পদ্মপাতা পর্ব ৩

#পদ্মপাতা
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৩

৭.
সূর্যটা আস্তে আস্তে তার আলো ছড়াচ্ছে। অন্ধকারকে ছাপিয়ে আলোরা যেন নিজের রাজত্ব ঘোষণা করছে।একটু একটু করে অন্ধকারগুলোকে তাড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। অন্ধকাররা মুখ ভেঙচিয়ে বলছে আবার ফিরে আসবো।আলোদের ভাবখানা এমন তারা কিছু শুনেইনি।

ঢাকা শহরের সকালগুলো হয় খুবই ভিন্ন।গাড়ির পে পু আওয়াজ,কাকের কা কা স্বর ধ্বনি আর অসহ্য গরম যেন ঘুমন্ত মানুষটার কানে কানে বলে, “আরে উঠ বেহায়া আর কত ঘুমুবি”। আর ঘুমন্ত মানুষটা কপাল কুঁচকে, মুখটাকে কালো করে করে ঘুম থেকে উঠে।

কিন্তু চাঁদপুরের সকালগুলো সম্পূর্ণ আলাদা।সকালবেলাগুলো শুরু হয় এক অদ্ভুত স্নেহের ছোঁয়ায়।পাখির কিচিরমিচির,শীতল বাতাস আর আকাশের রং এর বাহার যে কাউকে মুগ্ধ করতে বাধ্য!

আবির তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকাল উপভোগ করছে।শহীদুল্লাহ্ হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এতো সুন্দর অনুভূতি উপলব্ধি করা যায় নাকি!নাকি তার গ্রাম, তার আপন ঠিকানা বলে এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকাল উপভোগ তার এতো ভালোলাগে?কাছেই ধুরী দিঘী আপন মনে নিজের মতো স্থির হয়ে আছে।আকাশটা হলদেটে।

আবির বাড়ি আসলে তার সকালের চা নিয়ে আসার দায়িত্ব চাঁদের।ভিতুটা হয়তো ঘুম থেকেই উঠেনি।ফজরের নামাজের পর সকাল উপভোগ করার আনন্দ এই মেয়েটা বুঝলোনা।

দরজার ঠকঠক আওয়াজে ঘরে এসে দরজাটা খুলে দিলো আবির।মতিন দাঁড়িয়ে। হাতে দুইকাপ চা।

-বাবা আসেন।ভিতরে আসেন। আপনি কষ্ট করে চা আনতে গেলেন কেনো।চাঁদ কোথায়?

মতিন একটা চায়ের কাপ আবিরের হাতে দিলেন।তারপর ঘরের ভিতরে ঢুকে খাটে বসলেন।আবিরও বসলো তার পাশে।মতিন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
-তোমার সাথে কথা বলতে আসলাম।আজকাল তো তুমি মহা ব্যস্ত থাকো।বাবার খবর নেওয়ারও সময় থাকেনা।
-না, বাবা এসব কি বলেন।
-থাক।তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?
-জ্বি, ভালো।
-হুমম।ভালো হলেই ভালো।সিফাতদের বাসা থেকে ফোন আসলো। ওরা চাচ্ছেন আগামী মাসের মধ্যে প্রমার সাথে সিফাতের বিয়েটা সেরে ফেলতে।তোমার কি মত?
-আমি আর কি বলবো।আপনি যা ভালো মনে করেন।
-আমি চাচ্ছি ওদের কথা রাখতে।
-আচ্ছা, তাহলে তাই হোক।আর সিফাত তো ছেলে হিসেবে ভালো।
-তুমি কি এখন ঘুমাবা?
-না,বাবা।কোনো কাজ ছিল?
-হুমম।তাহলে চলো ক্ষেতগুলো দেখে আসি।আর দোকানের ভাড়া উঠানোর কথা আজ। একেবারে ভাড়া উঠিয়ে নিয়ে আসবো।
-আচ্ছা, বাবা।চলেন।

ফজরের নামাজের সময় সাদা পাঞ্জাবি পড়েছিল আবির।বাবার সাথে সে বেরিয়ে গেলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আড়চোখে একবার তাকালো চাঁদের ঘরে।তার ভীতু হরিণী ঘুমের দেশে।চোখ সরিয়ে আবির সিদ্ধান্ত নিলো ফজর নামাজ না পড়ার জন্য একটা শাস্তি দিতে হবে চাঁদকে।ভালো করে বললে জীবনেও এই মেয়ে একটা কথা শুনেনা।

৮.

হালকা আলো চোখে পড়ায় ঘুম ভাঙলো চাঁদের।
চাঁদ স্থির হয়ে কতোক্ষণ বসে রইল।তারপর তার মনে হলো সে না নানুমার ঘরে ছিল।এখানে আসলো কিভাবে।কোনো জীন গঠিত ব্যাপার কি?ভয়ে ভয়ে সূরা নাস,সূরা ফালাক আর আয়তুল কুরসি পড়ে গায়ে ফু দিয়ে নিলো সে।পরে ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়াল। আবিরকে তো চা দেওয়া লাগবে।যতই রাগ করুক।সকালবেলা চা না পেলে মার একটাও মাটিতে পড়বেনা।চাঁদ দৌড় লাগালো নিচ তলার রান্নাঘরে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হঠাৎ কাজলের সাথে ধাক্কা লাগলো তার।

-আরে সুন্দরী। আস্তে হাঁটো। কিসের জ্বালা শরীরে?বললে মিটায়ে দেই।

একথা বলে কাজল বিদঘুটে এক হাসি দিলো।চাঁদ এসবে অভ্যস্ত।এই কালুরে কিভাবে শিক্ষা দিতে হয় তার জানা আছে।

-কাজল চাচা। ধুরী দিঘীতে অনেক ব্যাঙ আছে।খালি লাফায়।তাদের গিয়ে জিজ্ঞেসা করেন।
-এই আমি তোমার কোন জনমের চাচা লাগি।

চোয়াল শক্ত করে বললো কাজল।চাঁদের এসব কথার তোয়াক্কা করলোনা। সে ছুটলো রান্নাঘরে।

-একবার খালি সুযোগ পাই সুন্দরী। তোমার তেল আমি কমামু।

চাঁদ রান্নাঘরে ঢুকে দেখলো বড় মামি রুটি বানাচ্ছেন। আর রহিমা খালা সবজি কাটে।

-মামি, চা বানায় দাও।আবির ভাইকে দিয়ে আসি।
-তোর দিতে হবেনা।
-কেন? মামি।
-আবির চা খেয়ে বেরিয়েছে।
-ওহ্।

মন খারাপ হয়ে গেলো চাঁদের। কাল আবিরের প্রতি যা রাগ ছিল তা আর এখন নেই চাঁদের।চাঁদ তার আবির ভাইয়ের উপর রাগ করে থাকতেই পারেনা।
চাঁদ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে গেলো গোয়ালঘরের দিকে। দুলি আর মুলিকে একটু আদর করবে তো তাই।পচু একটা সাইকেলের চাকাকে লাঠি দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেলছিল।এই খেলার নাম তার মনে নেই।তবে খেলতে ভালোলাগে।চাঁদকে দেখে বললো,

-চাঁপু,শোনো।
চাঁদ পচুর দিকে ছুটে গেলো।তার পড়নের কামিজের সাথে উড়নাটাকে সাইটে বেধে পচুর হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে চাকা ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
-কি বলবি।বল।
পচু একটু মুখ গোমরা করে দাঁড়িয়ে রইল।তার এতো সাধের খেলা।এখন নিতে চাইলে চাঁপু নির্ঘাত পিঠে একটা বসাবে।এদিকে চাঁদ অনেক দূর চলে গিয়েছে।
সে চললো চাঁদের পিছুপিছু। দৌড়াতে দৌড়াতে বললো,
-চাঁপু।আজকে পাটকাঠি ভাইয়েরা মাছ ধরতে যাবে। তোমারে বলছে যাইতে।

চাঁদ খেলা থামিয়ে বললো,
-কি করে যাই বলতো?আবির ভাই বাড়িতে তো।

৯.
পচু খানিকক্ষণ ভেবে বললো,
-তুমি চুপিচুপি দুপুরে চলে যাবা। আবি ভাই বুঝবে না।
-আবি ভাই না আবির ভাই বল।আমাকে চাঁপু, চাঁপি যাই ডাকিস আবির ভাইকে এমনে ডাকবি না।
-কেনো?
-বেশি কথা বলিস তুই।আমি বড় না তুই?
-তুমি।
-তাহলে কে কার কথা শুনবে?
-আমি তোমার কথা শুনবো।
-হুমম।মনে রাখলেই পারিস।

চাঁদ আবার খেলায় মনোযোগ দিলো।পচুসহ আরো কিছু বাচ্চা তার পিছনে দৌড়ে তার খেলা দেখছে।মাটির রাস্তা। দুইপাশে ধান ক্ষেতের সারি।মাটির রাস্তায় আপন মনে দৌড়াচ্ছে এক প্রাণময়ী কিশোরী।মাঝেমাঝে আবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে সে।তার হাঁটু সমান চুল গুলো আর খোপায় বাধা রইল না।খুলে ছড়িয়ে পড়লো তার পিঠে।তার সে খেয়াল আছে নাকি সে তার খেলায় মত্ত।

দূরে দাঁড়িয়ে একজনের বুকের ব্যথা যে সে বাড়িয়ে দিলো।তার কি শাস্তি হওয়া উচিত? সে ব্যক্তির মনের ভিতরে থাকার যাবত জীবন কারাদণ্ড নাকি ভালোবাসার ফাঁসি?

মতিন নিজের মতো জমি দেখাতে ব্যস্ত।সাথে আছে জমাল।ব্যবসায় মতিনকে সাহায্য করে সে।আবিরের সেদিকে খেয়াল নেই সে তার প্রেয়সীকে দেখায় ব্যস্ত কিনা!যতো দেখে ততো আরো দেখতে ইচ্ছে করে। তার প্রেয়সী, তার হরিণী এতো সুন্দর। মাশাআল্লাহ।

খেলার মাঝে হঠাৎ দূরে ধানক্ষেতে আবির,বড়মামাকে দেখতে পেয়ে খেলা ফেলে বাড়ির দিকে দৌড় লাগালো চাঁদ। বড়মামা হয়তো কিছু বলবেন না।কিন্তু আবির নিশ্চিত মেরে ছাল তুলে ফেলবে।পচুও চললো পিছুপিছু। আর ডাক তো আছেই,
-ও চাঁপু কি হইলো।আরে এই চাঁপু।

চাঁদের সেদিকে খেয়াল নেই।আপাতত সে তার নিজের জীবন নিয়ে এখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে।আবির ভাই না দেখলেই হলো।দেখলে তো সর্বনাশ।
চাঁদের এহেন কান্ডে সশব্দে হেঁসে উঠলো আবির।তার হাসির শব্দে মতিন আর জমাল তার দিকে তাকালো।মতিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেসা করলেন,

-কী ব্যাপার তুমি হাসছো কেন?
-কিছুনা বাবা।
-কাজে মন দাও।
-জ্বি।

লজ্জা পেয়ে আবারও জমি দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো আবির।অবশ্য তার মন ব্যস্ত হয়নি।আর কোনোদিন হবেও না।সেটা শুধু একজনের জন্যই বাঁধা।মন যেন চাঁদের মনকে বলছে,

“তোমার ভীতি
তোমার চঞ্চলতা
তোমার হাসি
তোমার পাগলামো
ভালোবাসি
খুব বেশি ভালোবাসি।”

মেঘনা নদীতে আজ ঢেউ বেড়েছে। আবিরের মনের ভিতরেও কি সেই একই ঢেউ বইছে। পাশেই তো মেঘনা দেখা করে দুই ঢেউ এক করে দেখলে কেমন হয়?মাপা যাবে কার স্রোত বেশি!

(চলবে)……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here