প্রণয় রেখা পর্ব -১০+১১

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১০.

মোহনা অত্যন্ত বিস্ময় নিয়ে ভেবে চলছে এই প্যাকেট তাকে কে পাঠিয়েছে। অনেক ভেবে মস্তিষ্কে একটা উত্তর’ই ছুটে এল, “লরিন” নয়তো। মোহনা প্যাকেট টা এবার খুলল। ভেতরে সেই ঝুমকো গুলো দেখে আরেকদফা চমকাল সে। অতি আশ্চর্যের বিষয়! এই প্যাকেট যদি লরিনও দিয়ে থাকে কিন্তু ও বুঝল কী করে যে মোহনার এই ঝুমকোগুলোই পছন্দ হয়েছিল? তবে কি সে মোহনাকে কোনোভাবে ফলো করছে? মোহনা এবার সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চেয়ে দেখল আশে পাশে কেউ আছে কিনা। না, এইদিকে পরিচিত কেউ নেই। সেই বাচ্চাটাকেও আর খুঁজে পেল না সে। এবার এই ঝুমকা নিয়ে কী করবে সেটাই সে বুঝতে পারছে না। কে এইগুলো পাঠিয়েছে সেটাও সে শিউর না। এইগুলো যেমন ছুঁড়ে ফেলে দিতেও পারছে না আবার ব্যাগে করে নিতেও পারছে। উফফ, এতো ঝামেলার উপর মহাঝামেলা। সে বিরক্ত হয়ে ঝুমকোগুলো হাতে নিয়েই বাসার দিকে হেঁটে চলল।

বাসার গেইটের সামনে গিয়ে সে ঝুমকোগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে। বাবার চোখে পড়লে আবার আরেক ঝামেলায় পড়তে হতে পারে, তাই আর সে রিস্ক নিল না। রুমে এসে ফ্রেশ হতে গেল। গোসল থেকে বেরিয়ে বেলকনিতে গেল ভেজা কাপড় নাড়তে। তখন হঠাৎই চোখ গেল, মনে হলো বাইরের দূরের নারকেল গাছটার আড়ালে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। মোহনা চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করল। বোঝার চেষ্টা করল লোকটা কে। অতদূর থেকে চেহারা স্পষ্ট নয় বিধেয় বুঝে উঠতে পারল না। তবে তার কেন যেন মনে হচ্ছে কেউ তার উপর নজর রাখছে। সে কেউ টা লরিন হতে পারে আবার হতে পারে অন্য কেউ।

বেলকনিতে মোহনা বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। তার অস্বস্তির লাগছিল। রুমে এসে সে চুল মুছছে আর তার সাথে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনাগুলো ভেবে যাচ্ছে। কোনোটার সাথে কোনোটা সে মেলাতে পারছে না। সব যেন কেমন গরমিল লাগছে। লরিন কে খুব রহস্যময় লাগছে। আর দিশাকে সন্দেহজনক। আবার এদের মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি আছে কিনা সেটা নিয়েও এখন সে খুব চিন্তিত।

খাওয়া শেষ করে মোহনা আর মাহিয়া রুমে এল। মাহিয়ার মন আজকে ভালো নেই। সে আজকে গণিত স্যারের কাছে খুব বকা খেয়েছে। সহজ একটা অংক সে করতে পারেনি তার জন্য স্যার খুব অপমান করেছে। মাহিয়ার সেটা খুব সম্মানে লেগেছে। না পারলেই কি বকা লাগে? অপমান করা লাগে? মানুষ যে সবসময় সব পারবে এমন তো কোনো কথা নেই। মানুষ মাত্রই ভুল, তারও ভুল হয়েছে। তাই বলে তাকে পুরো ক্লাসের সামনে এত অপমান করবে? এত খারাপ একটা মানুষ কী করে হতে পারে?
মাহিয়া বোনের কাছে একগাদা বিচারের ঝুলি নিয়ে বসেছে। বোন তার কিছু আদৌ শুনছে কিনা সেটাও বোঝা মুশকিল। কিন্তু মাহিয়াও থামার পাত্র না। সেও অনর্গল বলেই যাচ্ছে। স্যারকে যত ধরনের বকা দেয়া যায় সব সে দিয়েছে। তবুও অশান্ত মন তার শান্ত হবার নামই নিচ্ছে না। এক পর্যায়ে হাঁপিয়ে উঠে নিজ থেকেই থেমে যায় সে। এতক্ষণে সে খেয়াল করে মোহনা এসবের কিছুই শুনেনি। সে গালে হাত দিয়ে বসে অন্যদিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। এতে আরো বেশি জ্বলে উঠে মাহিয়া। জোরে চেঁচিয়ে উঠে বলে,

‘তুমি আমার কোনো কথা শুনোনি আপু?’

মোহনা চমকে তাকায়। বলে,

‘তোকে একটা জিনিস দেখাব?’

ভ্রু কুঁচকে মাহিয়া বলে,

‘কী জিনিস?’

মাহিয়া তার ব্যাগটা নিয়ে আসে। প্রথম চেইন খুলে সেই ঝুমকো জোড়া বের করে। সেগুলো দেখে মাহিয়া প্রচন্ড খুশি হয়ে বলে,

‘আমার জন্য এনেছ বুঝি?’

মোহনা কপাল কুঁচকে বলে,

‘আজ্ঞে না। এগুলো কেউ একজন আমাকে দিয়েছে। কিন্তু সে কে সেটা আমি জানিনা।’

‘ও মাই আল্লাহ! তারমানে গোপন প্রেমিক? বাহ, আপু; তোমার এই ছোট্ট জীবনে তুমি সবকিছুই পেলে এই যেমন, দেশি প্রেমিক, বিদেশি প্রেমিক এখন আবার একজন গোপন প্রেমিক। আর কী লাগে তোমার।’

মোহনা চেতে গিয়ে বলে,

‘একটা থাপ্পড় দিব তোকে। আমি কী ঝামেলায় আছি সেটা শুধু আমি বুঝতে পারছি। তুই ছোট, তাই এই ব্যাপারগুলো তুই আবেগের চোখে দেখছিস। কিন্ত এই জিনিসগুলো যে কতটা প্যারাদায়ক সেটা কেবল আমিই জানি। এখন এগুলো নিয়ে কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। কে দিয়েছে সেটাও জানি না। রাখব নাকি ফেলে দিব? এত সুন্দর জিনিস, ফেলে দিতেও মায়া হয়। আবার রাখতে গেলেও মন খচখচ করে। উফফ, কী যে এক জ্বালা।’

‘এক কাজ করো, এইগুলো কাউকে দান করে দাও।’

‘দান আবার কাকে করব?’

‘কেন, আমাকে।’

মোহনা শক্ত চোখে তাকালে মাহিয়া বলে,

‘এভাবে তাকানোর কী আছে? তুমিই তো বললে যে তুমি এটা রাখতেও পারছো না আবার ফেলতেও পারছো না তাই বেটার হবে তুমি এইগুলো আমাকে দিয়ে দাও। তাহলে আর এই নিয়ে তোমার আর এত দুটানায় পড়তে হবে না। ভালো আইডিয়া না, বলো?’

মোহনা জোরে শ্বাস ছেড়ে ঝুমকো গুলো মাহিয়ার হাতে দিয়ে বলল,

‘নে এগুলো তোর। এবার শান্তি?’

মাহিয়া সেগুলো কানে লাগিয়ে বলল,

‘হ্যাঁ। দেখো, কী সুন্দর লাগছে!’
.
.

আজ সন্ধ্যায় মোহনার বাবা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। মাহিয়া একবার খুশি হচ্ছে তো আরেকবার কষ্ট পাচ্ছে। বাবা থাকলে তাকে সারাক্ষণ খুব বকা খেতে হয়, আবার বাবা না থাকলে বাবার জন্য খুব কষ্টও হয়। তবে মোহনার বিকেল থেকেই মন খারাপ। বাবা তাকে খুব বেশি শাসন করলেও বাবার অনুপস্থিতি তাকে খুব কষ্ট দেয়। প্রতিবারই বাবা যাওয়ার সময় সে কাঁদে। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। নিয়মমাফিক বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে খুব কেঁদেছে। আর মাহবুব সাহেবও প্রতিবারের মতোই মেয়েদের একগাদা জ্ঞান দিয়ে কপালে চুমু এঁকে তবেই যাত্রা শুরু করলেন। আবার হয়তো অনেকদিন পর আসবেন। কিন্তু সেটা কতদিন সেটা কেউ নিশ্চিত জানে না।

.

‘এখনও কাঁদছো আপু?’

মোহনা ওড়না কিনারা দিয়ে চোখ মুখ মুছে বলল,

‘কই না তো।’

‘তোমার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি কাঁদছিলে। বাবা তো আবার কিছুদিন পর চলে আসবেন, এত কেঁদো না প্লীজ। তুমি কাঁদলে আমারও কান্না আসে।’

মোহনা হেসে বোনকে টেনে তার পাশে বসাল। বলল,

‘জানিস, ছোটবেলায় তুইও খুব কাঁদতি। একেবারে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতি। তখন তোকে দেখলে আমার কী যে হাসি পেত। তুই খুব সুর টেনে কাঁদতি। কীভাবে যেন, এএএএএ করে জোরে টান দিয়ে..’

মোহনা কথাটা বলে খুব হাসে। মাহিয়া মন খারাপ করে তখন বলে,

‘আগে এত কাঁদতাম, তাহলে এখন কেন বাবার জন্য কাঁদি না? আমার কি বাবার প্রতি মায়া এখন কমে গিয়েছে আপু?’

‘ধুর, তা কেন হবে। মা বাবার প্রতি সন্তানদের মায়া কখনো কমে নাকি? শুধু সেই মায়াটা প্রকাশ করার মাধ্যমটা বদলে যায়। কেউ কেঁদে কেটে সেটা প্রকাশ করে আবার কেউ হেসে হেসে। না কাঁদলেই যে তার কোনো মায়া নেই এমন কোনো কথা নেই। যে মানুষগুলো খুব কম কাঁদে তাদের মায়ার পরিমাণ আরো বেশি হয়ে থাকে। তারা কেবল সেটা প্রকাশ করতে পারে না। ব্যাস শুধু এইটুকুই। এখানে কাঁদা না কাঁদা নিয়ে কোনো পার্থক্য নেই, বুঝেছিস?’

মাহিয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। মোহনা আলতো হেসে বলল,

‘আচ্ছা, তুই বস। আমি একটু চা বানিয়ে আনি, চা খেতে ইচ্ছে করছে।’

মোহনা চা বানাতে যায়। মাহিয়া তখন তার ফোনটা নেয় গেমস খেলার জন্য। কিন্তু গেইম টা ওপেন করার আগেই একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। মাহিয়া কেটে দেয় কলটা। কিন্তু কল আবার আসে। পরপর অনেকগুলো। বিরক্ত হয়ে একপর্যায়ে কল রিসিভ করে। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘হ্যালো, কে বলছেন?’

‘জ্বি, আমি হসপিটাল থেকে বলছি। এখানে একজন বয়স্ক লোক ভর্তি হয়েছেন। আমি উনার ফোন থেকেই এই নাম্বারটা নিয়ে আপনাকে কল করেছি। আসলে উনার একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। তাই আপনাকে এক্ষুণি একবার হসপিটালে আসতে হবে।’

মাহিয়া ক্ষেপে গিয়ে বলল,

‘আমাকে কি বোকা পেয়েছেন, হ্যাঁ? আপনি বলবেন আর আপনার বলা এড্রেসে আমি সুরসুর করে চলে যাবো? আর তারপর আপনি আমাকে কিডন্যাপ করে আমার মা বাবার কাছে মুক্তিপণ দাবি করবেন তাই তো? এসব চালাকি আমার খুব ভালো করে জানা আছে। ফোন রাখেন।’

লোকটি রেগে গিয়ে বলে,

‘আরে আজব তো, কী বলছেন এসব। এক মিনিট দাঁড়ান, আমি উনার শার্টের পকেট থেকে একটা কার্ড পেয়েছি। উনার নাম মেবি মাহবুব রহমান। পল্লি বিদ্যুত অফিসের একজন সিনিয়র কর্মচারী। উনি আপনার কে হোন? উনার ফোনের ডায়েল লিস্টে আমি প্রথমে আপনার নাম্বারটাই পেয়েছি। তাই আপনাকে কল করছি, উনার এক্সিডেন্ট হয়েছে, পারলে এক্ষুণি হসপিটালে আসুন।’

মাহিয়া কিছুক্ষণ থ মেরে থেকে হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে উঠল,

‘আপু, বাবাআআআআ…’

চলবে…#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১১.

লায়লা বেগম হসপিটালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন। মোহনা আর মাহিয়া মা’কে কোনোমতেই শান্ত করতে পারছে না। তাদের নিজেদের মনও খুব একটা শান্ত নয়। কেবল মা’কে দেখিয়ে তারা সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। মাহিয়ার চোখ থেকেও জল পড়ছে। বাবার কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত তার সাদা শার্ট টা নষ্ট করে দিয়েছে। সেই শার্ট টা তার চোখে ভাসছে। বাবার বুজে থাকা চোখগুলো তাকে পীড়া দিচ্ছে। বাবাকে অমন ভাবে দেখাটা তার মস্তিষ্ক মানিয়ে নিতে পারছে না। বুকের ভেতরে ছটফট করছে। মোহনা নিস্তব্ধ নয়নে বাবাকে দেখেছে। এইতো কিছুক্ষণ আগে বাবা তার কপালে চুমু খেয়েছিল। তাকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেছিল। আর এই ক্ষণিক সময়ের ব্যবধানে এত কিছু হয়ে গেল, আশ্চর্য!

অপারেশন থিয়েটার থেকে ডক্টর বেরিয়ে এসে বললেন,

‘পেশেন্টের খুব রক্ত গিয়েছে। উনার এখন ইমারজেন্সি রক্ত প্রয়োজন। আপনাদের মধ্যে কারো রক্তের গ্রুপ কি বি পজেটিভ?’

মোহনা তার মা আর বোনের দিকে তাকাল। তাদের তিনজনেরই রক্তের গ্রুপ এ বি পজেটিভ। মোহনা বলল,

‘না ডাক্তার। আমাদের রক্তের গ্রুপ এ বি পজেটিভ।’

‘তাহলে এক কাজ করুন, আপনাদের পরিচিত কেউ বি পজেটিভ রক্তের থেকে থাকলে তাকে এক্ষুণি আসতে বলুন। আমাদের ব্লাড ব্যাংকে বর্তমানে এই গ্রুপের রক্ত নেই। আর এই দিকে কোনো ব্যাংককেই এই রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। আপনারা একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখুন পান কিনা। পেলে আমাকে জানাবেন।’

মোহনার খুব ভয় করছে। সে কাঁপাকাঁপা হাতে তার ফোন থেকে তার সকল ফ্রেন্ডদের কল দিল। কিন্তু তাদের কারোরই রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ না। ঐদিকে এশা আর রাফাত এসব শোনার পর তারাও রক্ত খুঁজতে লাগল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো এই গ্রুপের রক্ত খুব কম মানুষেরই হয়ে থাকে। তাই এই গ্রুপের রক্ত ম্যানেজ করা খুব কষ্ট সাধ্য।

অনেক খোঁজাখুঁজির পরও মোহনা কোনো রক্তদাতা জোগাড় করতে পারল না। ডাক্তার আবার এল। তাদের তাড়া দিয়ে বলল যা করার একটু তাড়াতাড়ি করতে, পেশেন্টের অবস্থা ভালো নেই। মোহনার মা’র কান্না আরো বেড়ে যায়। মাহিয়াও কাঁদতে আরম্ভ করে। মোহনা কোনো উপায় বের করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়ে। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে তার ছোট কাকার রক্তের গ্রুপ ও বি পজেটিভ। কিন্তু উনি এখন আসতে চাইলেও পারবেন না। এতটা পথ আসতে আসতে অনেক সময় চলে যাবে। ততক্ষণে হয়তো বাবার অবস্থা আরো খারাপের দিকে চলে যাবে। রাফাত আর এশাও হসপিটালে আসে। তারাও যথাসাধ্য চেষ্টা করছে রক্তের জোগান দেওয়ার জন্য। ফেইসবুকেও পোস্ট দিয়েছে। একজন রক্তদাতাও পেয়েছে। কিন্তু তারও হসপিটালের পৌঁছাতে দুই ঘন্টার মতো সময় লাগবে। কিন্তু এত সময় তাদের হাতে নেই।

মোহনা অস্থির হয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করে চলছে। নিজেকে তার বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। বাবার এই কঠিন সময়ে সে বাবাকে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারছে না। কেমন মেয়ে সে, বাবার জন্য সামান্য রক্তের জোগান দিতে পারছে না?

মোহনা অনেক ভেবে মনে হলো, সবাইকেই যখন বলেছে তখন লাস্ট একবার লরিনকেও বলা উচিত। হতেও তো পারে ওর রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ।

মোহনা তাই করল। আর দেরি না করে লরিন কে মেসেঞ্জারে আনব্লক করে কল করল। কয়েকবার কল করার পর কলটা রিসিভ হলো। মোহনা ইতস্তত কন্ঠে বলল,

‘আমাকে একটা সাহায্য করবেন, লরিন?’

‘সাহায্য? Means help?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেমন সাহায্য?’

মোহনা ঢোক গিলে বলল,

‘আপনার ব্লাড গ্রুপ কী?’

লরিন অবাক হলো। বলল,

‘ব্লাড গ্রুপ দিয়ে কী হবে?’

‘আগে বলুন না।’

লরিন বলল,

‘বি পজেটিভ।’

মোহনা যেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। কেঁদে ফেলল সে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

‘লরিন, আপনাকে এক্ষুণি একবার হসপিটালে আসতে হবে। আমার বি পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন। আমার বাবাকে বাঁচাতে হবে। প্লীজ, আমাকে আপনি সাহায্য করুন। আমার বাবাকে এক ব্যাগ রক্ত দিন। প্লীজ লরিন।’

‘ঠিক আছে, আপনি আমাখে ঠিকানা দিন। আমি এখনি আসছি।’

মোহনা ঠিকানা দিল। তারপর ফোন কেটে মা’র কাছে দৌড়ে গেল। বলল,

‘মা, রক্তের জোগান হয়ে গিয়েছে।’

লায়লা বেগম খুশি মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন। এশা আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,

‘লরিন কে কল করেছিলি?’

মোহনা তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল।
.

.

লরিন এল। মোহনা তাকে নিয়ে ডাক্তারের কেবিনে গেল। ডাক্তার প্রথমে তার একটু রক্ত নিয়ে ভালোভাবে টেস্ট করে নিল। টেস্টের সব রিপোর্ট ভালো এসেছে। মোহনা এতে ভীষণ খুশি হয়। ডাক্তার লরিন কে একটা বেডে শুইয়ে তার হাতে ক্যানোলা লাগিয়ে দেন। মোহনা তার পাশেই ছিল। লরিন মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে চেয়ে বলে,

‘ঠোমার বাবার কী হয়েছে?’

মোহনা থমথমে স্বরে বলে,

‘এক্সিডেন্ট।’

‘ও মাই গড। এখন উনি কেমন আছেন?’

‘ভালো নেই। খুব রক্ত গিয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে রক্ত লেগেছে। কোথাও পাচ্ছিলাম না। অবশেষে আল্লাহ আপনাকে পাঠিয়েছেন। ধন্যবাদ লরিন।’

লরিন জবাব দিল না। সে তার হাতের ক্যানোলার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলল,

‘শুধুই ঢন্যবাদ?’

প্রায় এক ঘন্টা পর ডাক্তার কেবিন থেকে বেরিয়ে বললেন,

‘উনার অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। মাথায় পাঁচটা সেলাই লেগেছে। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিলে গিয়েছে, সেগুলো ড্রেসিং করে দিয়েছি। আপাতত উনার জ্ঞান নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো চলে আসবে। আপনারা এখন বাইরেই অপেক্ষা করুন। উনার জ্ঞান ফিরলে নার্স এসে আপনাদের বলবে।’

পাঁচটার সেলাই এর কথা শুনে মাহিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘বাবার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে আপু, তাই না?’

মোহনা ঠোঁট গুঁজ করে মাথা নাড়াল। লায়লা বেগম মাহিয়াকে বুকে টেনে আদর করলেন। তারপর হঠাৎ লরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ওই তো রক্ত দিয়েছে? ও কে মোহনা?’

মোহনা লরিনের দিকে এক পলক চেয়ে বলল,

‘আমার বন্ধু মা।’

লরিন অবাক হলো ভীষণ। বড়ো বড়ো চোখ করে সে মোহনার দিকে তাকাল। লায়লা বেগম তখন লরিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা। তুমি ছিলে বলেই আমার স্বামীর আজ এত বড়ো উপকার হয়েছে। রক্ত না পেলে না জানি কী হতো। তোমার এই ঋণ আমি কোনোদিনও শোধ করতে পারব না।’

লরিন আলতো হেসে বলল,

‘It’s my pleasure aunty. আপনাদের সাহায্য করতে পেরে আমার নিজেরও খুব ভালো লাগছে।’

লায়লা বেগম প্রসন্ন গলায় বললেন,

‘তুমি খুব ভালো ছেলে বাবা। দোয়া করি তুমি অনেক বড়ো হও।’

মোহনা আড়চোখে লরিনের দিকে তাকাল। লরিনের চোখ মুখ খুশিতে যেন ঝলমল করছে। যেন বাংলাদেশে আসা আজ তার স্বার্থক হয়েছে। সে মোহনার দিকে তাকাতেই মোহনা চোখ সরিয়ে ফেলে। লরিন অতঃপর মুচকি হেসে দূরে একটা চেয়ারে গিয়ে আরাম করে বসে।

মাহবুব সাহেবের জ্ঞান ফিরলে একে একে কেবিনে সবাই প্রবেশ করে। জ্ঞান ফিরলেও তিনি এখনো কথা বলার অবস্থাতে নেই। মাথায় উনার খুব আঘাত লেগেছে। তিনি নিষ্পলক চোখে চেয়ে কেবল উনার স্ত্রী আর দুই মেয়েকে দেখছেন। উনাকে ছাড়া এই মানুষগুলো কতটা অসহায়। এই কিছুটা সময়ে একেক জনের চেহারা কেমন হয়ে গিয়েছে। যদি কখনো সত্যি সত্যিই উনি একেবারে হারিয়ে যান তখন এই মানুষগুলোর কী হবে। কীভাবে নিজেদের ওরা সামলে নিবে। আহ, ভাবতেই উনার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। উনি না থাকলে কে এই মানুষগুলোকে আগলে রাখবে? কে?

মাহিয়া কাঁদছে। মোহনা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বাবা ইশারা দিয়ে তাদের কষ্ট পেতে বারণ করে। তাও মাহিয়া কাঁদছে। বাবার ঐ রুক্ষ কঠিন মুখৃটাতে এই নরম অসহায়ত্বের ছোঁয়া তারা মেনে নিতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে। লায়লা বেগমও নিরব চোখে তাকিয়ে আছেন স্বামীর দিকে। এই মানুষটাকে ছাড়া তিনি যে ঠিক কতটা অসহায় এই কিছুটা সময়ে সেটা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।

চলবে…

(পেইজের রিচ একেবারে নেই বললেই চলে। দয়া করে একটু বেশি বেশি কমেন্ট করবেন। কিছু না পেলে স্টিকার কমেন্ট করবেন, তাও চলবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here