#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ১৭
,
,
গভীর রাতে ইরার হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়।ইরা কিছুক্ষণ এদিকওদিক ঘুরে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
কিন্তু ঘুম কিছুতেই চোখের পাতায়,ধরা দেয়না।
ইরার বিরক্ত লাগে।এটা তার এক মহা সমস্যা।রাতে একবার ঘুম ভেঙে গেলে পরে আর কিছুতেই ঘুম আসেনা।
সে আর কিছুসময় শুয়ে আড়মোড়া ভাঙে।
উঠে চুপচাপ বসে থাকে।
পানির পিপাসা পেয়েছে খুব।হাত বাড়িয়ে পাশের সেন্টার টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নেয়।কিন্তু দেখে গ্লাস খালি,একফোটাও পানি নেই জগে।
ইরা আশেপাশে খোজে।জগের দেখা পায়না।
ইরা একটু অবাক হয়।তার স্পষ্ট মনে আছে সে ঘুমানোর আগে ঘরে পানি ভর্তি জগ এনে রেখেছিলো।
কিন্তু সেই জগটা এখন গেলো কোথায়?গায়েব তো আর হতে পারেনা?তাছাড়া জগের তো হাত পাও নেই যে একা,একা হেটে চলে যাবে।
ইরা বিস্ময় ভরা মনে উঠে দাড়ায়।
এই মুহুর্তে তার মোটেও ওতোগুলো সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু কি আর করার?পানি আনতে ডাইনিং য়ে যেতেই হবে।
রুমের লাইট অন করতে গিয়ে ইরা আরও একদফা অবাক হয়।
লাইটটা জলছে না।কিন্তু ঘুমানোর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তো ঠিকই ছিলো?
এবার সে ফোন খোজে।
অন্ধকারে চারপাশে হাতরায়।
নিচে বাড়ির সামনের বাগানে আলো জালানো আছে।
সেইজায়গা থেকে মৃদু আলো ইরার রুম সামান্য আলোকিত করেছে।ইরা ওতোটুকু আলোকে সম্বল করেই ফোন খোজে।
কিন্তু পায়না।
ইরা চিন্তায় ভ্রু কুঁচকায়।
তার মাথায় আসেনা, হুট করে আজকেই সবকিছু এমন এলোমেলো হচ্ছে কেনো?
সে মৃদু আলোয় দরজার দিকে এগোয়।
দরজার কাছে আসতেই কেউ তাকে জাপটে ধরে।
ইরা আচমকা এমন আক্রমনে ভয় পেয়ে যায়।
সে দিকবিদিক ভুলে চিৎকার করে ওঠে।
তবে তার চিৎকারে শব্দ বের হয়না।শব্দ হওয়ার আগেই সামনের মানুষটা ইরার মুখ চেপে ধরে।
ইরা মোচড়ামুচড়ি করে।
হাত দিয়ে সামনের মানুষটাকে কিল ঘুসি দেয়।
সে বুঝতে পারে,লোকটা শৌখিন।শৌখিনের স্পর্শ আজকাল চিনতে পারে ইরা।
গায়ের ঘ্রানটাও চেনে।
তারপর ও সে শৌখিনকে সরাতে চায়।
হাত পা দিয়ে কিল ঘুসি দিয়েও যখন ছুটতে পারেনা তখন দাত দিয়ে শৌখিনের হাত কামড়ে ধরে।
শৌখিন তখন মত্ত ছিলো ইরার চুলের ভাজে মুখ লুকাতে।
আচমকা কামড়ে সে ছিটকে সরে আসে।
এক হাত আরেক হাত দিয়ে চেপে ধরে।
চাপা আর্তনাদ করে ওঠে।
ইরাও পিছু সরে আসে।
রাগে তার শরীর জলছে।
শৌখিন কেনো এসেছে এতো রাতে?ইরার কাছে এতো রাতে তার কি কাজ?তাও এমন চোরের মতন?তার মিতালি তো আছে?তবে ইরাকে কেনো জ্বালাচ্ছে?
রাগে কিড়মিড় করতে করতে ইরা বলে ওঠে,
—এতো রাতে এঘরে কেনো এসেছেন আপনি?
শৌখিন ততক্ষণে চোখ তুলে তাকায়।চোখের কোনে তার জল চিকচিক করে।হয়তো হাতে ব্যাথা পেয়েছে খুব।ব্যাথার তোড়েই হয়তো চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেছে।
ইরা মৃদু আলোয় ও সে জল স্পষ্ট দেখতে পায়।তার বুক মোচড় দিয়ে ওঠে।
পরক্ষনেই নিজেকে সামলায়।
শৌখিনের জন্য সে দুর্বল হতে পারেনা।
উহু,কখনোই না।
সে তো কারো ভালবাসা কেড়ে নেওয়ার মতো মানুষ নয়।
শৌখিন বলে ওঠে,
—আসতে পারিনা বুঝি?
ইরা কাঠকাঠ গলায় জবাব দেয়,
—না।
—কেনো?
—কেনো মানে?আপনি এতো রাতে একটা অন্য মেয়ের ঘরে আসতে পারেননা।ব্যাস।
শৌখিন মাথা নিচু করে মৃদু হাসে।
বলে,
—অন্য মেয়ের ঘরে কোথায় আসলাম?আমি তো আমার বউর ঘরে আসলাম।
ইরা থতমত খায়।সে কি বলবে বুঝতে পারেনা।
সত্যি সে শৌখিনের বউ।শৌখিন আসতেই পারে তার ঘরে।
তবে এতোদিন এ ধারনা কোথায় ছিলো?
ইরা বলে ওঠে,
—এতোদিন এ কথা মনে ছিলোনা?
শৌখিন চুপ হয়ে যায়।
সত্যি সে ভুল করেছে।মস্ত বড় ভুল করেছে।
সে মানছে তার ভুল হয়েছে।
মিতালিকেও ঠকিয়েছে সে।
সে চাইলেই পারতো ইরাকে ডিভোর্স দিয়ে মিতালিকে বিয়ে করতে।
কিন্তু তখন কি শৌখিন সুখি থাকতে পারতো?নাকি মিতালিকে সুখি রাখতে পারতো?
মিথ্যা ভালবাসার নাটক করতে হতো তখন।
তবে যে আরও বেশি ঠকানো হতো মিতালিকে।
শৌখিন ভাবে সে কাল সব কথা মিতালিকে খুলে বলবে।এভাবো ধোয়াশার মাঝে রাখার কোন মানেই হয়না।তারচেয়ে সবকিছু ক্লিয়ার করলেই ভালো হবে।
সে ইরার দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় আনে।করুন গলায় বলে,
—আমার ভুল হয়ে গেছে ইরা।সত্যি ভুল হয়ে গেছে।
কিন্তু এখন যে সে ভুলটা শুধরাতে চাই।
—মিতালি আপুর কি হবে?
–ওকে আমি সবটা বলবো,সবটা।
কালই বলবো।
—ওনাকে কি আপনি ভালবাসেন না?
–আমি জানি না।আমি কিচ্ছু জানিনা।
অনুভূতির এ খেলায় আমি একেবারেই অজ্ঞ।
শুধু জানি আমি তোর সাথে সারাটাজিবন থাকতে চাই।
হাতে হাত রেখে পথ চলতে চাই।তোর চোখে চোখ রেখে জিবনের সুখ দুঃখ ভাগ করতে চাই।
ইরা মনোমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে।
তার কেনো যেনো সব সপ্ন মনে হয়।এই যে এই সময়,এই কথা সব সব সপ্ন মনে হয়।
শৌখিনের তীক্ষ্ণ চাহনীর দিকে তাকাতেই ইরা কেঁপে ওঠে।
তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেলে।
তার হাত পা কাপে।
শরীর জুরে শিহরন বয়।
শৌখিন সেদিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে।
গা,দুলিয়ে হাসে।
ইরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
—হাসছেন কেনো?
শৌখিন তার হাত সামনে আনে।
ইরা তখন কামড় দিয়ে দাগ বসিয়ে দিয়েছিলো।
সেদিকে তাকাতেই ইরার খারাপ লাগে।
সে বলে,
—ইশ,কতোটা দেবে গেছে আপনার।
এতোটা লাগবে আমি সত্যি বুঝতে পারিনি।
স্যরি।
—উহু,শুধু স্যরিতে তো কাজ হবেনা।
—তাহলে?
—তাহলে আবার কি?প্রতিশোধ নেবো আমি।
আমায় কামড় দিয়েছিস এবার আমি তোকে কামড়াবো।
ইরা চোখ বড়বড় করে।
বলে,
—সত্যি কামড়াবেন আমায়?
শৌখিন মৃদু হেসে হুট করে ইরাকে কোলে তুলে নেয়।
বলে,
—সত্যি।
💮💮💮
রেহেনা বেগম ড্রয়িংরুমে বসে চা খাচ্ছেন।তার সাধসকালে চা খাওয়ার অভ্যাস।তবে আজ চা খেতে একটুও ভালো লাগছেনা।কিন্তু আশ্চর্য!অন্যদিন তো এমন লাগেনা?
রেহেনা বেগম জোরে ডেকে ওঠেন,
—রহিমা,এই রহিমা।
রহিমা সকালের নাস্তার তৈরীর কাজ করছিলো।রেহেনা বেগমের গলা শুনতেই সে কিচেন থেকে দৌড়ে আসে।
শাড়ির আচল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলে,
—জ্বী, বলেন ম্যাডাম।
কি হয়ছে?
—আজ চা এরকম হয়েছে কেনো?
—কিরকম?
রেহেনা বেগম বিরক্ত হন।তিনি বোঝাতে পারছেন না।
বলেন,
—বিদঘুটে স্বাদ, অন্যদিনের মতো না।
রহিমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ব্যাপারটা বুঝতে পারে।
বলে,
—অন্যরকম তো লাগবোই ম্যাডাম।
আজ যে চা আমি বানাইছি।
—তুমি বানিয়েছো?
—হ, প্রতিদিন তো ইরা বানায় চা।
কিন্তু আজ এখনো কিচেন মুখী হয়ই নি সে।নিচেও নামেনি।
রেহেনা বেগম কপালে চিন্তার ভাজ ফেলেন।
সকাল হয়েছে অনেক্ষন,এতক্ষণ তো ইরা ঘরে শুয়ে থাকার মেয়ে নয়।
সকাল সকাল উঠে নামাজ পরে চা বানাতে আসে সে।
কিন্তু আজ হঠাৎ তার হলোটা কি?
চিন্তামগ্ন হয়েই বলেন,
—মেয়েটার শরীরটা খারাপ করলো নাকি?আজ যে এতোবেলা করে ঘুমাচ্ছে?
—হইতেও পারে।
আমি কাল তারে মনমরা দেখছি খুব।
একটু আনমনা হয়ে বলে,
—তাছাড়া জিবনডার ওপর দিয়ে যা যাইতেছে তার।
চিন্তা কইরা কইরা তো শরীরডা একেবারে শেষ হইয়া গেছে।
রেহেনা বেগম বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন।
তিনি জানেন ইরা প্রচুর চিন্তা করে।
তার জিবনটা যে পুরো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এই নষ্ট হওয়ার পেছনে পুরোপুরি ভাবে দায়ী যে রেহেনা বেগম নিজে।
তার ছেলেটাকেও তো কষ্টে রেখেছেন।
ভালো করতে গিয়ে দুজনকেই কষ্ট দিয়ে ফেলেছেন।
বলেন,
—আমি সব ঠিক করে দেবো রহিমা।
সব ঠিক করে দেবো!
দায়িত্ব যখন নিয়েছি সে দায়িত্বও আমি পালন করবো।
ইরার জিবনটা নতুন করে সাজিয়ে দেবো।
,
,
,
চলবে….
(আজ আরেকটা পর্ব দেবো)