পূর্ণতায় তুমি পর্ব – ৩

গল্পঃ পূর্ণতায় তুমি ( তৃতীয় পর্ব )
লেখকঃ আবির।

হিমি শুভকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবার জন্য ঠোঁটের কাছাকাছি ঠোঁট নিতেই মজনু চেচিয়ে বললো,– ম্যাডাম আজ বুধবার, কিছু খাওয়া যাবেনা একদম।

হিমি ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললো,– ক্যান আজকে কি আমার উপোস নাকি হাঁদারাম, কতবার বলছি আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাবি না!

মজনু এগিয়ে এসে বললো,– ঘন্টাখানেক পরে আপনার শ্যুটিং, ঠোঁটের লিপস্টিক নষ্ট হলে সমস্যা। শ্যুটিং সম্পন্ন হবার আগে পর্যন্ত সব হাউ হাউ ফিলিংস কন্ট্রোলে রাখতে হবে।

আসলে হিমি ইচ্ছে করেই শুভকে কিস করতে চেয়েছে যেন অবনী দেখে আরও কষ্ট পায়, কিন্তু অবনী পেছন থেকে শুভর ডাক শোনার অপেক্ষায় থাকলেও পেছনে ফিরে তাকায়নি একবারও।

স্টেশনে এসে ট্রেনের টিকিট কেটে অপেক্ষায় আছে অবনী। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন এসে উপস্থিত, অবনী ট্রেনে চড়ে বসলো।

কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে, মনে হচ্ছে অক্ষিগোলক এক্ষুনি বেরিয়ে আসবে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে আনমনে তাকিয়ে পেছনের স্মৃতিগুলো ভাবছে অবনী–

অবনী ভীষণ করে চাইতো একটা বেবি নিতে, প্রতিটি মেয়ের মনেই মা হবার স্বপ্নটা কমন, সে একটি কিউট বেবির মা হবে। প্রতিবার শারীরিক মেলামেশার সময় অবনী চাইতো জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি ব্যবহার না করতে, কিন্তু শুভর তাতে আপত্তি ছিল, শুভ বারবার বলতো আরে বেবি পরেও নেয়া যাবে, আগে কয়েকবছর উপভোগ করি নতুন বিবাহিত জীবনটা।

এখন শুভর জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি ব্যবহার নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে অবনীর, তাহলে কি শুরু থেকেই শুভর মনে এরকম ছিল যে শরীরটা লুটে নিয়ে একদিন বিদায় করে দিবে!

নাহ! মনের আকাশে ব্যথার কালো মেঘের ঘনঘটা, সে মেঘের বৃষ্টি ঝরছে অবনীর চোখ থেকে অঝোরে!

ট্রেনের জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে অবনী, এমন সময় চোদ্দ-পনেরো বছর বয়সী একটা ছেলে হাতে বাদামের ডালা নিয়ে এসে অবনীকে বললো,– আপু বাদাম লাগবে?

অবনী ঘুরে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছে বললো,– না ভাইয়া লাগবে না।

অবনীর চোখ জল দেখে ছেলেটার ভীষণ খারাপ লেগেছে হয়তো, অবনীর সামনের সিট ফাঁকা, সেখানে বসে ছেলেটি বললো,– আপা তোমার টাকা দেওন লাগবো না, কয়টা বাদাম দেই খাও তুমি।

অবনী শুষ্ক হাসি হেসে বললো,– না লক্ষী ভাই আমার, আমি এখন খাবো না!

ছেলেটা মায়াবী একটা হাসি দিয়ে বললো,– আপা আমি যদি বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দেই, তাহলে খাবে? তোমার কষ্ট আরও কমিয়ে দিলাম!

অবনী হেসে ফেলে বললো,– তুই তো নাছোড়বান্দা, কেন এত মানুষ থাকতে আমাকেই কেন তোর বাদাম খাওয়াতে হবে রে পিচ্চি!

ছেলেটার মুখ শুকিয়ে গেল, চোখ জলে টলমল করে উঠলো, অবনীর চোখে চোখ রেখে ছেলেটা বললো,– আপা, আমারও তোমার মতোই বড়ো বইন ছিল, আব্বায় আম্মায় মারা যাবার পরে আমার বইনই আমারে আগলাইয়া রাখতো, কত্ত আদর করতো জানো! আপার আদরের কারণে আব্বা আম্মার কথা মনেই পড়তো না! কিন্তু আমার আপাও মারা যাবার অনেক আগে থেকেই তোমার মতো এইরকম কান্না করতো।

অবনী অবাক হয়ে বললো,– কিন্তু কেন কান্না করতো সে!

ছেলেটা চোখের জল মুছে বললো,– তখন তো জানতাম না, আপায় মারা যাবার পরে কাকি কইছিলো আপার নাকি ক্যান্সার হইছিল, সেইটা জানার পরে আপায় আমার কথা ভেবে কান্না করতো, আপায় মারা গেলে আমার কি হবে!

কষ্টে ছেলেটার কথা আটকে যাচ্ছে!

অবনী স্তব্ধ হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ছেলেটার মুখের দিকে।

চোখের জল মুছে ছেলেটা আবার বললো,– জানো আপা, আমার আপার কান্না দেখে আমিও কান্না করতাম, আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হইতো, তহন ভাবতাম আমার কাছে টাকা থাকলে আপারে চকলেট কিন্না দিতাম, আপায় খুশি হয়ে আর কান্না করতো না! এই যে এহন আমি বাদাম বেচি, এহন আমার কাছে টাকা থাকে, তখন যদি থাকতো তাইলে আপারে কতকিছু কিন্না দিতাম, আমি আপার ভাই, আমারো একটা দায়িত্ব আছেনা কও?! আপার কান্না আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টের, তাই আপার মতো কাউরে কান্না করতে দেখলে আমার খারাপ লাগে!

অবনী কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা! অবনীর পাসের সিট খালি, ছেলেটাকে ডেকে পাশে বসিয়ে অবনী বললো,– একদম কান্না করবে না, এই যে আমি তোমার বড়ো বোন। আচ্ছা তোমার নাম কি?

ছেলেটি বললো,– আমার নাম সজল!

ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অবনী বললো,– তোকে আমি পিচ্চি বলে ডাকবো এখন থেকে।

ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বোঝালো,– আচ্ছা সমস্যা নেই।

অবনী বললো,– শোন পিচ্চি, আমি বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছি, তুই খাবি, আর তুই বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিবি, আমি খাবো। বাদাম খেতে খেতে দুই ভাইবোন গল্প করবো।

একটা মুচকি হাসি দিয়ে পিচ্চি বললো,– আচ্ছা আপা।

বাদাম খেতে খেতে পিচ্চি বললো,– আমি বাদাম কেন বিক্রি করি জানো আপা?

অবনী বললো,– না তো! কেন বিক্রি করিস?

: আপা ছোটবেলা থেকে বাদাম আমার পছন্দ, ভাত না খাই বাদাম খাওয়া লাগবোই! আব্বায় প্রতিদিন আমার জন্য নিয়া আইতো বাদাম। তারপর আব্বায় মারা যাবার পর আর কারে বলমু বাদাম আনতে, আপায় মাইনষের বাসায় কাম করে অল্প টাকা পাইতো, সেই টাকা দিয়া দুই ভাইবোনের সারা মাস যাইতে টেনেটুনে! আপয়া মারা যাবার পরে চিন্তা করছি কিছু না করলে খামু কি! তাই বাদাম বেচি, নিজের পছন্দের জিনিস খাইও, আবার টাকাও পাই!

: আচ্ছা বাদ দে পিচ্চি কষ্টের কথা, সত্যি করে বলতো, তোর কি লেখাপড়া করতে ইচ্ছে হয়?

: ঠিক মতো তিনবেলা ভাত জোটেনা, আবার পড়ালেখা। প্যাটে খিদা থাকলে পড়ালেখা কন যাই কন কিছুই ভালো লাগেনা!

: আচ্ছা তুমি থাকো কোথায়!

: আপা আমার কোনো ঠিক নেই, এই স্টেশন, সেই স্টেশন, যেহানে রাইত, সেহানে কাইত!

: আচ্ছা তুই যাবি আমার সাথে? বিশ্বাস হয় আমাকে? আমাদের বাড়িতে থাকবি, তোকে স্কুলে ভর্তি করাবো!

অবনীর কথা শুনে পিচ্চির চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক! হেসে ফেলে বললো,– আপা আমারে পড়ালেখা করান লাগবে না, তোমাগো বাড়িতে থাকতে দিলেই হইবো, দেইখো আমি বাদাম বেইচা তোমাগো অনেক কিছু কিন্না দিমু!

অবনী মিষ্টি হেসে পিচ্চির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,– লক্ষী ভাই আমার, তোমার বাদাম বিক্রি করতে হবেনা, আপাতত লেখাপড়া করবি, বড়ো হয়ে ব্যবসায়ী হবি। জানিস আমারও আপন ভাই নেই, আজ থেকে তুই আমার ভাই।

পিচ্চির জীবন কাহিনি শুনে অবনীর চিন্তাভাবনা নতুন পথের সন্ধান পেলো। পৃথিবীতে পিচ্চির মতো কত মানুষ আছে জীবনের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করে চলতে হয়। অবনী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো নিজেকে ভেঙে আবার নতুন করে গড়তে হবে, ভেঙে পড়লে চলবে না, ঘুরে দাড়াতে হবে।

রাত আড়াইটা, স্টেশনে এসে ট্রেন থামলো। পিচ্চিকে নিয়ে ট্রেন থেকে নামলো অবনী। লোকজন ধীরে ধীরে চলে গেল, স্টেশন প্রায় ফাঁকা। এখান থেকে অবনীদের বাড়িতে যাবার কোনো গাড়ী এখন পাওয়া যাবেনা, ফজরের আজান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

স্টেশন ফাঁকা, পিচ্চিকে নিয়ে বসে আছে অবনী। হঠাৎ কয়েকটি বখাটে ছেলের উদয়! সিগারেট টানতে টানতে ছেলেগুলো অবনীর সামনে এসে দাঁড়াল। বখাটেদের সর্দার অবনীর মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললো,– ম্যাডাম এভাবে বসে থাকতে বোরিং লাগেনা! চলেন চিপায় গিয়ে টাইমপাস করি, গ্যারান্টি দিলাম সময় খুব ভালো কাটবে।

ছেলেটার কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে পিচ্চি ধাক্কা দিয়ে বখাটেদের সর্দারকে বললো,– সর আমার আপার লগে বাজে কথা কবিনা!

সর্দার তার সাঙ্গপাঙ্গদের ইশারায় পিচ্চির ব্যবস্থা করতে বললো।

বখাটেদের দুজন পিচ্চিকে চ্যাং-দোলা করে তুলে নিয়ে একটা খাম্বার সাথে বেধে চাকু দেখিয়ে বললো,– সাউন্ড করলে এখানেই খতম করে দেবো একদম!

পিচ্চি ভয়ে শেষ।

বখাটেদের সর্দার খপ করে টান মেরে অবনীর বুকের ওড়নাটা হাতে নিয়ে নিলো…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here