প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -১৭

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-১৭

তরী জানালার ধার ঘেঁষে বসে আছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে আর কিছুক্ষণ বাকি। গোধূলির হলুদ আভা ছেয়ে গেছে পুরো প্রকৃতি জুড়ে। জানালা ভেদ করে সেই হলুদ বর্ণ আছড়ে পড়ছে তরীর মুখে, শাড়ির আশেপাশে। হঠাৎ ঘরের আলো জ্ব*লে ওঠায় তরী চমকে উঠলো। পাশে তাকাতেই দেখতে পেল সুজাতাকে। তিনি শুকনো হাসি দিয়ে বললেন,

-“এভাবে ঘর অন্ধকার করে বসে আছিস কেন, মা? মন খারাপ করিস না। তোকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে।”

তরী তড়িৎ গতিতে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো, তার একদম মন খারাপ হয় নি। বাইরে আঙুল দিয়ে ডুবন্ত সূর্যের দিকে দেখিয়ে বোঝালো, সে তো সূর্যাস্ত দেখছিল। হেসে হাত নাড়িয়ে ইশারা করলো, তার ভীষণ ভালো লাগে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখতে।

মিসেস সুজাতা তরীর গালে হাত বুলিয়ে দিলেন। হেসে বললেন,

-“আচ্ছা, বুঝলাম! এখন দেখ তো এই বইগুলো! সৌহার্দ্য যাওয়ার আগে এই বইয়ের নাম দিয়ে আমাকে বলে গেল, তোর জন্য বইগুলো আনিয়ে নিতে। এগুলো দিয়েই হবে? নাকি আরো কোনোটা লাগবে দেখে নে।”

তরী বইগুলো দেখে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে জানালো, আপাতত লাগবে না। সুজাতা পুনরায় সুন্দর করে হেসে বললেন,

-“পরে লাগলেও তোর বলতে হবে না। আমার ছেলে-ই আনিয়ে দিবে, দেখিস! তোর আঁচলে বাঁধা পড়তে খুব বেশি দেরী নেই আমার ছেলের, যা বুঝতে পারছি।”

সুজাতা হাসতে হাসতে চলে গেলেন। তরী কিছুটা অপ্রস্তুত হলো কথাটা শুনে। তবুও বিষয়টা নিয়ে তেমন একটা ভাবলো না। বইগুলো টেবিলে রাখতে গিয়ে সৌহার্দ্যের মোটা মোটা মেডিক্যাল সায়েন্সের বইয়ের ভাঁজে একটা অতি সুন্দর ডায়েরি দেখতে পেল। এতো বইপত্রের মাঝে তরীর নজর ডায়েরিটাতেই ঠেকলো, কারণ জিনিসটা অসাধারণ সুন্দর আর চোখে পড়ার মতোই। তরী সেটা হাতে নিলো। তরীর চোখ চকচক করে উঠলো, যখন সে বুখতে পারলো এটা সৌহার্দ্যের ব্যক্তিগত ডায়েরি। সৌহার্দ্যের মনে ঠিক কী চলছে, সেটা হয়তো এই ডায়েরি থেকে জানা যাবে।

অনেক আশা নিয়ে তরী ডায়েরিটা নিয়ে বসলো পড়ার জন্য। সেটা খুলে দেখলো, প্রথম পৃষ্ঠায় বেশ বড় বড় করে লেখা,

❝প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা❞

তারিখ দেখে বুঝলো, সৌহার্দ্য সেই কৈশোরকাল থেকে এই ডায়েরিটা লিখছে। কিন্তু কয়েকবছর লেখা কন্টিনিউ করার পর সৌহার্দ্য লেখা বন্ধ করে দিয়েছে। ডায়েরির সবগুলো লেখায় তরী চোখ বুলালো। “চাঁদ” ব্যাতিত আর কাউকে নিয়ে একটা শব্দও লিখেনি সৌহার্দ্য এখানে। শেষ লেখাটা বারো বছর আগের। সৌহার্দ্য লিখেছে,

“আমার আকাশ অন্ধকার করে দিয়ে আমার চাঁদ হারিয়ে গেল। চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল। জীবন থেকে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটাকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম। যেখানে চাঁদ-ই নেই, সেখানে পূর্ণিমা আসবে কোত্থেকে? তাহলে কি ‘প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা’র যাত্রায় এখানেই ইতি ঘটলো? হয়তো!”

তরী পরের পৃষ্ঠাগুলো ঘাটলো। বেশ কয়েকটা ফাঁকা পেইজ উল্টে দেখলো, একটা পৃষ্ঠায় দুদিন আগের তারিখ বসিয়েছে সৌহার্দ্য। কিন্তু এখনো কিছু লেখেনি সে। তার মানে সৌহার্দ্য ডায়েরিটা পুনরায় লেখা শুরু করেছে! কী লিখবে সৌহার্দ্য? তরী ডায়েরিটা আগের জায়গায় রেখে মনে মনে ভাবলো, সৌহার্দ্য যা-ই লিখুক, সেটা তাকে জানতে হবে। আর তার জন্য এই ডায়েরিটা তাকে রোজ চেক করতে হবে।

২৮.
সৌহার্দ্য প্রহরের দিকে বেশ রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রহর সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আপনমনে ড্রাইভ করছে।

-“আজ সারাটা দিন আমার ব*র*বা*দ করে কী লাভ হলো তোর? আমি আজকে কতগুলো এপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল করে তোর সাথে দেখাকরতে এসছি, তোর কোনো আইডিয়া আছে? এপয়েন্টমেন্ট গুলো রাতে শিফট করেছি৷ কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে হসপিটালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার বেশ রাত হবে। মানে আমার যতটুকু ফেইম এ কয়দিনে এচিভ করেছি, তোর জন্য সব ব*র*বাদ হবে মনে হচ্ছে।”

সৌহার্দ্য দাঁতে দাঁত চেপে প্রহরকে কথাগুলো বললেও প্রহর সেগুলো গায়েই মাখলো না। সশব্দে হেসে বললো,

-“কাম অন, ইয়ার! আগে তো পুরোই আঁতেল ছিলি! আর এখন কাজ-পাগল।”

বলেই আরো দ্বিগুন শব্দ করে হাসতে লাগলো। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো,

-“কী? আমি আঁতেল ছিলাম?”

-“আজ্ঞে হ্যাঁ! নাকের ডগায় চশমা আর হাতের মধ্যে বই ছাড়া তোকে দেখা-ই যেত না। ডিএমসি-এর অন্যতম পড়ুয়া বালক তো আপনি-ই ছিলেন!”

প্রহর হাসতে হাসতে গাড়ি ব্রেক করলো। ঠোঁটের মাঝে একটা সিগারেট চেপে ধরে লাইটার দিয়ে সেটা জ্বালালো। একটা টান দিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলো, সৌহার্দ্য চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রহর ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বললো, কী?

-“এই অভ্যাস আবার কবে থেকে হলো? টিচিং প্রফেশনে থেকে স্মোক করিস কীভাবে তুই?”

-“ঠিক যেভাবে তুই ডাক্তারি পেশায় থেকে করিস, সেভাবেই! ”

প্রহরের সোজাসাপ্টা উত্তর। সৌহার্দ্য বেশ বিরক্ত হলো। বললো,

-“আমার ব্যাপারটা আলাদা। কিন্তু তোকে এসবে মানায় না। এসব কেন করিস তুই? বাদ দে এসব!”

-“আচ্ছা, বাদ দিলাম। নে, ধর!”

বলেই ঠোঁটের সিগারেটটা সৌহার্দ্যের দিকে এগিয়ে দিলো। সৌহার্দ্য সেটা হাতে নিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো। প্রহর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“তুই কি ছেড়ে দিয়েছিস নাকি স্মোকিং? আই ডোন্ট থিংক সো!”

সৌহার্দ্য রেগে বললো,

-“শাট আপ! এমনি দুপুরে লাঞ্চের কথা বলে দেরী করলি। তারপর পার্কে নিয়ে গেলি, অথচ তুই ভালো করেই জানিস যে, পার্কে কথা বলার পরিবেশ নেই। এখন আবার নিজের বাসায় নিয়ে যাচ্ছিস। তুই যদি মনে করে থাকিস যে, আগের পুরোনো স্মৃতি আমার চোখের সামনে এভাবে তুলে ধরলে আমি তোর করা অন্যায় ভুলে যাবো, তোকে ক্ষমা করে দিবো, তো সে গুড়ে বালি। তুই একটা প্র*তা*র*ক! আর প্র*তা*র*কের কোনো ক্ষমা নেই।”

প্রহর মলিন হাসলো। বললো,

-“অথচ সেই প্র*তা*র*ককেই আজও বিশ্বস্ত মনে হয় তোর। এজন্যই শুধু আমার কাছে এসেছিস আজ, নিজের মনে জমে থাকা সংশয়গুলো দূর করার জন্য। আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করে উঠতে পারিসনি, তাই না? ”

সৌহার্দ্য অপ্রস্তুত হলো। প্রহর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,

-“তোর কথা গায়ে মাখি না আমি। এগুলো বলা-ই স্বাভাবিক। কিন্তু সব কিছুর আড়ালেও একটা সত্য থাকে। সেই সত্যিটা আমি সঠিক সময়েই প্রকাশ করবো।”

প্রহর গাড়ি থেকে নেমে গেল। সৌহার্দ্যও নামলো। প্রহরের কথাগুলোর মানে সে বুঝে উঠতে পারলো না। ওকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারলো না। ভাবতে ভাবতে সৌহার্দ্য প্রহরের পিছু পিছু ওর বাড়িতে ঢুকলো।

-“যেই প্রহরের কিছুই ছিল না, সেই প্রহরের আজ এমন আলিশান বাড়ি-গাড়ির অভাব আর নেই। কিন্তু এতো কিছু থেকেও প্রহরের আজ কিছুই নেই।”

প্রহরের বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে সৌহার্দ্য ড্রয়িং রুমের আশে পাশে তাকালো। বললো,

-“অর্থী, মনিমা- এরা কোথায়? পুরো বাড়ি ফাঁকা কেন?”

প্রহর মলিন হেসে বললো,

-“অর্থী তো কানাডায়! স্কলারশিপে সেখানে পড়তে গেছে দুই বছর আগেই। আর মা…… আছে কোথাও! তুই রুমে এসে বস। ডিনার করেই তো যেতে হবে! আমি একটু ফ্রেস হয়ে আসি।”

সৌহার্দ্য প্রহরের ঘরে গিয়ে বসলো। প্রহর ফ্রেশ হয়ে ওর হাতে এক মগ কফি এনে দিলো। মুখোমুখি বসে বললো,

-“সারাদিন আমার সাথে থেকে নষ্ট করেছিস। সেজন্য সরি বলবো না। আসলে আমি সেজন্য বিন্দুমাত্র দুঃখিত না। হা হা হা!”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো প্রহরের মুখের দিকে। প্রহর হাসি থামিয়ে বললো,

-“আচ্ছা বল! তোর রহস্যময় বউকে নিয়ে কী জানতে পেরেছিস?”

সৌহার্দ্য সিরিয়াস হলো। থমথমে মুখে বললো,

-“চাঁদ বেঁচে আছে, প্রহর। ও মা*রা যায়নি!

প্রহর মুখের ভেতর কফি নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো। সৌহার্দ্য ওর তাকানোর ভঙ্গি দেখে এই সিরিয়াস কথার মাঝেও ফিক করে হেসে দিলো। বললো,

-“তুই একদম বদলাসনি! জোকার কোথাকার! ”

প্রহর একঢোকে কফিটা শেষ করলো। অত্যাশ্চর্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

-“হোয়াট? চাঁদ বেঁচে আছে? কীভাবে? সেদিন ঐ বাড়িটাতে যখন আ*গুন লেগেছিল, তখন তো চাঁদও ঐ বাড়িটার ভেতর ঢুকেছিল! তাহলে ও বেঁচে থাকে কীভাবে?”

-“দারোয়ান বলেছিল যে, চাঁদ আর ওর মা একা ঢুকেছিল৷ কিন্তু আ*গুন নেভানোর পর তো শুধু চাঁদের মায়ের পো*ড়া মৃ*ত দে*হ পাওয়া গিয়েছিল! চাঁদকে পাওয়া যায়নি।”

সৌহার্দ্যের কথা শুনে প্রহর মাথা নাড়ালো। আসলেই পাওয়া যায়নি। বললো,

-“ধারণা করা হয়েছিল যে, চাঁদ অনেক ছোট ছিল। আর ওর দে*হটা এমনভাবে পু*ড়ে*ছি*ল যে, আর খুজে পাওয়া যায়নি। তবে এই যুক্তিটা আমার কাছে নিতান্তই অমূলক লেগেছে। সে যাই-হোক! তুই হঠাৎ চাঁদকে নিয়ে পড়লি কেন?”

সৌহার্দ্য তরীর বাবার কাছ থেকে শোনা সব ঘটনা প্রহরকে খুলে বললো। পকেট থেকে লকেটসহ চেইনটা বের করে দেখিয়ে বললো,

-“এটা চাঁদের গলায় থাকতো সবসময়। এটা যদি ঐ সময় তরীর গলায় পাওয়া গিয়ে থাকে, তার মানেটা কী বুঝতে পারছিস?”

-“তার মানে তরী-ই চাঁদ!”

সৌহার্দ্যের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে প্রহর অবাক কন্ঠে বললো,

-“তাহলে সেদিনের ঘটনার পেছনে কেউ ছিল! এটা সম্পূর্ণ-ই পরিকল্পিত। তরীর মাকে খু*ন করা হয়েছে আর তরীকেও ওভাবে পুঁ*তে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কে আছে এসবের পেছনে? আর ঐদিন দারোয়ান মিথ্যে বলেছিন তাহলে?”

সৌহার্দ্য ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,

-“সবটা জানতে হলে আমাদের ঐ দারোয়ানকে খুজে বের করতে হবে আগে। ও অনেক কিছু জানে। রহস্যভেদ না-হয় ওকে দিয়েই শুরু করা যাক!

-চলবে…….

(পাঠকমহল সবাই রেসপন্স করবে প্রত্যাশা করছি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here