ধ্যান ভাঙলো বর্ণের। সামনে দাঁড়ানো সাদা শাড়ি পরিহিতা নারীটার দিকে তাকিয়ে হাসি দিলো। নিজের সামনের ভিজে চুপসে যাওয়া চুল গুলো হাত দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বললো,
“শব্দ হারায় নি, ছি*ন*তাই হয়েছে। একটা ভীষণ দুষ্ট নারী দিনে-দুপুরে ডা*কা*তি করেছে তাদের।”

বর্ণের কথার ভঙ্গিতে নীলাম্বরী নিজের ডানহাতটা ঠোঁটের উপর চেপে ছোট ছোট চোখ গুলো খিঁচে বন্ধ করে প্রাণখোলা এক হাসি দিলো। হাসির সাথে অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“কি ভয়ঙ্কর! কি ভয়ঙ্কর! কার এত বড় সাহস যে ডাক্তার সাহেবের কথা কেঁড়ে নেয়?”

“যদি বলি আমার প্রেমবতীর।”

বর্ণের কণ্ঠ খাদে নামলো। বিবশ,ভ্রম মাখানো কণ্ঠে প্রেমে সিক্ত নারী কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো। শরীরের লোমকূপ শিরশির করে প্রেমময় একটা স্রোত বয়ে গেলো। কি আশ্চর্য, শরীরেও আজকাল বিদ্যুৎ বয়ে যায়!

নীলাম্বরীকে চুপ হতে দেখে বেশ উচ্চশব্দেই হেসে উঠে প্রেমিক পুরুষ। বা’হাতটা দিয়ে মায়াবতী অঙ্গনার ডানহাত’টা চেপে ধরে মোহনীয় কণ্ঠে বললো,
“চলুন, আজ বৃষ্টিতে ভিজে শহর ঘুরার প্রস্তাবটা নাহয় আমিই দিলাম। যাবেন কী?”

এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে বোধহয় রমণী উত্তর দিলো। পা বাড়ালো জলে টইটুম্বুর রাস্তায়। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তার মাঝে শুভ্র রাঙা বস্ত্রে এক অদ্ভুত প্রেমে আকৃষ্ট কপোত-কপোতী হেঁটে যাচ্ছে।

রাস্তায় গাড়ি নেই, রিক্সা নেই, কোনো মানুষজন নেই। হাঁটতে হাঁটতে ভিজে একবারে নেতিয়ে গেলো তারা। হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে দিলো বর্ণ। ভ্রু কুঁচকালো নীলাম্বরী, অবাক কণ্ঠে বললো,
“থামলেন যে!”

ডাক্তার সাহেবের দৃষ্টি স্থির, নে*শাগ্রস্ত। সেই ঘোরের মাঝেই ডাক্তার সাহেব আনমনেই বললো,
“এই মাঝ রাস্তায় যদি ছোট্ট অন্যায় করি, দূর্বাফুল কি মূর্ছা যাবে?”

নীলাম্বরী বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“মানে!”

বর্ণ হুট করেই নীলাম্বরীকে ঘুরিয়ে দিলো। নীলাম্বরীর পিঠ ঠেকলো তার বুকে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিক্ত কাঠগোলাপ গুলো বের করে নীলাম্বরীর খোপায় খুব যত্নে লাগিয়ে দিলো সে। বৃষ্টির গতি বাড়ছে সাথে কমছে কপোত-কপোতীর দূরত্ব। উষ্ণ লজ্জা ভর করেছে নারীদেহে। হঠাৎ সেই নারীদেহকে অবাক করে দিয়ে একটা শক্ত-পোক্ত হাত আঁকড়ে ধরলো তার কোমড়। গ্রীবায় ঠেকলো পুরুষালী থুতনি। খুব গোপনে, যত্নে পুরুষালী রুক্ষ ঠোঁট খানা ছুঁয়ে গেলো রমণীর কানের পিছনের নরম, কোমল চামড়া খানা। গলার মাঝে প্রেমের উষ্ণ ছোঁয়া এঁঁকে ধীর কণ্ঠে মানব উচ্চারণ করলো,
“কাঠ ফাঁটা রোদ্দুর নির্বাসনে গেলো, প্রেম দিলো ধরণীর বুকে,,
বৃষ্টি তাই অঝোরে ঝরছে নিশিদিন, প্রেম মিলনের সুখে।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here