#পরিপূর্ণতা
#শেষ_পর্ব
#লেখিকা_N_K_Orni
— কি সারপ্রাইজ?
নাবিলা কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাশ থেকে নূর বলে উঠল,
— তোমরা দুজন কি বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলবে? নাকি ভেতরেও যাবে?
নূরের কথা শুনে নাবিলা বলে উঠল,
— ঠিকই তো। তোরা ভেতরে আয়। আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে তোদের এখনো বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
বলেই নাবিলা সরে দাঁড়াল। ওরা ভেতরে ঢুকল। তখনই নাবিলার আম্মু মিসেস তাসনূভা ওখানে আসেন। তিনি নিরাকে দেখে বলে ওঠেন,
— তুই এসেছিস মা? আমি তো নাবিলাকে বলছিলাম আজকে যেন তোকে ফোন দেয় আসার জন্য। আর তুই চলে এলি।
— কিন্তু হঠাৎ তোমরা আমাকে এতো খুঁজছো কেন?
নিরা ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল,
— কাহিনী কি? পুরো খুলে তো বলো।
এবার পাশ থেকে নাবিলা বলে উঠল,
— আচ্ছা আচ্ছা বলছি। তাহলে শোন আমার…
নাবিলা থেমে গেল। ওকে থেমে যেতে দেখে নিরা বলে উঠল,
— তোর কি?
— আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
— কিইই সত্যিই? তুই আমাকে এতোদিন বলিসনি কেন?
— আরে পরশুই ঠিক হয়েছে। তুই আসলে তোকে সরাসরি বলব ভেবেছিলাম।
— এতো অনেক ভালো খবর। কিন্তু দুলাভাই কি করে? কোথায় থাকে? কেমন দেখতে?
নাবিলা এবার নিরাকে বলতে না দিয়ে বলে উঠল,
— আরে বোইন থাম থাম। তোকে আমি সরাসরি দেখাব তখন দেখিস।
— আচ্ছা।
— তোমরা শুধু মাম্মামকে নিয়েই পড়ে আছো। আমার দিকে দেখছোই না। আমি কি অদৃশ্য হয়ে গেছি?
নূরের কথা শুনে ওখানে থাকা সবাই হেসে উঠল। মিসেস তাসনূভা এবার নূরকে কোলে নিয়ে বলে উঠলেন,
— ঠিকই তো। আমরা কেউ নূর সোনাকে খেয়ালই করছি না।
নাবিলা এবার বলে উঠল,
— আম্মু তুমি নূরের খেয়াল রাখো। আমি নিরাকে নিয়ে একটু বাইরে যাচ্ছি। বিথী তুইও থাক। আমরা একটু আসছি।
— কই যাবি?
— গেলেই দেখতে পাবি।
— আচ্ছা চল।
তখনই নূর পাশ থেকে বলে ওঠে,
— আমিও যাব তোমাদের সাথে প্লিজ।
— আচ্ছা চলো তোমাকেও নিয়ে যাই। চল নিরা।
— হ্যাঁ চল।
—————–
বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন নিরব আহমেদ। আর বিছানার পাশে থাকা চেয়ারে বসে আছেন মিসেস নাফিসা। রুমে চলছে পিনপিন নীরবতা। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে মিসেস নাফিসা বলে উঠলেন,
— এই সবই আমাদের পাপের ফল। না জানি আমার মেয়েটা কেমন আছে? কি করছে?
পাশ থেকে নিরব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন,
— এখন আমি বুঝতে পারি আমি ওইদিন কতোবড় ভুল করে ফেলেছিলাম। সব দোষই আমার। আমিই ওকে না দেখে শুনে বিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর যখন ডিভোর্স নিয়ে ফিরে এলো তখনও আমি ওকে তাড়িয়ে দিলাম।
তখন মিসেস নাফিসা বলে উঠলেন,
— তাও আবার সমাজের কথা ভেবে। তোমার দুই কুলাঙ্গার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমার মেয়েটাকে বের করে দিলে।
মিসেস নাফিসা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন,
— এখন কই তোমার সেই ছেলেমেয়ে। তোমার মেয়ে তো তোমার সম্মানের কথা না ভেবে বিয়ের দিন পালিয়ে গেল। আর ফিরে এলো না। একবারের জন্য ফোনও দেয় নি। আর তোমার ছেলে। সেই বা কই? হঠাৎ একদিন বিয়ে করে নিয়ে এলো। আর তার ঠিক একমাস পর বলল আমাদের সাথে তার থাকা সম্ভব না। সে আলাদা থাকতে চায় তার বউ নিয়ে। এখান থেকে যাওয়ার পর একবারের জন্যও কি খোঁজ নিয়েছে? আর দুজন শুধুমাত্র এই বাড়িতে। আমরা মরে পড়ে থাকলেও কেউ এসে খোঁজ নিবে না। কই তোমার সেই সমাজ? আশেপাশের কেউ একবারও খোঁজ নিয়েছে। এই সমাজের দোহাই দিয়ে, তোমার দুই কুলাঙ্গার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমার মেয়েটাকে বের করে দিলে। যখন ওর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল আমাদের। এখন কই তোমার সেই সমাজ আর ছেলেমেয়ে?
নিরব সাহেব মিসেস নাফিসার দিকে তাকিয়ে দেখলেন তার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। নিরব সাহেব মলিন মুখে বলে উঠলেন,
— সত্যিই আমি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি। এ ভুলের আর কোনো ক্ষমা নেই।
—————
নাবিলা নিরা আর নূরকে নিয়ে একটা হসপিটালের সামনে এলো। নিরা একবার সেদিকে তাকাল তারপর নাবিলার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
— এখানে কেন নিয়ে এলি? আচ্ছা তুই কি অসুস্থ? ডাক্তার দেখাতে এসেছিস? আগে বলবি তো।
— আরে আরে ওসব কিছুই না। তুই আগে চল আমি তো তোকে দেখাচ্ছি।
নাবিলা এবার ওদেরকে নিয়ে একজন ডাক্তারের চেম্বারের সামনে নিয়ে এলো। নিরা অবাক হয়ে বলল,
— তুই বলে ডাক্তার দেখাবি না। তাহলে এখানে কেন নিয়ে এলি?
— আগে ভেতরে চল।
ওরা তিনজন ভেতরে ঢুকল। ভেতরে যেতে নিরা একজন হাস্যজ্বল পুরুষকে দেখতে পেল। নাবিলা এবার লোকটার দিকে ইশারা করে নিরার কানে মুখ নিয়ে বলল,
— এটাই তোর দুলাভাই। বুঝলি?
নিরা এবার নাবিলার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল,
— আগে বললেই হতো তোর হবু বর ডাক্তার। আর তার সাথে দেখা করাতে এখানে এসেছিস। প্রথমে বললেই হতো।
— আগে বললে কি সারপ্রাইজ থাকত? হুহ।
নাবিলা এবার লোকটার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— রিয়াদ দেখ আমি চলে এসেছি। তোমাকে আমার বান্ধবী নিরার কথা বলেছিলাম না। ওই যে নিরা আর ওর মেয়ে নূর।
— ওহ আচ্ছা। বস তোমরা।
নিরা আর নূর বসল। তারা অনেকক্ষণ গল্প করল। তারপর নাবিলা বলে উঠল,
— এবার যাওয়া উচিত।
— আচ্ছা চল।
ওরা তিনজন ওখান থেকে বেরিয়ে গেল। ওরা হসপিটালের করিডর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তখনই পেছন থেকে কেউ নিরা বলে ডাক দিল। নিরা প্রথমে ভেবেছিল হয়তো অন্য কাউকে ডাকছে। কিন্তু বারবার ডাকায় নিরা পেছনে তাকিয়ে দেখে নিহাদ। ওকে দেখতেই নাবিলা কটমট করে ওঠে। সে বলে ওঠে,
— এই ফালতু লোকটা এখানে কি করছে? আর তোকেই বা ডাকছে কেন? তুই একদম ওই লোকটার কথা শুনবি না।
— দাঁড়া আগে গিয়ে শুনে আসি আমাকে কেন ডাকছে?
— না তুই যাবি না।
— আরে আমি কেন যাব না? ও তো ভালো আছে। আমিও ওকে দেখিয়ে দিতে চাই যে আমিও ভালো আছি।
— কিন্তু…
— কোনো কিন্তু না। আমি যাচ্ছি। একটু কথা বলেই চলে আসব। তুই থাক।
বলেই নিরা নূরের হাত ধরে নিহাদের সামনে গেল। তারপর তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
— আমাকে ডাকছিলেন?
— হ্যাঁ তোমাকেই ডাকছিলাম।
— বলুন কি বলার জন্য ডাকছিলেন?
— তুমি অনেক বদলে গেছো।
— সময়ের সাথে সাথে সবকিছুতেই পরিবর্তন আসে। আমারও সেই রকম পরিবর্তন হয়েছে।
— কেমন আছো?
— খুব ভালো। আপনি?
— আছি। নিজের ভুলের শাস্তি পাচ্ছি।
— মানে?
— আমি এখন বুঝি তোমার সাথে সেই সময় অনেক বড় ভুল করে ফেলেছিলাম। আর আজ তার জন্য শাস্তিও পাচ্ছি। তুমি চলে যাওয়ার পর মা আমার পছন্দ অনুযায়ী মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিয়েছিল। ঠিক তেমন মেয়ে যেমনটা আমি চাইতাম। কিন্তু সবচেয়ে বড় জিনিস যেটা হলো চরিত্র, যেটাকে আমি কখনো গুরুত্ব দেই নি। সেই চরিত্রটাই নেহার মধ্যে ছিল না। আমাদের বিয়ের পরও ও একাধিক ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। বাচ্চা এখন নেব না বলে বেশ কয়েকবার এব্রোশন করিয়েছে। কিন্তু শেষ অপারেশনে একটু ভুল হয়। যার কারণে ও আর কোনদিন মা হতে পারবে না।
— তা আপনি হসপিটালে কি করছেন?
— ওই যে বললাম না শাস্তি পাচ্ছি। নেহা অনেক ছেলের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে। যার কারণে ওর এইডস ধরা পড়েছে। ও এই হসপিটালেই ভর্তি।
— ওহহ।
— তা তুমি এখানে? কোনো কাজে এসেছিলে?
— হ্যাঁ। আমার বান্ধবী নাবিলার হবু বর ডাক্তার। তার সাথেই আমরা দেখা করতে এসেছিলাম।
— ওহহ।
তখনই নিহাদের চোখ যায় নূরের দিকে। নূর মাম্মামের হাত ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল আর আশেপাশে যেসব লোকজন যাওয়া আসা করছে তাদের দেখচ্ছিল। নিহাদ এবার নূরের দিকে ইশারা বলে,
— তোমার মেয়ে এটা?
— হ্যাঁ আমার মেয়ে।
— আবার বিয়ে করেছ তাই না?
— আপনার কেন এই কথা মনে হলো?
— এই যে বললে অনেক ভালো আছো। তারপর তোমার ব্যবহারে কতোটা বদল এসেছে। এসবেই বোঝা যায় বিয়ে করেছ।
— কেন? বিয়ে করলেই যে শুধু ভালো থাকা যায় সেটা আপনাকে কে বলল? একজন মানুষ কি একা থাকতে পারে না? আমি একাই ভালো আছি। আপনারা মনে করেন যে পুরুষ ছাড়া একজন নারী চলতে পারে না। কিন্তু আমি পেরেছি। কোনো পুরুষ ছাড়াই আমি চলছি। আপনাদের এই সমাজ নামক যাতাকলে পিষে কত মেয়ের যে জীবন নষ্ট হয়েছে তার হিসাব নেই। আপনাদের সমাজে ডিভোর্সিদের জায়গা নেই। সবাই মনে করে তাদের দোষেই ডিভোর্স হয়েছে। কেউ ডিভোর্সিদের কোনো মর্যাদা দেয় না। কিন্তু আমি নিজে থেকেই বলছি আমি ডিভোর্সি আর আমার তাতে কোনো আক্ষেপ নেই। আপনাদের মতো দুইমুখী পুরুষদের সাথে থাকার চেয়ে ডিভোর্সি হওয়া ভালো।
নিহাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিরার দিকে। এই নিরার সাথে সে খুব অপরিচিত। এই নিরাকে সে চেনে না। নিরা আবার বলে উঠল,
— আসছি। ভালো থাকবেন।
বলেই নিরা নূরের হাত ধরে নাবিলা কাছে চলে এলো। নিহাদ তখনও অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নিরা নাবিলার কাছে আসতেই নাবিলা বলল,
— কি বলছিল লোকটা?
— বাসায় গিয়ে বলব তোকে।
— তুই আবার ওর জীবন ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছিস নাকি?
— তোর মাথা নষ্ট? ওই কথা আমি স্বপেও ভাবি না। ও আমার জীবনের এক কালো অতীত যা আমি কখনো মনে করতে চাইনা।
— এই না হলে আমার বেস্টি।
— তাহলে চল যাই।
— চল।
দুজনে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
সমাপ্ত
( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালো না লাগলে ইগনোর করবেন কিন্তু কোনো বাজে মন্তব্য করবেন না। )