#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১২.
রাতে কেবল একটা স্যুপ’ই মাহবুব সাহেব কে দেওয়া হলো। বেশি ভারী খাবার তিনি আপাতত খেতে পারবেন না। মাহিয়ার এতে খুব মনক্ষুন্ন হলো। ঐটুকু একটা স্যুপে কি আর কারো পেট ভরে? বাবার মতো এমন বলিষ্ঠ দেহী মানুষদের সুস্থ থাকার জন্য আরো বেশি খাবারের প্রয়োজন, ডাক্তাররা কি এসব বোঝেন না? মাহিয়ার অভিযোগের আর অন্ত নেই। মাহবুব সাহেব এই শরীরেও মেয়ের কথা শুনে প্রসন্ন হাসলেন। বাবার পেট ভরল না বলে মেয়ের কত কষ্ট। আহ, মেয়ের কী চিন্তা, কী ভালোবাসা!
মোহনা দেখে দেখে বাবাকে ঔষধ খাইয়ে দিল। রাতে তাদের একটা বড়ো কেবিনে শিফট করা হলো। মাহবুব সাহেব সারাদিনের অসুস্থতায় ঘুমিয়ে পড়লেন। এতক্ষণ মোহনা মাহিয়া আর তাদের মা কেবিনেই ছিল। মাহবুব সাহেব ঘুমিয়ে পড়ায় এখন তারা কেবিনের বাইরে বেরিয়েছে। বাইরে এশা রাফাতের সাথে দূরে একটা বেঞ্চে লরিনও বসে আছে। লরিন কে দেখেই মোহনা তার কাছে যায়। গিয়ে বলে,
‘আপনি এখনো যাননি কেন?’
‘ঠোমার বাবা ঘুমিয়েছেন?’
‘জ্বি, কিন্তু আপনি এখনো এখানে বসে আছেন যে? আপনি হোটেলে ফিরে যান। আপনারও রেস্ট প্রয়োজন।’
‘না না, আমি ঠিক আছি। ঠোমরা তো কিছু খাওনি তাই না? আমি খাবার নিয়ে এসেছি সবার জন্য। এগুলো খেয়ে নিও।’
এই বলে লরিন মোহনার দিকে খাবারের প্যাকেটগুলো এগিয়ে দিল। মোহনা যেন কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। লরিন কখন গিয়ে খাবার আনল তার কোনো ধারণা নেই। সে ইতস্তত করছে খাবারের প্যাকেটগুলো নিবে কী নিবে না। এশা পেছন থেকে এসে বলল,
‘কী হলো নে।’
মোহনা এশার দিকে তাকালে এশা তাকে ইশারা দিয়ে আশ্বস্ত করে। মোহনা প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে বলে,
‘ধন্যবাদ। তবে খাবার না আনলেও চলতো। আমরা ক্যান্টিনে খেয়ে নিতে পারতাম। তবে কষ্ট করে আনার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনি খেয়েছেন?’
লরিন মাথা নাড়িয়ে না করল। মোহনা বলল,
‘চলুন, আমাদের সাথে খেয়ে নিবেন।’
লরিন খুশি হলো। তার ক্ষুদ্র মন যেন এইটুকু আহ্বানেই বারবার প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে। এই আহ্বানে আনন্দ আছে, আছে ভালোলাগা। লরিন তার পেছন পেছন গেল। মোহনা মা’র কাছে গিয়ে বলল,
‘আম্মু দেখো, লরিন আমদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে।’
লায়লা বেগম আরো বেশি কৃতজ্ঞ হয়ে পড়লেন। আপ্লুত কন্ঠে বললেন,
‘আমাদের জন্য আর কত কষ্ট করবে বাবা? এমনিতেই তুমি এতকিছু করলে, তার উপর এত খাবার আনার কী দরকার ছিল?’
লরিন জবাব না দিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিল। তারপর সবাই কেবিনের ভেতরের একটা টেবিলে খেতে বসল। খাবারের প্যাকেটগুলো খুলে মোহনা অবাক হলো খুব। এতসব বাঙালী খাবার লরিন খুঁজে খুঁজে আনল কী করে। সে লরিনের দিকে তাকাতেই লরিন তার বিস্ময় বুঝতে পারে। মোহনা প্রশ্ন করার আগেই তাই সে জবাব দিয়ে উঠে,
‘রাফাতকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওই খাবারগুলো কিনতে আমাখে সাহায্য করেছে।’
মোহনা ম্লান হেসে সবার প্লেটে খাবার বাড়তে লাগল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাফাত আর এশা চলে গেল তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যদিও তারা কেউই যেতে চাচ্ছিল না তবে মোহনা তাদের জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছে। কেবিনের ভেতরে আরেকটা বেডে মাহিয়া আর তার মা শুয়ে পড়েছে। মোহনা একটা সোফায় কিছুক্ষণ শুয়েছিল। তবে তার ঘুম আসছিল না। উঠে আস্তে আস্তে বাইরে বের হলো সে। যদিও এখন অনেক রাত। তবে হসপিটালের বাইরের পরিবেশ যেন অন্য কথা বলছে। বাইরে এখনো বেশ মানুষ এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছেন। বেশ কিছু ডাক্তার নিজস্ব পেশেন্ট দেখায় ব্যস্ত হয়ে আছেন। এর মাঝেই মোহনা বাইরে লম্বা বারান্দায় হাঁটতে লাগল। কিছুটা সামনে যেতেই সে থেমে যায়। দূর থেকে লরিন কে আসতে দেখে কপালে চওড়া ভাঁজ ফেলে। লরিনের হতে ধোঁয়া উঠা ওয়ান টাইম কফির গ্লাসটা তো অন্য সুর গাইছে। তারমানে লরিন এতক্ষণ এইখানেই ছিল, সে হোটেলে ফিরে যায়নি? লরিন আরো কিছুটা পথ এগিয়ে এসেই মোহনা কে দেখে থমকে দাঁড়ায় তারপর মুচকি হেসে আবারও সামনের দিকে এগুতে থাকে। মোহনার একেবারে কাছে আসার পর মোহনা বিচেলিত গলায় বলে উঠে,
‘আপনি এখনও যাননি?’
‘না।’
‘কেন?’
‘সবাই চলে গেলে এখানে কে ঠাকবে?’
মোহনা বলল,
‘আমরা আছি তো।’
‘তাও মনে হলো আমার ঠাকার প্রয়োজন। তাই ঠেকেছি।’
এই বলে সে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল। তার পেছন পেছন মোহনাও গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
‘আপনার হোটেলে ফিরে যাওয়া উচিত লরিন। আমরা সবাই এখানে আছি। কোনো অসুবিধা হলে আমি আপনাকে বলবো। আপাতত আপনি ফিরে যান।’
লরিন চোখ উপরে করে চেয়ে বলল,
‘আমার এখানে ঠাকাতে ঠোমার এত কিসের আপত্তি? আমি তো আর ঠোমাকে বিরক্ত করছি না। ঠুমি বরং কেবিনে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়, ঠোমার এখন রেস্টের প্রয়োজন।’
মোহনা ঈষৎ চটে গেল। বলল,
‘আপনারও রেস্টের প্রয়োজন মি. ডানিয়েল লরিন। এখানে বসে বসে কফি খেয়ে ঘুমের বারোটা না বাজিয়ে হোটেলে ফিরে গিয়ে একটা ঘুম দেন। তারপর না হয় কাল সকালে এসে আবার দেখা করে যাবেন। আর এটাতেই আপনার ভালো, বুঝেছেন?’
‘আমার ভালো ঠুমি বুঝবে না। থাক বাড দাও, কফি খাবে?’
মোহনা কোমরে হাত দিয়ে জোরে শ্বাস টানল। তা দেখে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল লরিন। লরিনের হাসিতে মোহনা কেমন বিব্রত বোধ করল। তাই সে কোমর থেকে হাত সরিয়ে বলল,
‘হাসছেন কেন?’
‘You are just looking a angry bird. My angry bird.’
এই বলে সে কফির কাপে চুমুক দেয়। মোহনা অবাক চিত্তে ভাবতে থাকে, ছেলেটা বাঙালী না হয়ে বড্ড ভুল করে ফেলেছে। যদি সে বাঙালী হতো তবে একটা খাঁটি প্রেমিক পুরুষ হতে পারতো। দেবদাসের মতো কঠিন হতো তার সেই প্রেম। রবীন্দ্রনাথের মতো তখন তীক্ষ্ণ হতো তার প্রেমের কবিতা। ইশ, বড্ড ভুল করে ফেলেছে সে বাঙালী না হয়ে। তবে মোহনাও হতে পারতো তার একনিষ্ঠ সুদর্শনা, তার কোমল হৃদয়ের প্রেমপূজারী। আহ, কী একটা সুযোগ মিস হয়ে গেল।
মোহনা এক সিট জায়গা ফাঁকা রেখে বসল। কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল। অতঃপর বলল,
‘আপনি কি আজ ঐ ঝুমকোগুলো কিনেছিলেন?’
লরিন তাকাল তার দিকে। ভ্রু খানিক কুঁচকে বলল,
‘ঝুমকা মিনস?’
‘Earing.’
‘ওহ।’
“ওহ” বলে লরিন আবার তার কফি পানে মনোযোগ দিল। মোহনা তাকিয়ে আছে তার জবাবের জন্য। লরিন তাতে পাত্তা না দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে এদিক ওদিক দেখছে আর কফি খাচ্ছে। মোহনা বিরক্ত হয়ে গলা ঝাড়ে। ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি লরিন; উত্তর দিচ্ছেন না কেন?’
লরিন তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আহ্লাদিত কন্ঠে বলল,
‘কফি খাবে?’
মোহনা নাকের পাল্লা ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল। লোকটার সাথে কথা বলাই বৃথা। লরিন মোহনার রাগকে খুব একটা আমলে নিল না। সে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে বলল,
‘আরো দু কাপ কফি আনছি। একসাথে খাবো।’
এই বলেই সে কফি আনতে চলে গেল। আর মোহনা আহাম্মকের মতো চেয়ে তার যাওয়া দেখল। লোকটার কি আজ কফির পিনিক উঠেছে নাকি? খালি কফি কফি করছে কেন, আশ্চর্য!
মোহনার সাথে কফি খেয়ে তবেই হাল ছাড়ল লরিন। সে এবার তৃপ্তির নিশ্বাস ছাড়ল। মোহনার দিকে চেয়ে দেখল তার চোখ মুখ এখনো আগের মতোই বিরক্তের সাগরে ডুবে আছে। মোহনার দুই ভ্রু’র মাঝে কুঁচকে যাওয়া অংশটা যেন খুব নিখুঁত ভাবে তার নিরব রাগটা ফুটিয়ে তুলছে। মেয়েদের এমন নিরব রাগ বেশ সুন্দর। মোহনা এমনিতেই সুন্দর, এখন তাকে আরো সুন্দর লাগছে। লরিন চেয়ে থেকে ম্লান সুরে বলল,
‘ঠুমি খুব সুন্দর মোহনা।’
মোহনা লরিনের দিকে তাকাতেই লরিন অপ্রস্তুত ভঙিতে হাসল। মোহনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আমার সৌন্দর্যের মোহে’ই হয়তো আপনি পড়েছেন।’
লরিন আলতো হেসে বলল,
‘ভালোবাসতে কি সৌন্দর্যের প্রয়োজন হয়?’
মোহনা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
‘জানি না।’
লরিন বলল,
‘মানুষ সুন্দরের প্রেমে পড়ে, আমিও পড়েছি। তবে সেই সৌন্দর্যঠা আত্মিক। আর এই সৌন্দর্য অবিনশ্বর। আর ঠাই আমার প্রেমও অবিনশ্বর।’
মোহনা অবাক হয়ে তাকাল। বলল,
‘এসব কথা আপনাকে কে শিখেয়েছে লরিন? এত কঠিন কথা আপনি কার থেকে শিখলেন?’
চলবে…#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৩.
এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে করতে মোহনা এবার ক্লান্ত। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তার পাশের লোকটা বরাবরের মতোই বেশ নিরব। সে যেন মুখ খুলবে না বলে পণ করেছে। মোহনার এবার রাগ হচ্ছে। একেবারে গা জ্বালানো রাগ। লোকটা কিছু বলছে না কেন? এত প্যারা দেওয়ার কোনো মানেই হয়না। মোহনা চট করে উঠে দাঁড়াল। রেগে গিয়ে বলল,
‘সবকিছুর একটা লিমিট থাকে লরিন। আমার আর এসব সহ্য হচ্ছে না। আপনি এক্ষুণি আপনার হোটেলে ফিরে যান। তারপর সেখান থেকে সব প্যাক করে নিজের দেশে চলে যান। বাংলাদেশে আর একদিনও আপনি থাকতে পারবেন না। আপনি ভীষণ বাজে একটা লোক। আপনাকে এত অনুরোধ করার পরও আপনি আমাকে কিচ্ছু বলতে চাইছেন না। আপনার এইসব কর্মকান্ড আমার আর সহ্য হচ্ছে না। হয় আমাকে এক্ষুণি সব সত্যি বলুন, নয়তো এক্ষুণি এখান থেকে চলে যান।’
এত কথার পরেও লরিনের মাঝে খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে এক পলক তার হাত ঘড়িটার দিকে চেয়ে বলল,
‘দুইটা বাজতে চলল। ঠোমার এখন ঘুমানো উচিত মোহনা।’
মোহনা রেগে বলল,
‘ঘুমাবো না। আপনি আমার কথার জবাব দিন। বলুন, আপনাকে কে সাহায্য করছে? কার কাছ থেকে আপনি আমার সম্পর্কে এত কিছু জেনেছেন? বলুন লরিন, প্লীজ।’
লরিন নরম সুরে জবাব দিল,
‘Calm down mohona. এত হাইপার কেন হচ্ছো? সবকিছুই জানতে পারবে। সময় এলে আমি নিজেই ঠোমাকে সব বলব। এখনই এত উত্তেজিত হইয়ো না। আমি একদিন ঠোমায় সব বলব।’
‘সেই একদিন টা কোনদিন? আমাকে এক্সেক্ট ডেইট বলুন।’
‘Ok fine. সামনে মাসের বারো তারিখ।’
মোহনার কপালে ভাঁজ পড়ল। সে চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘আপনি তাহলে এতদিন এখানে থাকবেন?’
লরিন হেসে বলল,
‘হ্যাঁ।’
মোহনা বিরক্ত হয়ে আবার বসল। লরিন বলল,
‘এবার শান্তি পেয়েছ?’
মোহনা তার দিকে চেয়ে বলল,
‘আপনি ভীষণ বিরক্তিকর একটা মানুষ লরিন।’
‘I know. But you know what, মানুষকে বিরক্ত করাটা একটা আর্ট। এটা সবাই পারে না। আমি পারছি, তার মানে আমি ট্যালেন্টেট।’
‘কচু আপনি।’
‘কচু? what’s that?’
‘কচু মানে আপনার মাথা।’
লরিন মাথায় হাত দিয়ে বলে,
‘কচু মিনস মাথা। মাথা মিনস হেড। ওহ, It means কচু মিনস হেড?’
মোহনা তার মাথায় হাত দিয়ে বসে। কাকে সে কী বলছে। উফফ! লোকটা তাকে পাগল করে তবেই দম ফেলবে। মোহনা জোরে নিশ্বাস টেনে বলে,
‘কচু মিনস নাথিং। কচুর চিন্তা বাদ দিয়ে আপনি এখন ঘুমাতে যান। আর আমাকেও এবার একটু শান্তি দিন।’
লরিন ভাবুক চোখে চেয়ে বলল,
‘শান্টি কোন দোকানে কিনতে পাওয়া যায়? বলো, আমি ঠোমার জন্য কিনে নিয়ে আসি।’
‘মজা করছেন আমার সাথে? আমি কিন্তু একদমই মজার মুডে নেই।’
লরিন হাসল। বলল,
‘ঠুমি সবসময়ই রেগে থাকো। কখনো তো একটু হেসে হেসেও কথা বলতে পারো। বেশি রাগ শরীরের জন্য ভালো নয়।’
‘হয়েছে আপনার বলা? আমি কেবিনে গেলাম। পারলে আপনিও হোটেলে চলে যান। গুড নাইট।’
লরি মৃদু সুরে বলল,
‘গুড নাইট।’
মোহনা তারপর কেবিনে চলে যায়। লরিন কিন্তু যায় না। সে বসে থাকে ঠাঁই। সেখানে বসেই দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই ঘুম তার ভাঙে সকাল দশটায়, কারোর কর্কশ সুরে। তাকিয়ে দেখে তার সামনে মোহনা রণমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। লরিন সোজা হয়ে বসে, তার ভাবখানা বোঝার চেষ্টা করে। মোহনার রেগে যাওয়ার কারণ ঘাটতেই তার মনে পড়ে সে সারারাত এই হসপিটালেই ছিল। আর তার জন্যই মোহনা এই মূর্তি ধারণ করেছে। লরিন তখন প্রসন্ন হাসে। চোখ কচলে উঠে দাঁড়ায়। ভারী স্বরে বলে,
‘কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।’
মোহনা নাক মুখ কুঁচকে বলল,
‘আর মিথ্যে বলতে হবে না। আপনি যে ঘাড়ত্যাড়া সেটা আমি জানি। এখন আর মিথ্যে বলে লাভ নেই। চলুন কেবিনে চলুন; আম্মু ডাকছে।’
মোহনা কেবিনের দিকে পা বাড়ায়। লরিনও তার পেছন পেছন যায়। কেবিনে গিয়ে দেখে এশা আর রাফাতও চলে এসেছে। লরিন অবাক হয়। ওরা দূরে থেকেও এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। আর সে কাছে থেকেও এতক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। কী সাংঘাতিক ঘুম তার!
লায়লা বেগম লরিন কে দেখে বসতে বললেন। রাফাত আসার সময় নাস্তা নিয়ে এসেছে। সবাই এখন নাস্তা খাবে। লরিন ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসে। মাহবুব সাহেব হালকা খাবার খেয়ে রেস্ট নিচ্ছেলেন। এতক্ষণ খেয়াল না করলেও এবার তিনি লরিনকে খেয়াল করলেন। অপরিচিত লাগল তাকে। মাহবুব সাহেব আস্তে করে লায়লা বেগমকে ডাকলেন। লায়লা বেগম কাছে গেলে তিনি তাকে লরিনের কথা জিজ্ঞেস করলেন। লায়লা বেগম বললেন, লরিন মোহনার বন্ধু আরো বললেন সেই তাকে কে রক্ত দিয়ে সাহায্য করেছে। মাহবুব সাহেব বেশ খুশি হলেন। লরিনকে আস্তে করে ডাকলেন। লরিন তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মাহবুব সাহেব নিচু স্বরে বললেন,
‘ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি না থাকলে হয়তো আজ আমার অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যেত। তোমার জন্য অনেক অনেক দোয়া রইল বাবা।’
লরিন খুশি খুশি গলায় বলল,
‘আমি কৃতজ্ঞ আংকেল। আপনার সুস্থতা কামনা করছি।’
মাহবুব সাহেব আলতো হেসে বললেন,
‘আচ্ছা, যাও খেতে বসো।’
সবাই একসাথে বসে সকালের নাস্তা করল। মাহবুব সাহেব বেডে হেলান দিয়ে বসে সবাইকে দেখছিলেন। লরিনকে একটু বেশিই খেয়াল করছিলেন। সে যে বিদেশি সেটা বুঝতে মাহবুব সাহেবের বেশি একটা সময় নিল না। তার কথাবার্তা, তার শারীরিক গঠন খুব সহজেই এটা বুঝিয়ে দেয় যে সে বিদেশি। তাও ছেলেটার মাঝে একটা দেশি দেশি ভাব আছে। কেমন খুব সহজেই মিশে যেতে পারে। মাহবুব সাহেবের মনে বেশ কৌতূহল জাগে ছেলেটার সম্পর্কে আরো কিছু জানার জন্য। মোহনাও কখনো তার এই বন্ধুর সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়নি। নতুন বন্ধুত্ব হয়েছে হয়তো। হ্যাঁ, হয়তো এইজন্যই মোহনা ওকে আপনি আপনি করে সম্বোধন করছে।
.
মোহনা বাবাকে একটা ঔষধ দিয়ে বলল,
‘বাবা, নাও। এই ঔষধটা এখন খেতে হবে।’
মাহবুব সাহেব ঔষধটা খেয়ে নিলেন। রুমে তখন মোহনার বন্ধুরা কেউ নেই। মোহনা ঔষধের প্যাকেট নিয়ে বক্সে রাখছিল। তার বাবা তখন বলল,
‘লরিন কি বিদেশি, মোহনা?’
মোহনা তাকিয়ে ইতস্তত কন্ঠে বলল,
‘হ্যাঁ বাবা, ও বিদেশি।’
‘আচ্ছা। তোমাদের ইউনিভার্সিটিতে পড়ে?’
মোহনা ঢোক গিলে। আবারও মিথ্যে বলতে হবে। তাই আর সাত পাঁচ না ভেবে সে বলে দিল,
‘হ্যাঁ।’
‘তোমরা কি একই ব্যাচের?’
মোহনা মাথা খাটিয়ে বলল,
‘না বাবা, ও আমার এক ব্যাচ সিনিয়র।’
‘ওহহ আচ্ছা। ছেলেটা ভালোই। বিদেশি হলেও খুব সুন্দর বাংলা বলতে পারে। ওর সাথে কথা বলে আমার ভালো লেগেছে।’
মোহনা প্রত্যুত্তরে ম্লান হাসে। বাবা বলেন,
‘কালকে থেকে তো তোমাদের উপরও কম ধকল যাইনি। তাই যাও এখন তোমাদের মা’কে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি এখানে একাই থাকতে পারবো। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।’
‘না বাবা, একসাথে সবার যাওয়ার দরকার নেই। মা আর মাহিয়া এখন যাক। তারপর ওরা এলে আবার আমি যাবো।’
‘আহা, এত ঝামেলা করার কী দরকার। একসাথে যাও একসাথে চলে আসবে। আমি এখানে একা থাকতে পারব।’
ওয়াশরুম থেকে মোহনার মা এসে বললেন,
‘মোহনা যা বলেছে তাই হবে। তোমার একা থাকার দরকার নেই। আমি আর মাহিয়া আগে গিয়ে আসি তারপর মোহনা যাবে।’
মাহবুব সাহেব তর্কে হেরে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মহিলা মানুষ সব এক কথায় থাকলে তখন তর্ক না করে চুপ থাকায় শ্রেয়।
মা আর মাহিয়া বাসায় গেল। মোহনা হসপিটালে একাই। মাহবুব সাহেব চোখ বুজে শুয়ে আছেন। এশা আছে তবে রাফাত কোথাও গিয়েছে। সকালের খাবারের পর মোহনা আর লরিন কে দেখেনি। হয়তো সেও হোটেলে ফিরে গিয়েছে।
কিছুক্ষণ বাদেই লায়লা বেগম আর মাহিয়া ফিরে আসে। মা একেবারে দুপুরের রান্নাবান্না করে নিয়ে এসেছেন। মোহনা এবার বাসার দিকে যায়। সে রিক্সা ডেকে রিক্সায় উঠার সঙ্গে সঙ্গেই কোথ থেকে যেন লরিন এসে হাজির হয়। মোহনা অবাক চিত্তে বলে,
‘আপনি আবার কোথ থেকে এলেন?’
লরিন জবাব না দিয়ে রিক্সায় উঠে তার পাশে বসে পড়ল। মোহনা বড়ো বড়ো চোখ করে বলল,
‘আরে কী হলো?’
লরিন তাকে পাত্তা না দিয়েই রিক্সাওয়ালকে বলল,
‘মামা চলেন..’
চলবে…