পুরোনো ডাকবাক্স পর্ব -০২

#পুরোনো_ডাকবাক্স
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০২

“ওখানে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? এসো এখানে এসে বসো।”

মিসেস মোহনার কথা শুনে পাশে গিয়ে বসলো আলিজা। মিসেস মোহনা, নওরীনকে নাস্তা নিয়ে আসতে বলল আলিজার জন্য। নওরীন টানা পায়ে চলে গেল। আলিজার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করল,
” রাতে তো কিছু খাও নি, ঘুম কি হয়েছিল?

” জি উনি খাবার গরম করে দিয়েছিলেন আমি খেয়েছিলাম।

” কে, আরসাল?(উচ্চারণ আরছাল)

” জি।

” বাহ, কাজের কাজ করেছে দেখছি আমার ছেলেটা।

এর মাঝে নওরীন নাস্তা এনে দিলে মিসেস মোহনা নিজে হাতে আলিজাকে খাইয়ে দেয়। আলিজা ছলছল চোখে মিসেস মোহনার দিকে তাকাতেই তিনি আলিজার চোখের পানি মুছে দিয়ে কান্না করতে নিষেধ করেন।
“ছোটবেলা থেকে মায়ের আদর পাই নি, বাবা মাঝে মাঝে তুলে খাওয়াতো। আর আমি আমার সেই বাবাকেও হারিয়ে ফেললাম। আমি তো একা, চির একা আমাকে নিঃস্ব করে দেওয়ায় কার কি লাভ হতে পারে!

” খাওয়ার সময় কান্না করতে নেই মা, চুপচাপ খেয়ে নাও তারপর কথা বলব। উহু কোন কান্নাকাটি চলবে না।

খাওয়া শেষ করে তিনজন বসে আছে। এমন সময় নেওয়াজ আঙ্কেলের কথা মনে হলে তিনি কোথায় তা জানতে চায় আলিজা।

” তোমার আঙ্কেল একটু কাজে গিয়েছে, হয়তো তদন্তের জন্য সাহায্য চেয়ে পুলিশ ডেকে পাঠিয়েছে।

” ওহ আচ্ছা।

” তোমার বাবা তার শেষ সময়ে তোমাকে তোমার আঙ্কেলের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছে। তোমার আঙ্কেল ও কঠোরভাবে তোমাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জানি না তোমরা নিজেদের কতটা গুছিয়ে নিতে পারবে। তবে আমার ছেলে খুব ভালো একটা ছেলে। তোমাদের মতামত না নিয়ে বিয়ে দিয়েছে তোমার আঙ্কেল তাই সে রেগে আছে। তুমি তাকে সময় দাও, তার কথা শুনে চলো একটু তাহলে দেখবে সে কতটা ভালো। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা তৈরি হতে বেশি সময় লাগে না।

“জি আন্টি।

“সব সময় মন খারাপ করে থাকবে না, আরসালের সাথে সময় কাটাবে তাহলে দেখবে ভালো লাগবে।

” জি চেষ্টা করব আন্টি। আর উনি খুব ভালো মানুষ আমি গতরাতে যতটুকু বুঝেছি।

আলিজা ভাবছে গতরাতে উনার ব্যাগ গুছানোর কথা জানাবে কি না, এমন সময় বাহিরে থেকে মিঃ নেওয়াজের গলা ভেসে আসে। নওরীন দৌঁড়ে বাহিরে যায়। কিছুক্ষণ পর ভেতরে এসে আলিজাকে বাহিরে যেতে বলে তাকে যেতে বলেছে। মিসেস মোহনাও ইশারা করে বাহিরে গিয়ে দেখতে বলে।

আলিজা ওরনা দিয়ে মাথাসহ সমস্ত শরীর ঢেকে ধীরপায়ে বাহিরের রুমে যায়। বাইরের রুমে গিয়ে দেখে নেওয়াজ আঙ্কেলসহ কয়েকজন পুলিশ সোফায় বসে আছে। আলিজাকে দেখেই তারা দাঁড়িয়ে যায়। আলিজা এগিয়ে আসে, সবাইকে বসতে বলে। মিঃ নেওয়াজ তাকেও বসতে বলে।

” আমার বাবার খু°’নের তদন্তের কি খবর অফিসার? কিছু জানা গিয়েছে কি? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খু*’নীকে খুঁজে বের করুন। কেন আমাকে এত একা করে দিলো? কি ক্ষতি করেছিল আমার বাবা!

” আমাদের তদন্ত চলছে ম্যাম। আসলে আমরাসহ কেউ আপনার বিষয়ে জানতাম না এখনও কেউ বুঝেই উঠতে পারছে না যে আপনি আমজাদ শেখ এর মেয়ে। আমরা চাচ্ছি এখন কেউ না জানুক, কারণ নেওয়াজ স্যার যতটুকু বললেন আপনাকে সেফ রাখতেই আপনাকে ছোটবেলা থেকে আড়ালে রাখা হয়েছিল। মাত্র এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে এখন যদি শ*’ত্রু আপনার ব্যাপারে জেনে যায় তাহলে আপনার ওপর ও আক্র*”মণ করবে।

“আমার ব্যাপারটা ভাবতে হবে না, প্লিজ আপনারা আমার বাবার খু*’নীকে ধরুন।

” ম্যাম আপনি গতকালের ঘটে যাওয়া ঘটনা একটু বলুন প্লিজ, গতকাল তো কথাই বলতে পারি নি।

” অবশ্যই বলব, আমি আমার বাবার খু’*নের বিচার চাই। আমার বাবাকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি, প্রতিটা মেয়ে জানে বাবা আসলে কি হয়!

আলিজা গতকাল ভোরবেলা বের হওয়ার ঘটনা পরিপূর্ণভাবে খুটিনাটি সব বলে দেয় যেন এতে কোনরকম ক্লু পেলেও কাজে লাগাতে পারে পুলিশ।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করে পুলিশ বিদায় নিয়ে চলে যায়।
আলিজা আর নেওয়াজ বসেছিলেন, দুজন বসে কথা বলছিল এমন সময় বাবার বাসায় যাওয়ার কথা জানালে আরসালের বাবা আর “না’ জানায় না। কারণ মেয়েটা বাবার জন্য সবসময় কান্না করেই চলেছে ওখানে গিয়ে যদি একটু ভালো লাগে তাই আরসালকে সাথে নিয়ে যেতে বলে। আলিজাও রাজি হয়ে যায়।

**
রাস্তার পাশে বসে বসে প্রিয় মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে তিথি। সপ্তাহখানেক দেখা হয় না তাদের, গতকাল রাত থেকে কথাও হয়নি। সকালে গম্ভীর গলায় প্রিয় মানুষটি তাকে দেখা করতে বলল। সে বুঝতে পারছে না আরসাল সকালে গম্ভীরভাবে কেন কথা বলল! সে তো এরকম করে না, কি হলো তার!

প্রায় আধাঘন্টা অপেক্ষা করার পর আরসালকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে যায় তিথি। আরসাল এগিয়ে এসে তিথির সামনে দাঁড়ায় কিন্তু অপরাধবোধ কাজ করছে, তিথির দিকে তাকাতেই পারছে না সে। কিভাবেই বা তাকাবে সে অনেক বড় অ°’ন্যায় করে ফেলেছে সে। সবটা জানার পর তিথি কিভাবে রিয়েক্ট করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না আরসাল। তিথি নীরবতা ভেঙে আরসালের দিকে এগিয়ে আসে। সোজা জড়িয়ে ধরে তাকে, যেন কতদিন পর সামনে পেল তাকে।

” একেই তো সাতদিন পর দেখা করলে আবার এতক্ষণ অপেক্ষাও করালে!(বুকে মাথা রেখে)

” সোজা হয়ে দাঁড়াও একটা কথা আছে তোমাকে বলার।( দুই হাত দিয়ে তিথি নিজের থেকে আলাদা করে, সরিয়ে দেয়।)

” কি এমন কথা যার জন্য তোমার বুক থেকে আমাকে সরাতে হলো? তুমি তো জানো ওটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত জায়গা যেখানে আমার একটু শান্তি আর স্বস্তি মিলে।

” আমার কথাটা শোনো তিথি।

” জি বলুন।(দুইহাত বুকে গুজে)

” তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?

” আপনি কথা বলতে এসেছেন বলুন আমি শুনছি।

” তুমি এখনই রাগ করলে আমি তোমার সাথে করা অন্যা*’য়ের কথা কিভাবে বলব তিথি!

” মানে? বুঝলাম না, কিছু হয়েছে তোমার?

” অনেককিছু ঘটে গিয়েছে আমাদের জীবনে তিথি।

” কি ঘটলো শুনি? আর তুমি মুখ বাংলা পাঁচের মত করে আছো কেন?

” বিয়ে….

” কার বিয়ে?

” আমার বিয়ে…

” তোমার বিয়ে কি?

” গতরাতে বাবা একটা মেয়েকে বাসায় আনে, তারপর জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়।

” মজা করছো আমার সাথে, প্র‍্যাংক হচ্ছে আমার সাথে?

” তিথি আমি কলেজের টিচার, আমি কেন তোমার সাথে এসব করব? সকাল সকাল তোমাকে ডেকে এরকম মজা করার কোন ইচ্ছে আমার নেই।

” তাহলে তুমি যা বলছো, সেগুলো কি আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?

” হ্যাঁ, সত্যি বলছি। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্সের ব্যবস্থা করব।

” মানে সত্যি বলছো তুমি?

” হ্যাঁ তিথি আমি সত্যি বলছি। বিশ্বাস করো, এই আমাকে দেখে বুঝতে পারছো না? আমি চিন্তায় সারারাত ঘুমোতে পারি নি।

তিথির মুখে আর কোন কথা নেই। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে আরসাল তো এরকম মজা করে না তার সাথে তবে এখন সে যেটা বলছে সেটা কি সত্য? তার কি আরসালের কথা বিশ্বাস করা উচিৎ? যদি সে সত্যিই বলে থাকে তবে এটা কেন করল তার সাথে!

” বিশ্বাস করতে বলছো?

” হ্যাঁ

” দাঁড়াও এক মিনিট…

তিথি আরসালের বোনকে কল দেয় তখনই। তিথি ভাবে আরসাল হয়তো তার সাথে মজা করছে তার বোন এখনই বলবে এসব কিছুই হয় নি আর আরসাল ধরা পড়ে যাবে। তিথি ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলে ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর “হ্যাঁ ” আসতেই তিথি কল কেটে দেয়। মনে হচ্ছে পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গিয়েছে তার।

” তোমার বাসার সবাই তো জানতো আমাদের ব্যাপারে তাই না? তাহলে তোমরা সবাই মিলে আমার ভালো থাকা কেড়ে নিলে কেন আরসাল? আঙ্কেল ও তো আমাকে খুব পছন্দ করতেন তাহলে এরকম কেন করলে তোমরা আমার সাথে? কম বিয়ে তো ভাঙিনি আমি তোমার জন্য। আমার সব শেষ করে দিয়ে এখন এসে বলছো তোমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে বাহ!

কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে তিথি। একদম দিশেহারা লাগছে দেখতে, বারবার নাক টানছে আর চোখ মুছে যাচ্ছে। প্রিয় মানুষ হারিয়ে গেলে বুঝি সব থমকে যায়!

” তিথি প্লিজ, আমি ভেবেছিলাম তুমি অন্তত আমাকে বুঝবে।

” তোমাকে বিয়ে করতে বলল আর তুমি বিয়ে করে নিলে? এতদিন দেখেছি মেয়েদের তার বাসা থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় এখন তুমি প্রমাণ করে দিলে ছেলেদেরও…..

” তোমার বাবা যদি নিজের মাথায় রিভাল*’বার ঠেকিয়ে প্রেসার দেয় তাহলে তুমি কি করতে বলো তো? যা হয়েছে তা যে একেবারেই সমাধানযোগ্য নয় সেটা তো না তাই না? আসলে কি বল তো পুরুষ কষ্ট প্রকাশ করে না বলে তোমরা ভাবো আমাদের কোন কষ্টই নেই৷ আর তাছাড়া আমি রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে আসব বলে ভেবেছিলাম। বের হয়ে কোথায় যেতাম আর মেয়েটার সাথে খারাপ আচরণ ও করে ফেলেছিলাম পরে জানলাম তার বাবাকে খু*’ন করা হয়েছে তার দায়িত্ব আমার বাবাকে দেওয়া হয়েছে জন্য বাবা অন্য কোন পথ না দেখে এটা করেছে।
তোমার ওপর আমার ভরসা ছিল, ভালোবাসলে বিশ্বাস রাখতে হয়। তুমি তো…..

” আমি যদি বিয়ে করে এসে তোমাকে এভাবে জানাতাম তাহলে কি করতে বল? আমার এরকম আচরণ করা কি স্বাভাবিক না আরসাল?

” প্লিজ তিথি তুমি অন্তত আমার থেকে দূরে যেও না, তুমি তো জানো আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি খুব তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে ডিভোর্সের কথা জানাবো।

” তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে আরসাল, এখন আর আমার কথা মাথায় এনো না তুমি। আমি মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সংসার কিভাবে ভাঙবো বল? আর যেখানে মেয়েটার কেউ নেই, সে এখন তোমার দায়িত্ব। তার খেয়াল রেখো, অযত্ন করো না প্লিজ। তাকে সময় দিও, আমাকে ভুলে যেতে খুব একটা সময় লাগবে না তোমার। আসছি আরসাল, ভালো থেকো।

” আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে ভালো থাকবো?

কথার কোন উত্তর না দিয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়ায় তিথি। চোখে যেন সে ঝাঁপসা দেখছে, বুক ফেটে কান্না আসছে। এতটা একা তার কখনও লাগে নি। খুব পছন্দের, ভালোবাসার জিনিস, মানুষগুলোই কেন অন্য কারও হয়ে যায়!

পিছন থেকে আরসাল বারবার ডাকতে থাকলেও পিছন ফিরে তাকায় না তিথি। সে এসে বলেও না, “আরসাল যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে তুমি আমার হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো, আমি খুব স্বার্থপর, আমি তোমার সাথে কাউকে দেখতে পারব না।”
আরসালেরও যেন চোখ থেকে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে তিথি, আর ভেতর থেকে একা হয়ে যায় আরসাল। ভালোবাসার পরিণতি এমন না হলেও তো পারতো।

চলবে…….

যারা যারা পড়ছেন, প্লিজ রেস্পন্স করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here