প্রণয়ের ত্রিভুবন পর্ব ১

–‘এই মেয়ে তুমি প্র্যাগনেন্ট কিভাবে হলে? ‘

শান্তভাবে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে কফির মগে চুমুক দিতে মগ্ন ছিলো শুভ্রিলা। এহমারের এমন গলা ফাটানো চিৎকার শুনে চমকে যেয়ে নড়ে উঠতেই মগ থেকে খানিকটা কফি টি-টেবিলে পড়ে যায়। এহমার সত্যিটা জেনে গিয়েছে মনে আসতেই একরাশ ভয় ঘিরে ফেলে তাকে। তৎক্ষনাৎ বিষম খেয়ে যায়! এহমারের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে তার চুল এলোমেলো, শার্টের বোতাম খোলা। এ যেন এক বিধ্বস্ত এহমার।রেগেমেগে থরথর করে কাঁপছে সে। হাতে রয়েছে প্রেগন্যান্সির স্টিপটা । যেখানে স্পষ্টভাবে দুটি লাল দাগ দৃশ্যমান। তার এমন বিধ্বংসী রূপ দেখে আরো ভয় পেয়ে যায় শুভ্রিলা। মনে মনে ভাবে এ সময়ে রাগ করলে চলবে না, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে । স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা চালায় শুভ্রিলা।

–‘আ__আসলে এহমার আমি তোমাকে আগেই জানাতে চেয়েছিলাম। পরে ভাবলাম সারপ্রাইজ দেবো…! ‘
কোনো রকম আড়ষ্টতার সাথে কথাগুলো বলে থেমে যায় শুভ্রিলা। মুখটায় মলিনতার ছাপ স্পষ্টরূপে বিদ্যমান। তার কথায় সর্বাঙ্গে যেনো কাঁটা ফুটে ওঠে এহমারের। বারংবার নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা ব্যর্থ করছে।

–‘লাইক সিরিয়াসলি শুভ্রু? তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছো, তোমার গর্ভে থাকা সন্তানের বাবা আমি? ছিহঃ এতো সুন্দর করে দোষটা আমার চাপিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র গলায় আটকালো না? ভালোবেসে বিয়ে আমাদের। তোমাকে নিজের প্রাণ মানি প্রাণ। আজ বিয়ের দু-দুটি বছর হয়ে যাচ্ছে তোমার সাথে সেরকম রিলেশান তো দূরের কথা টাচ্ও করিনি। তুমি বিয়ের পর বলতে তোমার স্পেস চাই, স্পেস চাই। আমি ভালোবেসে নিভৃতে তা দিয়েছি। তোমার উপর এখনো কোনো পুরুষত্বের অধিকার ফলাই নি। তবে তুমি? সত্যি শুভ্রু তোমার থেকে এতোটা জঘন্যরকম কিছু কোনোদিনই এসপেক্ট করিনি আমি!’

এহমারের চোখগুলো রক্তিম লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মাথার নিউরনগুলোর চলাচল রীতিমতো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চোখের কার্নিশে পানি এসে জড়ো হয়ে গিয়েছে। আজ অব্দি কোনোদিনই এতোটা রেগে শুভ্রিলার সাথে কথা বলেনি সে। মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে গিয়েছে৷ কিন্তু ফলস্বরূপ তাকে কি ধোঁকা পেতে হলো? ঘৃণায় গা টা ঘিনঘিন করে উঠে তার। আজ এসব এহমার নিতে পারছে না কেনো যেনো। তার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে এসব ব্যাপার। মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছে শুভ্রিলা। কি বলবে বুঝতে পারছে না। ভেতরে জমে থাকা চাপা কষ্টগুলো আজ যেনো নিমিষেই মাথা চারা দিয়ে উঠছে।

ফ্লাশব্যাক…….

ভার্সিটিতে আজকে প্রথম ক্লাসে এসেই কয়েকজনের সাথে খাতির জমিয়ে ফেলেছে শুভ্রিলা। তার সাথে থাকা মেয়েগুলো সাদরে আপন করে নিয়েছে৷ তাদের কথাবার্তা দেখে বোঝার উপায় নেই একটু আগেই তারা পরিচিত হলো। শুভ্রিলার পাশে বসা মেয়েটা অনেক মিশুক ধরনের। পইপই করে শুভ্রিলাকে তার চলতি রিলেশনশিপের কথাও জানিয়ে দিয়েছে। মেয়েটাকে দেখে বেশ প্রাণোচ্ছল মনে হলো শুভ্রিলার। মেয়েদের সাথে কথা বলছে শুভ্রিলা। তার দৃষ্টি বড়সড় দড়জাটার দিকে নিবদ্ধ। সেখানে তাকাতেই দৃশ্যমান হচ্ছে ছেলে-মেয়েদের আসা যাওয়া। এমন সময় একজন ছেলে হলে প্রবেশ করে। সেখানে চাহনি ক্ষেপ করে শুভ্রিকা আর পিহু। ছেলেটা দেখতে বেশ লম্বা। উজ্জ্বল গৌরবর্ণের মুখটিতে দীপ্তি পাচ্ছে তারুণ্যের ছোয়া। চোখের চশমাটা যেনো এক ছটাক সৌন্দর্যমাত্রা এনে দিয়েছে৷ টি-শার্ট পরিহিত ছেলেটার এক পাশের কাঁধে ঝোলানো রয়েছে ব্যাগ। কিছুটা জবুথুবু হয়ে হলে প্রবেশ করে ছেলেটা। কোনোদিকে দৃষ্টি না দিয়ে সোজা যেয়ে একটা বেঞ্চের কিছুটা জায়গা নিজের দখলে নিয়ে বসে পড়লো। প্রথম দেখায় ছেলেটাকে আস্ত একটা ভীতুর ডিম মনে হলো শুভ্রিলার। সবাইকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো কেউ ছেলেটাকে চেনে কি-না। সবাই না বোধকভাবে মাথা দুলালো। তবে, হতাশ হলোনা শুভ্রিকা বরং ভেতরে ভেতরে উত্তেজনাটা বেড়ে গেলো কয়েকগুনে।
–‘এই যে ভাইয়া!’ বলে শুভ্রিলা ডেকে উঠলেই হলের সব ছেলেরা তার দিকে লক্ষ্য করে। তবে ছেলেটার সেদিকে খেয়াল নেই। সে আনমনে জানালার বাহিরে তাকিয়ে ক্যামপাসটা লক্ষ্য করে চলছে৷ শুভ্রিলার বেশ কয়েকবার ডাকাডাকির পর বোধগম্য হয় তার। চট করে মাথা তুলে সেদিকে তাকায় সে। শুভ্রিলার পাশে থাকা মেয়েগুলো তো এতোক্ষণে হেসেই খুন! শুভ্রিকা স্বাভাবিক হয়ে প্রশ্ন ছেলেটার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
— ‘নাম কি আপনার? ‘
–‘ জ্বি এহমার!’ এহমার কেনোরকম উত্তর দেয় এহমার। মেয়েদের সাথে তেমন কথাবার্তা বলে না সে। সব সময় কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করে মনের মধ্যে। এখনও কিছু ব্যতিক্রম হয় নি! সবার দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে সবাই হা করে তার দিকে চেয়ে আছে। অনেকের মাঝে কানাকানিও হচ্ছে! বুকটা যেনো ধুক করে ওঠে এহমারের! কোনোমতে অন্যদিকে তাকিয়ে হল থেকে বের হয়ে যায় সে। শুভ্রিলার বেশ মজা লাগছিলো বিষয়গুলো। তার সাথে থাকা মেয়েগুলোর হাসি এখনো থামাচ্ছে না।তাদেরই একজন হাসতে হাসতে বলে উঠলো,

–‘ছেলেটা তো দেখছি আস্ত একটা ভীতু। কেমন করে মিনমিনিয়ে চলে গেলো!’
এবার পুরো ক্লাসেই যেনো হাসির রোল পড়ে গেলো। ওপাশের বারান্দায় দাড়িয়ে এহমার ফোন টিপছিলো। হঠাৎ এমন হাসির শব্দে ভরকে যেয়ে সেদিকে তাকায় এহমার। সে বুঝে উঠতে পারছে না কি নিয়ে এতোটা মাতামাতি চলছে! আবার ভেতরে প্রবেশ করার সাহসটুকুও কুলাতে পারছে না। বলা যায় না তাকে নিয়ে আবার সবাই ট্রল করছে না তো? কি করবে বুঝতে পারছিলো না এহমার। এমতাবস্থায়, সেদিকে তাকাতেই দেখে শুভ্রিকা তার সামনে এগিয়ে আসছে। কোনোভাবে ধাতস্থ হয় এহমার। তার সামনে শুভ্রিলা এগিয়ে আসতে আসতে বলে,

–‘হোয়াট দ্যা হেল মি.এহমার? আপনাকে নিয়ে ট্রল করা হচ্ছে তো ক্লাসে। এভাবে আপনি ভয় পাচ্ছেন কেনো? আসুন ভেতরে!’
শুভ্রিলা নির্লিপ্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলে এহমারের বুকে গুঁজানো হাতগুলো টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো। ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভরকে যাচ্ছে এহমার। ভেতরে প্রবেশ করার আগেই কোনোমতে শুভ্রিলার নিজের হাত ছুটিয়ে নেয়। কতগুলো জোড়া চোখ সাগ্রহে তাদের দিকে দেখছে। এহমারের কপোল বেয়ে ঘাম পড়তে শুরু করলো। শুভ্রিলার দিকে পরখ না করেই চটপট যেয়ে তার বেঞ্চে বসে পড়লো। তার পাশে আরেকটা ছেলে বসেছে দেখে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো এহমার। পকেট থেকে চার ভাজ করা রুমালটা নিয়ে কপাল মুছে ফেলল। বুকটা এখনো কেমন দ্রিম দ্রিম করছে।
শুভ্রিলা নিজের বেঞ্চে যেয়ে বসে পড়লো। আজ তার সাহস দেখে নিজেই অবাক হচ্ছে সে। ঠোঁট কামড়িয়ে ধরে শুকনো ঢোক গিলে শুভ্রিলা। কোনোদিনই এতো সাহসে কোনো ছেলের হাত ধরেনি সে। তবে আজকে….

চলবে?
#প্রণয়ের_ত্রিভুবন
#সুপ্তি_আনাম
#সূচনা_পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here