পদ্মপাতা পর্ব ৬

#লেখিকা-আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পদ্মপাতা
#পর্ব-৬

১৬.
দুপুরের কাঠফাটা রোদে চারিদিকে প্রচন্ড গরম পড়েছে। সূর্যের হাসি যেন উপচে পড়ছে।গাছগুলো যখন গরমে কাতর হয়ে চিৎকার করছে,”পানি,পানি।”
তখন সূর্য নিজের তাপটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর হা হা হা করে হেসে বলছে,”আহারে খুব গরম তাই নারে।”
গাছগুলো তখন চোখ রাঙিয়ে বলছে,”নিষ্ঠুর,নিষ্ঠুর।তুই একটা নিষ্ঠুর।”
সূর্যের ভাবখানা এমন যেন সে অনেক মজা পেয়েছে।

চঞ্চল পায়ে বাড়ির বাইরে যাবার ফন্দি আঁটছে চাঁদ।আবির বাড়িতে থাকায় সে এখন বাইরে বেশি একটা বেড়োতে পারেনা।চাঁদের মনে হয় গাছগুলো তাকে ডাকছে। আহাজারি করে বলছে,”আয় না চাঁদ। উঠ না আমাদের ডালে।”কিন্তু আবির ভাইকে কে বোঝাবে। গতকাল পাটকাঠিরা মাছ ধরতে গেলো সেখানেও চাঁদ যেতে পারেনি।সাঁতার পারেনা বিধায় আবিরের মানা নদীর ধারে যেতে।ইস্,সবগুলো মাছ জুবু,তমাল আর পাটকাঠি নিয়ে নিলো। ভাবতেই কপাল কুঁচকে গেলো চাঁদের। সদর দরজার কাছে ঘুরঘুর করছে সে।আবির অদূরে সোফায় বসে।হাতে একটা বই।

আড়চোখে চাঁদ আবিরের দিকে তাকালো।আবিরও চাঁদের দিকে।চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনের। চাঁদ মুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিলো।আবির বইটা পাশে রেখে বলে উঠলো,
-“এইদিকে আয়তো চাঁদ। ”

চাঁদের কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো।আবির ভাই কি তার বাইরে যাওয়ার ফন্দি ধরে ফেলেছে।চাঁদ যখন ভয়ে ভয়ে আবিরের দিকে এগুচ্ছিল তখনই সদর দরজা দিয়ে আগমন ঘটে নিতির।চাঁদ হাফ ছেড়ে বাঁচে।

-আরে চাঁদ কেমন আছো?
-ভালো আছি নিতি আপু।
-কিরে আবির কি অবস্থা তোর?

সোফায় বসতে বসতে আবিরকে প্রশ্ন করলো নিতি।

-হুমম।ভালো।হঠাৎ তুই এলি?তোদের মেডিকেল বন্ধ দিয়েছে নাকি?
-হ্যাঁ রে।গতকাল বন্ধ দিলো।রাতেই রওনা দিয়েছি।

তিলোত্তমা কি যেন কাজে রান্না ঘরে যাচ্ছিলেন।নিতিকে দেখে থেমে গেলেন।

-আরে নিতি।কতদিন পর এলি তুই।কেমন আছিস?

নিতি উঠে তিলোত্তমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-ভালো আছি খালামনি।তুমি কেমন আছো?
-হুমম।ভালো।
-খালুজি কোথায়?
-তোর খালুজি তো বাইরে গিয়েছে। তুই আবিরের সাথে কথা বল।আমি তোর জন্য পানি নিয়ে আসি।
-আচ্ছা। খালামনি।
নিতি আবার গিয়ে আবিরের পাশে বসলো।প্রমা উপর থেকে নেমে নিতিকে দেখে জড়িয়ে ধরলো।
-কি বিয়ের কনে কেমন আছেন?
-জ্বি,আপু ভালো।
প্রমা বেচারি একটু লজ্জাই পেলো।

১৭.
নিতি আবিরের সাথে কথা বলায় মত্ত।আর আবিরও অনেক হেসে হেসে কথা বলছে তার সাথে।আবির নিতিকে নিজের একজন ভালো বন্ধু মনে করে।ছেলেবেলা থেকেই নিতির সাথে তার ভালো সম্পর্ক। তবে চাঁদের ব্যাপারটা গোপন করেছে সে।যদিও নিতি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করছে আর সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।তবুও যোগাযোগটা আছে আগের মতো।সদর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে এক ধ্যানে হাসোজ্জল আবির আর নিতিকে দেখছে চাঁদ।নিতি আপু কত আধুনিক। পড়নে প্যান্ট,ফতুয়া। মাথার চুলগুলো ঘাড় পর্যন্ত। খয়েরী আর লাল রং করা।কত পরিপাটি,কত সুন্দর।
এবার নিজের দিকে তাকালো চাঁদ।একটা পুড়ানো সেলোয়ার-কামিজ পড়নে তার।ওড়নাটা একপাশে নিয়ে বাঁধা।হাটুঁ সমান চুলগুলো অগোছালোভাবে বেণী করা।চাঁদের নিজেকে একটা কাকের বাসা মনে হলো।

তার হৃদয় মনে হয় পুড়ছে। এ কেমন দহন যন্ত্রণা। তখনই ডাইনিং টেবিলের কাছ থেকে মোহনা আর তিলোত্তমার অস্পষ্ট কথোপকথন ভেসে আসলো।
তিলোত্তমা বলছে,
-ওদের একসাথে কত ভালোলাগে তাই না বুবু।আমার তো নিজের আর সন্তান নেই।কালমুখী খেয়ে ফেলছে।আমার অনেক ইচ্ছা বোনের মেয়েটাকে আবিরের বউ করার।তুমি কি বলো বুবু।
-হুমম। দেখি আবিরের বাবাকে বলে।দুজনেই তো পড়াশোনা করে।
-অন্তত আংটি পড়ায় রাখলেও তো হয়।
-দেখি কি করা

আর শুনতে পারলোনা চাঁদ।একদৌড়ে চলে আসলো বাইরে।গোয়াল ঘর পেরিয়ে আমবাগানে প্রবেশ করলো।একটা বড় আমগাছের নিচের শিকড়ে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লো সে।কিন্তু তার এতো কষ্ট লাগছে কেন?কিশোরী মন উত্তর খুঁজে পায়না।মন শুধু কাঁদতে চাচ্ছে।আবির ভাইকে তো সে ভয় পায়।আবির ভাইয়ের বিয়ে হলেও তার কি?

১৮.

এই বাড়িতে প্রিয় মানুষ বলতে কেবল দুইজন ব্যাক্তিই আছে চাঁদের।আনোয়ারা আর আবির।একজন প্রিয় মানুষকে হারানোর এই দুঃখ?নাকি অন্যকিছু?এই যে পায়ের পায়েলটাও তো আবিরের দেওয়া চাঁদ সেটা জানে।আবির কিভাবে পড়িয়ে দেয় তা জানেনা।তবে প্রত্যেকবার আবির আসলে নিজের পায়ে নতুন পায়েল পায় চাঁদ।আবারো ডুকরে কেঁদে উঠলো চাঁদ।

-কাদঁছিস কেন?
হঠাৎ আবিরের কন্ঠে হকচকিয়ে উঠলো চাঁদ।অতি সন্তর্পণে নিজের চোখের জলটা মুছে নিলো।
-কই কাঁদছি আবির ভাই।চোখে কি যেন পড়েছে।
আবির চাঁদের পাশে বসে বললো,
-বাহ্।আমার কাছে মিথ্যা বলাও শিখে গিয়েছিস।গুড।তোর তো অনেক উন্নতি হয়েছেরে চাঁদ।

চাঁদ উঠে দাঁড়াতে চাইল।কিন্তু আবির তার বেণী টেনে ধরলো।
-আবির ভাই।আমার চুল।
-আমি উঠতে বলেছি।বস,চুপচাপ।

চাঁদ বসে যায়।আবির আড়চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে চাঁদের মুখের দিকে।নিতির সাথে তাকে দেখে মেয়েটাকি কষ্ট পেলো।মুখটা কান্নার কারণে লাল হয়ে আছে।তার চাঁদ তার জন্য হিংসা করছে।তার জন্য জ্বলছে। তার চাঁদ কি বড় হয়ে গেলো।ভাবতেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে আবিরের মুখে।চাঁদ মুখ ফুলিয়ে বসে আছে তার পাশে।চুলে টান দেওয়াতে রাগ করেছে মেয়েটা।আবির ফিসফিসিয়ে চাঁদকে বললো,

“তোমার মায়া ভরা মুখ
তোমার দুষ্টুমি হাসি
তোমার ভিতু হরিণীর ন্যায় চোখ
তোমার ছড়ানো ছিটানো কেশ
আমার চাই
এই অগোছালো তুমিটাকে আমার চাই
বড্ড বেশি করে চাই”

চাঁদ হতভম্ব,স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল আবিরের পানে।তার আবির ভাইকে কি আমগাছের জ্বিনে ধরলো কিনা।ভাবতেই মনে মনে দোয়া পড়তে শুরু করলো চাঁদ। আবির ততক্ষণে উঠে দূরে চলে গিয়েছে। আবির না ফিরে তাকিয়েই বললো,
-কোথাও যাবিনা আর গাছে উঠবিনা।খবরদার।আর বিকালে বাজারের পাশে মেলায় যাবো।রেডি থাকিস।

চাঁদ ভেঙচি কেটে বললো,
-আপনার নিতি যাবেনা?
আবিরের প্রচুর হাসি পাচ্ছে। তাই মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে মুখ না ফিরিয়ে বললো,
-হুমম।আমার নিতিও যাবে।

চাঁদ আরেকটা ভেঙচি কাটলো আবিরকে।আবির ততোক্ষণে সে স্থান ত্যাগ করেছে।
চাঁদ ভাবছে, বিশ্লেষণ করছে আবার ভাবছে আবিরের কথাগুলো।তার কিশোরী মন কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছেনা।

আবির বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক ধ্যানে ধুরী দিঘীর পানে তাকিয়ে আছে।অস্বচ্ছ পানিগুলো স্থির হয়ে আছে।

-কি করিস আবির?
-কিছুনা।তুই আমার ঘরে?
-কেনো আসতে পারিনা বুঝি।এমন ভাবে বলেছিস যেনো জীবনেও আসিনি তোর ঘরে।
-তুই বেশি বুঝিস।
-আমারও তাই মনে হয়।বিকালে মেলায় নিয়ে যাবি কিন্তু। প্রমা, রুমা আর দিমাও যাবে।অনেক মজা হবে তাইনা।
-হুমম।চাঁদও যাবে।
-ও।চাঁদের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম।মেয়েটা অনেক মিষ্টি। তোর বোন বলে কথা। তুই সুন্দর তোর বোনও সুন্দর।

আবিরের ভিষণ রাগ উঠলো।খালি বোন আর বোন।চাঁদ কি তার মায়ের পেটের বোন।যত্তসব।কিন্তু কিছু বললোনা।আপাতত নিতিকে বের করা প্রয়োজন।আবিরের ছোট প্রেয়সী নয়তো আবার কেঁদে গা ভাসাবে।আবির কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললো,
-মায়ের সাথে কথা বলে আয়।মা তোকে খুঁজছিল।
-আচ্ছা।

নিতি বেরোতেই বিছানায় বসলো আবির।তার প্রিয়তমার অশান্ত মুখ,চোখে মুখের প্রশ্ন সব ভেবে আবারো হেসে উঠলো সে।তার প্রিয়তমার মনেও কি তার রঙের ছোঁয়া লেগেছে? এটা কি গভীর প্রণয়ের লক্ষণ!

(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here