প্রণয়িনী পর্ব -১৪

#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|১৪তম পর্ব |

ভোর পাঁচটা বাজে চল্লিশ মিনিট। বাংলা মাসের এখন পৌষ মাস। পৌষ মাস হল বাংলা বছরের নবম মাস। এই মাস শীত ঋতুর অন্তর্গত। শীত ঋতুতে আরেকটি মাস রয়েছে এবং তা হল মাঘ মাস। শীত ঋতু ত্রিশ দিনে গঠিত। শীত ঋতুতে আমরা জানি যে অনেক শীত পড়ে। বিশেষ করে পৌষ মাস এর শীতে আমরা কাহিল হয়ে যাই। আমরা ঘরের বাইরে বের হতে চাই না এবং সব সময় লেপের নিচে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
সাদা বিলাই সেই কখন থেকে আমাকে জরিয়ে ধরে বসে আছে। আমাকে নিয়ে নাকি সে দুঃস্বপ্ন দেখেছে। আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি যে কি দেখেছেন স্বপ্নে। কিন্তু তিনি চুপ, মুখে মনে হয় তালা দিয়ে রেখেছেন আর পন করেছেন যে, আজ কোনভাবে’ই নিজের মুখ খুলবেন না। অবশেষে বিরক্তির সহিত বলেছিলাম যে, আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন? আমি কি মরে গিয়েছি নাকি দূরে কোথাও চলে গিয়েছি! প্রত্যুওরে আমার তুলতুলে মখমলের ন্যায় দু’গালে থাপ্পড় দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। সেই কখন থেকে বসে আছে এখন পর্যন্ত। সাদা বিলাইয়ের জড়িয়ে ধরাতে অস্বস্তি হচ্ছে। নড়াচড়া করা তো দূরের কথা সাদা বিলাইয়ের দিকে ফিরে চেহারার ভাবভঙ্গি যে দেখবো তাঁরও কোন সুযোগ নেই। পর পর আমার মাথায় অধর ছুঁয়ে দিচ্ছে আর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখছে। সাদা বিলাইয়ের এমন কান্ডে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– মারলেন তো আমার তুলতুলে গালে তবুও শান্তি পাচ্ছেন না? ছাড়ুন আমাকে আমি আপনার সাথে একঘরে থাকব না।

আমার কথা শুনে সাদা বিলাই আমার কাঁধে কুটুস করে কামড় বসিয়ে বলল,

– তুমি চাইলেও আমার কাছ থেকে দুরে যেতে পারবে না। যেখানেই থাকো না কেন অমার প্রণয়ের প্রণয়িনী হয়েই থাকতে হবে। ফের যদি আমার কাছ থেকে চলে যাবার নাম নাও তো ভালোবাসা নামক জেলে আটক করে রাখব।

সাদা বিলাইয়ের এমন মিষ্টি মার্কা হুমকি শুনে শুকনো ঢুক গিললাম। টুকটাক কথা বলতে বলতেই সকাল হয়ে গেল। বিয়ের পর আজ প্রথম আমাদের মাঝে এত কথা হলো। কথা বলতে বলতে কখনও খুব জোড়ে কামড় খেয়ে কেঁদেছি নয়তো সুড়সুড়ি পেয়ে হেসেছি। আজকের সকালটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। শুভ সকাল কি এমনি এমনিই প্রিয়জনকে বলে কেউ! এই শুভ সকাল বলার মধ্যে যে কত ভালোবাসা আছে তা আজ অনুভব করলাম। কেন যেন এখন নিজেকে বড়ো বড়ো মনে হচ্ছে। আগের মত দুষ্টুমি মাথায় ঘুরে না সবসময়। সাদা বিলাইকে অনুভব করতে ইচ্ছে করে সর্বক্ষণ।

– রাদ, তুবা বাহিরে আসো। জরুরি কথা আছে।

শাশুড়ি মায়ের গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। সাধারণত আমার শাশুড়ি মা খুবই শান্ত এবং নম্রভাষী। আজ শাশুড়ি মায়ের উচ্চস্বরে কথা বলা খুব ভাবাচ্ছে আমাকে। গায়ে শাল জড়িয়ে দরজা খুলতে চলে গেলাম। ততক্ষণে রাদও গায়ে জ্যাকেট পরিধান করে ফেললেন। একসাথে ঘরে থেকে বের হয়ে নিচে সোফার রুমে উপস্থিত হলাম। শাশুড়ি মা, শ্বশুর বাবা চিন্তিত হয়ে বসে আছেন সোফায়। আমরা নিকটে যেতেই শ্বশুর বাবা রাদের উদ্দেশ্যে বলল,

– রাদ, আবরারের সাথে কি কোন বিষয়ে ঝামেলা করেছিস?

শ্বশুর বাবার কঠোর কন্ঠস্বরে ভরকে গেলাম। বাবার কথার প্রত্যুওরে রাদ বলল,

– আবরারের সাথে কখনোই আমার ঝামেলা হয়নি। এখন কি হয়েছে সেটা বলো। আবরার কোথায়?

রাদের করা প্রশ্নে চারদিকে নজর বুলালাম। সত্যিই তো আবরারকে এখানে দেখা যাচ্ছে না সাথে লিজাকেও। ব্যাপারটা কেমন যেন সন্দেহজনক। লিজার মাকে দেখলাম এক কোণায় দাঁড়িয়ে হাসছে। লিজার মাকে একা দেখে আমি দিজার মাকে জিজ্ঞেস করলাম,

– লিজা কোথায় আন্টি? সবাই আছে তাকে দেখছি না যে?

আমার প্রশ্ন শুনে আন্টি হকচকালেন, চকমে উওর দিলেন,

– বেবি তো ঘুমোচ্ছে। সারারাত পড়াশোনা করেছে আমার মেয়েটা।

লিজার মাকে আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু বাবার কথায়ে তা পারলাম না।

– রাদ, আবরার ভোর সকালে কাউকে কিছু না বলে চলে গিয়েছে। আমি ভাবিকে কল করেছিলাম আবরারের কিছু হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু ভাবি প্রত্যুওরে বলল যে, আবরার নাকি বাসায় যায়নি।

শ্বশুর বাবার কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেলেন। রাদ মুঠোফোনে কয়েকবার আবরারকে ফোন করেও পেলেন না। রাদের অবস্থা দেখে বুঝতে পারলাম সত্যিই আবরার নামক ভাইয়াটা রাদের জান। রাদ বিড়বিড় করে বলছে,

– কি হয়েছে ভাই? কোথায় তুই? আমার ভাইটা খুব অভিমানী। আমার কোন কথায় কি কষ্ট পেয়েছে সে? কোথায় চলে গেল? আর ভাবতে পারছি না।

রাদের চিন্তিত মুখ দেখে শ্বশুর বাবা বললেন,

– রাদ, আবরার যেখানে আছে ফিরে আসবে। তুমি চিন্তা করিও না। সিঙ্গাপুর যাওয়া খুবই দরকার আমাদের কম্পানির জন্য। তুমি তৈরী হয়ে নাও নয়টায় ফ্লাইট।

– হ্যাঁ বাবা।

এতক্ষণ কথার মাঝে রাদের চলে যাওয়াটা মাথা থেকে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হওয়াতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। রাদির দিকে তাকিয়ে দেখি সে অসহায় চোখে আমার পানে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বললাম না। কারন এখন আমার কিছু বলা মানে রাদ দুর্বল হয়ে যাওয়া; যা আমি চাইনা। কাজ কাজের জায়গায়, বউ বউয়ের জায়গায় আমি সবসময় মনে করি।

একে একে রাদ নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছাচ্ছে আর আমি খাটে বসে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আমার তাকানো দেখে রাদ সবকিছু ফেলে খাটে এসে আমার পাশে বসলো। রাদের এখান আমার পাশে বসা দেখে সোজা হয়ে বসে রইলাম। কারণ আমি জানি, এই ছেলে কাছে আসা মানে উল্টাপাল্টা কিছু করা।

– শুভ্রপরী, কেন যেন আজ তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, আজ যদি তোমাকে ছেড়ে চলে যাই তাহলে তোমাকে হারিয়ে ফেলব।

সাদা বিলাইয়ের কথা ভীষণ হাসি পাচ্ছে। আমি কোথায় যাবো? কি চিন্তা করে এই ছেলেটা? হাসতে হাসতে সাদা বিলাইকে উত্তর দিলাম,

– পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি? আপনার মাথর তাড় ছিড়ে গিয়েছে হয়তো। কোথায় যাবো আমি? যদি কখনো কোথাও যাই তাহলে সেটা হচ্ছে মায়ের কাছে বা ফারিফতার কাছে। এ ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কেউ নাই। ভাই বোন যারা ছিল তারা তো আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। যাদের চাইলেও কাছে এনে বসিয়ে রেখে আদর করতে পারব না।

জানি না আমার কি হলো! ভাইয়া আর আপুদের কথা মনে করে হুহু করে কেদে উঠলাম। সাদা বিলাই হয়তো জানে না আমার আরো ভাইবোন ছিল। আজ কেন যেন তাদের কথা মনে পড়ছে খুব। হয়তো এই দুই দিন নরমালভাবে থাকার চেষ্টা করেছি এজন্য। আচ্ছা! সাদা বিলাই কি কখনো বুঝতে পারবে আমার এত হাসি খুশির কারনটা যে অন্য কিছু! আমি তো চাইনা আমার কালো ঘৃণিত অতীত মনে করতে। ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায় একটি ঝড় এসে আমার সকল আনন্দ ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এজন্যই তো সারাক্ষণ ছোট বাচ্চাদের মত দুষ্টুমি হাসি মজা করতে থাকি যেন অতীতের তিক্ত স্মৃতি স্বরণ না হয়। এসব ভাবতে ভাবতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি আমি। আমার কান্না দেখে সাদা বিলাই আমাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

– হুস শুভ্রপরী, কাঁদে না এভাবে। তোমার কান্না দেখে তো আমি যেতে পারব না। ভালোবাসি খুব তোমাকে। তোমাকে সারা জীবন বেধে রাখবো আমার এই ছোট্ট হৃদয়ে। কথা দাও, কখনো কারো কথা শুনে আমাকে ভুল বুঝবে না যতই বাধা আসুক না কেন। আমার থেকে দূরে সরে যাবে না। আমাদের বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন আমি তোমাকে ভালোবাসি। শুধু তোমাকে।

সকাল আটটার মধ্যেই সাদা বিলাই চলে গেল ভিনদেশে আমাকে একা ফেলে। সাদাবিলাই চলে যেতেই নিজের ঘরে এসে বসলাম। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ঘরটা। মনে হচ্ছে কি যেন থেকেও নেই। সাদা বিলাইয়ের দুষ্টুমি মাখা স্পর্শ গুলো খুব মিস করছি।

দু’দিন কেটে গেল সাদা বিলাই আমার কাছে নেই। এই দুইদিনে হাজার বারের বেশি সাদা বিলাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। সাদা বিলাই কল দিলে প্রথমে মিনিট দশেক আমার পানে এক নজরে তাকিয়ে থাকবে তারপর কথা শুরু করবে।

আগামীকাল শ্বশুর বাবার এক আত্বীয়ের মেয়ের জন্মদিন। বাড়ির সকলেই যাবে সেখানে। শ্বশুর বাবা আমার জন্য সুন্দর একটা ড্রেস নিয়ে এসেছেন সেখানে পরে যাবার জন্য। সুন্দর করে পরিপাটি হয়ে তৈরি হলাম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাবো বলে। হাতে মুঠোফোন নিয়ে নিজের কয়েকটা ছবি তুলে পাঠিয়ে দিলাম সাদা বিলাইকে। বেটা ভিনদেশে গিয়ে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে তাই না! এইবার তুমি দূরে থেকে আমার ছবি দেখবে আর লুচির মতো ফুলবে।
হুয়াট্স অ্যাপে সাদা বিলাইকে ছবি পাঠিয়ে দেখলাম অপরিচিত নাম্বার থেকে কেউ কিছু অডিও ক্লিপ পাঠিয়েছে।
অডিও ক্লিপ চালু করে কানে নিতে কারোর কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। কেউ বলছে,

” রাদ তুবাকে বিয়ে করেছে শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। আমি একটা মেয়েছে ভীষণ ভালোবাসি যারও নাম তুবা। রাদকে সরাসরি তুবাকে দেখিয়েছিলাম কিন্তু রাদের মিসটেকের জন্য আমার তুবাকে তুলে না নিয়ে এনে অন্য আরেকটা মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসে। ভাগ্যক্রমে সেই মেয়ের নামও তুবা। আদ জিদের বশে মেয়েটাকে বিয়ে করে নেয়। মেয়েটা রাদের পূর্বপরিচিতও ছিলো না বা রাদ মেয়েটিকে ভালোবাসতো না। সবটাই ছিল প্রতিশোধ। রাদ আমাকে ভালোবাসে তাই আমার জন্য তুলে নিয়ে আসে কিন্তু বিয়ের দুদিন পর জানতে পারে যে এই তুবা সেই তুবা না। ছয়মাস পর ওদের ডিভোর্স হয়ে যাবে এজন্য তুবাকে নিজের কাছে রেখেছে রাদ।

অডিও ক্লিপ শুনে টপটপ করে চোখ বেয়ে অবাধ্য অশ্রুকণা অনবরত ঝড়ে যাচ্ছে। অডিও ক্লিপের কন্ঠস্বর যে আবরারের কন্ঠস্বর তা বুঝতে পেরেছি আমি। এতদিন রাদের সবকিছুই নাটক ছিলো তা ভাবতেই কষ্ট লাগছে । তুবা যে তার সাদা বিলাইয়ের প্রণয়ের দহনে পুড়ে যাচ্ছে তা কি সাদা বিলাই জানে! জানবে কীভাবে, সে তো প্রতিশোধের নেশায় আয়মানকে ব্যবহার করেছে মাত্র। বিছানায় বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে এখন। শাশুড়ি মায়ের ডাকে মুখে হাত দিয়ে বসে রইলাম।

– তুবা, মা আমার তৈরি হসনি এখনও? আমরা অপেক্ষা করছি তাড়াতাড়ি চলে আয়।

শাশুড়ি মায়ের ডাকে শুনে কান্না থামিয়ে বললাম,

– মা তোমরা চলে যাও। আমার শরীর ভালো লাখছে না।

– কি বলিস মা, দরজা খোল দেখি তো!

– আহ মা, ঔষধ সেবন করেছি। তুমি একঘন্টা থেঈএ চলে আসিও। আমি ততক্ষণে ঘুম দেই।

শাশুড়ি মা আচ্ছা বলে সাবধানে থাকতে বলে চলে গেলেন। শাশুড়ি মা চলে যেতেই ফোন বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম । আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভাগ্যে ভালোবাসা নেই। সবাই আমাকে কষ্ট দিতে সদা প্রস্তুত থাকে।

“আপন বলতে যার কেহ নেই,
সে তো মহা দুঃখি।
প্রিয়জনের আঘাতে
সর্ব অশান্ত হয় অন্তরখানি।”

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here