প্রণয় রেখা পর্ব -১৪+১৫

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৪.

‘আমার কিন্তু এবার খুব রাগ হচ্ছে লরিন। আপনি আমার সাথে কেন যাচ্ছেন? আরেকটা রিক্সা নিতে পারছেন না?’

লরিন মুচকি হেসে বলল,

‘না, পারছি না। সামান্য রিক্সাও ঠুমি আমার সাথে শেয়ার করতে পারছ না? এত হিংসুটে কেন ঠুমি?’

‘কী? আমি হিংসুটে?’

মোহনা ভীষণ রকম চটে গেল। লরিন ঠোঁট চেপে হাসছে। মোহনা কে রাগিয়ে সে বেশ মজা পাচ্ছে। মোহনা বড়ো বড়ো নিশ্বাস ছেড়ে বলে,

‘আপনি একটা অসভ্য ছেলে। নূন্যতম সভ্যতাও আপনার মাঝে নেই। আপনাকে শুধু আমি কেন জীবনেও কোনো মেয়ে পছন্দ করবে না।’

লরিন শব্দ করে হেসে বলল,

‘Seriously, you think so? Do you know, আমার ইউনিভার্সিটির কত মেয়ে আমার সাথে ডেট করতে চায়? You don’t have any idea, they are crazy for me. আর ঠুমি বলছো, কেউ আমাকে পছন্দই করবে না? আহ, হাসালে আমায়।’

মোহনা দম ছেড়ে বলল,

‘তো যান না আপনার ইউনিভার্সিটির সেইসব পাগলদের কাছেই যান। তাদের সাথেই গিয়ে ডেট ফেট করুন। এখানে কেন পড়ে আছেন? এখানে থেকে আপনার কোনো লাভ নেই, উল্টো অনেক লস হচ্ছে। তাই বেটার হবে, নিজের দেশে ফিরে যান, আর ঐসব মেয়েদের সাথে ডেট করুন।’

লরিন তীক্ষ্ণ চোখে মোহনার দিকে চেয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলল,

‘By any chance, are you jealous Mohona?’

মোহনা পাল্টা জবাবে চেঁচিয়ে উঠল। বলল,

‘আমি কেন জেলাস হব? আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড লাগি নাকি যে আপনার এসব কথা শুনে আমার হিংসে লাগবে? এসব আজগুবি কথা বলা বন্ধ করুন। যা বলেছি এখন সেটা নিয়েই ভাবুন। তাতেই আপনার মঙ্গল।’

লরিন কোনো উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ পর আবার মোহনাই তাকে বলল,

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

‘Yeah, sure.’

‘Are you Muslim?’

‘Yeah, I am Muslim.’

মোহনা জবাব পেয়ে খানিক বিমোহিত হলো। একপলক লরিনের দিকে চেয়ে পরে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে চাইল। খানিক সময় চুপ থেকে আবারও মোহনা প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘আপনার মা বাবা জানেন আপনি যে বাংলাদেশে এসেছেন?’

লরিন মোহনার দিকে চেয়ে বলল,

‘আমার মা বাবা নেই। আংকেলের কাছে বড়ো হয়েছি। আর উনি জানেন সবকিছু।’

মোহনা নিচু সুরে বলল,

‘স্যরি।’

‘It’s ok.’

পরে আর কেউই কোনো কথা বলেনি। মোহনার কেমন অস্বস্তি লাগছিল। তার মনে হচ্ছিল লরিনের হয়তো তার প্রশ্ন শুনে খারাপ লাগছে। মোহনা একবার চেয়েছিল লরিনের সাথে আরেকবার কথা বলবে। কিন্তু দ্বিধা দ্বন্দ্বের পাহাড় সরিয়ে কথা বলা আর হয়ে উঠেনি। এর মাঝে মোহনাও তার বাসায় এসে পৌঁছে যায়। রিক্সা থেকে নেমে টাকা বের করতে নিলেই লরিন তাকে বাঁধা দিয়ে বলে, সে একেবারে হোটেলে নেমে টাকা দিয়ে দিবে। মোহনা আর কিছু বলে না। লরিন হালকা করে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে সেখান থেকে চলে আসে।

গোসল শেষ করে এসে মোহনা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।‌ দুপুরের ঝলসানো সূর্য একেবারে মাথার উপর। চারদিকে তার ভীষণ কিরন। উত্তপ্ত দহনে‌ তার জনজীবন অতিষ্ঠ। তার এত কিসের তেজ? সারাক্ষণ এত দাউ দাউ করে কেন‌ জ্বলে? একটু শান্ত হতে পারে না, অসহ্য। সূর্যকে এতসব কথা শুনিয়ে তবেই মোহনা ক্ষান্ত হলো। আজকাল সূর্যের এই তেজ তার পছন্দ হচ্ছে না। পছন্দ না হওয়ার কারণ তার জানা নেই। তবে মনে তার সূক্ষ যন্ত্রণা হচ্ছে। শীতকালকে কেন যেন খুব মিস করছে সে। সেই হাড় হিম করা শীত এখন আর আসে না। আগে শীতে গ্রামে গেলে সে শীতের কঠিন দাপট টের পেত। এখন আর গ্রামে যাওয়া হয় না। ঢাকা শহরে শীতের খুব একটা দেখা মেলে না। এত এত দালানকোঠার ভীড়ে শীত আসলে পাশ কাটিয়ে আসতে পারে না। তার মোটা শরীর নিয়ে মাঝখানেই আটকে যায়। তাই তো শীতের কথা আজকাল খুব মনে পড়ে। মনে হয়, এই অসহ্য উত্তাপের পরে এবার একটু শীতলতার খুব প্রয়োজন। আর কত সময় সেই মহান সময়ের অপেক্ষা করতে হবে কে জানে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মোহনার চুল শুকানো হয়ে গিয়েছে। সে রুমে এসে মুখে অল্প একটু ক্রিম মাখে। তারপর ওড়না টা গায়ে জড়িয়ে ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। গেইটে তালা দিয়ে বাইরে বের হয়ে মোহনা রিক্সা খুঁজতে লাগে। এই ভর দুপুরে সে তেমন কোনো রিক্সা’ই দেখছে না। অনেক্ষণ সে তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। পরে কোনো রিক্সার হদিস না পেয়ে পায়ে হেঁটেই সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। প্রায় পনেরো মিনিট হাঁটার পর সে থামল। সূর্যের তাপে ঘেমে একাকার। আর হাঁটতেও ইচ্ছে করছে না। দূর থেকে একটা রিক্সা আসতে দেখে মনে মনে ভীষণ খুশি হয়ে হয় সে। তবে তার সেই খুশী বেশিক্ষণ টিকে না। রিক্সাটা একটু কাছে আসার পরই মোহনা বুঝতে পারে এতে মানুষ আছে। হতাশ হয়ে পড়ে সে। মন খারাপ করে সাইড হয়ে দাঁড়ায়। রিক্সাটা তার কাছে এসেই থামে। মোহনা ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখে রিক্সায় আর কেউ না লরিন। তাকে দেখে মোহনা দুই হাত বুকের উপর ভাঁজ করে বিরক্ত সুরে বলে,

‘আপনি?’

‘হ্যাঁ, উঠে পড়।’

‘না, আমি আপনার সাথে যাব না।’

‘শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে? এখানে এখন কোনো‌ গাড়ি পাবে না। চল আমার সাথে, ঠোমাকে আমি নামিয়ে দিয়ে চলে যাব।’

মোহনা ভেবে আর কোনো উপায় বের করতে পারল না। লরিনের সাথে না গেলে তাকে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে লরিনের পাশে রিক্সায় উঠে বসল সে। রিক্সা অতঃপর চলতে আরম্ভ করল।

দুজনেই খুব চুপচাপ। ফাঁকা রাস্তায় খুব একটা গাড়ি নেই। মেশিনের রিক্সাটা তাই খুব ছুটছে। মোহনা খোলা চুল বাতাসের তালে তালে যেন এক নৃত্য তে মেতেছে। একপাশের চুল বারবার লরিনের মুখের উপর গিয়ে পড়ছে। মোহনা সেগুলো কে দ্রুত গুছিয়ে নিলেও বাতাসের বেগে সে আটকাতে পারছে না। এক পর্যায়ে চুলগুলো সব একপাশে নিয়ে এল। লরিন তখন ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘চুলগুলোকেও কি একটু স্বাধীনতা দেওয়া যায় না?’

মোহনা বুঝল না। প্রশ্নসূচক দৃষ্টি তে তাকালে লরিন বলে,

‘বুঝনি? থাক আর বুঝতে হবে না।’

মোহনা কিছুক্ষণ বিরক্ত চোখে চেয়ে থেকে চোখ সরাল। লরিন পুনরায় বলল,

‘আচ্ছা, ঠোমার বাবার এক্সিডেন্ট কীভাবে হয়েছিল?’

‘জানি না, এই ব্যাপারে এখনো বাবার সাথে কথা হয়নি।’

লরিন আর কোনো প্রশ্ন করল না। রিক্সা তার গন্তব্যে এসে থামে। মোহনা নেমে এবার জোর করেই ভাড়া টা দিয়ে দেয়। এতে লরিন খুব রেগে যায়। সে আর সেই রিক্সা দিয়ে যায় না। মোহনার সাথে কোনো কথা না বলেই সোজা রাস্তায় হাঁটা ধরে। লরিনের এমন ব্যবহারে মোহনা খুব অবাক হলেও ব্যাপারটা খুব একটা আমলে নিল না নিয়ে সে ভেতরে চলে যায়।

মোহনা কেবিনে গিয়ে দেখল তার বাবা খেয়ে দেয়ে ঘুমাচ্ছে। মা আর বোন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল, সে আসলে এক সঙ্গে খাবে বলে।

খাওয়া শেষ করে মোহনা মা’কে সাহায্য করে সবকিছু গোছাতে। কাজ করতে করতেই মা’কে সে জিজ্ঞেস করে,

‘আম্মু, বাবার এক্সিডেন্ট টা কীভাবে হয়েছিল? বাবা কিছু বলেছে?’

‘হু, রিক্সা দিয়ে বাস স্টেশনে যাওয়ার সময় নাকি একটা ছোট ট্রাক এসে পেছন দিয়ে জোরে ধাক্কা দেয়। তোর বাবা তাল সামলাতে না পেরে ডিরেক্ট গিয়ে রাস্তায় পড়েন। অত জোরে পড়ার কারণে মাথায় অনেক ব্যাথা পান। রাস্তাতেই নাকি অনেক রক্ত গিয়েছে। পরে সেই রিক্সাওয়ালা সহ আরো কিছু লোক উনাকে হসপিটালে নিয়ে আসেন।’

‘আর ঐ ট্রাক ড্রাইভার? ওকে কেউ ধরতে পারেনি? ও কেন ধাক্কা দিল?’

‘সেকি আর দাঁড়িয়েছে নাকি? ধাক্কা দিয়েই তো পালিয়ে গিয়েছে।’

‘ওর নামে মামলা করতে হবে আম্মু। এভাবে কে গাড়ি চালায়? দেখে শুনে চালাবে না? আমি ওর নামে থানায় মামলা করব।’

‘থাক মা, এখন আর এত ঝামেলা করে কোনো লাভ হবে না। আল্লাহ যে তোমার বাবাকে সুস্থ করে দিয়েছেন সেটাই আমাদের জন্য অনেক।’

মোহনার সেই ট্রাক ড্রাইভারের উপর খুব রাগ হয়। সামনে পেলে হয়তো খুব কেলানি দিত। ঐ লোকের ছোট্ট ভুলের জন্য আরেকটু হলেই তো সে তার বাবাকে একেবারের জন্যই হারিয়ে ফেলছিল। কী ভয়ানক ব্যাপার, ভাবতেই তো বুকে মোচড় দিয়ে উঠে তার।

________________________________________

পরদিন মাহবুব সাহেবকে নিয়ে হসপিটাল থেকে সবাই বাসায় ফিরে। এশা আর রাফাতের সাথে সেখানে লরিনও ছিল। যাকে মোহনা একটু পরপর চোখ রাঙিয়ে বলছিল বাসা থেকে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু লরিন তার বাবার সাথে যে আড্ডা জুড়িয়েছে মনে হচ্ছে না সে এত সহজে যাবে। মোহনার যেমন এতে বিরক্ত লাগছে অন্যদিকে আবার ভয়ও করছে। হুট করে লরিন আবার সবকিছু বলে না দেয়। ওর যা ঠোঁট কাটা স্বভাব, ভুল করেও যদি কিছু বলে ফেলে তাহলেই মোহনা শেষ।

চলবে….#প্রণয়_রখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৫.

একসঙ্গে সবাই দুপুরের খাওয়া দাওয়া করেছে। সকাল থেকে দুপুর এই পুরোটা মোহনা বেশ বিস্ময় নিয়ে লরিন কে দেখছিল। লরিনের ব্যবহারে যেন সে ক্রমে ক্রমে কেবল মুগ্ধই হচ্ছিল। ছেলেটা কী সুন্দর ভাবে সবার সাথে মিশে গিয়েছে। যেন এটা তারই পরিবার। মাহিয়ার সাথে সেকি তার দুষ্টুমি। তার গম্ভীর আর রাগী বাবাটাও যেন লরিনকে বেশ পছন্দ করলেন। এত সহজে আজ অবধি কেউ উনার পছন্দের পাত্র হতে পারেনি। তবে লরিন ক্ষণিকের মাঝেই তার সুহৃদ হয়ে উঠল।

খাওয়া দাওয়া শেষ ড্রয়িং রুমে গিয়ে আবার সবাই বসল। মোহনা তখন ড্রয়িং রুমের দরজার সামনে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে লরিন কী করছে। দেখল, তাদের আড্ডা আবারও জমে উঠেছে। মোহনা লরিনকে ইশারা দিতে চাইল। কিন্তু লরিন তার খোশগল্পে এত ব্যস্ত যে মোহনা কে দেখার সময় কই তার। বাবার সামনে জোরে যে ডাকবে সেই সুযোগও পাচ্ছে না। পেছন থেকে এশা এসে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘কিরে, বেটা তো তার শ্বশুর মশাইকে ভালোই হাত করে নিচ্ছে।’

মোহনা চোখ রাঙিয়ে বলে,

‘বাজে বকিস না না তো। এই রাফাতকে মেসেজ দিয়ে আমার রুমে আসতে বল।’

‘উমা, এখান থেকে ডাকলেই তো হয়।’

‘না, বাবার সামনে এখন ডাকা যাবে না। তুই ওকে মেসেজ দে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে, দিচ্ছি।’

এশা রাফাতকে মেসেজ দিলেও রাফাত সেটা সিন করল না। ফোন তো তার হাতে নেই, পকেটে। সেও এখন বেশ আড্ডায় মেতেছে। ছেলে মানুষ, খেলা বিষয়ক আলোচনা বেশ পছন্দ করে।

মোহনাও দরজার সামনে থেকে নড়ছে না। আড়াল থেকে তাদের সব কথা বার্তা শোনার চেষ্টা করছে। কথা তালে তালেই মোহনার বাবা হঠাৎ লরিন কে জিজ্ঞেস করলেন,

‘তোমাদের দেশে এত ইউনিভার্সিটি থাকতে তুমি এখানে এসে কেন ভর্তি হলে? আমি তো আরো ভাবছিলাম মোহনাকে মাস্টার্স এর জন্য লন্ডন পাঠাব। তোমাদের এখানের “ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন” তো বেশ ভালো পড়াশোনার জন্য। আমার তো খুব ইচ্ছা মোহনাকে এটাতেই ভর্তি করব। অনার্সেই ইচ্ছে ছিল তবে কোনো কারণবশত হয়ে উঠেনি। তা তুমি এত ভালো ভালো ইউনিভার্সিটি ছেড়ে এখানে এলে যে? তোমার মা বাবা কেউ কি বাংলাদেশি?’

বাবার প্রশ্ন শুনে মোহনার পিলে চমকে উঠে। এখনই সব সত্য বেরিয়ে যাবে। এই হাঁদারাম সব সত্যি বলে দিবে নিশ্চিত। এখনই একে না সরালে কেল্লা ফতে। মোহনা আর দেরি না করে এক ছুটে রুমে ঢুকে পড়ে। কী বলবে কী বলবে ভাবতে ভাবতে বলে,

‘লরিন…লরিন ভাইয়া, আপনার না চারটার দিকে একটা ক্লাস আছে? ঐ দেখুন চারটা বাজতে চলল, আপনার এখনই যাওয়া উচিত। নাহলে ক্লাস মিস হয়ে যাবে।’

লরিন হতভম্ব। সে ঠিক শুনছে তো? মোহনা তাকে ভাইয়া বলেছে? সিরিয়াসলি? লরিনের চোখে মুখে আষাঢ়ের মেঘ জমতে শুরু করে। এত বিষন্ন তাকে আগে কখনো দেখা যায়নি। সে যেন এটা হজম করতে পারছে না। মোহনা তাকে বাসা থেকে বের করার জন্য শেষ পর্যন্ত ভাইও ডাকল। ব্যাপারটাই লরিনের খুবই মনক্ষুন্ন হলো। সে সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ওহ হ্যাঁ, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আংকেল, আমার এখন একটা ক্লাস আছে, আমার তাই যেতে হবে। আপনি আপনার খেয়াল রাখবেন। আসি। আসসালামু আলাইকুম।’

তারপর সে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মোহনার দিকে একবার চেয়ে বলল,

‘আন্টিকেও আমার সালাম দিও।’

তারপর সে আর দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে বেরিয়ে গেল। আশ্চর্য! মোহনা বোকার মতো চেয়ে রইল কেবল। কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতে তার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। ছেলেটা তার উপর আবারও ক্ষেপেছে। কিন্তু এখানে তার কী দোষ। সে তাকে এভাবে বিদায় না করলে তো এক্ষুণি সব ফাঁস হয়ে যেত। তবে ভাইয়া ডাকটা সত্যিই বেচারার একেবারে কলিজায় গিয়ে লেগেছে। সেও তো কম হাঁদারাম না, একবার বুঝল না বাবা সামনে বলে ভাইয়া ডেকেছে।

মোহনা জোরে নিশ্বাস ছাড়ে। যাকগে, ও যা খুশি ভাবুক তাতে তার কী।

মোহনা চলে আসতে নিলে মাহবুব সাহেব তাকে ডাকলেন। মোহনা ফিরে বলল,

‘বাবা, কিছু বলবে?’

মাহবুব সাহেব গম্ভীর সুরে বললেন,

‘ছেলেটা কে তো এক কাপ চাও খেতে দিলে না, এত তাড়া দিয়ে বের করে দিলে কেন?’

মোহনা ইতস্তত কন্ঠে বলল,

‘বাবা, আমি উনাকে তাড়া দেইনি তো। উনার এখন ক্লাস আছে, সেটাই বলেছি শুধু। ক্লাসটা বোধ হয় খুব জরুরি ছিল, তাই হয়তো নিজেই এত তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছেন। সমস্যা নেই, আবার অন্য একদিন আসতে বলবনি।’

‘ঠিক আছে।’

রুমে ফিরে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মোহনা। উফ, বাবাও যেভাবে প্রশ্ন করে তার তো দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। সে বিছানায় গিয়ে এশার পাশে বসল। তখনই মাহিয়া বেলকনি থেকে ছুটে এসে রাগ দেখিয়ে বলতে লাগল,

‘ভাইয়া আরেকটু থাকলে কী হতো, হে?’

মোহনা ধমক দিয়ে বলল,

‘এত ভাইয়া ভাইয়া করছিস কেন? মনে হচ্ছে যেন ও তোর মায়ের পেটের ভাই।’

মাহিয়া নাক মুখ ফুলিয়ে অভিমানের সুরে বলল,

‘মায়ের পেটের ভাই হলে ভালোই হতো। ভাইয়া খুব ভালো। তোমার মতো এত ঝগড়াটে না। কী সুন্দর করে কথা বলে। একটুও রাগ নেই।’

‘আহা, প্রথম দেখাতেই এত কিছু বুঝে গেলি? শোন, অপরিচিত মানুষের সাথে সবাই এমন সুন্দর করে কথা বলে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো তুই যদি ওর বোন হতি তাহলে তুই জীবনেও ওর এত প্রশংসা করতে পারতি না। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের নিজের ভাই বোন ব্যতিত পৃথিবীর অন্য সব ভাই বোনকে পছন্দ করে। আর কী, ওর রাগ নেই বলছিলি? বেটা নিমচা শয়তান। যত শয়তানি পেটে পেটে। মানুষের সামনে একেবারে দুধে ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে যায়।’

মাহিয়া খুব রাগ দেখিয়ে বিছানার অপর প্রান্তে গিয়ে বসল। ফ্যাচফ্যাচ করতে করতে বলল,

‘হ্যাঁ, যেন উনিই খুব ভালো। পৃথিবীতে আর কোনো ভালো মানুষ নেই। বেচারা ভাইয়ার মুখটা কী চুপসে ছিল। জানো, নিচ থেকে আমাকে হাত নাড়িয়ে বাই বলেছে। হাসি আসছিল না তাও আমাকে দেখে জোর করে হেসেছে। তুমি নিশ্চয়ই ভাইয়াকে খুব কষ্ট দিয়েছ তাই ভাইয়ার মুখটা অমন হয়ে গিয়েছে।’

বোনের ক্যাচাল শুনতে শুনতে মোহনা বিরক্ত হয়ে কানে হাত দিয়ে বসে। উফ, মেয়েটার মায়া যেন উপচে পড়ছে। কই এত মায়া তো কোনোদিন তার জন্যও দেখায়নি। আজ লরিনের জন্য যেন বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। যতসব অদ্ভুত বিষয়!

.

বিকেলের দিকে এশা আর রাফাতও তাদের বাড়িতে ফিয়ে যায়। ওরা চলে যাওয়ার পর মোহনা আর মাহিয়া ঘুমিয়ে পড়ে। বেশ অনেকটা সময় দুজনে ঘুমায়। প্রায় রাত আটটার দিকে তাদের ঘুমের ইতি ঘটে। মাহিয়া একটু আগেই উঠে যায়। সে ঘুম থেকে উঠেই মোহনার ফোনটা আস্তে করে হাতে নেয়। গোপনে ভাবে কিছু একটা করবে। কিন্তু তার সেই উদ্দেশ্য সফল হবার আগেই মোহনার ঘুম ভেঙে যায়। তাকে দেখেই মাহিয়া দ্রুত ফোনটা রেখে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। মোহনাও আর ঘুমের ঘোরে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি।

_______________

রাতের খাবার শেষ করে মাহবুব সাহেব সকলকে তার রুমে যেতে বললেন। কী যেন জরুরি কথা বলবেন। তার আদেশ মতো সবাই তার রুমে গেল। মাহবুব সাহেব বিছানায় হেলান দিয়ে বসলেন। তার হাত পায়ের ব্যান্ডেজ খোলা হলেও মাথার টা এখনো খোলা হয়নি। মাহিয়া আর মোহনা বাবার পায়ের নিচে বসল। তাদের মা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে কাপড় ভাঁজ করছিলেন। মাহবুব সাহেব কিছুক্ষণ ভাবুক মনে বসে থেকে অতঃপর বললেন,

‘মোহনা, কাল কি তোমার ক্লাস আছে?’

‘জি বাবা, আছে তো।’

‘কালকে তোমার ভার্সিটিতে যাওয়ার দরকার নেই।’

মোহনা বেশ অবাক হলো। বাবা তাকে ভার্সিটিতে যেতে বারণ করছে? সে বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘কেন বাবা? কাল কি কিছু আছে?’

‘হ্যাঁ, কাল আমাদের বাসায় মেহমান আসবেন। তুমি কাল বাসায়ই থেকো, মা’কে কাজে সাহায্য করতে পারবে।’

মাহিয়া ভীষণ উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘কারা আসবেন বাবা?’

‘তোমার অরূপ ভাইয়া আর তার মা বাবা।’

মাহিয়া খুব খুশি হলো। অরূপ ভাইয়া তাকে ভীষণ ভালোবাসে। বিদেশ থেকে আসার সময় নিশ্চয়ই তার জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসেছে। সে তো সেই খুশিতে আজ রাতে আর ঘুমাতে পারবে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here