পূর্ণতায় তুমি পর্ব – ৫

গল্পঃ #পূর্ণতায়_তুমি ( পঞ্চম পর্ব )

নেশায় বুদ হয়ে পড়ে আছে শুভ, পাশে হিমি শুয়ে আছে অর্ধনগ্ন অবস্থায়। এই অবস্থায় শুভকে জড়িয়ে ধরে হিমি কয়েকটি সেল্ফি তুলে অবনীর হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিলো। হিমির উদ্দেশ্য এসব দেখে যেন অবনীর মনটা আরও ভেঙে যায়।

কোনো মেয়ে তার প্রিয়জনের পাশে অন্য মেয়ের ছায়াও সহ্য করতে পারেনা, সেখানে নিজের স্বামীর বুকে অন্য মেয়েকে দেখে অবনীর কেমন লাগবে সেটা দেখার জন্য অবনীর এই পৈশাচিক কর্মকাণ্ড, আর এসব দেখে অবনী আর কখনও না ফেরে সেই প্ল্যান।

ফোনে নোটিফিকেশন সাউণ্ড বাজতেই ফোন আনলক করে হোয়াটসঅ্যাপে হিমির পাঠানো ছবিগুলো দেখে নিজেকে স্থির রাখা সম্ভব হলোনা অবনীর, মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেল।

আকাশ এবং পিচ্চি অনেক চেষ্টা করে অবনীর হুশ ফেরালো। অবনী যে বিশাল বড়ো আঘাতে আবারও এলোমেলো, সেটার ছাপ স্পষ্ট অবনীর চোখে মুখে!

কি হয়েছে জানতে চেয়েও আবার চুপ হয়ে গেল আকাশ, এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্ন করা ঠিক হবেনা।

ফজরের আজান হলো, স্টেশনে গাড়ির ভীড় বাড়তে লাগলো। আকাশ অবনীকে বললো,– এবার বাড়িতে যাবার গাড়ী তো পেয়ে যাবেন, তাহলে আর দেরী কেন!

অবনী বললো,– আপনি কোথায় যাবেন?

আকাশ মৃদু হেসে বললো,– আমি তো যাযাবর, পুরো পৃথিবীটা আমার, যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবো!

অবনী বললো,– আপনি আমার এতবড় উপকার করলেন, যদি বন্ধু ভাবেন তাহলে আমার একটা কথা রাখবেন?!

: বলুন।

: আপনিও আমাদের সাথে চলুন!

: কিন্তু…!

: কোনো কিন্তু নয়, আপনার যতদিন ইচ্ছে আমাদের ওখানে থেকে তারপর নাহয় চলে যাবেন।

: ওকে, এত করে যখন বলছেন তখন আর না করি কীভাবে!

পিচ্চি আকাশকে বললো,– এত করে বললো কই ভাই, একবারই তো বললো! ভাব তো সুবিধার মনে হচ্ছেনা!

আকাশ পিচ্চির মুখ চেপে ধরে বললো,– তোকে বখাটেরা খাম্বার সাথে বেধে রেখেছিল ভালোই করেছিল, স্পিকার অনুযায়ী আওয়াজ বেশি তোর।

অবনী মুচকি হাসলো।

গাড়িতে করে সকাল সকাল বাড়ি এসে পৌঁছল অবনী, অবনীর দাদী উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলো, অবনীকে দেখে ঝাড়ু ফেলে এগিয়ে এসে অবনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,– মরা বাড়িটা আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে দাদী বললো,– কিরে, তোর সোয়ামীর তো ভালোই উন্নতি হইছে!

অবনী বললো,– কীসব বলছো দাদী!

দাদী বললো,– ঠিকই তো বলছি, তোর স্বামী শুভ আরও হাতখানেক লম্বা হইছে দেখতাছি!

অবনী হেসেফেলে বললো,– দাদী তোমার চশমা নেই বলে আকাশকে শুভ মনে হচ্ছে! ওর নাম আকাশ, ও আমার বন্ধু!

আকাশ বললো,– আর আজকে থেকে দাদী আমার বান্ধবী!

দাদী ঝামটি মেরে বললো,– এহ!

আকাশ হেসেফেলে বললো,– এহ না দাদী, তোমাকে আর সঙ্গীহীন দিন কাটাতে হবেনা, তোমার রাজকুমার লোকেশন বরাবর উপস্থিত!

অবনী হেসেফেলে আকাশকে বললো,– এসেই শুরু! এবার একটু থামেন।

অবনীর মা বাবা আসলো, তাদের সাথে আকাশের এবং পিচ্চির পরিচয় করিয়ে দিলো অবনী।

সকালের নাস্তা খেয়ে সবাই বিশ্রাম নেবার পালা।

বিকেলে অবনীদের গ্রামে ঘুরতে বের হলো আকাশ ও পিচ্চি। ঘুরেফিরে সন্ধ্যা হবার আগেই ফিরে এলো।

সন্ধ্যা লগনে আকাশ দখলে নিয়েছে কালো মেঘেরা, কিছুক্ষণ থমথমে পরিবেশ, তার পরেই দমকা হাওয়ার শনশন করে বয়ে যাবার শব্দ। গাছের শুকনো ডাল ভেঙে পড়ছে সশব্দে। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। টিনের চালে বৃষ্টির ছন্দে কেমন এক স্বর্গীয় আনন্দ বিরাজ করছে মনে। পিচ্চি ও আকাশকে যেই রুমে দেয়া হয়েছে, সেই রুমে অবনী ও দাদীও বসে আছে, সবাই মিলে গল্প করছে।

অবনীর মা একটা ট্রে-তে করে চা এবং চাল ভাজা দিয়ে গেল। গ্রামের বাড়িতে বৃষ্টির দিনে চায়ের সাথে চালভাজা অথবা মুড়ি খাবার আনন্দটাই আলাদা, সময়টা আরও চাঙা হয়ে ওঠে। জানালা দিয়ে হুহু করে বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা শীতল হাওয়া রুমের মধ্যে ঢুকছে। আকাশের ঠান্ডা লাগছে বুঝতে পেরে একটা পাতলা কাঁথা এনে আকাশের হাতে দিয়ে অবনী বললো,– এটা গায়ে জড়িয়ে নিন, ভালো লাগবে।

গল্প শেষে যে যার রুমে। অবনী অন্ধকারে তার রুমের জানালার পাশে দাড়িয়ে বাইরের বৃষ্টি ভেজা উত্তাল হাওয়ার গাছের ডাল-পাতা উড়িয়ে নেবার দৃশ্য উপভোগ করছে, বাইরে পরিবেশ এবং অবনীর মনের পরিবেশ দুটোই আজ একইরকম। অবনীর মনেও কষ্টের দমকা হাওয়া সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যাচ্ছে।

এমন এক বৃষ্টি ভেজা দিনে বাজার থেকে ফেরার পথে ব্রেইন স্ট্রোক করে রাস্তায় পড়ে যায় অবনীর বাবা, শুভ তখন ঢাকা থেকে এখানে এসেছিল ঘুরতে, বাবাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে শুভ জলদি করে জেলা শহরে হাসপাতালে নিয়ে যায়, সেখান থেকে ঢাকায়। অবনীদের পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতা দেখে শুভই অবনীর বাবার চিকিৎসার সকল ব্যয় বহন করে। সেখান থেকেই শুভর প্রতি এক পৃথিবী কৃতজ্ঞতার জন্ম নেয় অবনীর মনে। শুভ এবং অবনীদের মধ্যে খুব ভালো সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

শুভ অবনীকে পছন্দ করতো জেনেও অবনী এড়িয়ে যেত বরাবর, কারণ অবনীর মন অনেক আগেই অন্য কারো হয়ে গেছে, যাকে কখনও সামনাসামনি দেখেনি অবনী, অথচ ভালোবাসে নিজের প্রাণের চেয়েও অধিক।

শুভ অবনীর বাবার কাছে ডাইরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব দেয়, এবং জানায় যে অবনীকে তার ভীষণ পছন্দ।

একদিন বাবা অবনীকে ডেকে হাত ধরে বলে,– আমার একটা কথা রাখবি মা?

অবনী মিষ্টি হেসে বলে,– তোমার একটা কথা নয়, তোমার হাজার কথা রাখবো নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও।

এই হাসি ছিল অবনীর শেষ হাসি।

বাবা অবনীর হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বললো,– শুভ আমাদের জন্য কম করেনি, আমার মনে হয় ও তোকে সুখেই রাখবে মা, ও তোকে বিয়ে করতে চায়, তুই রাজি হয়ে যা, এটাই তোর কাছে তোর বাবার শেষ আবদার!

অবনী সেদিন পাথরের গড়া অনড় নিষ্প্রাণ মূর্তি হয়ে গিয়েছিল, বাবার ইচ্ছা পূর্ণ করতে গিয়ে ভালোবাসার কুরবানী দিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে যে পড়ে সেই বোঝে এই যন্ত্রনার গভীরতা।

অবনী মুখ থেকে সেদিন একটা শব্দ বের করতে পারেনি, সারারাত কেঁদে কাটিয়েছিল। এরপর নিজের মনে যন্ত্রণার বেড়ি পরিয়ে ধীরে ধীরে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে। আর ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে মরতে থাকে প্রতিক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত।

একদিন শুভ আসে অবনীদের বাড়িতে, রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, ঠিক তখন শুভ চলে আসে অবনীর রুমে।

ঘুমের মধ্যেই বুকে কারো স্পর্শ অনুভব করে ঘুম ভেঙে যায় অবনীর, চিৎকার করে উঠবে এমন সময় দুটি ঠোঁট গিলে নেয় অবনীর ঠোঁট দুটি, অবনী ভীষণ ভড়কে যায়, গলা দিয়ে আওআজ বের হতে চায়না! অবনীকে টেনে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে শুভ বললো,– ভয়ের কিছু নেই, আমি শুভ, দুদিন পরে তো আমাদের বিয়ে হচ্ছেই…

চলবে…

আবীর হোসেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here