পরিপূর্ণতা পর্ব -০১

— শোনো নিরা আমি আর তোমার সাথে থাকতে চাই না। আমি ডিভোর্স চাই।

নিহাদের এই কথা শুনে নিরা বড়ো একটা ধাক্কা খেল। সে অশ্রুসিক্ত নয়নে নিহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ডিভোর্সের কারণটা কি জানতে পারি?

নিরার কথা শুনে নিহাদ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে উঠল,

— উফফ নিরা তুমি ভালো করেই জানো কারণটা। তোমার সাথে আমার ঠিক যায় না। তুমি খুবই সেকেলে, গেঁয়ো টাইপের। যাকে বলে আনস্মার্ট। আমার সব ফ্রেন্ডদের বউকে দেখেছ? তাদের নখের যোগ্যও না তুমি।

— বিয়ের দুই বছর পর আজকে তোমার মনে হচ্ছে আমি আনস্মার্ট, গেঁয়ো। তুমি তো প্রথম থেকেই জানতে আমি এমন। তাহলে বিয়ে কেন করেছিলে আমায়?

— বাবা কথা রাখতে বিয়ে করেছিলাম। ভেবেছিলাম তোমাকে নিজের মতো করে নিবো। কিন্তু তুমি তো তুমিই। তাই আমি ঠিক করেছি তোমাকে ডিভোর্স দিবো। তারপর নিজের পছন্দ মতো কাউকে বিয়ে করব। আমি ডিভোর্সের জন্য এপ্লাই করেছিলাম। আর আজকে ডিভোর্স পেপার পেয়েও গেছি। তাই তোমাকে বলছি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দয়া করে মুক্তি দেও। পেপারটা দিয়ে গেলাম প্লিজ সই করে দিও।

বলেই নিহাদ ডিভোর্স পেপারটা টেবিলের ওপর রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নিরা ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। তার দুই চোখ দিয়ে অজস্র অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছে। তখনই রুমে নিরার শাশুড়ি মিসেস নাহিদা রুমে এলেন। নিহাদ এতোক্ষণ কথাগুলো বেশ জোরেই বলছিল। তাই মিসেস নাহিদা সবটা শুনেছেন। তিনি রুমে এসেই নিরার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলে উঠলেন,

— আমার ছেলে কি বলে গেল শোনোনি? নাকি কানে পোকা ধরেছে? তাড়াতাড়ি সই করে বাড়ি থেকে বিদেয় হও।

শাশুড়ির কথা শুনে নিরা ছলছল চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

— মা আপনিও?

— আমি কি? আমি কি তোমাকে কোলে তুলে নাঁচব? যাও তাড়াতাড়ি সই করে বাড়ি থেকে বের হও।

নিরা আর কিছু বলল না। একহাত দিয়ে চোখ মুছে ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিল। তারপর কাঁপাকাঁপা হাতে সই করে দিল। মিসেস নাহিদার মুখে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠেছে।

— এবার তাড়াতাড়ি বের হও বাড়ি থেকে। এখন তুমি এই বাড়ির আর কেউ নও।

নিরা কাঁপাকাঁপা স্বরে বলে উঠল,

— আমাকে কিছুক্ষণ সময় দিন। আমি চলে যাচ্ছি।

— আচ্ছা।

বলেই মুখ বেঁকিয়ে চলে গেলেন। যেতে যেতে বিরবির করে বলে উঠলেন,

— যাক অবশেষে আপদ বিদেয় হলো।

ওনার এই কথাটা নিরার কান এড়ালো না। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার ব্যাগে তার কিছু জামাকাপড়, কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আর সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
নিরা আনমনে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর ভাবছে হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেল? সে যখন অনার্স প্রথম বর্ষে পড়তো তখন একদিন তার বাবা এসে বলল তার বিয়ে ঠিক করেছে তার বন্ধুর ছেলের সাথে। নিরা এই বিয়েটা করতে একদমই রাজি ছিল না। সে আরও পড়তে চেয়েছিল। তবুও এক প্রকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার বিয়েটা হয়ে যায় নিহাদের সাথে। বিয়ের পর সে ভেবেছিল মানিয়ে নিবে। তার শাশুড়ি তাকে পছন্দ না করলেও শশুর সবসময় তার পাশে ছিল। তাকে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতিও দিয়েছিল। কিন্তু এখন সে কি করবে? কিছুই বুঝতে পারছে না। সে কি বাসায় ফিরে যাবে? আচ্ছা তার বাবা মা কি তাকে মেনে নিবে? নাকি অন্যদের মতো তারাও তাড়িয়ে দিবে? সে ঠিক করল সে প্রথমে বাসায়ই যাবে। যেহেতু বিয়েটা তার বাবা মায়ের পছন্দে করেছিল সে। নাকি তার দায়িত্ব তার বাবা মাকেই নেওয়া উচিত। নিরা এসব ভাবতে ভাবতেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। আশেপাশের কোনোদিকে তার খেয়ালই ছিল না।
সে যেন অন্য একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। তখনই কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে টেনে নিয়ে এলো। নিরার ঘোর ভেঙে গেল। সে তাকিয়ে দেখে তার বেস্টফ্রেন্ড নাবিলা দাঁড়িয়ে আছে। নাবিলা তার দিকে তাকিয়ে রেগে বলে উঠল,

— মরার শখ হয়েছে নাকি তোর? রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছিলি কেন?

নিরা মলিন মুখে বলল,

— মরলেই বোধহয় ভালো হতো। সবাই বেঁচে যেত।

নিরার কথা শুনে নাবিলা কিছুটা অবাক হয়ে বলল,

— কি হয়েছে তোর? এসব কি বলছিস? আর ব্যাগ নিয়ে কোথায়ই বা যাচ্ছিস?

— কিছুই হয়নি আমার। আমি একটু বাসায় যাচ্ছি।

বলেই নিরা হাঁটতে শুরু করল। নাবিলা পেছন থেকে বলে উঠল,

— আচ্ছা যা। কিন্তু কোনো দরকার হলে আমাকে ফোন দিবি। তোকে দেখে আমার খুব একটা স্বাভাবিক লাগছে না।

নিরা শুকনো হেসে আবার হাঁটতে শুরু করল। সে এবার আশেপাশে তাকিয়ে বলল,

— আর হাঁটতে ভালো লাগছে না। দেখি একটা রিক্সা পাই কিনা?

সে কাছাকাছি একটা রিক্সা পেয়ে গেল। সেটায় উঠে ঠিকানা বলল। রিক্সা চলতে শুরু করল। নিরার ভাবনা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। তার একটা বিষয় নিয়ে বেশ চিন্তা হচ্ছে। তার বাবা মা তার কষ্ট বুঝতে নাকি তারাও তাকে দূরে সরিয়ে দিবে।

— আপা আপনার ঠিকানায় চইলা আইছি।

রিক্সাওয়ালার ডাকে নিরার ঘোর ভাঙে। সে রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাসায় সামনে দাঁড়াল। আজকে দেড় বছর পর সে বাড়িতে এসেছে। নিহাদ তার এই বাড়িতে আসা মোটেও পছন্দ করতো না। শেষ বার এসেছিল যখন তার বাবা অসুস্থ হয়েছিল তখন নিহাদকে অনেক অনুরোধ করার পর সে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু দুই ঘন্টা পরই সে তাকে নিয়ে চলে যায়। আজ এতোদিন পর সে আবার তার বাড়িতে যাচ্ছে। নিরা লিফটে উঠে পড়ল। কিছুক্ষণ পর লিফট ছয়তলায় এসে থামল। নিরা লিফট থেকে নেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর কাঁপা কাঁপা কলিং বেলে চাপ দিল।

— আসছি!

ভেতর থেকে তার মায়ের গলার আওয়াজ শুনে সে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। আজকে কেন যেন তার অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে? নিরার মা মিসেস নাফিসা কিছুক্ষণ পর এসে দরজা খুলে দিলেন। দরজা খুলে মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিসেস নাফিসার মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। তিনি হাসি মুখে বলেন,

— নিরা মা তুই এসেছিস? নিহাদ কই? বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তাই না?

বলেই তিনি বাইরের দিকে উঁকি দেন। নিহাদের নাম শুনে নিরা মলিন হাসে। সে মনে মনে বলতে থাকে,

— আমার বাড়িতে আমি এতোদিন পর এলাম। আর মা আমাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিহাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে।

— কে এসেছে?

নিরার বাবা নিরব আহমেদের কথা শুনে মিসেস নাফিসা পেছন ফিরে তাকান। তারপর হাসি মুখে বলেন,

— নিরা এসেছে।

স্ত্রীর কথা শুনে নিরব সাহেব সামনে এগিয়ে আসেন। তার নিরার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে ওঠেন,

— তুমি হঠাৎ এখানে এলে যে? নিহাদ কই?

নিরা মনে মনে বলে উঠল,

— সবাই খালি নিহাদকে নিয়ে পড়ে আছে। আমি যে এতোদিন পর এলাম কেউ আমার কথা ভাবছেই না।

নিরা নীরবতা ভেঙে বলে উঠল,

— নিহাদ আসেনি। আমি একাই এসেছি।

— তুমি একা এসেছ মানে? নিহাদকে জানিয়ে এসেছ তো?

নিরা এবার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মনে মনে বলল,

— এখন আমার নিজের বাড়িতে আসতে অন্য কারো অনুমতি নিয়ে আসতে হবে? হুহহ!

— হ্যাঁ সে জানে আমি এখানে এসেছি।

— আচ্ছা। তাহলে কয়দিন থাকছো এখানে? নাকি আজকেই নিহাদ এসে নিয়ে যাবে?

নিরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,

— নিহাদ আর কোনোদিন আসবে না। আর না তো আমি ওখানে ফিরে যাব। আমি ওখান থেকে সারাজীবনের মতো চলে এসেছি। ওখানে আর ফিরে যাচ্ছি না।

নিরার কথা শুনে নিরব সাহেব রেগে বলে উঠলেন,

— সারাজীবনের জন্য চলে এসেছ মানে? তুমি ভেবেছ তুমি সব ছেড়ে এখানে চলে আসবে আর আমি তোমাকে থাকতে দেব? এটা আমার বাড়ি। কোনো হোটেল নয় যে যখন পারে এখানে এসে থাকবে। তুমি এখানে এসে থাকলে আশেপাশের মানুষ কি বলবে? আমার আরও দুটো ছেলে মেয়ে আছে। তাদের ভবিষ্যৎ আছে। তুমি এখানে পড়ে থাকলে আমার বাড়ির পরিবেশ নষ্ট হবে যা আমি মোটেই চাই না। তাই যেখান থেকে এসেছ সেখানেই যাও। আমি বাড়িতে তোমার কোনো জায়গা হবে না।

বলেই নিরাকে কিছু বলতে না দিয়ে তিনি নিরার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। নিরা স্তব্ধ হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। সে এমনটা আসা করেনি। সে নিজেই নিজেকে বলতে লাগল,

— আজ আমি তোমাদের কাছে এতোটাই পর হয়ে গেছি। তোমাদের দুই ছেলে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাবছ। আর আমার ভবিষ্যতের কথা একবারও ভাবলে না। আমার জীবনটা তো তোমরাই নষ্ট করেছিলি। আর আজ তোমরাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো। আমি এখানে থাকলে সমাজ কি বলবে সেটা ভাবছ? আজকে আমার থেকেও সমাজ তোমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল।

নিরার চোখের কোণা দিয়ে পানি বেয়ে পড়ে। এদিকে মিসেস নাফিসা নিরব সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

— কাজটা কি ঠিক হলো? তুমি এভাবে ওকে না বললেও পারতে?

— আমি যা করেছি ঠিকই করেছি। ও নিশ্চয়ই নিহাদের সাথে ঝগড়া করে এসেছে। আমি যদি ওকে এখানে থাকতে দিতাম তাহলে ওর জেদ বেড়ে যেত। এখন দেখবে ও ঠিক আবার ওই বাড়িতে চলে যাবে।

— তবুও ওভাবে না বললেও পারতে।

নিরব সাহেব কিছু বলতে যাবেন তখনই নিরা দরজার ওপাশ থেকে বলে উঠল,

— ঠিকাছে আমি আর কোনোদিন তোমাদের বাসায় আসব না। তোমরা থাকো তোমাদের বাকি দুই সন্তানকে নিয়ে। আমি তো তোমাদের কেউ না। আমার থেকেও সমাজ তোমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা তো আমার পুরো কথাটাই শুনলে না। তার আগেই সবটা বলে দিলে। আরে নিহাদ আজকে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কারণ আমি আনস্মার্ট, গাঁইয়া, ক্ষ্যাত। আর এখন তোমরা বের করে দিলে সমাজ কি বলবে তাই ভেবে? আচ্ছা তোমরা থাকো তোমাদের সমাজ নিয়ে। আমি আর কোনোদিন এখানে আসব না।

নিরার কথা শুনে নিরব সাহেব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি বুঝতে পারলেন তিনি খুব ভুল করে ফেলেছেন। তিনি তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দেখলেন নিরা কোথাও নেই। সে চলে কোনো এক অজানা গন্তব্যের পথে। নিরব সাহেব মাথায় হাত দিয়ে ওখানেই বসে রইলেন। মিসেস নাফিসা পাশে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলেন।

চলবে,,,

( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। )

#পরিপূর্ণতা
#পর্ব_১
#লেখিকা_N_K_Orni

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here