পবিত্র সম্পর্ক পর্ব ৩+৪

#পবিত্র_সম্পর্ক
লেখক : রিদন রায়হান
পর্ব : ০৩

— আমার মেয়ের মত কত মেয়ে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের আইনি ব্যবস্থা কোন সুরক্ষা তাদের দিতে পারছে না, পুলিশ টাকা খেয়ে পুরো ব্যপারটা ধামাচাপা দিয়ে দিবে, নয়তো ধর্ষিত হওয়া মেয়েটির উপরই উল্টো অভিযোগ সৃষ্টি করবে। আমাদের মত মধ্যবিত্ত, গরিবরা কি এর বিচার পাবে না? কে দিবে আবার সঠিক বিচার?
লোকটার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো রায়হান। “লোকটার কথাগুলো বাস্তব সত্যি। সত্যিই তো কত মেয়ের জীবন প্রতিদিন এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা আমি কি পারি না তাদের বিচার পাইয়ে দিতে। হুম, আমি পারবো। আমি লড়বো আমার ভালোবাসার জন্য, প্রতিটি অসহায় মেয়ের জন্য।” মনে মনে রায়হান।

দরজার লক খুলে সাদিয়াকে নিয়ে আমজাদ চৌধুরি এবং রেহানা বেগম বাসায় ঢুকে। তারা সাদিয়াকে নিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকতেই দেখে রায়হানের ছোট ভাই হৃদয় কানে হেডফোন লাগিয়ে বসে আছে। সাদিয়াকে দেখে চমকে তাকায়। আবার বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “মা-বাবা, কি ? তোমরা এই মেয়েকে এ বাড়িতে নিয়ে এসছ কেন ?”
আমজাদ চৌধুরি ছেলের কথা শুনে রেগে যান। ওর হাত ধরে টেনে, আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলে, “কী বলছিস কী তুই? মেয়েটা তোর কথায় কষ্ট পাবে। তোর ভাই এসব শুনলে কিন্তু রেগে যাবে ” হৃদয় “আরে ছাড়ো তো” বলে ওর বাবার ধরে রাখা হাতটা ঝাড়ি মেরে ছাড়িয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, এই নষ্টা মেয়েকে এ বাড়িতে আমি থাকতে দিব না।
রেহানা বেগম ছেলেকে ধমক দিয়ে বলল, ” হৃদয়, তুই তোর বাবাকে ধাক্কা মারলি? ছিঃ। আর ও তোর হবু ভাবি মুখ সমলে কথা বল নয়তো জুতা মারবো তোর মুখে ”
— চুপ কুত্তার বাচ্চা, বেশি কথা বললে খবর আছে। আর তুই কি বলছিলি যেন, হবু ভাবি। কিসের হবু ভাবি তোর হবু ভাবির গুষ্টি কিলাই। এসব ধর্ষিতা, নষ্টা ময়ের এ বাড়িতে কোনো জায়গা নেই। আর তুই এখানে এখনো কি করিস যা বেরো এ বাড়ি থেকে নষ্টা মেয়ে কোথাকার।

রায়হান মাত্র বাসায় ঢুকছিল হৃদয়ের মুখে এসব কথা শুনে রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো ভিতরে ঢুকেই চার পাঁচটা চড় বসিয়ে দিল হৃদয়ের গালে।
— তুই আমার ভাই? যে একটা অসহায় মেয়ের ব্যপারে এমন কথা বলে, যেখানে সেই মেয়েটার কোন দোষই নেই সে আর যাই হোক আমার ভাই কখনো হতে পারে না।

রাগে গজগজ করতে লাগল রায়হান মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “সদিয়াকে এ কথা বলে তো হৃদয় ধর্ষকদের সাপোর্টার হয়ে গেল মা। তুই এখনো আমার সমনে দাঁড়িয়ে আছিস? ( বলে একটা ধাক্কা মারলো হৃদায়কে ) বাবা ওকে আমার সামনে থেকে চলে যেতে বল নাহলে আমি কিন্তু কেন অঘটন ঘটিয়ে ফেলবো।

— ভাইয়া তুই এবার বাড়াবাড়ি করছিস। এতগুলো থাপ্পর মারলি ধাক্কা মারলি। কিছু বললাম না খালি।

“কিছু বললি না খালি মানে, ওই? কী বলতে চেয়েছিলি তুই? আবার বল তো?”, বলে হৃদয়ে গালে আবারো চড় মারল রায়হান।

হৃদয়ের কথার উত্তরে রেহানা বেগম বললেন, “তুই তো ওর ছোট বড় ভাই হয়ে তোকে শাসন করতেই পারে। তুই যে একটু আগে তোর বাবাকে ধাক্কা মারলি, সেটা?”

রেহানা বেগমের কথা শুনে রায়হান চোখ বড়বড় করে তাকল হৃদয়ের দিকে। বলল, “কিহহহহ? ও বাবাকে ধাক্কা দিছে ? বাবা? বলে বাবার দিকে তাকাতেই দেখলো তার চোখে পানি।
এমনিতেই রেগে আছে রায়হান, মাথা গরম তার উপর এ কথা শুনে যেন পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল তার? আসেপাশে লাঠি জাতীয় কিছু খুঁজল। না পেয়ে, এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। ঘড়ে ক্রিকেট খেলার বেট খুঁজে পেয়ে সেটা নিয়ে এসেই এলোপাথাড়ি বারি শুরু করলো। রাহানকে থামানের চেষ্টা করছে ওর মা এবং বাবা। হাত থেকে বেট ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে বেটটা। সাদিয়ার এই সব কিছুর জন্য নিজেকে দ্বায়ী মনে হচ্ছে, সাদিয়াও রায়হানকে থামানোর প্রাণপনে চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ হলো। সাদিয়া মেঝেতে বসে পরল রায়হানের পায়ে ধরে কান্না করতে করতে বলল, প্লিজ ছেড়ে দিন ওনাকে, এ সব কিছু আমার জন্য হচ্ছে আমি এখানে না আসলে এসব হতো না। আল্লাহর দোহাই ছেড়ে দিন উনাকে।
রায়হান বেটটাকে দূরে ছুড়ে ফেলে দিল তারপর মেঝেতে বসে কান্নারত সাদিয়াকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, “তুমি এসবের জন্য কোন ভাবেই দ্বায়ী নও। নিজেকে কেন দ্বায়ী করছো? আজ ওর ভেতরের মোখশটা আমার আমার সামনে চলে এলো। ” ওঠ “, বলে সাদিয়াকে ধরে উঠালো। তারপর হৃদয়কে দাঁড় করিয়ে বলল, ” বেরো তুই এ বাড়ি থেকে, যা বেরো। ” হৃদয় চুপচাপ মাথা নিচু করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে সাদিয়া হৃদয়ের হাত ধরে ওকে থামিয়ে দিল।বলল, “এটা আপনার বাড়ি আপনি কোথায় যাচ্ছেন।বরং আমিই চলে যাচ্ছি।” কথাটা বলে বলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় সাদিয়া। রায়হানের বুকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করতে থাকে। সাদিয়াকে হারিয়ে ফেলার ভয় জাগে মনে।
রায়হান “সাদিয়া” বলে ডেকে দৌড়ে সাদিয়ার কাছে গেল। সাদিয়ার হাত ধরে এক টান দিয়ে বুকে নিয়ে নিল। বলল , তুমি কোথায় যাচ্ছো সাদিয়া? আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো?
— যেখানে দু’চোখ যায় সেখানে যাবো । দেখবেন আমাকে ছাড়া থাকতে থাকতে ঠিকই অভ্যাস হয়ে যাবে। এত বছর তো একাই ছিলেন।
— এভাবে বলো না সাদিয়া। আমি যে তোমায় খুব ভালোবাসি।
— ধর্ষিতাকে যে ভালোবাসতে নেই।
— ভালোবাসা এসব কিছুই দেখে না সাদিয়া। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমার ধার্মিকতাকে ভালোবাসি।
— আমার কারণে আপনাদের পরিবারে সমস্যা হচ্ছে। আপনাদের পরিবারটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। আপনি নিজের ভাইকে এভাবে…
— আমার পরিবার তোমার কারণে ভাঙ্গছে না, তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলে আমার পরবিবার আমাকে হারাবে, তখন হয়তো পরিবারটা ভাঙ্গবে।
— কী বলতে বোঝাতে চাইছেন আপনি?
— যেটা সবসময় বলে আসছি সেটাই। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না, মরে যাবো।
— আল্লাহ মাফ করুণ। এসব কথা বলবেন না।
— তুমি তো সেটাই চাইছো যে, আমি মরে যাই!
— আমি কখন কারো মৃত্যু কমনা করি না।
— মৃত্যু কামনা না করলেও মেরে ফেলার মতই কাজ করছিলে। তুমি আমায় ফেলে চলে গেলে সত্যি আমি মারা যাবো।

আজান হচ্ছে! আজানের শব্দ কানে আসতেই সাদিয়া কেঁদে উঠল। “আমি নামাজ পরবো।” বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পরল।

— হ্যা পরবে তো। হেই , তুমি কাঁদছো কেন ??
— আ…আ…আমার এ অপবিত্র শরীরে নামাজ আদায় করলে কি আল্লাহ তা কবুল করবে?
— নিশ্চই করবে । আর হ্যাঁ, তুমি অপবিত্র নও। তোমার মন পবিত্র। নমাজ পরে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো যাতে তোমার মত কোন মেয়ের সাথে এমনটা না হয়।
সাদিয়ার কান্নার স্বর বেড়ে গেল। ও শক্ত করে রায়হানকে জরিয়ে ধরে বলল,
— কেন? কেন হলো আমার সাথে এরকম? কী দোষ করেছিলাম আমি? যার শাস্তি আল্লাহ আমায় এভাবে দিল।
— আল্লাহ হয়তো তোমার পরিক্ষা নিচ্ছে, সে তার মুমিন বান্দারের মাঝে মাঝে পরিক্ষায় ফেলে। দেখে, তারা সেই দুঃসময়ে আল্লাহ-কে ভুলে যায় কি না। তাই এই সময়ে আরো বেশি বেশি তাকে স্বরণ করতে হবে। বুঝলে?
— হুম।
— মা-বাবা হয়তো আমাদের এভাবে কথা বলতে দেখে ঘরে চলে গেছে। চলো…
— কোথায়?
— আমার রুমে
বলে সাদিয়াকে একপ্রকার জোর করেই নিজের রুমে নিয়ে গেল রায়হান।

ঘরে গিয়ে সাদিয়াকে বলল, ” আমি বুঝতে পারছি তুমি গোসল করতে চাইছো। ”
— কিভাবে বুঝলেন?
— ওই যে তখন বললাম ভালোবাসি তোমাকে। আর ভালোবাসার মানুষটির সব কিছু বুঝতে পারা যায়।

“ওদের ছোঁয়া এখনো আমার শরীরে লেগে আছে।”, বলে এক হাত দিয়ে আরেক হাতে আঁচড় দিতে লাগলো। গলায়, মুখেও আঁচড় দিতে লাগলো। ঠোট ঘষতে লাগলো।

রায়হানের এই সব দেখে চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। নিজেকে সামলে চোখের পানি মুছে ওর হাত দুটো সক্ত করে ধরে ফেলল। বলল, ” কি করছো এসব? এমন করলে কেটে রক্ত বের হয়ে যাবে তো। গোসল করলেই দেখবে ভালো অনুভব করবে। আর আমাকে কথা দাও? এখন যা করলে তা আর পুনরাবৃত্তি ঘটাবে না সাদিয়া। কথা দাও?
— হুম।
— আশা করি কথা রাখবে। কথা দিয়ে কথা না রাখা ব্যক্তি মুনাফিকের খাতায় নাম লিখায়। নিশ্চয়ই মুনাফিককে আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন না।

সাদিয়া কিছু বলল না, চুপকরে চলে গেল ওয়াশ রুমে। রায়হান গাড়ি নিয়ে সোজা চলে গেল মার্কেটে, দু’ঘন্টা ঘুরে সাদিয়ার জন্য বেশ কিছু জামা ও একটা বেনারসি শাড়ি নিয়ে বাসায় রওনা হলো। সাদিয়া এখনো গোসল করছে, দু’ঘন্টা মেয়েটা গোসল করছে ভেবে রায়হানের মা ওয়াশ রুমেয় বাইরে থেকে সাদিয়াকে নক করে বললো “সাদিয়া, মা তাড়াতারি বেড়িয়ে আসো।” সাদিয়ার যেন বেরোতে ইচ্ছাই করছে না ওই বাজে লোকগুলোর ছোঁয়া এখনো ওর শরীরে লেগে আছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু রেহানা বেগম বেরোতে বলে গেছে বেরোতে হবে। হ্যংগার থেকে তোয়ালে নিতে যাবে তখনি দেখলো, সে তো জামা-কাপড় না নিয়েই ভিতরে ঢুকে গেছি। এখন কিভাবে বের হবে। তখনি বাইরে থেকে একটা ছেলে কন্ঠ ভেসে উঠলো। রায়হান বলল,
— সাদিয়া শুনছো ? তুমি তো কোন জামা না নিয়েই ভিতরে ঢুকে গেছ। তোমার জন্য এই শাড়িটা এনেছি, বাইরে রেখে গেলাম, পরে নিও ।
— জ্বি আচ্ছা।

কিছুক্ষণ পর রায়হান ঘড়ে এসে দেখলো সাদিয়া লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি পরে বসে আছে ড্রেসিংটেবিল এর সমানে মুখ, গলা, হাতে থাকা আঁচড়ের দাঁগগুলো দেখছে। ভেঁজা খোলা চুলে, লাল টুকটুকে শাড়িতে অপূর্ব লাগছে ওকে। আয়নাতে রায়হানকে দেখেই চমকে উঠো সাদিয়া। পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল,
— শড়িটা?
— হুম, তোমার জন্য কিনে এনেছি।
— কিনে এনেছেনই যেহেতু এই বেনারসি কেন? আমি থ্রিপিস পরতে কমফোর্টেবল।
— হুম, জানি। থ্রিপিস ও এনেছি সাথে।
— তাহলে বেনারসি কেন দিলেন তখন?
— বিয়েতে মানুষ বেনারসিই তো পরে।
— জ্বি বুঝলাম না?
— বাইরে গেলেই বুঝবে।
” চলো ” বলেই ওর হাত ধরে টেনে ওকে বাইরে নিয়ে গেল।

রায়হানের বাবা-মা কাজি আর রায়হানের কিছু আত্মীয় বসে আছে ডাইনিং রুমে। সাদিয়া রাজি হচ্ছে না এ বিয়েতে। সে চায়না ওকে বিয়ে করে রায়হান পরে পস্তায়। ওকে বিয়ে করলে ওদের পরিবারের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি হবে। তারচেয়ে বড় কথা ও মনে করছে রায়হান ওর উপর সহানুভূতি দেখাচ্ছে।

— আমি বুঝতে চাইছি না কেন আপনি আমার নরক হয়ে যাওয়া জীবনে নিজেকে জরাতে চান। আমার প্রতি এতটা সহানুভূতি না দেখালেও চলবে।

— আমি কোন সহানুভূতি দেখাচ্ছি না। আমি তোমাকে ভালেবাসি। একটু বোঝার চেষ্টা করো।

” সবার সামনে ভালোবাসি কথাটা বলাতে সাদিয়া একটু অবাক হলো।” রায়হান কি করবে কিছুই ভাবতে পারছে না। সাদিয়া যদি সত্যি সত্যি ছেড়ে চলে যায়? বুকে প্রচন্ড রকমের ব্যথা অনুভব হচ্ছে ওর। রায়হানের কখনো এ অবস্থায় পরবে ভাবেনি। বুক ফেটে কান্না বের হচ্ছে ওর। রায়হান প্রায় কেঁদে দিয়ে বলল, “তুমি কি এখন এ বিয়েটা করবে না ??” সাদিয়া এই প্রথম রায়হানকে কাঁদতে দেখছে আজ। কিছুকক্ষণ চুপ থেকে আস্তে করে উত্তর দিল ” না ” রায়হান আর কিছু ভেবে উঠতে পারলো না। সেখান থেকে উঠে টি টেবিল এর উপরে থেকে ধারালো ছুড়ি এনে সাদিয়ার সামনে বুকের মধ্যে চেপে ধরলো। সবাই ওর এরূপ কাজ দেখে ভয় পেয়ে গেল। রায়হান অস্পষ্ট স্বরে বলল, তুমি এটাই দেখতে চাইছিলে তাই না? ” সাদিয়া খেয়াল করলো চাকুটা বেয়ে রক্ত পরছে। ” কি হলো উত্তর দাও? ” বলে রায়হান ছুড়িটাকে আরেকটু চাপ দিতেই সাদিয়া কেঁদে উঠে বলল, ” আমি বিয়েতে রাজি, রাজি আমি বিয়েতে। ”
#পবিত্র_সম্পর্ক
লেখক : রিদন রায়হান
পর্ব : ০৪

রায়হান ছুঁরিটা নিজের বুকে আরেকটু চাপ দিতেই সাদিয়া কেঁদে উঠে বলল, “আমি রাজি, রাজি আমি আপনাকে বিয়ে করতে। ”

রাত একটা বেজো পনেরো মিনিট ! রায়হান সাদিয়াকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। রায়হান চারিদিকে একবার তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজকের দিনটা নিয়ে কত কি ভেবে ছিল। সাদিয়া বউ সেজে বসে থাকবে। ও হাতে একটা লাল টুকটুকে একটা গোলাপ নিয়ে ঘরে ঢুকবে। ওর পাশে গিয়ে বসে ওর লাজুক মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সেই গোলাপ সাদিয়ার ঠোটে ছুয়িয়ে দিবে। সাদিয়া কেঁপে উঠবে। সারা রাত দুজন গল্প করবে আরো কত কি ভেবে রেখেছিল কিন্তু ভাগ্যের কি নর্মম পরিহাস সে ইচ্ছেগুলো আর পূরণ হলো না।

সাদিয়া পুরো ঘড়টা আনমনে দেখতে লাগলো। আর একটা মাস পর এই দিনটা কত সুন্দর হতো ওদের। ফুল দিয়ে সাজানো খাটের উপর ও বউ সেজে বসে থাকতো আর রায়হান ওর পছন্দের একগুচ্ছ লাল গোলাপ হাতে নিয়ে এসে ওর পাশে বসত। সাদিয়া যখন রায়হানের হাসিভরা মুখটা দেখে লজ্জা পেয়ে নিচে তাকিয়ে থাকতো তখন রায়হান ওর থুতনিতে ধরে বলতো, “লজ্জা পাচ্ছ কেন লাল টুকটুকে বউ আমার? চেয়ে দেখো তোমার জন্য আনা এই লাল গোলাপটাও আজ যেন লজ্জায় লাল হয়ে আছে। ” তখন সাদিয়া মুচকি হেসে বলতো, ” এসব কথাও বলতে জানেন আপনি? চলুন আগে দুজন দুই রাকাত নামজ পড়ে নেই, তারপর দুজন মিলে গল্প করবো। ” তখন রায়হান কিছুক্ষন ভেবে বলবে ” হুম, চলো ” — এসব ভেবে চোখে দু’ফোটা পানি চলে আসলো সাদিয়ার। খাটের উপর বসে সে চোখের পানি মুছে ফেলল যা রায়হানের চোখে এঁড়ালো না।

রায়হান ভাবলো, “আজকের এই খারাপ দিনটার কথা ভেবে কেন আমি আমার সব ইচ্ছেগুলো অপূর্ণ রাখবো? কেন সাদিয়ার স্বপ্নটা পূরণ করবো না? বাগানের গছগুলোতে বেশ কিছু গোলাপ ফুল ফুটেছে সেখান থেকে কিছু ফুল নিয়ে আসলে কেমন হয়?” যেই ভাবা সেই কাজ বাগান থেকে কিছু গোলাপ ফুল নিয়ে আসলো।

সাদিয়া রায়হানকে হঠাৎ কিছু না বলে ঘর থেকে চলে যাওয়াতে মন খারাপ করেছিল। রায়হান সেটা বুঝতে পারলো। সাদিয়া খাটে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল রায়হান ওর কাছে গিয়ে ফ্লুরে হাটু গেরে বসলো সাদিয়া চমকে ওর দিকে তাকালো। রায়হান ওর পছিন থেকে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল বের করে সাদিয়ার সামনে ধরে বলল, “ফুলগুলো হয়তো লাল টুকটুকে নয় কিন্তু এরা তোমার মতই পবিত্র সাদিয়া। আমার এই ছোট্ট ভালোবাসাটাকে গ্রহন করো।” সাদিয়া হয়তো এত খুশি কখনো হয়নি। “এত কিছুর মধ্যেও মানুষটা আমার এই ছোট্ট স্বপ্নের কথা মনে রেখেছে। সত্যিই খুব ভালোবাসে আমায়।” খুশিতে চোখে পানি চলে আসলো সাদিয়ার। রাহানের দুগালে হাত রেখে কপালে চুমু খেয়ে কেঁদে দিল।



সাদিয়ার ছাত্রীর মা সালেহা বেগম তার ছেলেকে এত রাত্রে বাড়িতে ফিরতে দেখে বলল,
— কিরে? রাত একটা বাজে এখন তোর বাড়ি ফেরার সময় হলো? ( সাহেলা )
— মা একটু কাজ ছিল। ( ঈশান )
— এত রাতে কিসের কাজ। তোর বোনটা যে বড় হচ্ছে রাত বিরেতে একা ওকে নিয়ে বাসায় থাকি সেদিকে কে তোর খেয়াল আছে? এমনিতেই দিন-কাল ভালো না। ( সাহেলা )

মা আর ভাইয়ার কথা শুনে ড্রয়িং রুম থেকে পড়া রেখে আসলো মিম। মিমকে দেখে ওর ভাই ঈশান বলল,
— কিরে তুই এখনো ঘুমাস নি? ( ঈশান )
— পড়ছিলাম, এ বছরই তো আমার এস. এস.সি পরিক্ষা তাই। ( মিম )
— আরো তো এগারো মাস আছে এখনি এত পড়ার কি আছে। যা ঘুমা গিয়ে ( ঈশান )
ভ্রু-কুচকে মিম বলল,
— কিরে ভাইয়া তোর শার্টে সেপ্টিপীন আসলো কোথা থেকে? এমন সেপ্টিপীন না আমি আমার ম্যামকে কিনে দিয়েছিলাম। (মিম)
— কারো সাথে লাইন-টাইন মারছিস নাকি? এসব থেকে দূরে থাকিস। মিমের ম্যাম মিমকে বলেছে প্রেম করা হারাম। বুঝছিস। ( সাহেলা )
— আরে মা কি শুরু করলে তুমি। ওই ডিম এর বাচ্চা কোথায় পিন?( ঈশান )
— এইদিক আয়…… আরে একটু নিচু হ লাম্বু একটা। ( মিম )
— আচ্ছা হচ্ছি রে বাবা। ( ঈশান )

মিম ভাইয়ার শর্ট থেকে পিনটা এনে দিয়ে বলল,
— এই যে, এটা কি হুম।
— কি জানি কোথা থেকে আসলো এটা। আচ্ছা আমাকে দিয়ে দে এটা।
— না দিব না এটা আমি রাখবো ( বলে দৌড়ে ঘরে চলে গেল। )

তখনি সাহেলা বেগম এর হাতে থাকা ফোনটা বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করে কথা বলার পরই তিনি কেঁদে দিলেন মিমকে চিৎকার করে একটা ডাক দিয়ে বলল,
— মিমরে, তোর সাদিয়া আপুরে কেউ….. আমাের বাড়ি থেকে যাবার সময়ই মেয়েটার সাথে সর্বনাশটা হলো। আল্লাহ

মিম ঘড় থেকে এসে সব শুনে কাঁদতে লাগলো। বড় বোন ডাকে তার তার সাথে এমন হয়ছে সেটা মনতে পারছে না মিম।

মিম আর ওর মা কাঁদছে কিন্তু ওর ভাইয়া একবারের জন্যও ওদের সান্তনা দিল না, বরং তার মুখে একটা ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠছে। মিম আর ওর মাকে কাঁদতে দেখে বললো, “মা, মিম যা হবারর হয়ে গেছে। কান্নাকাটি বন্ধ করো। আমার খুদা পাইছে মা খাবার দিয়ে যাও ” — ব্যপারটা খটকা লাগলো মিমের।
ওর ভাইয়ার এত রাত করে বাড়িতে ফেরা, তার শার্টের সেপ্টিপিনটা আর ওর ম্যাম এর সেপ্টিপিনটার কথাগুলোও মনে পড়লো। সব মিলিয়ে কেন জানি ওর ভাইয়াকে সন্দেহ হতে লাগলো মিমের।
সাহেলা বেগম এর ও ছেলের আচরণ ঠিক বলে মনে হলো না।



রাত প্রয় চারটা বাজতে চলেছে। রায়হান সাদিয়া কারোরই ঘুম আসছিল না ওই ঘটনার কারনে। অবশেষে একটু ঘুমিয়েছে ওরা।

ক্লান্ত পশুগুলোর একজন সাদিয়াকে গাড়ি থেকে টেনে নামালো। আরেকজন বেশ বড়-সড় একটা পাথর এনে যেইনা সাদিয়ার মুখে মারতে যাবে তখনি আরেকজন মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, “আমাদের মজা নেয়ার দরকার ছিল সেটা হয়ে গেছে। একেবারে মেরে ফেলার প্রয়েজন নেই। মেরে ফেললে আমার এক প্রিয়জন খুব কষ্ট পাবে”
তখনকার সেই দৃশ্যগুলো ভাসছে সাদিয়ার চোখে। ঘুমের মধ্যেই বলছে ” আমি চিনি, আমি চিনি তার ভয়েস। আমি…আ…আ…আমি চিনি তার ভয়েস।

রায়হানের ঘুম খুব হালকা হওয়ায় সাদিয়ার গোঙ্গানোর আওয়াজ শুনে ঘুমে ভেঙে যায় ওর। সাদির কথাগুলো শুনে বলে,
“সাদিয়া, কি হয়েছে তোমার? কার ভয়েস চিনো তুমি। সাদিয়া? ”
রায়হারে কথা শুনে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে উঠে সাদিয়া। উঠে রায়হানকে দেখে ওকে জরিয়ে উচ্চ শোরে কাঁদতে থাকে। হঠাৎ সাদিয়ার এমন কারাতে ভয় পেয়ে যায়। বলে,

— সাদিয়া কি হয়েছে আমাকে বলো? কাঁদছো কেন তুমি? কোন খারাপ স্বপ্ন দেখেছ নাকি? ঘুমের মধ্য কি যেন বলছিলে, কারো ভয়েস চিনো। কার ভয়েস? কিসের ভয়েস?
–ও…ও….ওই ধর্ষক….পশুগুলোর মধ্যে আ…আ…আমি একজনকে চিনি, তার ভয়েসটা….”
— কি…? তুমি চিনো? দেখেছিলে কি তাকে? ( বলে ওর বুকের উপর থেকে সাদিয়ার মুখটা সরিয়ে সাদিয়ার দিকে তাকালো) তুমি একটু শান্ত হও। তারপর বলো।
— আমি ওই পশুটাকে দেখিনি শুধু কন্ঠ শুনেছি কিন্তু আমার খুব চেনা মনে হচ্ছে সেই কন্ঠটা। কন্ঠটা কার ঠিক তা মনে করতে পারছি না।
— মনে করার একটু চেষ্টা করো প্লিজ।
— আহ…..আমি পারছি না মনে করতে। পারছি না। ( বলে নিজেকে নিজে মারতে লাগলো, চুল টানতে লাগলো নিজের )
সাদিয়ার হাত চেপে ধরে, রেগে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “সাদিয়া ! মনে করতে পারছো না ঠিক আছে নিজেকে মারতে বলেছি। ”
— আমি….
— চুপ করো তুমি। এখন আর একটাও কথা না। একটু ঘুমাও তোমার শরীর অনেক দুর্বল।
— কিন্তু…..
— একটাও কথা বলে বারণ করছি না? আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। তুমি ঘুমাও
— হাত বুলাতে হবে না। আপনিও ঘুমান।

রায়হান সাদিয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “আমি ঘুমাবো তো তুমি আগে ঘুমাও। আমার ঘুম ভাঙলে, এত তাড়াতারি আবার ঘুম আসেনা।” বলে সাদিয়াকে ধরে শুয়েয়ে দিল তারপর সাদিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাদিয়া ঘুমিয়ে গেল। রায়হান ভাবতে লাগলো,

— ধর্ষকদের মধ্যে কারো একজনের কন্ঠ সাদিয়ার চেনা মনে হচ্ছে। এর মানে সাদিয়া তাকে চিনে। সাদিয়া যদি সে ব্যক্তিকে ভালোভাবে চিনতো বা ওর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়ে থাকতে তাহলে সাদিয়া খুব সহজেই কন্ঠ শুনে চিনে যেত। এর মানে সাদিয়ার কোন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ধর্ষনের সাথে জরিত নয়। এবং
সাদিয়া যদি সেই ধর্ষককে আগে দুই একবার দেখে থাকতো বা তার কন্ঠ শুনে থাকতে তাহলে তার কন্ঠ সাদিয়ার চেনা মনে হতো না।
বাকি থাকলো শুধু তারা যাদের সাথে বেশ কয়েকবার সাদিয়ার দেখা হয়েছে যাদের কন্ঠও চিনে কিন্তু তেমন ভালো ভাবে চিনে না। তাদের মধ্যেই থেকেই একজন ধর্ষকদের সাথে জরিত।

এখন যাদের সাথে সাদিয়ার ঘনিষ্ঠ কোন সম্পর্ক নেই তাদের সবার ভয়েস রেকর্ড করে সাদিয়াকে শোনাতে হবে। যাতে ওর মাথায় কোন চাপ না পরে আর যাতে খুব সহজেই চিনে ফেলতে পারে সাদিয়া তাকে।
ইয়েস এটাই করতে হবে আমাকে।



চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here