পুরোনো ডাকবাক্স পর্ব -০১

বাসরঘরে বিছানায় বসে বাবার মৃত্যুতে কান্না করছে আলিজা। একদিনেই বাবার মৃত্যু আর মেয়ের বিয়ে এরকম ঘটনা হয়তো এই পৃথিবীতে খুব অল্পই ঘটেছে।
অন্যদিকে, বাসা থেকে জোর করে বিয়ে দেওয়ায় আলমারি থেকে নিজের পোশাক ব্যাগে তুলছে নতুন বর আরসাল। যে বাড়িতে তার এবং তার পছন্দের কোন মূল্য নেই সে বাড়িতে কোনভাবেই আর একটা রাত ও কাটাতে পারবে না সে। আর সেখানে বাসর রাত তো বিলাসিতা। আরসালের আর তিথির দুই বছরের ভালোবাসার কোন মূল্যই দিল না তার পরিবার। যদিও ভালোবাসার সময় কম তবুও সে তিথিকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তিথির কথা ভেবে বুক ভারি হয়ে আসছে আরসালের। হুটহাট করে কোথায় থেকে কোন মেয়েকে সাথে এনে ফাঁদে ফেলে সোজা বিয়ে দিয়ে দিল তার বাবা!

রাতের অন্ধকার দূর হতে না হতেই বাবাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে আলিজা। একজন বাবা যে একটা মেয়ের কাছে ঠিক কতটা মূল্যবান সেটা হয়তো সেই বাবার মেয়ে ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না।

ব্যাগে নিজের পোশাক তুলছে আর রাগে ফুসছে আরসাল। এমনিতেই বাবাকে হারানোর শোক আবার অন্যদিকে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে যাকে বিয়ে করতে হলো এইরকম এক পরিস্থিতিতে তার এরকম ব্যবহার দেখে শব্দ করে কেঁদে ফেলে আলিজা। আলিজা শব্দ করে কেঁদে ফেলায় আরসালের কপালে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট দেখা দিল।

আরসাল আলমারি থেকে শার্ট বের করে ঢিল মে°’রে নিচে ব্যাগে রেখে আলিজার দিকে তেড়ে যায় সে।

“উফফ থামবেন আপনি! আমার জীবনটা তো শেষ করেই দিয়েছেন, এখন আবার এখানে বসে বসে কি নাটক শুরু করলেন!

আলিজা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে আরসালের দিকে। মাথায় কাপড় দেওয়া ঠিকই তবে মুখ ঢাকা ঘোমটা না তাই সহজেই আরসাল দেখে বুঝতে পারলো মেয়েটা কান্না করতে করতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। এক পলক তাকিয়েই বুঝলো মেয়েটা অতি মাত্রায় সুন্দরী, কান্নার দরুণ চোখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। একে তো জোর করে বিয়ে তার ওপর মেয়ের এরকম কান্না করতে করতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলা দেখে রাগ যেন অতিমাত্রায় বেড়ে গিয়েছে আরসালের। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে আলিজার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,

” এরকম ম°’রা কান্না কেন করছেন আপনি?

আলিজা আরেকদফায় অবাক হলো তার মানে উনি জানেন না যে তার বাবা মা°রা গিয়েছে নাকি জেনেও এমন ব্যবহার করছে তার সাথে!

” আপনি কিছুই জানেন না?

আরসাল এবার ভ্রু কুচকে উল্টো প্রশ্ন করে আপনি তো দেখলেনই কিভাবে বিয়ে হলো আমি কিভাবে জানবো আপনার ব্যাপারে? আমি তো নিজেই নিজের সমস্যা সমাধান করব কিভাবে বুঝতে পারছিলাম না তার ওপর আজকের এই অঘটন।

” আমার বাবাকে খু°’ন করা হয়েছে।

কথাটি শুনে চমকে ওঠে আরসাল। আমতা আমতা করে আবার জিজ্ঞেস করে, “খু°’ন! কিন্তু কেন? আর আপনিই বা কিভাবে বুঝলেন? ”

“আমি আমার বাবাকে খুব ভালোবাসি, তিনি ছাড়া আমার কেউ ছিল না, এখন তো সেই বাবাও আমার সাথে রইলো না।

আরসাল নিজের মাথা ঠান্ডা করে আলিজার পাশে গিয়ে বসে। ভালো না হয় তিথিকে বাসে কিন্তু তারপর ও তো এখানে এই মেয়েটার কোন দোষ নেই, তার নিজের বাবা জোর করে তাদের এই বিয়েটা দিয়েছে। মেয়েটা আজকেই তার বাবাকে হারিয়েছে, অন্তত এটা জানার পর তার সাথে খারাপ আচরণ করা যায় না, এতটা অমানবিক আরসাল নয়। সে আরেকদিক ভেবে নেয়, মেয়েটার সাথে ভালো ব্যবহার করলে হয়তো মিউচুয়ালি ডিভোর্স করা যাবে আর তারপর তিথিকে সে বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু এই কাজটা এই মেয়েকে দিয়েই করাতে হবে, কারণ আরসাল চাইলে, পরিবারকে জানালে তার বাবা এটা কোনদিন হতে দিবেন না। কিন্তু এখন এসব নিয়ে ভাবা যাবে না বুদ্ধি যেহেতু মাথায় চলে এসেছে তাহলে বাড়াবাড়ি না করাই ভালো, হঠকারিতায় কিছুই হয় না। রাগের কারণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু কোথায় যেত, কি করতো, কিছুই তো সে জানে না। সবচেয়ে ভালো হবে এই রাতটা চিন্তা করে কোন পদক্ষেপ নিলে। যত যাই হয়ে যাক কালকে তিথির সাথে দেখা করতেই হবে। তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে হবে তিথি বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে নিশ্চয়ই সব বুঝবে। ভাবনার ইতি টেনে সে আলিজার দিকে তাকায় মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে।

” বললেন না তো?

” একগ্লাস পানি খাওয়াবেন? গতকাল রাতের পর থেকে আর কিছু খাওয়া হয় নি খুব পিপাসা পেয়েছে।

” আচ্ছা আপনি কান্না বন্ধ করুন, আমি এনে দিচ্ছি।

আরসাল পাশের টেবিল থেকে গ্লাসে পানি নিয়ে ভাবছে আজকে আপনার বাবা না মা°রা গেলে অন্যকিছু না ভেবে এখানে নিশ্চিত অতিরিক্ত স্লিপিং পিল মিশিয়ে খাইয়ে দিতাম। রাতের মধ্যে গু°’ম করে দিতাম সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে। কিন্তু আমি এতটা নির্মম নই তাই আজকে বেঁচে গেলেন।

” এই নিন পানি, খেয়ে নিন।

আলিজা আরসালের হাত থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। পানি শেষ করে আরসালের দিকে আবার গ্লাসটি এগিয়ে দেয়। আরসাল আলিজার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে টেবিলে রেখে দেয়।

“কিছু খাবেন?

” না আমার ক্ষুধা নেই।

“আপনার নাম হয়তো আলিজা? বাবা ডেকেছিল একবার।

” হুম।

” আপনি বলছিলেন আপনার বাবাকে খু°’ন করা হয়েছে। কি কারণে খু°’ন করা হলো তাকে? কে ই বা খু*’ন করল?

” আমার বাবা আমজাদ শেখ।

” আমজাদ শেখ! কি বলছেন আপনি? উনার তো কোন মেয়ে ছিল না, ইভেন উনার তো একটা ছেলে শুধু শুনেছি বাবার কাছে।

” আমি বাবার আগের পক্ষের মেয়ে।

” মানে উনি দুইবার বিয়ে করেছিলেন?

” হ্যাঁ

বিষয়টা একটু অবাক করে আরসালকে কারণ এ বিষয়টা সবার কাছে অজানা। তার বাবা নিজে আমজাদ শেখ এর এত কাছের মানুষ তার ছেলে হয়ে এই বিষয়ে সে অবগত নয়!

” এরকম ঘটলো কিভাবে?

আলিজা কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয়, আমি তুরস্কে থাকতাম, বাবা আমাকে ওখানে রেখে দিয়েছিলেন। কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছিলো আমাকে কেউ অনুসরণ করছে সেটা বাবাকে জানালে এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি এখানে নিয়ে আসেন। তার পরিবারের সাথেই ছিলাম এই কয়েকদিন। গতরাতে বাবাকে বলি ভোরবেলা দুজন হাটতে বের হব, বাবা ও রাজি হয়ে যায়। ভোরবেলা বাবা ডাকলে দুজন বেরিয়ে পড়ি।
বাবার সাথে যারা থাকে তারা আমাদের থেকে অনেকটা পিছেই ছিল। দুজন হাটছিলাম আর গল্প করছিলাম হঠাৎ কোত্থেকে একটা গু°’লি এসে সরাসরি বাবার বুকে বিধে যায়। আমার বাবা ওখানেই……

কথাগুলো বলে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে আলিজা। আরসাল কি বলে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারছে না।
সে এটাও বুঝতে পারছে না এই সময়ে সে যে আলিজাকে অনিচ্ছায় বিয়ে করেছে, ডিভোর্স দিতে চাইছে বা সে যে অন্য কাউকে ভালোবাসে এসব কি বলা ঠিক হবে! একেই তো মেয়েটা বাবা হারানোর শোকে নিজেকে সামলে উঠতে পারছে না আবার এরকমভাবে বিয়ে আবার যদি তার বিষয়টি শোনে তাহলে একবারে শেষ হয়ে যাবে মেয়েটা।

” আচ্ছা আপনি কান্না বন্ধ করুন আমি খাবার এনে দিচ্ছি খেয়ে ভালো মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়বেন।
কি হলো চুপ করুন একটু, আমি সকালে আপনার সব কথা শুনে আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করব কথা দিলাম।

” আমার শেষ সম্বলটুকুও আমি হারিয়ে ফেললাম।

আলিজা বিলাপ করে কান্না করতে থাকে, এদিকে আরসাল চলে যায় তার জন্য খাবার আনতে।

খাবার গরম করে প্লেটে সাজিয়ে রুমে এসে দেখে আলিজা রুমে নেই। খাবারের প্লেট বিছানার ওপর রেখে মেঝে থেকে ব্যাগটা তুলে আলমারিতে রাখে সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত বারোটা পার হয়ে গিয়েছে। এতরাতে আবার সে কোথায় গেল ভাবতেই ওয়াশরুমে পানির শব্দ শুনতে পায় সে বুঝতে পারে হয়তো আলিজা ফ্রেশ হতে গিয়েছে।

আলিজার বাবা আমজাদ শেখের সাথে তার বাবা আছেন অনেকদিন ধরে। যখন আরসাল অনেক ছোট ছিল, দুজন একসাথেই রা’*জনী°’তিতে যুক্ত ছিলেন। আলিজার বাবার পদক্ষেপগুলো সবাই খুব পছন্দ করতেন তাই আরসালের বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা করবেন একসাথে করবেন। তারপর থেকে আরসালের বাবা আর আলিজারর বাবা একসাথে, আমজাদ শেখ যেকোন সিদ্ধান্ত তার বাবার কথা শুনেই নিতেন। তবে তার ব্যাপারে বা বাহিরের কোন ব্যাপারে বাসায় কখনও আলোচনা হয় না। আমজাদ শেখ এর যে কোন মেয়ে আছে সেটাও আজকে জানতে পারলো আরসাল।
আলিজা হাতমুখ ধুয়ে বাহিরে চলে আসে। এসেই দেখে আরসাল দাঁড়িয়ে আছে।

” তোয়ালে হবে? আমি তো আপনার নামটাও জানি না।

” আমি আরসাল, এই নামেই ডাকতে পারেন। এই নিন তোয়ালে।(তোয়ালে এনে আলিজার দিকে এগিয়ে দিয়ে)

” আচ্ছা ঠিক আছে।
আলিজা আরসালের হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে হাত মুখ মুছতে থাকে।

” আপনার জন্য খাবার এনেছি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।

” আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।

” আমি কষ্ট করে খাবার গরম করে নিয়ে এলাম আর আপনি বলছেন খাবেন না?

” আপনি খেয়েছেন?

” হ্যাঁ খেয়েছি আপনি খেয়ে নিন।

” আপনি বোধ হয় আমার ওপর রাগ করে ব্যাগ গুছাচ্ছিলেন কোথাও চলে যাওয়ার জন্য।

” এখন এসব ছাড়ুন, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি সোফায় ঘুমোবো। অনেকরাত হয়ে গিয়েছে খেয়ে ঘুমান।

কথাগুলো বলেই আরসাল বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে সোফায় ঘুমিয়ে যায়।
আলিজা খাবারের প্লেট সামনে নিয়ে বসে আছে আর ভোরবেলা ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবছে। তার বাবার শ°’ত্রু কে হতে পারে এসব তার খুঁজে বের করতেই হবে। নেওয়াজ আঙ্কেল অর্থাৎ আরসালের বাবার সাহায্য নিয়ে সব বের করতে হবে। তাকে একা করে দেওয়ার শা°’স্তি তো খু°’নীকে পেতেই হবে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দশটা বেজে গিয়েছে। তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে উঠে পড়ে আলিজা। সকালের নামাজটা যে তার পড়া হয় নি। গতকাল তো সবচেয়ে খারাপ একটা দিন ছিল তার জন্য। সোফার দিকে তাকিয়ে দেখে আরসাল সেখানে নেই। উনিও তো তাকে একটু ডেকে দিতে পারতেন। আলিজা বিছানা থেকে উঠে ওযু করে ফজরের কাজা নামাজ আদায় করে নেয়। তখনও আরসাল ঘরে ফিরে নি। তিনি কোথায় যেতে পারেন এত সকালে সেটা ভেবে পাচ্ছে না আলিজা। আরসাল কি করে না করে বাসায় কে কে থাকে কিছুই জানে না আলিজা। রাতে হয়তো আরও দুজনকে দেখেছিল আলিজা। তবে কেউ কেন তার খোঁজ নিতে আসছে না!
আলিজা নিজেই ভাবে নেওয়াজ আঙ্কেলের সাথে কথা বলার কথা তার বাবার বিষয়ে।
আলিজা রুম থেকে বাহিরে বের হওয়ার কথা চিন্তা করলে ষোলো / সতেরো বছর বয়সী একটা মেয়ে রুমে ঢুকে আসে। এই মেয়েটাকে সে গতরাতে দেখেছিল।

“ভাবি, ঘুম থেকে উঠলে কখন?

” কিছুক্ষণ আগে, আমাকে ডাকা হয় নি কেন?

” ঘুমাচ্ছিলে তাই আম্মি ডাকতে নিষেধ করেছিল।

” আম্মি!

” হ্যাঁ বাবা বলল তুমি হয়তো সারারাত ঘুমোতে পারো নি তাই ডাকতে নিষেধ করায় আম্মিও ডাকতে দেয় নি। আর ভাইয়া তো কলেজে চলে গিয়েছে।

” কলেজে কেন?

” ভাইয়া তো কলেজের শিক্ষক বাংলা পড়ায়।

” বাসায় কে কে আছে?

” আব্বু,আম্মি, ভাইয়া, আমি আর দুইজন কাজের জন্য রাখা হয়েছে তারা আছে।

” বাসায় আর অন্য কোন পুরুষ নেই?

” না, তোমাকে এই সমস্যায় পড়তে হবে না। বাবা বলেছে তুমি সবার সামনে যাও না।

” তোমার নামটাই তো জানি না।

” আমার নাম নওরীন, সবাই রনু বলে তুমিও রনু বলে ডেকো।

” আচ্ছা ঠিক আছে।

” চলো আম্মি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

নওরীন আলিজাকে নিয়ে তার মায়ের ঘরে চলে যায়। উনি বসে বসে চশমা চোখে দিয়ে সুতোর কোন কাজ করছিলেন। আলিজাকে দেখে হাতের কাজ সরিয়ে রাখলেন।

চলবে….

#পুরোনো_ডাকবাক্স
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০১

(নামে কিছু সমস্যা থাকতে পারে, চেঞ্জ করা হয়েছে। সাজ্জাদ থাকলে অনুগ্রহ করে বুঝে নিবেন ওটা আরসাল হবে)

কেমন আছেন সবাই? চলে এলাম নতুন গল্প নিয়ে, আশা করছি ভালো কিছু পাবেন। গঠনমূলক মন্তব্য করবেন সবাই, ভুল হলে অবশ্যই ধরিয়ে দিবেন। প্রথম পর্ব কেমন লাগলো জানি না, তবে ভালো কিছু পাবেন এটুকু বলতে পারি। সবাই একটু রেস্পন্স করবেন, আপনাদের রেস্পন্স আমার মনোবল বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here