“প্রমত্ততা তুই পর্ব ১১

#প্রমত্ততা_তুই
#আফসানা_মিমি
||১১তম পর্ব ||

অন্ধকারে ছেয়ে আছে আকাশ। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বৃষ্টি ঝড়বে। হলোও তাই, রিমঝিম ধারায় বৃষ্টি পড়া শুরু করেছে। ভরা ক্যাম্পাসের মাঠ এখন শূন্য হয়ে আছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে যে যেখানে পেড়েছে আশ্রয় নিয়েছে। আয়না, জারিফ, জারিন আর তাঁদের বন্ধু বান্ধব ছাড়া।

আয়না নিজের ওড়না হাত দ্বারা মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। দৃষ্টি তার জমিনে চোখ বেয়ে অজস্র অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ছে। ঝিরঝির বৃষ্টিতে চোখের পানি আর বৃষ্টির পানি মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আয়নার বর্তমানের অশ্রুজল ব্যথার নয় বরঞ্চ কষ্টের। কিছুক্ষণ আগে বিনা অপরাধে শাস্তি পাওয়ার কষ্টের।

– কি মিস বোম্বাই মরিচ, এখন চুপ কেন? এতক্ষণ তো খুব হিংস্র দেখাচ্ছিল আপনাকে। আমার বোনকে বিনা অপরাধে আঘাত করার শাস্তি নিশ্চয়ই পেয়েছেন। এই মেয়ে তোমাকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম আমার এবং জারিনের আশেপাশে তোমাকে যেন না দেখি।

বৃষ্টিতে কাক ভিজে এটিটিউডের সহিত মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জারিফ আয়নাকে বলল। জারিফের হাবভাব এখন এমন যেন একটু আগে কিছুই হয়নি। আরো একবার আয়নার পানে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসি হেসে চলে যেতে নিলে আয়না বলে উঠে।

– মিস্টার তাযিন জারিফ, আপনার ভাষ্যমতে শাস্তির বদলে শাস্তি পেতে হবে আর রক্তের বদলে রক্ত তাই তো?

জারিফ ভেবেছিল আয়না দমে যাবে এবার। কিন্তু জারিফের ধারণা ভুল প্রমাণিত করে আয়না মাথা তুলে কথাগুলো বলল।

– মানে? কি বলতে চাও স্পষ্ট করে বলো।

জারিফ ভ্রু যুগল কুঁচকে আয়নাকে জিজ্ঞেস করে।
বৃষ্টিতে ভিজে আয়নার মুখশ্রীতে বিন্দু বিন্দু কণা জমে আছে তা এক হাত দিয়ে মুছে জারিফের কাছে এসে বলতে শুরু করল।

– কেউ যদি আপনার বোন সাজিয়াকে ধর্ষিত হবার জন্য কোন ছেলেকে উস্কিয়ে দেয় তো আপনার কেমন লাগবে?

– খুন করে ফেলবো যে আমার বোনের দিকে তাকাবে।

আয়না জারিফের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল।

– তাহলে অন্যের বোনের বেলায় ছাড় পাবে কেন? আর শাস্তি পেতে হবে কেন?

– যা বলবে ক্লিয়ার করে বলো কার বোনের কি ক্ষতি হয়েছে?

জারিফের কথায় আয়না এবার চিল্লিয়ে বলা শুরু করল।
– আপনার পেছনের মেয়েটা, যাকে আপনি বোন বলে সম্বোধন করছেন। গতকাল আয়না নামক মেয়ের জন্য কয়েকজন ছেলেদের ভাড়া করেন। আয়নাকে না পেয়ে আয়নার বন্ধুকে টার্গেট করে কিন্তু আল্লাহর সহায় হওয়ায় পুলিশের হাতে ছেলেরা পরে যায়। আর স্বীকার করে নেয় নিজেদের কুকর্মের কথা।

আয়নার কথা শুনে জারিফ স্তব্ধ বনে যায়। জারিন খারাপ তা জারিফ জানতো কিন্তু এতটা খারাপ তা জানতো না।

– কি মিস্টার জারিফ, এখন কী বলবেন। আমি কি ভুল করেছিলাম? এই আয়না কখনো ভুল করে না, খারাপ কে প্রশ্রয় দেয় না।

আয়নার কথার প্রত্যুওরে জারিফ কিছু বলতে পারেনি। কিই বা বলবে! একদিকে সত্যের পথ তো অপরদিকে বোন নামক কাল।

ঝিরঝির বৃষ্টি অনেক আগেই থেমে গিয়েছে। আকাশ অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। আয়না সকলের সামনে চিল্লিয়ে বলল।
– আপনারাই বলুন এই মেয়ের কী শাস্তি দিবেন। আপনাদের হাতে এখন সব। আর মিস্টার জারিফ আপনাকে আমি আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মনে রাখব আমাকে থাপ্পড় দেওয়ার প্রতিদান হিসেবে আপনাকে চাইবো। আজ এখন থেকে এই আয়না শুধু জারিফকে চাইবে। এই ভরা ক্যাম্পাসের সামনে বলে রাখলাম। আমি জারিফকে ভালোবাসি। কোন মেয়ে যদি জারিফের আশেপাশে দেখি তাহলে তার হাল বেহাল হয়ে যাবে।

আয়নার এমন উপস্থিত কথায় জারিফ চমকাল ,ভরকাল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।

আয়না জারিফের দিকে ক্রোধ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে গেল।

– দোস্ত আমার জন্য তোর এরকম ঝামেলা করা ঠিক হয়নি।

জিনিয়া মেয়েটা এখনও ভয় পেয়ে আছে। কাল একা বাসায় যাওয়ার সময় কয়েকটা ছেলে জিনিয়ার পিছু নেয় তখন জিনিয়া বুঝতে পেরে দৌঁড় দিয়। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ দেখে সাহায্যের আবেদন জানায়। পুলিশ ছেলেদের ধরে উওম মাধ্যম দেয়ার পর স্বীকার করে।

– জিনিয়া আমি তোর জন্য কিছু করিনি। একজন মেয়ের সম্মান হানি যে কতটা জঘন্য তা বুঝিয়ে আসলাম তাও আবার একটা মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে চেয়েছে কিভাবে? আমার তো শান্তি লাগছে না ইচ্ছে হচ্ছে ঐ মেয়েটাকে কেঁটে কুচি কুচি করে নদীতে ভাসিয়ে দিতে।

——-

গভীর রাত জারিফ কেবল পড়াশোনা শেষ করে ঘুমানোর প্রিপারেশন নিচ্ছে তো হঠাৎ আজকের দিনের কথা মনে পড়ে যায়। আয়না চলে আসার পর জারিফ জারিনকে নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষ যায়। সমস্ত ঘটনা জানানোর পর প্রিন্সিপাল স্যার জারিনকে ভার্সিটি থেকে বের করে দেয় এবং আগামী চার বছর যেন অন্য কোথাও ভর্তি হতে না পারে সে ব্যবস্থা করে দেয়।

জারিফ শুয়ে না চাইতেও আয়নার কথা ভাবছে। গতকাল জারিফের দেখা আয়না ছিল প্রফুল্লিত। আয়নার ভেতরকার উৎফুল্ল্য মেজাজটা ভেসে এসেছিল কিন্তু আয়না তো এমন নয়! সবার দেখা আয়না একরোখা গুন্ডি টাইপের। নরম ভাষায় কথা বলা তাকে মানায় না। উফ জারিফ আর ভাবতে পারছে না। জারিফ বুঝতে পারছে ধীরে ধীরে সে আয়না নামক প্রতিবিম্বে বন্দি হয়ে যাচ্ছে। আর আয়না তো আজ সকলের সামনে বলে দিলো সে আমাকে ভালোবাসে। সত্যিই কি তাই! আয়না তো নিজের মতো চলে কিন্তু জারিফের এমন মেয়ে অপছন্দনীয়। এসব হাজারো চিন্তা করে জারিফ এক কাজ করে বসলো।

– তোমার প্রতি দুর্বলতা কাজ করছে এর থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় বলে দাও।

জারিফ জানে না আগামীকাল তাঁর সাথে কী হবে। কিন্তু জারিফ খুব করে চাচ্ছে একটু বেহায়া হতে। আয়না নামক প্রতিবিম্বে খুব শক্ত করে আটকে যেতে। আয়নিকে জানতে, চিনতে খুব কাছ থেকে।

———

স্নিগ্ধ সকাল। আয়নার ঘুম ভেঙ্গেছে অনেক আগেই। আড়মোড়ে বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে উঠতেই আয়নার ফোনে মেসেজের শব্দ হয়। মেসেজ ওপেন করতেই আয়না ফোন ছুঁড়ে ফেলে ভীতু হয়ে বিছানার একপাশে জড়সড় হয়ে বসে পড়ে। দুই হাঁটু ভাঁজ করে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করতে থাকে।
আয়নার বড়ো বোন ফারিয়া আয়নাকে ডাকতে আসে। আয়নার এ অবস্থা দেখে দৌঁড়ে আয়নার কাছে বসে জিজ্ঞেস করতে থাকে।

– আয়ু, বোন আমার কি হয়েছে! দুঃস্বপ্ন দেখেছিস? ভুলে যা বোন এই দেখ আপাই আছে তোর কাছে কিছু হবে না তোর।

আয়না বড়ো বোনের কন্ঠস্বর শুনে পাগলের মত বলা শুরু করল।

– আপাই তুমি ঠিক আছো তো! ঐ বাজে লোকটা তোমাকে কষ্ট দিয়েছে তাই না! এই দেখো আমাকে এখানে ছুঁয়েছে। ঐ লোকটাকে ভয় পাই আমি খুব ভয় পাই। তোমাকে রক্ষা করতে পারলাম না আপাই।

– শান্ত হো বোন। ঐ লোকটা নেই দেখ! এখানে আমি ছাড়া কেউ নেই।

আয়নার তবুও কোনও হেলদোল নেই। আগের মতই বিড়বিড় করে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে আয়না জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আয়নার এই অবস্থা দেখে ফারিয়া ঘাবড়ে যায়। ফারিহার হাসবেন্ড, দর্পণ কেউ বাসায় নেই। এই অবস্থায় কি করবে বুঝতে পারছে না। অগত্যা আয়নার ফোন হাতে নিয়ে সাহায্য আবেদন করার জন্য কাউকে খুঁজতে থাকে। আয়নার ফোন ওপেন করতেই কয়েকটা মেসেজ চোখের সামনে ভেসে উঠে। প্রথমত ম্যাসেজটি ছিল এরকম,

” আমি ফিরে আসছি সবকিছুর হিসাব নিতে। তোমার এবং তোমার পরিবারকে ধ্বংস করতে।”

এরকম হুমকির মেসেজ দেখে ফারিয়া ঘাবড়ে যায়। সে মানুষটাকে যে আয়না খুবই ভয় পায়। আজ আয়নার এই অবস্থার জন্য দায়ী সে মানুষটা। ফারিয়া আয়নার ফোন আরো একটু ঘেঁটে আরেকটা মেসেজ দেখতে পায়। মেসেজটা দেখে একটু শান্ত হয় ফারিয়া কোন কিছু না ভেবে মেসেজ এর মালিককে কল করে বসে।

জারিফ কেবল ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটিতে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল ঠিক তখনই মুঠোফোন বেজে উঠে। আয়নার নাম্বার দেখে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আয়নার নাম্বার ভার্সিটির ফর্ম থেকেই নিয়েছে জারিফ। আয়না যেমন মেয়ে জারিফের মেসেজ দেখা মাত্রই জারিফকে জিজ্ঞেস করার জন্য উতলা হয়ে যাবে তা জারিফ জানে। মুঠোফোন বাজতে বাজতে কেঁটে যায়। জারাফ ফোন হাতে নিয়ে যেই না কল দিতে যাবে ঠিক তখনই আবার বেজে উঠে। রিসিভ করে কাছু বলবে আর আগেই অপরপাশে কেউ ক্রন্দনরত অবস্থায় বলা শুরু করল।

– হ্যালো, আমি ফারিয়া আয়নার বড়ো বোন। তুমি কে জানিনা কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।

ফারিয়ার কথা শুনে জারিফ আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। আয়নার বাসার ঠিকানা নিয়ে রওনা হলো।

হাসপাতালে অক্সিজেন মাক্স পড়ে বেডে শায়িত আয়না। মাত্র কয়েকঘন্টার ব্যবধানে মেয়েটা একদম নেতিয়ে পড়েছে।
আয়নার বড় বোন ফারিয়া জারিফের কাছে এসে বলল।
– তুমি সে ছেলেটা না, যে রেস্টুরেন্টে আয়নাকে বাঁচিয়েছিলে?
– জি আপু, আমি সেই ছেলেটা।
– আমার বোনকে ভালোবাসো?

– তা জানি না আপু। আপনার বোনের মধ্যে আমার মনের মত কিছুই নেই কিন্তু তবুও আপনার বোন তার প্রতিবিম্বে আমাকে আটকে ফেলেছে। না চাইতেও সবসময় আপনার বোনের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় সদা। এখন এটাকে আপনি যদি ভালোবাসা বলেন বলতে পারেন।

– শুনে খুব খুশি হলাম। আমার বোনের এই রুপ দেখেও কেউ তাঁকে ভালোবেসেছে। তোমাকে কিছু কথা বলবো আয়নার ব্যপারে। আশা করি কথাগুলো শোনার পর তোমার মনকে জিজ্ঞেস করবে যে তুমি আয়নার সাথে সারাজীবন কাঁটাবে নাকি সবকিছু শুরু হবার আগেই শেষ করে দিবে।

——-

নীল আকাশের বুকে রক্তিম সূর্যেরআলো ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। অজানা কোন এক স্থানে সূর্য অস্তমিত হচ্ছে। আজ দুইদিন যাবত জারিফের কোন দেখা সাক্ষাত নেই। আয়না জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হাসপাতালে দেখে ঘাবড়ে যায়। ফারিয়ার থেকে জানতে পারে জারিফই আয়নাকে এখানে নিয়ে আসে। জারিফকে বলা সমস্ত কথা ফারিয়া আয়নাকে বলে। মুঠোফোনের আওয়াজে আয়নার ধ্যান ভাঙ্গে। ফোন কানে নিতেই জারিনের কন্ঠস্বর শুনতে পায়।

– আয়না,আয়না, আয়না। কন্ঠস্বর শুনে নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছো আমি কে! হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ আমি জারিন তাযিন জারিফের হবু স্ত্রী। সেদিন তোমার জন্য ক্যাম্পাস থেকে আমাকে বার করে দিয়েছে আর চার বছরের জন্য কোন ভার্সিটিতে ভর্তি হতে না পারি সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তুমি কি ভেবেছো এসব করে আমার জারিফকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারবে? কখনও না জারিফ আমার আমারই থাকবে। খুব শীঘ্রই আমাদের বিয়ে হবে।

আয়না এতক্ষণ চুপ করে জারিনের কথা শুনছিল। জারিনের কথায় রাগে শরীর কাঁপছে। কোনরকম নিজের রাগ কন্ট্রোল করে আয়না বলল।

– জারিফকি আদৌও আপনার? আর রইলো ভার্সিটির কথা আপনি নিজের করা কৃতকর্মের ফল পেয়েছেন। আপনাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে কিন্তু হয়নি তো? জারিফ কিন্তু আমাকেই ভালোবাসতে বাধ্য। এই আয়না তার জিনিস আদায় করে নিতে জানি।

আয়না আর কথা বলতে পারেনি। রাগে শরীর কাঁপছে।

পরদিনই আয়না জারিফের খোঁজ নেয়। জারিফ মন ভালো করার জন্য বন্ধুদের সাথে পিকনিক করতে গিয়েছে। আয়না জারিফকে সেখান থেকেই কিডন্যাপ করে। আর তারপরের ঘটনা তো আপনাদের জানা।

বর্তমান,

পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজে জারিফের ঘুম ভাঙে। বুকের উপর ভারী বস্তুর আভাস পেয়ে দ্রুতগতিতে শোয়া থেকে উঠে যায়। সামনে বসা মানুষটিকে দেখে জারিফ বলে উঠে।
– তুমি!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here