পরীজান পর্ব -১০+১১

#পরীজান
#পর্ব ১০
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

নাঈম নিজের ঘরে শুয়ে আছে। মাথার মধ্যে হালকা
ব্যথা অনুভব করছে। যার জন্য মাথাটা বেশ ভারি মনে হচ্ছে নাঈমের। জ্বর ও এসেছে গায়ে। আজকে ওদের কেউই বের হয়নি। সবাই এখন নাঈমের পাশেই বসে আছে। মিষ্টি ভিশন ক্ষেপেছে পরীর উপর। ওর ধারণা পরীই একাজ করেছে। কিন্ত কিছু বলতে পারছেনা। ওর খুব ভয় করছে। এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না। তখনই ঘরে প্রবেশ করল শায়ের। নাঈমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,’এখন কেমন আছেন?’
নাঈম চোখ তুলে তাকিয়ে আলতো হাসলো,’জ্বী ভালো।’
চেয়ার টেনে বসে শায়ের বলল,’ভাগ্য ভাল যে আমি ঠিক সময়ে পৌঁছেছিলাম। রাতে জ্বরটা বেড়েছিল। ভাবলাম বের হব না। আল্লাহ ই নিয়ে গেছে আমাকে।’

‘আপনার কি মনে হয়?মানে কাজটা কে করতে পারে?’
‘আমার মনে হয় বিপক্ষ দল একাজ করেছে। আর নয়তো আপনার উপর কারো ক্ষোভ ছিল। আপনার সাথে কি কারো মনোমালিন্য হয়েছিল?’
নাঈম মাথা নেড়ে না বলল।
‘তাহলে বুঝতে পারছি না। বন্যার কারনে লোকজন ও লাগাতে পারছি না।’

পালক বলে উঠল,’জমিদার এবং ওনার ভাই এখন কোথায়?দেখছি না তো?’

‘ওনারা শহরে গিয়েছেন। দুদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। আমি এখন আসি।’

শায়ের উঠে চলে গেল। মিষ্টি বলল,’আমি নিশ্চিত কাজটা পরী করেছে।’
পালক শায়েরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,’ছেলেটা অদ্ভুত,মেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়ে কখনোই কথা বলে না।’

‘ওই অদ্ভুত এর মধ্যে ভুত আছে। এটা জমিদার বাড়ি নাকি ভুতের বাড়ি বুঝিনা। শোন নাঈম আমি আর কোন কথা শুনব না। এবার আমরা ফিরে যাচ্ছি।’

নাঈম কে শাসিয়ে কথাটা বলে মিষ্টি। প্রতুত্যরে নাঈম বলল,’আমাকে পরীর সাথে কথা বলতে হবে। কাজটা কি সে সত্যিই করেছে?’

‘পরী আপার লগে দেহা করার কথা ভুইলা যান সাহেব। আপার পরাণ থাকতে বেডা মাইনষের সামনে আইব না।’
হাতে ফলের থালা নিয়ে ঘরের ভেতর এলো কুসুম। তারপর আবারও বলতে লাগল, ‘পরী আপা আমারে পাঠাইছে আপনাগো সব কইতে। জানেন তো আমাগো বড় মা আপারে কসম দিছে হেয় যেন কোন পুরুষরে মুখ না দেহায়। কিন্ত ক্যান কসম দিছে তা আপাও জানে না। আপনাগো কেউ অন্দরে গেছিল আপা জানে কিন্ত হেয় আপনাগো ক্ষতি চায় না।এই গেরামের মানুষ একে অন্যের শত্রু। তাই আপা চায় আপনাগো ক্ষতি না হোক। আর আপনাগো সাবধান থাকতে কইছে। রাইতের বেলা বাইর হবেন না। সবসময় শায়ের ভাইয়ের সাথে থাকবেন। ‘

কথা শেষ করে কুসুম চলে গেল। কুসুমের কথার মানে পুরোপুরি কেউ না বুঝলেও পালক বুঝেছে। ও বলল,’তার মানে মালা বেগম এর কসমের জন্য পরী কারো সামনে আসে না। এমনকি নিজের চাচার সামনেও না। কারণ কি?পরীর রুপ?নাকি এর মধ্যে অন্য কারণ আছে?’

‘বেশি ভাবিস না পালক। ওদের সম্পর্কে জানার দরকার নেই। আজ নাঈমের উপর হামলা করেছে কাল আমাদের উপর ও করতে পারে!তার থেকে ভাল আমরা এখান থেকে চলে যাই।’
ভয় জড়ানো কন্ঠে বলল রুমি। নাঈম এবার রাগ করে বলে,’তোরা থামবি?এক চিন্তায় মরে যাচ্ছি আরেক চিন্তা ঢোকাচ্ছিস মাথায়। আমার মনে হচ্ছে কুসুম সব কথা বলেনি। এই বাড়ির সবাই আমাদের থেকে কিছু আড়াল করছে।’

‘অন্দরে যা হচ্ছে তা সবকিছু পরীর মা জানে। কিন্ত আমার মাথায় যেভাবনাটা ঢুকেছে সেটা হলো পরীর চাচা।’

পালকের কথায় শেখর বলল, ‘বিয়ে করেনি তাইতো?তার বউ হয়তো মারা গেছে। এজন্য আর বিয়ে করেনি। আর এসব ব্যাপার বাদ দে তো। আমরা দুদিনের অতিথি বলতে গেলে। কারো পারিবারিক বিষয়ে জেনে কি হবে?’

আসিফ বলল,’সেটাই ঠিক। বেশি গোয়েন্দাগিরি করলে শেষে আমাদের ই বিপদ।’

কেউ আর কোন কথা বলল না। নাঈম ভাবছে, শায়েরের কথা শুনে মনে হল ও কিছুই করেনি। কিন্ত কে করেছে?মাথা ফেটে যাচ্ছে নাঈমের। অন্যদিকে পালক ভাবছে মালার কথা। মালা হয়তো অনেক কিছুই জানে। কিন্ত কি জানে?

কুসুম ছুটে গেল পরীর কাছে। এতক্ষণ সব লুকিয়ে শুনেছে সে। পরীকে খবরটা দিতেই ছুটে গেল।
পরীর সামনে গিয়ে হাপাতে হাপাতে সব বলল। সব শুনে পরী মুচকি হাসল বলল,’শহরে বাবু পরীর লগে কথা কইতে চায়। এতো সপন দেহা ভাল না কুসুম। পরী তারে কিছুই করব না। পরীর বাপে জানলে অনেক কিছু করবো।’
‘একখান কথা জিগাই আপা?বড় মা আপনেরে কসম দিছে ক্যান?’
‘জানি নারে কুসুম। আম্মার মনে অনেক কষ্ট। সোনা আপার তো কোন খবর নাই। রুপা আপা থাকতেও নাই। আমারে নিয়া অনেক চিন্তা করে আম্মা। রুপ থাকা হইল অভিশাপ রে কুসুম। ‘

‘কন কি আপা?আপনে মেলা সুন্দর। যার লগে আপনার বিয়া হইবে হেয় অনেক ভাগ্যবান। ‘

‘নারে কুসুম। রুপ আছিল বইলা সবাই সোনা আপার দিকে খারাপ নজরে তাকাইতো। রুপা আপারে তো,’

একটু থামল পরী। ধরা গলায় বলল,’আমার দিকে কেউ খারাপ নজর না দেয় তাই আম্মা কসম দিছে আমি যেন কাউরে মুখ না দেহাই। পুরুষ মাইনষের নজর খুব খারাপ। মন চায় চোখ দুইটা উঠাইয়া ফালাই।’
কুসুম চুপ করে রইল। রাগে শরীর কাপছে পরীর। কুসুমের মনে হলো পরী বোধহয় কারো লালসার শিকার হয়েছিল। কিন্ত জিজ্ঞেস করল না। পরীকেই বলতে দিলো।
‘আজকের পুরুষ মানুষ সুন্দর কিছু দেইখা মুগ্ধ হয় না। লালসার চোখে দেখে। সুন্দর ছুঁতে পাগল হয় তারা। হিংস্র থাবা দিয়ে সব সৌন্দর্য শ্যাষ কইরা দেয়।আমার কাছে ওই পুরুষগো বাঁচার দরকার নাই। জানস কুসুম আমি একটা মানুষ রে খুন করতে চাই।যে তিন তিনটা জীবন নষ্ট করতে চাইছিল।’

চমকালো কুসুম, পরীর দিকে তাকিয়ে ভাবল এত সুন্দর ফুলকে কে নষ্ট করতে চেয়েছিল?সে বলল, ‘কেডা আপা?’
মুহূর্তেই পরীর ভাব গতি বদলে গেল বলল,’তা দিয়া তুই কি করবি?আম্মা আইবো কহন?’
একটু ভয় পেল কুসুম। এতক্ষণ তো ভাল করে কথা বলছিল এখন আবার হলো কি?কুসুম বলল,’কবিরাজ দেহান হইলেই আইব।’
‘তুই যা এহন।’
কুসুম কোনোমতে ছুটে পালালো। পরী জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এই মুহূর্তে রুপালির কথা ভিশন মনে পড়ছে পরীর। অনেক দিন দেখে না রুপালিকে।প্রিয়জন দূরে থাকলে বুঝি এমন কষ্ট হয়। পানি এলো পরীর চোখে। বোনদের খুব মনে পড়ে ওর। যাদের সাথে শৈশব কেটেছে আজ তারাই নেই।

রাতে মালার অবস্থার অবনতি হলো। কবিরাজ দেখিয়ে কোন লাভ হলো না। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে মালার। জেসমিন মালার পাশে বসে চোখের পানি ফেলছে।পরীকে খবর দিতে না চাইলেও সে খবর পেয়ে যায়। জুম্মান গিয়ে পরীকে খবর দিতেই পরী ছুটলো মায়ের ঘরের দিকে। পথিমধ্যে কিছু একটা ভেবে থেমে গেল পরী তারপর আবারও ছুটল পালকদের ঘরে। পরীর কথা শুনে ওরা সবাই ছুটে গেল মালার ঘরে। মালা তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। সবাইকে একসাথে আসতে দেখে জেসমিন আতকে ওঠে। পালক এগিয়ে এসে বলল,’কি হয়েছে ওনার?আমাকে দেখতে দিন?’
জেসমিন বলে উঠল, ‘তোমরা সবাই চইলা যাও।আপা এমনেই ঠিক হইয়া যাইব।’
পরী ক্ষেপে গেল জেসমিন এর উপর বলল,’বাধা দেন ক্যান?আমার আম্মা ভাল হইলে তো আপনার ক্ষতি তাই না?আমার আম্মার যদি কিছু হয় তাইলে ভাল হইব না। সইরা যান কইতাছি।’
জেসমিন কাঁদতে কাঁদতে পরীর হাত ধরে বলল, ‘পরী তুমি চইলা যাও। আপার ভাল চাই দেইখা কইতাছি। ‘

গর্জে ওঠে পরী,’হাত ছাড়েন আমার। ওই বুড়ি আর আপনে আম্মারে খালি কবিরাজের কাছে নিয়া যান যাতে আম্মা ভাল না হয়। আমি এইবার সব বুঝছি। আপনেগো কারণে আমি আম্মার ঘরে আইতে পারি না। আম্মা আগে ভাল হোক তারপর ওই বুড়িরে আমি ওর স্বোয়ামির কাছে পাঠায় দিমু। ডাক্তার আপা আপনে আম্মারে দেখেন।’

মাথা নেড়ে পালক কাছে যেতে জেসমিন আবারও না করছে। উপস্থিত সবাই অবাক হচ্ছে। জেসমিন এরকম করছে কেন?পরী বারবার অপমান করছে তবুও জেসমিন মানছে না। শেষে পরী আর রুমি টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো জেসমিন কে। মিষ্টি ও চলে এসেছে।
ঘন্টা খানেক পালক ছিল মালার কাছে। মালাকে একটু সুস্থ করে পালক বাইরে আসতেই পরী বলল,’কি হইছে আম্মার?আম্মা ভাল হইব তো?’
পালক কিছু না বলে জেসমিন কে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেল বাকিদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলল।পরীর তর সইছে না। রুমি পরীকে শান্তনা দিলো কারণ মেয়েটা শব্দ করে না কাঁদলেও চোখ থেকে পানি ঝরছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর পালক এসে পরীকে বলল,’পরী তোমার মায়ের অবস্থা বেশি ভাল না। শহরে নিয়ে গেলে তোমার মা ভাল হয়ে যাবে। যা করার জলদি করতে হবে। কবিরাজ তোমার মা’কে ভাল করতে পারবে না।’
পরীর ভয় হলো মালাকে নিয়ে। মালার কিছু হলে পরী কাকে নিয়ে থাকবে?শরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠল। চেষ্টা করেও নিজেকে শক্ত রাখতে পারছে না পরী। মায়ের প্রতি সব মেয়েরাই দূর্বল হয়। সব কষ্ট তারা হাসিমুখে মেনে নিলেও মায়ের কষ্ট মানতে পারে না। নারীর মন কোমল পদ্মের ন্যায় পরিস্ফুটিত। মায়ের জন্য মন চোখ দুটোই কাঁদছে পরীর। নিজেকে আজ দূর্বল মনে হচ্ছে। পালক পরীর কাধে হাত রেখে বলল,’চিন্তার কোন কারণ নেই পরী। ভাল ডাক্তার দেখালে তোমার মা ভাল হয়ে যাবে।’
পরী কৃতজ্ঞতার সহিত পালকের দিকে তাকালো।পালক সৌজন্য মূলক হাসি দিল। ঘরে গিয়ে পালক কারো সাথে কোন কথা বলল না।

সকালে কারো চিল্লানোর আওয়াজে ঘুম ভাঙে পালকের। বাইরে এসে দেখে মালা পরীকে মারছে।চুলের মুঠি ধরে মেরেই যাচ্ছে। জেসমিন মালার হাত ধরে টানছে। ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্ত পারছে না। পালক নিজেও দৌড়ে গেল। পরীকে ছাড়িয়ে বলল,’কি করছেন?এভাবে কেউ মারে নাকি?’

‘ওরে মাইরা ফালামু আমি। শরীর ভাল আছিল না দেইখা কাইল কিছুই কইতে পারি নাই। বড় মাইনষের মুখে মুখে তর্ক করা শিখছে ও। এমন মাইয়া লাগব না আমার।’

পরী বলল,’সব সময় আমার লগে এমন করেন ক্যান আম্মা। আমি আপনের ভাল চাই দেইখা,,,’
মালা পরীকে থামিয়ে বলল,’তোরে আমার ভাল দেখতে হইব না। তোর মুখ বন্ধ রাখলেই আমার ভাল। আল্লাহ এই কেমন মাইয়া আমার পেটে দিলা?’

মালা বিলাপ করতে করতে চলে গেল। পরী রাগে ফুসতে ফুসতে নিজের ঘরে চলে গেল। জেসমিনের সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্য প্রায়ই পরী মার খেত আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। মায়ের এরকম আচরণ পরীর ভাল লাগে না।
আফতাব বিকেলে ফিরে এসেছে। কালকে আসার কথা ছিল কিন্ত আজকে হুট করেই চলে এসেছে। মালার অসুস্থতার খবর পালক নিজে আফতাবের কাছে বলল। এও বলল সে যেন মালাকে নিয়ে শহরে ভাল ডাক্তার দেখান। নিজের পরিচিত একজন ডাক্তারের ঠিকানা ও পালক দিয়ে দিলো আফতাব কে। আফতাব দেরি করল না। পরদিন সকালে চলে গেল মালাকে নিয়ে। পরীকেও জানানো হলো না।
#পরীজান
#পর্ব ১১
#Ishita_ahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

মালাকে শহরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সাথে আফতাব ও গিয়েছে একথা জানার পরেও পরী স্থির। অন্দরের উঠোনে মোড়া পেতে জুম্মানের সাথে বসে বসে পেয়ারা খাচ্ছে। ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছে পালক। পরীকে দেখে পালক একটা মোড়া টেনে বসে বলল,’তোমার মা’কে শহরে নিয়ে গেছে তোমার বাবা জানো?’

‘হুম,সকালে কুসুম কইলো।’

‘আচ্ছা পরী তোমার মা কবে থেকে এরকম অসুস্থ?’
পরীর খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বলে,’আম্মার অসুখ করলে কাউরে জানায় না। এমনকি আমারেও না।আম্মা কয় বড় বউগো নাকি এমনেই সব ত্যাগ করতে হয়।’
কথাটা বলতে গিয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসল পরী। পালক মুচকি হাসলো।
মেয়েরা যখন থেকে কোন বাড়ির বউ হয়ে পা রাখে তখন থেকেই সে বাড়ির সুখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর দুঃখ গুলো ঘরের ময়লার ন্যায় ঝাট দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। বাড়ির সকলের খেয়াল রেখে আর সময় থাকে না নিজের একটুখানি যত্ন নেওয়ার। হ্যা এটাই নারীর সংসার। নিজের গায়ে দাগ পড়লেও সংসারে এতটুকু দাগ লাগতে দেওয়া যাবে না।

মিষ্টি আর রুমি আসতেই পালক উঠে দাঁড়াল। পরীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,’ফিরে এসে তোমার সাথে অনেক গল্প করব পরী।’
জবাবে পরী মাথা দোলায় শুধু। ওরা চলে যেতেই জুম্মান হেসে বলে,’এই আপা অনেক ভালো তাই না আপা?’

জুম্মানের কথায় পরী ও সায় দিলো। তারপর নিজের কাজে মন দিলো।
পালকের মনটা ভাল নেই কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। বৈঠক ঘরের উঠোনে পা রাখতেই শায়েরের সাথে দেখা। কিছু বলতে চেয়েও বলল না পালক। পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে নৌকায় উঠে সে। আজকে সবাই এক নৌকাতে যাচ্ছে। সবাই চুপ করে আছে। শুধু পানিতে বৈঠা ফেলার আওয়াজ ভেসে আসছে। নিরবতা ভেঙে নাঈম বলে উঠল,’বুঝলেন শায়ের সাহেব,জমিদার বাড়িটা ভিশন অদ্ভুত। বিশাল বাড়িতে মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন থাকে। কেমন ভুতের বাড়ি মনে হয়।’
বাইরের দৃশ্য দেখছিল শায়ের। নাঈমের কথা শুনে মুচকি হাসল বলল,’এখন ভুতের বাড়ি মনে হলেও একসময় লোক লস্করে পূর্ন ছিল এই বাড়ি। মাঝখান থেকে বন্যাই সব গুলিয়ে দিলো।’

কথাটা বলে আবার বাইরের দিকে তাকায় শায়ের। নাঈম আর কিছু বলল না। ভাবল শায়েরের মন হয়তো ভালো নেই। পালক শায়ের কে দেখছে। শায়েরের গোমড়া মুখটা ওর ভাল লাগছে না। এমনিতেও খুব একটা হাসে না শায়ের। আজকে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। বাগান বাড়িতে পৌছে পালক গেল শায়েরের পিছু পিছু। পালক কে নিজের সাথে আসতে দেখে দাঁড়াল শায়ের। পিছন ফিরে বলল, ‘কিছু বলবেন?’
পালক সহজ স্বীকারোক্তি দিলো,’হ্যা।’ শায়ের সোজা হয়ে দাঁড়াল। পালক জিজ্ঞেস করে,’আপনার মন খারাপ? তখন থেকে দেখছি চুপচাপ।’

‘শুধু কি এটুকুই জানতে চান?’

শায়েরের প্রশ্নে অস্বস্তি বোধ করল পালক। কথা গুলিয়ে ফেলে সব। আমতা আমতা করতে লাগল সে। পালকের অবস্থা দেখে শায়ের বলল,’আমার চোখ দুটোকে সস্তা ভাববেন না মিস পালক সরকার। আমার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে সেটা আপনি জানেন না। সেটা হল আমার চোখের যার চোখ পড়ে তার মনের কথা আমার চোখ পড়ে নেয়।’
পালকের মনে ঝংঙ্কার তুলে চলে গেল শায়ের। থরথর করে কাপছে সে। ভাবছে তাহলে কি শায়ের ওর অনুভূতি গুলো বুঝতে পেরেছে!!নাহলে তো এভাবে বলতো না। ওষ্ঠকোণে হাসি ফুটল পালকের। হাতের এপ্রোন শক্ত করে ধরে নিজের চেয়ারে বসল। এখনও তো শায়ের কে কিছুই বলেনি তাতেই এতো খুশি পালক। তাহলে ভালোবাসি বললে কত খুশি হবে?
তারমানে ভালোবাসি কথাটা বলার মাঝে আনন্দ আছে?কতটা আনন্দ?ভাবতে ভাবতে মুচকি হাসল পালক। এটাও ভাবল যে আজকে সব বলবে শায়ের কে। যদিও শায়ের তাকে মানবে না। তবুও অপূর্ণতা নিয়ে সে যাবে না।

বন্যার পানি কমতে শুরু করে দিয়েছে। দিন দশেকের মধ্যে পদ্মা তার পানি ফিরিয়ে নিবে মনে হয়। এদিক দিয়ে পালক দের তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে। গ্রামের সবাই কে ওরা মোটামুটি সচেতন করে ফেলেছে। তাই ওরা গ্রামের মানুষদের সাথে একটু বেশি সময় কাটাচ্ছে। সবাই কে ওরা এই ক’দিনে আপন করে নিয়েছে। সাধারণত গ্রামের মানুষগুলো একটু নোংরা হয়ে থাকে। বন্যায় দিক দিশা হারিয়ে সবাই আরো নোংরা হয়ে গেছে। কোন কিছুর ই তাদের ঠিক নেই। তবুও নাঈমরা নিজ হাতে সবাইকে সেবা দিয়েছে। যে মিষ্টি প্রথমে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সেই মিষ্টিও সবাইকে আপন করে নিয়েছে। গ্রামের সবার দোয়া এখন ওদের মাথায়। কত বৃদ্ধা যে নাঈমের মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছে তার হিসেব নেই।
অনেক দিন পর সম্পানকে দেখল নাঈম। সাথে বিন্দু ও রয়েছে। হাতে থাকা ব্যাগটা থেকে লাল রঙের দুমুঠো কাচের চুড়ি বের করে বিন্দুর হাতে দিয়ে শুধালো,’লাল শাড়ি পইরা,হাতে এই লাল চুড়ি আর সিথিতে লাল সিন্দুর পইরা যহন আমার বউ হইয়া আমার ঘরে আইবি তহন চোখ ভইরা তোরে দেখমু বিন্দু।’
লজ্জায় মাথা নত করে বিন্দু। সামনে থাকা পুরুষটিকে নিয়েই তার যত কল্পনা জল্পনা। তার ঘরের ঘরোনি হবে। শাখা সিদূর পরে সেজেগুজে ঘুরে বেড়াবে আর সম্পান সুমধুর কথা বলে লজ্জা দেবে বিন্দুকে। কিন্ত সম্পান তাকে এখনই লজ্জায় আড়ষ্ঠ করে ফেলছে। সম্পান বুঝতে পারল বিন্দু লজ্জা পাচ্ছে তাই সে কথা ঘুরিয়ে বলল,’কাইল ভোরে শহরে যামু তোর লাইগা লাল শাড়ি আনমুনে। পারলে ভোরে দেহা করিস।’
-‘কিন্ত আমি তো ভোরে উঠতে পারি না।’

-‘তুই তো আবার ঘুম পাগল। এত ঘুম পাগল হইলে সংসার করা মুশকিল হবে তাই ঘুম কমা বিন্দু। পরাণে এতো ঘুম রাখিস না।’
-‘পরাণে তো তুমিও আছো। তোমারে নিয়া ঘুমাই।’
দুষ্ট হাসলো বিন্দু সাথে সম্পান ও হাসলো। কিন্ত বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। নাঈম কে দেখে মিলিয়ে গেল বিন্দুর হাসি। তড়িৎ গতিতে ‘যাই’ বলে চলে গেল। কিন্ত সম্পান ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নাঈম কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়াল। মৃদু হেসে বলল,’নিজের ভালোবাসা তো ঠিকই পেয়ে গেছো অথচ আমার বেলায় অন্যায় কেনো সম্পান?তাহলে কি আমি ধরে নেব যার যার ভালোবাসা তার কাছে মূল্যবান বাকি সবই ঠুনকো?’
ঈষৎ চমকালো সম্পান। এই নাঈম কয়েকদিন আগে তার কাছে নিজের মনোভাব পোষণ করেছিল। বলেছিল সে পরীকে দেখতে চায় এবং খুব করে ভালোবাসতে চায়। সম্পানের কাছে আকুতি করে সাহায্য চেয়েছিল। কিন্ত ভিতু সম্পান তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল সে কোন সাহায্য করতে পারবে না। নাঈমের চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন মায়া হয়েছিল সম্পানের কিন্ত তার কিছুই করার নেই। এই সুদর্শন পুরুষটিকে ফেরাতে মন চাইছিল না। এছাড়া যে কোন উপায় নেই সম্পান মাঝির কাছে। সে আস্তে করে বলল,’আমি কিছুই করতে পারমু না ডাক্তারবাবু। পরীর লগে কথা তো দূরের কথা জমিদার বাড়ির ধারে কাছে যাওয়ার সাহস নাই আমার। ‘

-‘এতো ভয়ের কারণ কি সম্পান?’
-‘কারণ আইজ থাইকা আট বছর আগে রাখাল দাদার যে অবস্থা হইছিল তা দেইখা ভয়ে কাপছিল পুরা গেরাম। তার পর থাইকা জমিদার বাড়ির কোন মাইয়ার দিকে তাকানোর সাহস কারো হয় নাই। বিন্দু ও পারব না। আমি চাই না বিন্দুর কোন ক্ষতি হোক।’

কপালে দৃঢ় ভাজ পড়লো নাঈমের। রাখাল সম্পর্কে সে অবগত। সোনালী তার হাত ধরে পালিয়েছে। নাঈম আবার জিজ্ঞেস করে,’তুমি দেখেছিলে রাখাল কে? এখন ওরা কোথায় আছে?’
-‘জানি না। আমি তহন ছোড আছিলাম তাও আমার মনে আছে সব। আপনে যদি দেখতেন তাইলে আপনে ও পরীর আশেপাশে যাইতে চাইতেন না।আমি অখন যাই বাবু। একখান কথা কই, জমিদাররে যত ভাল দেখেন তত ভাল না। যেদিন রাখালরে মারছিল সবাই সেদিন বুঝছি আমি।’
সম্পান চলে গেল। নাঈম বুঝল রাখালের মারাকে কেন্দ্র করে গ্রামের সবাই এখনও জমিদারের ভয়ে তটস্থ। এজন্য কোন পুরুষ জমিদার বাড়িতে যায় না।তবে কি রাখালের সাথে ভয়ংকর কিছু হয়েছিল?তাই হবে?নাহলে সম্পান এতো ভয় পেতো না। তবে ওরা দুজন এতো কিছুর পরেও একসাথে আছে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।

সম্পানের কথাগুলো যেন নাঈমের ইচ্ছা আরো বাড়িয়ে দিলো। পরীর কথা সে কিছুতেই মাথা থেকে বের করতে পারছে না। প্রতিটি মুহূর্ত তার পরীকে ভেবেই কাটে। এরই মধ্যে সন্ধ্যা হতে চলল। সঙ্গে ঝড়ের পূর্বাভাস। মৃদু বাতাসে ছেয়ে গেল চারিদিক। মিষ্টি,রুমি আর আসিফ এসে নৌকায় চড়ে বসে। বড় নৌকা আজ নেই। তাই দুটো ছোট নৌকা ঘাটে বাধা। রুমিদের নৌকা ছেড়ে দিয়েছে। তখনই মিষ্টি বলে উঠল,’এই যা,পালককে ফেলে চলে এলাম।’

-‘পালক পরের নৌকায় আসবে চিন্তা করিস না।’

আসিফের কথায় শান্ত হলো মিষ্টি। নৌকা জমিদার বাড়ির সামনে থামতেই ওরা নেমে ভেতরে গেল। অন্দরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় আসতেই ওরা দেখতে পেল হারিকেন হাতে পরী এদিকে আসছে। পরীর একহাতে হারিকেন আরেক হাত দিয়ে পরনের ঘাগড়া সামান্য উঁচু করে ধরেছে। লাল আলোতে শোভা পাচ্ছে পরীর সৌন্দর্য যা দেখে ঈর্ষান্বিত হলো মিষ্টি। কিন্ত সে চুপ রইল। পরী কাছে এসে জানতে চাইল পালক কোথায়?রুমি জবাব দিলো সে পরের নৌকাতে আসছে। পরী একথা শুনে কুসুম কে ডাকতে ডাকতে নিচে চলে গেল।
নিজেদের কক্ষে গিয়ে মিষ্টি ক্ষোভ প্রকাশ করল। তেজি গলায় বলল, ‘এই মেয়েকে দেখলে আমার গা জ্বলে যায়।’
-‘ওর মতো সুন্দর না তুই এর জন্য?’
-‘নাহ ওর মতো সুন্দর হতেও চাই না। কিন্ত ওর জেদ দেখলে আমার বিরক্ত লাগে।’
-‘এতটুকু বয়সে এতো সাহস সঞ্চয় করতে সবাই পারে না। কিন্ত পরীর মধ্যে সে সাহস আছে। আছে যথেষ্ট বুদ্ধি। শক্তি দিয়ে না হলেও বুদ্ধি দিয়ে ও একশ জনের সাথে লড়তে পারবে।’
বিপরীতে জবাব দিল না মিষ্টি। চুপচাপ পোশাক বদলে পালঙ্কে সটান হয়ে শুয়ে রইল।
প্রহর বাড়তেই রুমির চিন্তা হলো। পালক তো এখনও এলো না। চারিদিকে প্রবল বেগে বাতাস বইছে। তাহলে কি ওরা আসতে পারেনি?মিষ্টি ঘুমাচ্ছে তাই রুমি গেল বৈঠক ঘরে। নাঈমদের কক্ষের দরজায় পরপর কয়েকবার টোকা দিতেই শেখর এসে দরজা খুলল। রুমি অবাক হয়ে ভেতরে ঢুকে বলল,’তোরা চলে এসেছিস তাহলে পালক কোথায়?’
বিষ্মিত কন্ঠস্বরে শেখর বলে,’তোদের সাথে আসেনি?আমরা তো ভাবলাম তোরা একসাথে এসেছিস।’
নাঈম শুয়ে ছিল। সে উঠে এসে বলল,’তাহলে পালক কোথায়?বাগান বাড়িতে আটকা পড়ল নাকি?’
-‘তাই হবে,তোরা পালককে আনার ব্যবস্থা কর তাড়াতাড়ি।’
রুমিকে আশ্বাস দিয়ে নাঈম ছুটে গেল শায়েরের ঘরে। শায়ের ওদের সাথেই ফিরেছে। নাঈমের মুখে পালকের কথা শুনে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাগান বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো সে। প্রবল বাতাসের মধ্যেই নাঈম,শেখর,আসিফ আর শায়ের বেরিয়ে পড়লো।

মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে পরীর। কেন যেন অস্থির অস্থির লাগছে ওর। এই ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যেও ঘামতে লাগল পরী। একটা স্বপ্ন দেখেছে সে কিন্ত কি দেখেছে তা মনে করতে পারছে না। এমনটা মাঝে মাঝেই হয় পরীর সাথে। স্বপ্নে কি দেখে তা কিছুতেই মনে করতে পারে না। সে কি সুস্বপ্ন দেখেছে নাকি দুঃস্বপ্ন?ভাবতে ভাবতে পরী হাটু জড়ো করে অন্ধকার কক্ষে বসে রইল। এভাবেই অনেকক্ষণ কেটে গেল। আর ঘুমাতে পারল না পরী। তবে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লো।
মোরগ ডাকার সাথে সাথেই কুসুম আর জুম্মান ছুটে এলো পরীর ঘরে। কুসুমের ডাকে ধড়ফড়িয়ে ওঠে পরী। কিন্ত কুসুম কথা বলতে পারছে না শুধু হাপাচ্ছে। পরী তাকিয়েই রইল। কুসুম নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,’পরী আপা সর্বনাশ হইয়া গেছে। কাইল রাইতে ডাক্তার আপা বন্যার পানিতে ডুইবা মইরা গেছে।’
কুসুমের কথাটা শুনে পরীর শরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠল। কাপতে লাগল সর্বাঙ্গ। কুসুম ডাক্তার আপা বলতে কাকে বোঝালো?প্রশ্ন টা করতে পারে না পরী। ঠোঁট দুটো তার অসম্ভব ভাবে কাপছে। পরীর চাহনি দেখে জুম্মান বলল,’ওই ভাল ডাক্তার আপা। আপা বাইরে লাশ আনছে।’

পরীর কানে একটা কথা বাজতে লাগল,’ফিরে এসে তোমার সাথে অনেক গল্প করব পরী।’
আর বসে থাকতে পারল না পরী। ছুট লাগালো সে। সিড়ি ভেঙে নিচে এসে যেই না বৈঠক ঘরের দিকে যাবে তখনই মালা চেপে ধরে পরীর হাত। একটানে পরীকে এনে বুকে চেপে ধরে মালা। মালাকে দেখে পরী অবাক হয় না বরং শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মালাকে। পরীর মুখ থেকে বার বার আম্মা শব্দটি বের হয়।

#চলবে,,,,,

আমার ভাগ্যই খারাপ । নাহলে গল্প দিতে না দিতেই ঝামেলা হতো না। জ্বরের কারণে সাত দিনে সকাল বিকাল করে ১৪ টা ইঞ্জেকশন নিয়ে সুস্থ হয়েছি। ১৪ টা ইঞ্জেকশন দিতে হাতে ৬৪ টা ফুটো করছে। অসহ্য ডাক্তার। আমার চোখের পানিতেও তার মন গলেনি।আবারও লেখা শুরু করলাম। আর কতো বাধা পেরোতে হবে জানি না। একজন লেখিকা নিশ্চয়ই চাইবে না যে তার বদনাম হোক বা কেউ তাকে কটু কথা বলুক। আমিও চাই না। তাই সবাই দয়া করে আমার সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করবেন।
আল্লাহ চাইলে এখন থেকে নিয়মিত গল্প দিব ইনশাআল্লাহ।
#চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here