প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -১৮

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-১৮

-“তরীর প্রতি আমার যে সন্দেহ ছিল, ধীরে ধীরে সেটা পাকাপোক্ত হচ্ছে শুধু! আমি প্রথমেই সন্দেহ করেছিলাম যে, ওর আইডেন্টিটিতে অনেক বড় একটা কোয়েশ্চন মার্ক আছে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা খু*ন হয়েছে, যার সবাই তোদের পরিচিত মানুষ। সেই
সন্দেহ থেকেই তরীর প্রতি সংশয় চলে আসে আমার মনে। খোঁজ নিয়ে অনেক কিছু জানতে পারি আমি। আর এটাও জানতে পারি যে, তরী-ই তোর চাঁদ!”

প্রহরের অকপট স্বীকারোক্তি শুনে সৌহার্দ্য চমকালো। বি*স্ফো*রিত চোখে তাকিয়ে বললো,

-“তুই তাহলে আগে থেকেই জানতি সবটা? এজন্যই সারাদিন আমাকে ঘুরিয়েছিস? তাহলে একটু আগে এতো অবাক হলি যে! নাটক ছিল সবটা?”

সৌহার্দ্যের রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে প্রহর কিটকিটিয়ে হেসে দিলো। বললো,

-“তোকে বোকা বানাতে আমার বরাবরই ভাল্লাগে। সবটাই জানি। ইনভেস্টিগেটর আমি। সব খোঁজ খবর রাখতে হয়।”

-“তাহলে আমাকে বললি না কেন? জানিস, প্রথম দিকে তরীর সাথে কতটা রুড বিহেভ করেছি আমি? যদিও ঐটার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তোর আমাকে জানানো উচিত ছিল!”

-“তোকে কেন জানাবো? তুই জেনে কী করবি? এখন বললাম কারণ তুই তো সব জেনেই গিয়েছিস! এখন আর লুকিয়ে কী লাভ? আর তাছাড়া আমি তো জানতাম তুই অরুণীকে ভালোবাসিস! ছোটবেলার ঐ চাঁদ-টাদ ভুলে উড়িয়ে দিয়েছিস। বাই দ্য ওয়ে, অরুণীর ভুত তোর ঘাড় থেকে নামলো কী করে সেটা আমাকে বল?”

প্রহর সন্দিগ্ধ ও প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। সৌহার্দ্য প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বললো,

-“অরুণীর প্রসঙ্গ এখানে এলো কোথা থেকে? ওর বিষয় নিয়ে কিছু বলতে বা শুনতে আসিনি আমি। সো, অফ-টপিক কথাবার্তা বলে টাইম ওয়েস্ট করিস না!”

-“রেগে যাচ্ছিস কেন? আচ্ছা, যা! অরুণীর টপিক বাদ। কাজের কথায় আসি। তুই যে ঐ বাড়ির গার্ডের সাথে কথা বলতে চাইছিস, সেটার ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছি আমি। যদি বেঁচে থেকে থাকে এখনো, তাহলে খুঁজে বের করতে দুই-তিনদিন লাগবে। আচ্ছা, আমাকে সত্যি করে একটা কথা বলবি?”

সৌহার্দ্য প্রহরের অনুমতি চাওয়ার ভঙ্গি দেখে ভ্রু কুঁচকালো। বললো,

-“এভাবে বলার কী আছে? তোকে মিথ্যে বলবো কেন আমি?”

-“তোর চেম্বারে যেদিন খু*নটা হলো, ঐ দিন তরী সত্যিই তোর সাথে ছিল?”

-“এগেইন! তুই আবার তরীকে সন্দেহ করছিস? তোকে বলেছি না? তরী এট-লিস্ট কোনো খু*ন-টুন করতে পারে না! আর ও আমার চাঁদ। ওকে নিয়ে অহেতুক কোনো সন্দেহ মনে পুষিস না। ওর দিকে আঙুল তুললে আমি কাউকে ছেড়ে কথা বলবো না। ইভেন তোকেও না!”

সৌহার্দ্য রেগে হনহন করে বেরিয়ে গেল। প্রহর ওকে পেছন ডেকে বললো,

-“সৌহার্দ্য, দাঁড়া! আরে ডিনারটা তো করে যা, ইয়ার!!”

সৌহার্দ্য শুনলো না। দ্রুতপদে চলে গেল বাসা থেকে। প্রহর আর এগোলো না। নিজের বেডরুমে এসে বেডের পাশের দেয়াল ঢেকে রাখা চাদরটাকে এক টানে সরিয়ে ফেললো। সাথে সাথে দৃশ্যমান হলো মধুর প্রাণবন্ত হাসির এক বিশাল আকৃতির ক্যান্ডিড। প্রহর ছবিটার দিকে এগিয়ে গিয়ে মধুর খোলা উড়ন্ত চুলে হাত বুলালো। হঠাৎ একটা কল এলো প্রহরের ফোনে। ওপাশ থেকে কিছু শুনে প্রহর দ্রুত গতিতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।

মধু টিউশন পড়িয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে এলো। হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো নয়টার ওপরে বেজে গেছে আজকে। তাড়াতাড়ি খোলাচুল গুলো পেছনে ঠেলে হেলমেট পরে নিয়ে স্কুটার স্টার্ট দিলো। মনে মনে বিরক্তি নিয়ে নিজেই নিজেকে বললো,

-“উফ! এতোগুলো পড়া বাকি!! আজও রাত জাগতে হবে, বুঝতে পারছি।”

মধু ঝড়ের গতিতে স্কুটার চালাচ্ছে। হোস্টেলের গলিতে ঢুকতেই মধুর পেছনে দুটো বাইক ধাওয়া করা শুরু করলো।

কয়েক মুহুর্ত পর মধু বুঝতে পারলো যে, বাইক দুটো ওকে ফলো করছে। কারণ ওরা ঠিক মধুর পিছু পিছু আসছে। মধু কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। দুই বাইকে মোট চার-পাঁচ জন আর এদিকে ও একা। ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে পড়ছে বারবার। মধু স্কুটারের স্পিড আরো বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হলো। বাইক দুটো তীব্র গতিতে ওর দুই পাশে চলে এলো।

-“আজই তোমার শেষ দিন! তোমাকে যে ম*রতেই হবে আমাদের হাতে!”

বাইকে থাকা ছেলেগুলো কথাটা বলে শব্দ করে হাসতে লাগলো। রাস্তা পুরো ফাঁকা হওয়ায় মধু কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-“আমাকে মা*রবি? শা*লা কা*পু*রু*ষের দল! সামনাসামনি আঘাত করার সাহস নেই বলেই পেছন থেকে হাম*লা করতে চাস। আজ যদি তোদের ভাগে আনতে পারি না? জাস্ট বাপের নাম ভুলিয়ে দিবো।”

ছেলেগুলো ওর সামনে বাইক থামালো। বাইক থেকে নামার প্রস্তুতি নিতেই ওদের সামনে পুলিশ ফোর্সের গাড়ি গিয়ে থামলো। পুলিশের গাড়ির হেড লাইট দেখে ওরা ঝড়ের বেগে বাইক নিয়ে চলে গেল। পুলিশের গাড়ির পেছনেই প্রহরের গাড়ি থামলো। প্রহর হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে একবারে পুলিশ ফোর্স, আরো একবার মধুর দিকে তাকিয়ে বললো,

-“অল ওকে? কোনো ঝামেলা করতে পারেনি তো ওরা?”

-“ওরা পালিয়ে গেছে, মিস্টার শাহরিয়ার! চেষ্টা করেছিলাম ওদের ধরার। কিন্তু কিছু করতে পারলাম না। ওরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছে।”

পুলিশ প্রহরকে আশ্বস্ত করে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। মধু চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে প্রহরের মুখের দিকে। সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,

-“আপনি আমাকে ফলো করছিলেন?”

প্রহর মলিন হেসে বললো,

-“আর যা-ই হোক, তোমার ক্ষতি তো আর হতে দিতে পারিনা! এজন্যই তোমায় ফলো করেছি, খোঁজ রেখেছি।”

-“তোর এইসব মিষ্টি কথায় আমি কোনোদিনও ভুলবো না। আর ক্ষতি?আমার সবচেয়ে বড় ক্ষতি তো তুই করেছিস! ভুলিনি আমি কিছু-ই!

মধু দ্রুততার সাথে স্কুটার নিয়ে চলে গেল। প্রহর ওর যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো।

২৯.
সৌহার্দ্য তার বাড়ি ফিরলো রাত এগারোটার দিকে। এতো রাত হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু প্রহরের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ইমার্জেন্সি পেশেন্ট দেখার তাগাদা পড়ায় বাড়ি ফিরতে এতো দেরি হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে সৌহার্দ্য অবাক হলো। কারণ পুরো ঘর অন্ধকার। তরীর কোনো খোঁজ নেই। সৌহার্দ্য কয়েক বার তরীর নাম ধরে ডাকলো। কিন্তু তরীর কোনো সাড়াশব্দ নেই। সৌহার্দ্য এবার জোরে জোরে সুজাতাকে ডাকা শুরু করে দিলো।

-“মা! মা!! কোথায় তুমি? এখানে এসো তাড়াতাড়ি! ”

সুজাতা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে সৌহার্দ্যের কাছে এসে বললো,

-“কী হয়েছে? বল! কাজ করছিলাম আমি। আর তুই চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছিস! কী হয়েছেটা কী?”

-“তরী কোথায়?”

-“তরী তো ওর বাবার বাসায় গেছে! ওর বাবা নাকি ওকে ডেকেছে। ড্রাইভার দিয়ে এসেছে ওকে ওর বাড়িতে। ওখানে থাকবে নাকি কয়েকদিন!

সৌহার্দ্য ওর মায়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পরমুহূর্তেই ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

-“আমাকে কিছু না জানিয়ে তরী চলে গেল? আর তুমি ওকে যেতে দিলে? আমাকে না জানিয়ে কেন গিয়েছে ও? তুমি তো অন্তত আমাকে একবার জানাতে পারতে! ডিজগাস্টিং!! ”

সৌহার্দ্য যে কাপড়ে ঘরে ঢুকেছিল, সেই কাপড়েই বেরিয়ে গেল। শুধু হাতে থাকা এপ্রোন ও স্টেথোস্কোপটা ফেলে গেল। সুজাতা পেছন থেকে ডাকলেও শুনলো। তিনি অবাক হয়ে ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন। বুঝতে পারলেন না, তার ছেলে তরীর প্রতি এতো পজেসিভ কবে থেকে হলো!

সৌহার্দ্য যখন তরীদের বাসায় পৌঁছালো, তখন তরীদের বাড়ির গেইটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দারোয়ান চেয়ারে বসে বসে নাক ডাকছে। সৌহার্দ্য গেইটের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে দারোয়ানকে ঝাঁকুনি দিয়ে তার ঘুম ভাঙালো। দারোয়ান হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। সৌহার্দ্যকে দেখে চিনতে পেরে গেইট খুলে দিলো। সৌহার্দ্য তড়িঘড়ি ভেতরে ঢুকে তৃতীয় তলায় চলে গেল সিড়ি বেয়েই।

সৌহার্দ্য কলিং বেল বাজানোর সময় খেয়াল করলো মেইন দরজা খোলা-ই আছে। এতো রাতে দরজা খোলা দেখে সৌহার্দ্য অবাক হলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ড্রয়িং রুমে তরীকে বসে থাকতে দেখলো। কিন্তু তরীকে কিছু বলার আগেই ওর কানে ভেসে উঠলো,

-“তোর বড় তোকে সত্যি সত্যি মেনে নিয়েছে, তরী? তুই আমাকে না জানিয়ে কেন বিয়ে করলি? তোর বিয়ে তো আমার সাথে হওয়ার কথা ছিল!”

-চলবে….

(কাল অনেক বড় একটা পর্ব দিবো। আজ বেশি লিখতে পারিনি বলে অভিযোগ করবেন না কেউ। আগামী পর্বে পুষিয়ে দিবো ইনশাআল্লাহ ♥️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here