প্রপর্ণ পর্ব ৩

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(৩)
#কুরআতুল_আয়েন

বিছানার এককোনায় বসে নতুন জীবনের পথচলা তার জীবনে কীভাবে আবির্ভাব ঘটাবে তারই হিসেব মিলাচ্ছে বেলী।নতুন জীবনের সূচনা কি এক ফালি রোদের মতো ঝলমলিয়ে আসবে নাকি আকাশ ভাঙা বৃষ্টির মতো একরাশ দুঃখ নিয়ে আসবে।জীবনটা খুবই অদ্ভুত তাই না!সব কিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে চলতে হয়।হোক সেটা সুখ বা হোক সেটা দুঃখ।বেলী নতুন জীবনের চিন্তা করতে করতে রুমটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।বেশ ঝকঝকে করছে রুমটা।সাদা চুনের রঙটায় যেনো রুমের জিনিসপত্র গুলো ফুটে উঠেছে।রুমটার সামনেই বড়সড় একটা বারান্দা।খুব টানছে বারান্দাটার দিকে।কিন্তু,উঠতে গেলেই কেন জানি অস্বস্তি ভর করছে।তা নিজের কাছেও অজানা।অনেক ইনিয়েবিনিয়ে উঠে দাঁড়ালো।গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো বারান্দাটার দিকে।সামান্য এতোটুকু জায়গা পেরিয়ে বারান্দাটার দিকে আসতে তার বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে বেলীকে।নতুন বউ বলে কি তার এমন হয়েছে!এইসব চিন্তা বাদ দিয়ে সামনের দিকে তাকালো বেলী।সামনে নেই তেমন কোনো গাছপালা শুধু বড়বড় বিল্ডিংয়ের স্তুপ।কিন্তু,তার নিজের রুমের দক্ষিণ দিকের জানালাটায় চোখ রাখলে তো গাছপালা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।আর,এইখানে গাছপালার কোনো দেখাই মিলছে না।তাই তো গ্রাম মানে প্রশান্তির এক জায়গা।গ্রাম মানেই ছায়া-ঢাকা,পাখি-ডাকা,সবুজ শ্যামলের সৌন্দর্যের অন্যতম।দূরের দিকে চোখ রাখলেও ঘরবাড়ি গুলো ভেদ করে আগে বৃক্ষ লতাগুলোর দিকে চোখ যায়।কিছুই ভালো লাগছে না বেলীর।রুমটাতে নিজেকে খুব বন্দী লাগছে।সেই কখন ফুপি তাকে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো।তারপর আর কেউ আসে নি তার সাথে দেখা করতে।অবশ্য,আসার কথাও না।কারণ,এই বাসায় ঢুকার সময় বড়সড় একটা জটলা বেঁধেছিলো বসার রুমে।জটলার মূল উদ্দেশ্য ছিলো বেলী।তাই তো,ফুপি তাকে চটজলদি করে রুমে নিয়ে আসলেন।আবারও দ্রুত গতিতে বেরিয়েও পড়লেন।

বেলীর শ্বশুড় আজাদ রহমান অনেকটাই চটে আছেন।হুট করেই নিজের সহধর্মিণী এমন একটা বোকার মতো কাজ করে ফেলবে তা কখনোই মাথায় বোধগম্য হয়নি।ব্যবসা তো আর একা একা দাঁড় করানো যায় না।অনেকের সাহায্য নিয়ে ব্যবসা দাঁড় করাতে হয়।আর,ব্যবসা ঠিক রাখতে হলে শত্রু,মিত্র সবার সাথেই সুসম্পর্ক গড়ে তোলতে হয়।সেই সুবাদে উনার খুব কাছের এক পার্টনারের মেয়ের সাথে বুরাগের বিয়ের আলাপ আলোচনা শুরু করতে চেয়েছিলেন।এতে অত্যন্ত তাদের মধ্যে সম্পর্ক টা ঠিক থাকতো।নিজের ব্যবসা টাও আরো একটু উন্নতির পথ দেখতো।সোফায় বসে নিজের হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছেন।নিজের রাগটাকে সংবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছেন।না হলে কখন উঠে গিয়ে নিজের সহধর্মিণী কে গালে দু এক থাপ্পড় বসিয়ে দিতেন।কিন্তু,ছোট ভাই আর ছোট ভাইয়ের বউয়ের সামনে নিজের এই রূপ টা দেখাতে চান না।নিজেদের রুমের চার দেয়ালেই না হয় নিজের রাগটা মেটাবেন।আফিয়া একটু পর সরুচোখে তাকাচ্ছেন স্বামী আজাদ রহমানের দিকে।স্বামীর মনে কি চলছে তা বুঝার মতো ক্ষমতা উনার আছে।না হলে তো আর এতো অন্যায় করার পরেও সংসার টাকে টিকিয়ে রাখতে পারতেন না।তবে এতোদিন চুপ করে থাকলেও আজকে তিনি চুপ করে থাকবেন না।স্বামীর প্রত্যেক টা কথার উত্তর তিনি দিবেন।কিছুটা গম্ভীর চোখে বুরাগের দিকে তাকালেন আজাদ রহমান।ছেলের ভাবসাব কিছুই বুঝতে পারছেন না।থমথমে গলায় বলে উঠলেন,

–“তুমি খুশি এই বিয়েতে?”

বসার রুমটায় নিরবতা বিরাজ করছে।এমনকি ফ্যান বা এসিও ছাড়া নেই।বাহিরের থেকে কাকের কা কা আওয়াজ ভেসে আসছে।মনে হয় খুধার জ্বালায় এমন ভাবে ডাকছে।কিন্তু,কাকের এই কা কা ডাকটা বসার রুমের সবার কানেই গিয়ে পৌঁছছে।এতে যেনো আরো রগচটা হয়ে গেলেন আজাদ রহমান।মুখটাকে আরো থমথম করে বললেন,

–“কি হলো উত্তর দিচ্ছো না কেন?তুমি কি খুশি এই বিয়েতে।”

সোফার এককোনায় বুরাগ পায়ের উপর পা তোলে বসে আছে।হাত থাকা ফোনটা নিয়ে উলোটপালোট করে নাড়াচাড়া করছে।ফোনটাতে চোখ রেখেই বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–“বিয়েটা সম্পূর্ণ আমার মনের বিপরীতে হয়েছে।একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমি বিয়েটা করেছি।”

বুরাগের দুই লাইনের এই কথাটাই আজাদ রহমানের মনটাকে প্রাণহীন থেকে প্রাণময় করে তোলেছে।সহধর্মিণী আফিয়ার দিকে কেমন একটা বাঁকা চোখে তাকালেন।এই চোখে রয়েছে তীব্র রাগ আর ক্রোধ।আফিয়া স্বামীর চোখের ভাষা দেখে শুধুমাত্র একটা মুচকি হাসি দিলেন।যেই হাসিতে নেই কোনো প্রাণ।আছে শুধু একরাশ দুঃখ।এখন আর অভিমান জমা হয় না।এতো বছরের সংসার টায় প্রথম প্রথম স্বামীর প্রতি অভিমান জন্মালেও এখন আর দুঃখ ছাড়া কিছুই কাজ করে না।তবে দুঃখ টা হলো স্বামীর এক একটা ভুলের জন্য।না জানি কবে সবকিছুর বিনাশ ঘটে।

আজাদ রহমার ঠোঁটের কোণে বিশ্বজয়ের একটা হাসি টেনে ধরে বললেন,

–“যাক!তোমার কথা শুনে আমি একটু শান্তি পেয়েছি।অত্যন্ত তোমার মায়ের মতো এই ভুল করো নি।”

বুরাগ ভাবলেশহীন ভাবে উঠে দাঁড়ালো।এইখানে আর বসে থাকার মানেই হয় না।নিজের বাবার কথায় শুধু মাথা দুলিয়ে জায়গা পরিত্যক্ত করার জন্য হাঁটা ধরলো।ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আজাদ রহমানও উঠে দাঁড়ালেন।

কোহিনূর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আফিয়ার দিকে।ভাসুরের মতিগতি বা কথাবার্তার ধরণ দেখে এতোটুকু বুঝতে পেরেছেন বেলীকে বউ হিসেবে উনার পছন্দ হয়নি।আর,বুরাগের কথা শুনেও মনের গহীনে কেমন একটা ভয় জুড়ে বসলো।তাহলে কি বেলীর জীবন টা আর পাঁচটা সংসারের মতো স্বাভাবিক হবে না।নিজের ভাইয়ের মেয়েটাকে নিজের সামনে কীভাবে কষ্ট পেতে দেখবেন!
————-
–“আচ্ছা বেলীপু তোমাকে আমি আর খুশি ভাবি বলে ডাকবো নাকি আপু বলে ডাকবো?”

হাসির এমন প্রশ্নে বেলী না হেসে পারলো না।এতোক্ষণ রুমে একা বসে বসে একদম বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছিলো।পরক্ষণেই দরজা ঠেলে রুমে আসলো হাসি আর খুশি।বসতে না বসতেই বেলীর দিকে এমন একটা প্রশ্ন ছুড়ে মারলো।বেলী হাসি মুখে বললো,

–“তোদের যা বলতে মন চায় তাই বলবি।”

হাসি,খুশি কিছুটা ভাবনার জগতে পা বাড়ালো।দুজনে কিছুটা ভেবেও তাদের মুখ থেকে চিন্তার ছাপ সরাতে পারলো না।কিছুটা দুঃখভরা কন্ঠেই খুশি বললো,

–“কি ডাকবো বুঝতে পারছি না।একদিক দিয়ে তুমি আমাদের ভাবি আর অন্যদিক দিয়ে তুমি আমাদের আপু।খুব ভাবাচ্ছে আমাদের কে কি বলে ডাকবো তোমায়।পরীক্ষার হলেও প্রশ্ন পাওয়ার পর এতো ভাবতে হয় না আমাদের।”

বেলী শব্দ করেই হেসে উত্তর দিলো,

–“আচ্ছা হাসি খুশি তোদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয় তোদের বংশের নাম কি?তাহলে তোরা কোন বংশের নাম বলবি?ফুফার বংশ নাকি ফুপির বংশ?

হাসি খুশি ঝটপট উত্তর দিলো,

–“আব্বুর বংশ।মানে রহমান বংশ।”

–“যেহেতু তোদের বুরাগ ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।সেহেতু আমি এখন এই বাসার বউ।এখন কথা হচ্ছে বাহির থেকে কেউ যদি এসে তোদের কে প্রশ্ন করে বসে,আমি তোদের কি হই তাহলে তোরা কি উত্তর দিবি?আমি তোদের আপু হয় নাকি ভাবি হই।”

–“তখন তো ভাবি বলবো।কারণ,তুমি আমাদের বুরাগ ভাইয়ার বউ।কিন্তু নানু বাড়িতে একসাথে ঘুরতে গেলে তখন তোমাকে কি বলব?”

বেলী হতাশার চোখে তাকালো হাসি খুশির দিকে।এইভাবে বুঝিয়েও কাজ হলো না।অবশ্য সবেমাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ে।এই মাথায় এইসব কঠিন কথা বুঝবেও না।তারা এইটাও বুঝতে পারছে না এখন ভাবি বলতে বলতে তাদের এক সময় এই ডাকটায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে।তাই বেলীও এই কথাটা এখন বুঝিয়ে দিতে চায় না।যখন অভ্যস্ত হয়ে যাবে তখন না হয় নিজেরাই বুঝে নিবে।

–“ঠিকাছে!তোদের নানুবাড়িতে যখন যাবো তখন না হয় আমাকে আপু বলে ডাকিস।”

অনেকটা সময় হাসি খুশির সাথে গল্প করে কেটে যায় বেলীর।কিচ্ছুক্ষণ পরেই আফিয়া আর কোহিনূর দরজা ঠেলে রুমে আসলেন।দু’জনের মুখেই চিন্তার ছাপ।তা বেলীর চোখ এড়ায়নি।আফিয়া জোরপূর্বক হেসে বেলীর কাছে গিয়ে বসলেন।কোহিনূর পড়াশোনার তাড়া দিয়ে রুম থেকে হাসি আর খুশিকে বের করে দিলেন।হাসি খুশিও নিজেদের মায়ের কথা অনুসরণ করে চলে গেলো।আফিয়া হাতে থাকা কয়েকটা শাড়ি বেলীর হাতে ধরিয়ে দিলেন।বেলী চুপচাপ মাথা নিচু করে নিয়েও নিলো।

বিছানার মাঝখানটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেই শাড়িগুলো।এইখানে আসার পর থেকে একবারও নিজের সদ্য বিবাহিত বর বুরাগের দেখা মেলেনি।অবশ্য তাতে কোনো বেলীর মাথা ব্যথা নেই।রঙবেরঙের শাড়ি গুলোর থেকে কোনটা পড়বে তা নিয়েই অনেকটা দুশ্চিন্তায় আছে বেলী।অনেক বেছে বেছে শুভ্র সাদা রঙের একটা শিপন শাড়ি হাতে তোলে নিলো।সাদা রঙটা তার বেশ পছন্দ।সাদা রঙটার দিকে তাকালেই বেলীর ঘন কাশবন,পেঁজা তুলোর মতো ভেসে চলা শরতের মেঘের কথা মনে পড়ে যায়।তার থেকে বড় কথা শান্তির প্রতীক।তাই,শুভ্র সাদা রঙের শাড়িটাই হাতে তোলে নিলো।

বারান্দায় বসে কিছু ফাইলপত্র দেখছিলো বুরাগ।এতোদিন বাসায় বসে থাকলেও এখন মনে মনে পণ করে নিয়েছে আর বাসায় বসে থাকবে না।নিজের বাবার সাথে ব্যবসায় যোগ দিবে।তাই ইচ্ছে করেই বাবার কাছ থেকে কতগুলো ফাইলপত্র নিয়ে এসেছে।নিজেকে এখন কাজের ব্যস্ততায় রাখতে চায়।অর্ধেক ফাইল দেখেই উঠে দাঁড়ালো বুরাগ।তড়িঘড়ি করে বাহিরে বেরিয়ে আসলো।মা’র সাথে ডিভোর্স টা নিয়ে কথা বলতেই ভুলে গিয়েছে।এখন মনে পড়েছে তাই এখনই উঠে দাঁড়ালো।যখন যেটা মনে পড়ে তখন সেটা বলে ফেলাই উচিত।তাই তো বুরাগ আর দেরি না করে দ্রুত পায়ে মায়ের রুমের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো।কিন্তু মাঝপথে এসে তাকে থামতে হলো।সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে বুরাগের ভিতর টায় যেনো রক্ত টগবগ করে উঠলো।এইসময় কোনোভাবেই তার সামনে এই প্রতারক কে আশা করে নি।চোয়াল শক্ত করে আর হাত মুষ্টিবদ্ধ করেও যেনো নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

–“শুনলাম নাকি বিয়ে করলে।তা কই তোমার বউ?”

বুরাগ কিছু বলে না।চুপ করে দাঁড়িয়ে নিজের রাগ টাকে সংবরণ করার চেষ্টা করছে।সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে পুরনো ঘা গুলো যেনো আপনাআপনিই বুরাগের ভিতর টাকে আরো ক্ষত করে দিতে লাগলো।সামনের ব্যক্তিটি আর কেউ না সম্পর্কে তার ফুফা হয়।দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক টা পরিবারের সবার সামনে স্বাভাবিক হলেও তাদের ভিতরকার সম্পর্ক টা একদম সাপে-নেউলের সম্পর্ক।

–“কি হলো বললে না তো।নাকি ভয় পাচ্ছো তোমার প্রাক্তন প্রেমিকার মতো তোমার বউও আবার আমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে বসে।অবশ্য আমার এতে কোনো সমস্যা নেই আমি সবাইকে সামলে চলতে পারবো।স্নিগ্ধাকে,তোমার ফুপিকে যেইভাবে সামলে আসছি সেইভাবে না হয় তোমার বউকেও সামলে নিবো।”

বুরাগের রাগ যেনো এখন শিরায় শিরায় পৌঁছে গিয়েছে।আর না পেরে সটান করে নিজের বাবার সমতুল্য ফুফার গালে চড় বসিয়ে দিলো।চড়ের প্রকোপে বুরাগের ফুফা লিটন কিছুটা পিছিয়ে গেলেও মুখে সেই লালসাযুক্ত হাসিটা রয়েই গেলো।চড় খেয়েও তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর আসে নি।বুরাগ কিছুটা চেঁচিয়ে বললো,

–“শুধুমাত্র ফুপির জন্য তোকে কিছু বলতে পারছি না।এই অবস্থায় তোর কথা শুনলে ফুপি নিজের অনাগত বাচ্চাগুলো সহ নিজেকে শেষ করে দিবো।কিন্তু,তোর পতন আসবে।সেদিন খুব বাজে ভাবেই ভুগবি তুই।”

মেজাজ টা বিগড়ে গিয়েছে বুরাগের।মা’র রুমে না গিয়ে পুনরায় উল্টো ঘুরে নিজের রুমে চলে আসলো।এসেই দরজাটাকে জোরে শব্দ করে লাগিয়ে দিলো।মাথাটা চেপে ধরে আছে।অতীতের সেই দুঃখভরা স্মৃতি গুলো ভেসে উঠছে।যখন স্নিগ্ধার সাথে নিজের ফুফার অবৈধ সম্পর্কে জানতে পারে তখনও সবকিছু ধোঁয়াশার মতোই লাগছিলো তার কাছে।নিজের কানকে যেনো বিশ্বাস করতে পারে নি।কিন্তু,ওইদিনের কালোরাত টার কথা মনে পড়তেই ভিতরটা হাহাকার করে উঠে।ব্যথায় মাথাটা ফেটে যাচ্ছে বুরাগের।আর কিছু ভাবতে চায় না সে।আর ভেবেও লাভ নেই সবকিছু তার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে।
————————–
অনেক কষ্টে শুভ্র সাদা রাঙা শিপন শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে বেলী।নিজেকে যতোটা সম্ভব ঢেকে রেখেছে।লম্বা চুল গুলোকে হাত খোঁপা করে নিলো।গলায় মায়ের দেয়া সেই চিকন চেইন,হাতে বালা আর কানে দুল।এর মধ্যেই তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকলেন কোহিনূর।বেলীকে তৈরি হতে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলেন।বসার রুমে ননদ অনেকক্ষণ ধরে তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন বুরাগের বউকে দেখার জন্য।তাই তো কোহিনূর দ্রুত গতিতে আসলেন বেলীকে নিয়ে যেতে।বেলীকে একবার দেখে নিজের সাথে নিয়ে রুম ভেদ করে বেরিয়ে পড়লেন।বেলীও ফুপিকে অনুসরণ করতে লাগলো।

বসার রুমে সবাই বসে আছে।সাথে বুরাগও আছে।তার সামনেই লিটন বসা।একটু পর পর সিড়ির দিকে তাকাচ্ছেন।বুরাগ নিজের ফুফার মতিগতি বুঝতে পারছে।তার ফুফা যে বেলীকে দেখার জন্য ছটফট করছে তা বুরাগের চোখ এড়ায়নি।কিন্তু,প্রচন্ড রাগ হচ্ছে নিজের মায়ের উপর।কেন বেলীকে এইখানে আসতে বলেছে।একটু কষ্ট করে ফুফিকে নিয়ে উপরে চলে গেলেই হতো।একপ্রকার বাধ্য হয়েই এইখানে বসে আছে বুরাগ।সবাই টুকটাক কথা বলা নিয়ে ব্যস্ত।বুরাগ আর না পেরে চুপ করে বসে রইলো।হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে আফিয়া ননদের সাথে কথা বলা থামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।দরজার সামনে গিয়ে দরজাটা খুলেই পিলে চমকে উঠলেন।চমকানোর রেশ কাটিয়ে আফিয়া ঠোঁট দুটো জিহবা দিয়ে ভিজিয়ে নিলেন।মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে আমতাআমতা করে বললেন,

–“স্নিগ্ধা তুই এইখানে?”

স্নিগ্ধা নিজের শাড়ির আঁচল টা ঠিক করে নিলো।মুখে হাসি ফুটিয়ে উত্তর দিলো,

–“হ্যাঁ!খালামনি।শুনলাম বুরাগ বিয়ে করেছে তাই বউ দেখতে চলে এসেছি।আর কালকে মা আসবে।”

কথাটা বলেই স্নিগ্ধা আফিয়া কে ভেদ করে রুমে ঢুকে পড়লো।আফিয়া স্নিগ্ধার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন।তবে আফিয়ার কপালে চিন্তার রেখা গুলো ফুটে উঠেছে।না জানি বুরাগ স্নিগ্ধা কে দেখে কেমন রিয়েকশন করে।আবার পুরনো প্রেম জেগে বসবে না তো।

বুরাগ চুপ করে বসে থাকলেও কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকেই তাকিয়ে ছিলো।দরজার বাহিরের আগুন্তক কে দেখার জন্যই বুরাগ সেইদিকে চেয়ে আছে।আচমকাই দরজা ভেদ করে আসা লাল শাড়ি পরিহিতা মেয়েটিকে দেখেই বুকের বা পাশটা কেমন চিনচিনিয়ে উঠলো।কিশোর বয়সের সেই প্রেমের মনটা বারবার উঁকি দিতে শুরু করলো।কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেনো আশেপাশের সবকিছু থমকে গিয়েছিলো বুরাগের।কতোদিন পর দেখেছে সেই চেনা ভালোবাসার মুখটা তা নিজেরই অজানা।কিন্তু,হঠাৎ ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে পাওয়া প্রতারণা গুলো একমুহূর্তে মনে পড়ে যায়।নিজের আবেগ টা সাইডে রেখে পুনরায় চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে।স্নিগ্ধা বুরাগের সামনে এসে বসে পড়লো।চোখে চোখ রেখে বললো,

–“শুনলাম বিয়ে করেছো তুমি।”

বুরাগ অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,

–“ভুল কিছু শুনোনি।”

স্নিগ্ধা বুরাগকে আর কিছু বলেনি।কিছুটা পাশে বসা লিটনের দিকে আঁড়চোখে তাকালো।লিটনও এতোক্ষণ লোভাতুর দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে ছিলো।স্নিগ্ধাকে এইখানে মোটেও আশা করেনি।তবে,এখন মনে হচ্ছে স্নিগ্ধা এসে ভালো হয়েছে আজকের রাত টা অত্যন্ত কিছুটা হলেও সুখে কাটাতে পারবে।

নিজের প্রাক্তন প্রেমিকা আর ফুফার চোখাচোখি টা বুরাগের চোখে পড়েছে।দুজনের চোখে কি চলছে তাও বুঝতে পারছে।তাদের দিকে ঘৃণার চোখে তাকাতেও যেনো লজ্জা করছে।সোফা ছেড়ে উঠতে গেলেই মা’র সাথে চোখ পড়ে গেলো বুরাগের।আফিয়া এতোক্ষণ দূর থেকেই ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন।স্নিগ্ধার সাথে ছেলের যে একটা ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো তা জানতেন কিন্তু,তা কেন নষ্ট হয়ে গেছে তা জানতেন না।বুরাগকে অনেকবার বলেও ছিলেন কিন্তু বুরাগ এই কথাটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে।আবার,নিজের বোনের মেয়ে হওয়াতে স্নিগ্ধাকেও সরাসরি কিছুতেই বলতেও পারেন নি।আফিয়া চোখের ইশারায় বুরাগকে উঠতে না করেছেন।বুরাগ কিছুটা অসহায় চোখে মা’র দিকে তাকিয়ে আবারও বসে পড়লো।

সিঁড়ি বেয়ে কোহিনূর বেলীকে নিয়ে নামছেন।বেলীর খুব ইতস্তত লাগছে।তাই ইতস্তততা নিয়েই ফুপির সাথে এগিয়ে আসলো।সবার সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো।বুরাগ পাশে ফিরে বেলীর দিকে তাকালো।কতক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে রইলো।শুভ্র সাদা শাড়িটায় বেশ লাগছে।গলার ভাঁজে চিকন চেইনটা আঁটসাঁট ভাবে আটকে আছে।যার কারণে গলাটা খুব আকর্ষণ লাগছে বুরাগের কাছে।এমনকি বুরাগের দৃষ্টি এখন বেলীর গলার ভাঁজটায়।নিজেকে এখন কেমন বেসামাল লাগছে।তাড়াহুড়ো করে চোখ নামিয়ে নিলো বুরাগ।দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে ঠিক করে নিলো।

লিটনও একপলকে তাকিয়ে আছে বেলীর দিকে।বেলীকে দেখে নিজের পুরুষত্বের লালসা যেনো উপচে বেয়ে পড়ছে। সাদা শিপন শাড়িটায় বেলীকে অপূর্ব দেখাচ্ছে।যার কারণে লিটন কিছুতেই চোখ ফিরাতে পারছে না।এখন কেন জানি স্নিগ্ধাকে তার তুচ্ছ মনে হচ্ছে।বেলীকে পাওয়ার একটা আকাঙ্ক্ষা তাঁর মনের ভিতর জেঁকে বসেছে।স্নিগ্ধা বেলীর দিকে কিছুটা রাগী চোখে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলো।হঠাৎ করেই মেয়েটাকে তার অসহ্য লাগছে।বারবার মনে হচ্ছে তার জায়গায় টা এই মেয়েটা ছিনিয়ে নিয়েছে।কিন্তু,নিজের করা অন্যায় গুলো তার কাছে কিছুই মনে হচ্ছে না।

আফিয়া এতোক্ষণ বেলীর দিকে ছেলের নিষ্পলক চাহনি দেখে নিজের মনে এক শান্তি অনুভব করছেন।বেলীর কাছে এগিয়ে গেলেন।সবার সাথে পরিচয়ও করিয়ে দিলেন।যখন বেলী সবার সাথে টুকটাক কথা বলছিলো বুরাগ আঁড়চোখা হয়ে তাকিয়ে ছিলো বেলীর দিকে।আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এইখানে স্নিগ্ধা থাকা সত্ত্বেও একবারও তার স্নিগ্ধার কথা মনে আসলো না।

আফিয়া সবার সাথে কথা বলে বেলীকে রান্নাঘরে নিয়ে আসার জন্য তাড়া দিয়ে উঠলেন।এইখাবে স্নিগ্ধার সামনে কিছুতেই বেলীকে বসতে দিতে চান না।কিন্তু,বুরাগ খুব করে চেয়েছিলো কিছুটা সময় যেনো বেলী তার পাশে বসে।নিজের মনের মতিগতি নিজেই ভেবে পাচ্ছে না বুরাগ।বারবার মনের হচ্ছে মনের কোণের ঝমে আসা মেঘ গুলো যেনো বর্ষণের একটু একটু দেখা মিলছে।যেদিন পুরোপুরি জমানো মেঘ গুলো বর্ষণে পরিণত হয়ে যাবে সেদিন নিজেকে অনেক সুখী মনে করবে।এই সুখটা পেতে চায় বুরাগ কিছুতেই হারাতে চায় না।
আফিয়া বেলীকে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন।বুরাগ তাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো।হঠাৎ করে বেলীর পিছনের দিকে চোখে পড়তেই তার মুখটা কঠিন হয়ে উঠলো।সাদা ব্লাউজ টা ভেদ করে কটকটে লাল রঙের বক্ষবন্ধনী টা একদম টগবগে রক্তের মতো ফুটে উঠেছে।আকাশে যেমন মেঘের আড়াল ভেদ করে সূর্য উঁকি দিয়ে উঠে ঠিক তেমনি সাদা কাপড় টা ভেদ করে কটকটে লাল রঙটা যেনো উঁকি দিয়ে উঠছে।পিছন থেকে সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।যার ফলে বুরাগের রাগে কপালের চারপাশের রগ গুলো ফুলে উঠেছে।নিজের ফুফার দিকে তাকিয়ে যেনো রাগ টা আরো আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠলো।ফুফা যে লালসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বেলীর দিকে তা যেনো কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।হুট করেই উঠে দাঁড়ালো বুরাগ।দ্রুত পায়ে বেলীর দিকে এগিয়ে গেলো।বেলীর কাঁধটা চেপে ধরে মা’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

–“মা আমি ওকে একটু রুমে নিয়ে গেলাম।”

আফিয়া ছেলের কথায় মুচকি হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।বেলী একপলক চমকে তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here