প্রণয়িনী,পর্ব:২

প্রণয়িনী
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ২

ছায়ানিকার কানে ভীষণ জ্বালা হচ্ছে তবুও নিজেকে সামলে সে প্রথমে তুলি আর তারপর তুর্জর সামনে চোখে চোখ রেখে জোর গলায় ডাকলো, তারপর হুট করেই হাতের মোবাইলের টর্চটা ফেললো সামনের অচেনা মেয়েটার দিকে… মেয়েটা হুট করেই ঘুরে দৌঁড়াতে লাগলো, আগপিছ না ভেবে ছায়ানিকাও পিছু পিছু দৌঁড় দিলো। বাড়ির পেছনের গেট পেরিয়ে মেয়েটা দৌঁড়ে যাচ্ছে জঙ্গলটার দিকে, চাঁদের আলোয় মেয়েটার আলতা রাঙা পা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট! শুকনো পাতার শব্দ আর মেয়েটার নূপুরের ধ্বনি মিলে যেনো তাল তুলছে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হঠাৎ ছায়ানিকা কিছু একটার ভেতর পড়ে গেলো তারপর, তারপর যেনো সারা পৃথিবীর অন্ধকার তার চোখে ভর করলো আর নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো ছায়নিকার দেহটা!

ভোরের আলো চোখে পড়তেই ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো ছায়ানিকা। নিজেকে একটা গর্তে আবিষ্কার করলো সে! সারা গায়ের জায়গায় জায়গায় চামড়া উঠে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তার উপর মাথায় তীব্র যন্ত্রনা। ভীষণ ইচ্ছে করছে তার খালার কোলে মাথা রেখে আঁদুরে গলায় বলতে, “মাথাটা টিপে দাও না গো মামনি”! কোনোমতে উঠে দাঁড়ালো ছায়ানিকা। ক’টা শুকনো পাতা উড়ে তার চুলে আটকে আছে, তা দেখেই রাতের সেই অদ্ভুত মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেলো তার। মেয়েটির কথা মনে পড়তেই আস্তে আস্তে রাতের সম্পূর্ণ ঘটনা চোখের সামনে ভাসতে লাগলো, কি গা ছমছমে ঘটনাটাই না ছিলো! তার বন্ধুরা… বন্ধুদের কথা মনে পড়তেই তার মনে হলো সে যখন ওই মেয়েটার পেছনে দৌঁড়াচ্ছিলো তখন তাকে পেছন থেকে মিতু আর তুর্জ ডেকেছিলো। বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার পর সে রিদানের চিৎকারও শুনেছিলো! কোনো অঘটন ঘটে যায় নি তো তার বন্ধুদের সঙ্গে, ভাবতে গিয়েই মাথার পেছনে শুকানো রক্ত টের পেলো ছায়ানিকা। তার মাথাটা কি ফেটে গেলো, হয়তো ফেটেছে নতুবা রক্ত আসবে কোথা থেকে! তবে এখন এসব ভাবার সময় নয়, তাকে তার বন্ধুদের কাছে যেতে হবে।

এমন হাজার চিন্তার ভিড়ে যখন ছায়ানিকা ব্যস্ত তখন শুকনো পাতার মড়মড় শব্দ তার কানে এসে লাগলো। কেউ একজন ও দিকেই আসছে, ছায়ানিকা নিজের সমস্ত শক্তি দিয়েই জোরে চিৎকার করলো “বাঁচাও, বাঁচাও” বলে। দু তিনবার ডাকার পরই গর্তের মুখে এসে দাঁড়ালো ছিপছপে গড়নের ফর্সা মতোন এক ছেলে। যদিও তার গায়ের রঙটা কাঁদামেখে পুরো ঢেকে গেছে। ছায়ানিকা অসহায়ের মতো গর্তের ভেতর থেকে হাতটা বাড়িয়ে দিতেই ছেলেটা হেসে দিলো… হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো,

—সকাল সকাল এই জঙ্গলে বুঝি জগিং করতে এসেছিলেন মোহ ম্যাডাম? আপনাকে কখনো দেখতে পাবো ভাবি নি কিন্তু!

মোহ নামটা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেললো ছায়ানিকা, বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,

—আমার নাম মোহ নয়, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে…
—মোহদিঘীর ধারে, একলা জঙ্গলে মায়াজাল এর রানী মোহ আসবেন না তো কে আসবেন!
—মায়াজাল এর রানী! মানে?
—কি অদ্ভুত, এ জঙ্গলে আসার আগে খবর নেন নি? ওই যে বাড়িটা দেখছেন… তার নাম মায়াজাল, আর সে বাড়ির একমাত্র অধিকারিনী মোহ ম্যাডাম। সবাই বলে মৃত্যুর পরও মোহ ম্যাডামের আত্মা ওই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু কেউ দেখেছে কি না জানি না। কারন ও বাড়ির ভেতরে গিয়ে নাকি কেউ ফিরতে পারে নি। তো সকাল সকাল এ ভুত বাড়ির জঙ্গলে আপনার কি?

ছেলেটা গতরাতের বাড়িটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে কথাগুলো বলছিলো, বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল ছায়ানিকার। তার প্রানপ্রিয় বন্ধুদের যে ও বাড়িতেই কাল রাতে ফেলে এসেছিলো সে! ছেলেটি তুড়ি বাজাতেই কেঁপে উঠলো ছায়ানিকা, তার ঘোর কাটলো… ছেলেটি শুয়ে গর্তের ভেতরে ছায়ানিকার দিকে তার একহাত বাড়িয়ে দিলো। ছায়ানিকা চুপচাপ ছেলেটির হাত ধরে উপরে উঠে এলো।

বসে বসে হাপাচ্ছে ছেলেটি, নিজের গায়ের টি-শার্টটায় মুখটা মুছে বিরক্ত সুরে বললো,

—আপনাকে দেখতে যতোটা হালকা মনে হয় সত্যি সত্যি কিন্তু আপনি ততোটা হালকা নন। ওয়েট আছে বস…
—যাস্ট ফিফটি কে.জি.
—তো আপনি সকাল সকাল এ জঙ্গলে যে?
—একই প্রশ্ন আমিও আপনাকে করতে পারি… আপনি সকাল সকাল এখানে কাঁদা মেখে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?
—বুদ্ধি আছে আপনার। আমি বিজয়, আপনি ভালোবেসে জয় ডাকতে পারেন। এখান থেকে আধ ঘন্টার পথ পেরোলে আমার দাদু বাড়ি, আপাতত মোহ দিঘীতে মাছ ধরতে এসেছি। একটা সিক্রেট বলি?
—কি?
—এ বাড়ির ভুতনী মোহ ম্যাডাম বেশ সুন্দরী ছিলেন বুঝলেন? তবে সুন্দরী ভুতনী রাত ছাড়া দিনে তোড়পার করেন না! সে রাতের রানী, রাতেই তার আধিপত্য!

ছায়ানিকার কাছে কথাগুলো মোটেও ভালো লাগছিলো না, সে মাটিতে বসে কেবল ভেবে যাচ্ছে তার বন্ধুদের কথা। না জানি তাদের কি অবস্থা! ছেলেটাকে কোনোমতে ধন্যবাদ দিয়েই উঠে দাঁড়ালো ছায়ানিকা, শরীর চলতে চাইছে না কিন্তু বন্ধুদের চিন্তা তার পায়ের গতি বাড়াতে বাধ্য করছে। ছায়ানিকাকে চলে যেতে দেখে ছেলেটা পেছন থেকে ডেকে বললো,

—আপনার নামটা তো বললেন না ম্যাডাম। কি ডাকবো? মায়া, মোহ নাকি অন্যকিছু?

বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই জিজ্ঞাসু দু’জোড়া চোখের সামনে পড়লো ছায়ানিকা… তুর্জ আর তুলি সোফায় বসে আছে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে, তাদের দৃষ্টিতে স্পষ্ট ভয়। অন্যদিকে রিদান, রাকিব আর রায়ান মেঝেতে পড়ে আছে অচেতন হয়ে। তারা ঘুমাচ্ছে নাকি জ্ঞান হারিয়েছে দেখে বোঝার উপায় নেই। ছায়ানিকাকে দেখেই দৌঁড়ে এলো তুলি, ওকে ধরে বসালো সোফায় তারপর জিজ্ঞেস করলো,

—হুট করে কোথায় চলে গিয়েছিলি কাল রাতে? কতো পিছু ডাকলাম, সাড়া দিলি না কেনো? আর এ কি অবস্থা তোর বলতো?

তুর্জ হুঙ্কার ছেড়ে বললো,

—এসব ভুত খুঁজা এখানেই শেষ। আর কোনো প্রয়োজন নেই, দেখ কি অবস্থা এ তিনটার… কতোবার ডাকলাম নড়ছেই না, এমন মরা ঘুম কেউ ঘুমায়!
—চোখে মুখে পানি দে…

মিনমিন করে বললো ছায়ানিকা, বাধ্য মেয়ের মতো তুলি উঠে গিয়ে রিদান, রাকিব আর রায়ানের চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা উঠে বসলো। বিধ্বস্ত ছায়ানিকার দিকে দৃষ্টি যেতেই রিদান চিৎকার করে বললো,

—কি হয়েছে তোর চিকা? চোখ মুখের এ অবস্থা কেনো? আর এতো জায়গায় ব্যাথা পেলি কি করে?

মেঝেতে অনেকটা হামাগুড়ি দিয়েই ছায়ানিকার কাছে এগিয়ে আসলো রিদান। ওর রক্ত শুকিয়ে থাকা পা টা নিজের কোলে তুলে কাঁটাটা তুললো আলতো হাতে তারপর ছলছল চোখে ছায়ানিকার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

—খুব ব্যাথা লাগছে তোর চিকা?

ফিক করে হেসে দিলো ছায়ানিকা, রিদানের মাথায় গাট্টা মেরে বললো,

—ব্যাটা তোর মাঝে আবেগও আছে? আমি তো ভাবতাম তোর মধ্যে আবেগ ভালোবাসা নেই… না মানে কখনো তো দেখি নি!
—কখনো তো তোকে এ অবস্থাতেও দেখি নি রে ছায়ানিকা!

ছায়ানিকা চমকে রিদানের দিকে তাকালো, এ জীবনে প্রথম তাকে ছায়ানিকা বলে ডেকেছে রিদান। সেই ডাকটাও কেমন ঘোর লাগা, এক নতুন অনুভূতির দমকা হাওয়া আলতো করে ছায়ানিকাকে ছুঁয়ে গেলো। রাকিব আর রায়ান তখনও মাথা ধরে বসে আছে, ছায়ানিকার হঠাৎ খেয়াল হলো গতকাল রাতের মেয়েটির কথা কেউ বলছে না কেনো! ছায়ানিকা নিজেই জিজ্ঞেস করলো,

—মেয়েটাকে দেখছি না যে!

রিদান অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে, সঙ্গে অন্যরাও। রিদান ছায়ানিকার পাশে উঠে বসে ওর জামার ছেঁড়া হাতাটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মুচকি হেসে বললো,

—তোর কি ব্যাথা লাগে না রে চিকা? হাতটা কতোদূর কেটেছে, জামা ছিঁড়ে গেছে অথচ তুই কোন মেয়ের কথা বলে যাচ্ছিস! একটা কথা বলতো, কোথায় গিয়ে নিজের এমন দশা করলি? তোর এতো সাহস আমার একদম ভালো লাগে না।

ছায়ানিকা বুঝলো সে ছাড়া উপস্থিত আর কারও গত রাতের ঘটনা মনে নেই, বললেও বিশেষ লাভ হবে বলে মনে হলো না… তাই চুপ করে থেকেই কিছুক্ষণ জঙ্গলের ছেলেটার কথা ভাবলো সে… কি যেনো নাম, “বিজয়”! ছেলেটা বলেছিলো এ বাড়ির নাম, “মায়াজাল” আর এ বাড়িতে যে থাকতো তার নাম ছিলো মোহ! মোহ এর আত্মা নাকি এ বাড়িতে ঘুরছে, কিন্তু গতকাল রাতের মেয়েটাকে তো তার আত্মা মনে হয় নি!

মন বলছে কাল রাতের ঘটনাটা অলৌকিক কারন এভাবে প্রত্যেকের ঘটনাটা ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। আবার অন্যদিকে মস্তিষ্ক বলছে, ভুত বলতে কিছু নেই… এসব সাজানো, সবই চোখের ধোঁকা। সকালের ছেলেটাও কেমন যেনো! এতো সুন্দর ছেলেটা কি না কাঁদায় মাখামাখি হয়ে মাছ ধরছিলো। মুহূর্তেই উঠে দাঁড়ালো ছায়ানিকা, ব্যাগ হাতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে একটা ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো… অপলক সে দিকে তাকিয়ে রইলো পাঁচ মূর্তি, কি অদ্ভুত আচরনটাই না করলো আজ ছায়ানিকা তাদের সঙ্গে! তারা বন্ধুরা একে অপরের থেকে কিছু লুকোয় না অথচ ছায়ানিকার গম্ভীর দৃষ্টি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে কিছু ভাবছে কিন্তু তা কি! ভেবে পায় না কেউ, সবটা কেমন ধোঁয়াটে হয়ে যাচ্ছে।

মোহদিঘীর সামনের ঘাটলায় দাঁড়িয়ে আছে ছায়ানিকা, ঘাটলার পাশের বসার জায়গায় বসে গল্প করছে রাকিব, রায়ান আর তুলি। তুর্জ দিঘীর পাড়ে এসে যেনো কবি হয়ে গেছে, খাতা কলম হাতে বসে বসে কি ভাবছে কে জানে! রিদান ক্যামেরা হাতে দিঘীর ছবি তোলার পাশাপাশি বন্ধুদের দু-একটা ছবি তুলছে। ছায়ানিকাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিদান এগিয়ে এসে মাথায় গাট্টা মেরে বললো,

—কি রে চিকা… কি ভাবিস?
—ভাবছি এ দিঘির পাড়ের কাঁদায় কারও পায়ের ছাপ নেই কেনো… মানে কেউ দিঘীতে নামলে গায়ে কাঁদা লাগবে, এমনকি কাঁদায় পায়ের ছাপও থাকবে! কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে বহুদিন কেউ এ দিঘীর পাড় দিয়ে নামে নি। ঘাটলাও একেবারে শুকনা।
—বোকার মতো কথা বলিস না তো চিকা, ভুতুড়ে বাড়ির দিঘীতে কে আসবে!

ছায়ানিকা প্রতিত্তর করলো না। বিজয় নামের ছেলেটার শরীরটা সত্যিই তো কাঁদামাখা ছিলো, তার নিজের হাতেও তো কাঁদা লেগেছিলো। তবে দিঘীর কোনো দিকেই তো পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে না, তবে কোনটা ঠিক! আধ ঘন্টা হাঁটার পর নাকি ছেলেটার বাড়ি অথচ গতকাল রাতে আসার সময় রিদান বলছিলো আশেপাশে কোনো মানুষ নেই, পেছনের দিকের জঙ্গল পেরুলেই বড় রাস্তা। তখন হুট করে কথাটা মাথায় না আসলেও এখন ঠিকই মাথায় নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে… মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই কে সত্যি বলছে বা কে মিথ্য… সবাইকেই ঠিক মনে হচ্ছে কিন্তু পর মুহূর্তে মনে হচ্ছে সবাই একত্রে ঠিক হওয়া তো সম্ভব না। তবে কে ঠিক!

সত্যিই কি ছেলেটা দিঘীতে মাছ ধরতে এসেছিলো, নাকি ছেলেটাও গতরাতের মেয়েটির মতোই তার ভ্রম! ভ্রম, হ্যাঁ ভ্রমই তো… নতুবা এখানে উপস্থিত কারও মস্তিষ্কে রাতের মেয়েটির অস্তিত্ব নেই কেনো! কেনো সে একাই গতকাল রাতের মেয়েটি আর সকালের অদ্ভুত ছেলেটির গোলক ধাঁধায় আটকা পড়ে আছে! উত্তর মেলে না ছায়ানিকার, তবে সে মনে মনে নিজেকেই বলে, “অলৌকিক কিছু হয় না ছায়ানিকা, কিছু হয় না। তুমি ভুল ভাবছো, কোনো রহস্য আছে এখানে… নিশ্চয়ই আছে”!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here