পূর্ণশশী পর্ব ৫

#পূর্ণশশী
(৫)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
____________________
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আমি অংশদের ল্যাব এর বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে রেখেছি৷ আর বিড়বিড় করে বলছি

”আয় বৃষ্টি জোরে,,
চুমু দেবো তোরে

একটু জোরে এলে,,
হাত দু’টো মেলে

ভিজবো আম…..

‘এই পাগলি কি বলছো এগুলো ‘? আরো কিছু বলার আগেই অংশ আমার মাথায় পেছন থেকে গাট্টা মেরে সামনে এসে প্রশ্ন করলো ।

‘উফ, অংশ দিলে তো মাথাটা ফুটো করে আমার।এভাবে কেউ মারে ‘? মাথায় হাত ঘষতে ঘষতে বললাম বিরক্তি নিয়ে। এই ছেলেটা সবসময় আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ গুলোতেই সবসময় বাঁধা প্রয়োগ করে। কবে থেকে ভাবছি বৃষ্টিতে ভিজবো কিন্তু একদমই সময়, সুযোগ হয়ে উঠে না৷ আজ আমার ক্লাস ও শেষ আবার বৃষ্টি ও শুরু হয়েছে। সূবর্ণ সুযোগ হয়ে যাবে আজকে বৃষ্টিটা একটু বাড়লেই। তাইতো হাত বাড়িয়ে সন্ধি করার চেষ্টা করছিলাম বৃষ্টির সাথে ছন্দ মিলিয়ে। কিন্তু অংশ সাহেব সেটা আর হতে দিলো না।

‘কি ব্যাপার শশী ল্যাব এর সামনে এসেছো কেন’?

‘বাহ রে, এখানে কেন আসি আমি? অবশ্যই তোমার জন্য’।

‘ তোমার ক্লাস শেষ? আর তোমাকে তো বলেছি আমার জন্য অপেক্ষা করতে হলে ক্যান্টিনে করবে। আর আমায় টেক্সট করে দিলেই তো হতো। তুমি জানো না হৃদয় তোমাকে দেখলেই লাইন মারার চেষ্টা করবে তবুও এখানেই কেন আসতে হবে’? অংশ রেগে রেগে বলল কথাগুলো। আমার পাগল সাহেব রেগে গেছেন তা দেখে আমি আশে পাশে একবার দেখে নিয়ে হুট করেই জড়িয়ে ধরে পা উঁচিয়ে আলতো করে চুমু খেয়ে নিলাম তার গালে। এমন হুট করে চুমু খাওয়ায় অংশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গালে হাত দিলো নিজের। আর আমি তো লজ্জায় আবার বারান্দা থেকে বাইরে তাকালাম৷ সামনে একটু দূরে ক্যাম্পাসের শিমুল গাছের নিচে পূর্ণ দাঁড়িয়ে আমাদেরই দেখছে৷

‘শশী সরে দাঁড়াও গাড়ি আসছে তো’। রানু আন্টি আমার হাত ধরে টেনে ফুটপাতে উঠিয়ে আনলেন আমায়। আর তখনি আমার সামনে দিয়ে সাঁই সাঁই করে একটা মাইক্রোবাস চলে গেল। ইশ, আরেকটু হলে গাড়িটা আমার উপর দিয়েই যেত। আজ সকালের নাস্তা শেষ করেই আমি আর রানু আন্টি বেরিয়েছি মার্কেটে যাবো বলে। তিনি ঘরের কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে যাবেন। প্রথমে মৌশিকে নিয়ে বের হচ্ছিলেন কিন্তু মৌশির ঘরকন্নার কাজকর্ম, জিনিসপত্রের ব্যাপারে একদমই জ্ঞান নেই। আমার যে অনেক আছে তা নয় তবে মায়ের সঙ্গে প্রায়ই কেনাকাটা করতে যাওয়ার দরুন এসব ব্যাপারে কিছুটা ধারণা আছে৷ আর মৌশি তো কোটিপতি বাবার মেয়ে হয়তো গ্লাসে জল ভরাটা ও তার আয়ত্বে ছিলো না। আর তাই আমি এসেছি কিন্তু সিগন্যাল এর অপেক্ষা করছিলাম রাস্তা পার হবো বলে। কিন্তু অতীতের ভাবনায় হঠাৎ এতোটাই বিভোর হয়েছিলাম যে কখন ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি খেয়াল নেই। হয়তো রানু আন্টি না থাকলে এতক্ষণে চাপা পড়তাম। অবশ্য এতে বেশ ভালোই হতো৷ আমার এক্সিডেন্টে অংশের মনে চলা ভাবনারা তো সামনে আসতো। কি করতো অংশ? সে কি কষ্ট পেত আর আমি যদি এক্সিডেন্টে মরে যেতাম? তবে কি কান্না করতো অংশ আমার জন্য? আমার ভাবনারা অবাধ্য হয়ে আবারও অংশকেই নিয়ে ভাবছে৷
আমি আসক্ত অংশের নেশায় আজও কেন করলাম পূর্ণকে বিয়ে? প্রতিশোধ নিতে! ভালোবাসায় কি আদৌ শোধ প্রতিশোধ থাকে? আর এখানে কি অংশের কষ্ট বলে কিছু হবে নাকি ওই বোকার মত ছেলেটা কষ্ট পাবে আমার ভুলের জন্য ।

‘ চাচা এই গ্লাস সেট এর দাম কত ‘? রানু আন্টি এক সেট গ্লাস পছন্দ করেছে আর আমি বলেছি দরদাম আমি করবো। আন্টি ও বললেন করো আজ নয় কাল তোমাদের ও করতেই হবে নিজের সংসার গুছাতে। আমি তো আর সারাজীবন পাশে থাকবো না। আন্টির কথায় একটু খারাপ লাগলো তবে আপাতত ইমোশন সাইডে রেখে গ্লাস দাম করবো। দোকানদার চাচা বললেন ‘ খালা একদাম ছয়’শ তবে নিতে চাইলে পঞ্চাশ টেকা কম দিয়েন’।

‘খালা কে’? চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম দোকানদারকে।

‘আপনেরে কইছি ‘। আমার দিকে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে জবাব দিলো দেকানদার।

‘ওই মিয়া ওই আমাকে কোন দিক দিয়া আপনার খালার বয়সি মনে হয়? হ্যা! চোখে কি রঙিন চশমা লাগাইছেন? আমার বয়স এখন ও ত্রিশ হয় নি বলে আমি এই ষাট বছরের বুইড়ার খালা। কিনবো না আপনার দোকানের গ্লাস। বেহুদা লোক সাহস কত্তো বড় আমাকে বলে খালা ‘। রেগে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছি কথা গুলো ওদিকে অন্যান্য দোকানের লোকজন সব হা করে আমার দিকেই চেয়ে আছে। সবাই কেমন বিনোদন নিচ্ছে মনে হচ্ছে রাগ তো আমার এমনিতেই বাড়তি তার উপর আশেপাশের সবার তাকানো দেখে আগুনে ঘি ঢালা কারবার। আবার চেঁচিয়ে উঠলাম ‘ ওই কি দেখছেন আপনারা এমন করে? মুভি চলে , নায়ক নায়িকা রোম্যান্স করতেছে যা না দেখলে মিস করে ফেলবেন? একদম চোখ গেলে দেবো ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকলে ‘। রাগে আমার মুখ থেকে অসংগত কথাবার্তা চলে সেটা নতুন কিছু না৷ কিন্তু কথা হলো আমি যে হারে সবাইকে মেজাজ দেখিয়ে কথা বলছি তাতে নিজেই নিজেকে পাগল ভাবছি। আশেপাশের মানুষ ধীর স্বরে অনেক কিছুই বলে গেছে সেদিকে আমার খেয়াল নেই। কিন্তু রানু আন্টি যে বেশ লজ্জায় পড়েছেন তা ওনার চুপচাপ দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়া দেখে বুঝেছি। দশ মিনিটের ভেতরে বড়সড় একটা সাইক্লোন তুলে অর্ধেক মার্কেটে তুফান চালিয়ে এখন আমি ও চুপচাপ বের হলাম। সবাই এখনও আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে।

দুপুরে খাবার খেতে মৌশি আমায় ডেকে গেছে। কিন্তু আমার মোটেও ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করছে না। মার্কেটে গিয়ে যা করেছি তার পর আন্টি আর আমার সাথে একটা কথা ও বলেন নি। হয়তো রেগে আছেন আমার স্যরি বলা উচিত৷ আসলে রেগে গেলে আমার আর হুশ থাকে না কোন কিছুর। কিন্তু পরে মাথা ঠান্ডা হতেই সবটা ঠিক না ভুল ছিলো তা বুঝতে পারি। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে যায়। এমন করেই তো পূর্ণের জীবনটা নষ্ট করলাম। আমার রাগ আমার জেদ আর বলি হলো পূর্ণ।
মৌশি আবারও এলো ডাকতে এবার আর বসে না থেকে বের হলাম। রানু আন্টি খাবার সার্ভ করছেন ফুপুকে আর শ্বশুরবাবা কে। আমাকে দেখে কেউ কোন কথা বললো না৷ আমিও না বলে মৌশির সাথে কিচেনে চলে গেলাম। রানু আন্টি ও এলেন কিচেনে ।

‘স্যরি আন্টি ‘। মাথা নিচু করে বললাম। আন্টি তরকারির বাটিতে তরকারি নিচ্ছিলেন আমার মুখে স্যরি শুনে একটু দাঁড়িয়ে আবার চলে গেলেন। ফুপু আর বাবার খাওয়া শেষ হতেই রানু আন্টি ডাকলেন ‘মৌশি, শশী খেতে এসো ‘। মৌশি যেতেই আমিও গেলাম। চেয়ার টেনে বসেই আবার ও বললাম ‘আন্টি স্যরি প্লিজ মাফ করে দেন’। বাচ্চা বাচ্চা ফেস বানিয়ে বলতেই আন্টি বললেন ‘থাক আর বাচ্চা সাজতে হবে না আপনাকে দু’দিন পর বাচ্চার মা হয়ে যাবেন। আর হ্যা স্যরি দরকার নেই শুধু মাথায় রেখো স্থান,কাল, মানুষ সবটা বিবেচনা করে মুখটা চালাতে হয়। সব জায়গায় সব ব্যবহার খাটে না ‘।

‘হুম ‘ বলেই মাথা নাড়ালাম। বাকিটা আল্লাহ জানে কতক্ষণ এই ‘হুম’ বহাল রাখতে পারবো৷ এরপর টুকটাক কথার মাঝে খাওয়ার পর্ব শেষ হলো। পুরো সময় আমি আর রানু আন্টি কথা বললাম কিন্তু মৌশি একটা কথা ও বলেনি। মেয়েটার মুখ ভার লাগছে। কিছু কি হয়েছে! আমার সাথে যে কয়বার কথা বলেছে ততবারই মনে হয়েছে নিজ ইচ্ছায় বলেনি বলতে চায় না৷ তবে কি মৌশি কোন কারণে আমার উপর রেগে আছে? উফ, কাল রাতে তো মৌশি দাঁড়িয়ে ছিলো জানালার সামনে দেখেছিলো আমাকে অংশের পাশে৷ হুম, এটাই কারণ হবে হয়তো। আমি অপরাধী পূর্ণের ছিলাম এখন আবার মৌশির ও হয়ে গেলাম।

শীতের হিমেল হাওয়া জানালার পর্দায় নিজের দাপুটে থাবা বসাচ্ছে। শীত বুড়ি দেশ ছেড়ে যাবার পথে এই থাবায় জানালায় থাকা পর্দা ততোটা কাবু হচ্ছে না। আজও আকাশে চাঁদ উঠেছে কিন্তু তাতে আলো নেই। হয়তো আছে মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে চোখে লাগছে না আমার। কি জানি, আমার খেয়াল তো প্রকৃতির এসব অনিন্দ্য সুন্দর লুকোচরি, হাওয়ার লুটোপুটিতে নেই। আমার খেয়াল তো এই মুহুর্তে আলমারির কপাট খুলে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটির উপর। সেই কখন থেকে এপাশ থেকে ওপাশে কাপড় রাখছে আবার সরাচ্ছে। আজ অফিস থেকে ফেরার সময় আমার বাবার বাড়ি গিয়েছিলো। মা আমার লাগেজ ভর্তি কাপড়চোপড় আর দরকারি অনেক জিনিস পাঠিয়ে দিয়েছে। পূর্ণের আলমারিটা দু’কপাট এর। কিন্তু দু’পাশের এক পাশ ভর্তি কম্বল কাথা, বিছানার চাদর, পর্দা, কুশন আরো অনেক কিছু আর এক পাশ অর্ধেক ভর্তি তার নিজের স্যুট,কোট, ড্রেস আর অর্ধেকে তার ফাইলপত্র হাবিজাবি। এখন আমার জিনিসপত্র রাখার জন্য জায়গা করতেই বেচারা কখনো নিজের কাপড়চোপড় বের করছে তো কখন কম্বল, চাদর, বালিশ। তবুও ঠিকঠাক জায়গা করে উঠতে পারছে না। মেজাজ আমার এবার খারাপ হওয়ার পথে। এই ছেলে শুধু কি হাবা এ তো এক নম্বরের গাধা। এরে ইন্জিনিয়ার বানাইছে কে আল্লাহ জানে। অফিস থেকে এসে খাবার খেয়ে লেগেছে এই কাজে। এক ঘন্টা হবার পথে এখনও এনার কাজ হলো না। জাস্ট অসহ্যকর ছেলে একটা।

‘এই সরো তো আমার কাপড়ের জন্য জায়গা করবে তো আমি করছি। এক ঘন্টা ধরে শুধু এখান থেকে ওখানে ওখান থেকে এখানে করে যাচ্ছে কাপড়কে। অকর্মা ঢেকি কোথাকার ‘ বলেই আমি বিছানা থেকে নেমে সোজা আলমারির সামনে গেলাম। তার কাঁধে হালকা করে ধাক্কা লাগিয়ে মাত্রই কাপড়ে হাত দিচ্ছি আর তখনই পূর্ণ মিনমিন করে বলল ‘ আমি তো আমার অফিসের একটা ফাইল খুঁজছিলাম ‘।

‘কিহ ‘!

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here