“প্রমত্ততা তুই পর্ব ১২

#প্রমত্ততা_তুই
#আফসানা_মিমি
||১২তম পর্ব ||

লজ্জা নারীর ভূষণ। একজন নারী লজ্জায় রক্তিমরূপ ধারণ করবে আর তা প্রেমিকপুরুষ উপভোগ করবে। লজ্জা ইমানের অঙ্গ। একজন নারীর লজ্জা থাকতে হবে।

জারিফ নিজের নেত্রদ্বয় পরপর হাত দ্বারা কচলিয়ে নিচ্ছে। সামনে যে সয়ং আয়না দাঁড়িয়ে আছে। পরনে লাল থ্রি-পিস, মাথায় ঘোমটা দেয়া আর মুখে লাজুক হাসি। নব্য বিবাহিতা রমণীর মতো দেখা যাচ্ছে। জারিফ নিজের দিকে লক্ষ্য করে বুঝল যে তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আছে। এদিক সেদিক নজর বুলিয়ে টি-টেবিলে পানির পাত্র দেখে দ্রুত পানি পান করে এলো।
তখনও আয়না লাজুক দৃষ্টিতে জারিফের পানে তাকিয়ে আছে। জারিফ ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করছে। গতকালও জারিফ আয়নার সাইকো রুপ দেখেছিল আর আজ সেখানে আয়নাকে দেখে মনে হচ্ছে বাগানের শুভ্র পবিত্র ফুল।
– তুমি এখানে, এই অবস্থায় আমার বাড়িতে কি করছো?

আয়না লাজুকভরা মুখে হেসে বলল,

– আপন নীড়ে আসতে মানা নাকি?

আয়নার এমন কথায় জারিফ চমকাল। জারিফ মনে মনে ভাবছে, আয়না হয়তো পুরো পাগল হয়ে গিয়েছে যার কারনে আবল তাবল বকছে। পরক্ষণে জারিনের কথা চিন্তা করে চোয়াল শক্ত করে ফেলে কিছুটা শক্ত কন্ঠস্বরে আয়নার উদ্দেশ্যে বলল।

– দেখো আয়না, আমি কালকের কথা কাউকে জানাইনি। তুমি নিজের বাসায় ফিরে যাও। সামনের সপ্তাহে জারিনের আমার সাথে বিয়ে। কিছুক্ষণ পর আমরা শপিং করতে যাবো। সুতরাং তুমি চলে যাও।

– বউ থাকতে আরেকটা বিয়ে করবেন, আপনার নামে মামলা করব। স্ত্রীহানির মামলা, যেই মামলায় ডুবে আপনি ঐ পেত্নির কথা ভুলে যাবেন।
আয়নার এরকম হেঁয়ালি কথায় জারিফ আশ্চর্যিত হয়ে যায়। বিস্ময়কর চোখে আয়নাকে প্রশ্ন করে।

– বউ মানে! কে কার বউ?

– আমি আপনার বউ।

আয়নার সহজ উওর।

– কবে বিয়ে হল আমাদের? কি বলছ এসব, মাথা কি ঠিক আছে তোমার?

– আমার মাথা ঠিক আছে। আসুন আজ আমরা ঘুরতে যাব লংড্রাইভে। যেখানে শুধু আমি আপনি থাকবো আর আমাদের মাঝখানে যে আসবে তার জন্য খুবই ভয়ানক শাস্তি থাকবে। হোক সেটা আপনার বোন বা আপনার বন্ধু।

শেষের কথাগুলো বলার সময় আয়নায় চোখ মুখ একদম পাল্টে গেল। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ মূলত এভাবে কথা বলে না। জারিফ চিন্তায় পড়ে যায়। একটু পর জারিন আসবে আয়নাকে এখানে দেখলে আয়নার বিপদ হয়ে যাবে।

– তা মিস্টার জামাই সাহেব, কি এমন হলো যে দুইদিনে আপনার ঐ বোনকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেলেন? কি দেখিয়ে পাগল করল আপনাকে? দেহ নাকি অন্যকিছু?

আয়নার মুখে এমন কথা শুনে জারিফের মাথায় রক্ত উঠে যায়। একটানে আয়নাকে নিজের কাছে এনে আয়নার হাত মোচড়ে ধরে। যার কারনে আয়নার পিঠ জারিফের প্রসস্থ বুকে এসে ঠেকে। দুজনেই নিশ্চুপ শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আয়না যতটাই গুন্ডি হোক না কেন জারিফের সন্নিকটে এলে ভেজা বিড়াল যা জারিফ সেদিনই জেনেছে।

– রোম্যান্স করতে যদি এতই ইচ্ছে হয় তো আমাকে বলতেন মিস্টার হাসবেন্ড। এভাবে অজুহাত দেখিয়ে কাছে আসার প্রয়োজন নেই আমি তো আপনারই।

মেয়ে হয়েও আয়নার এমন লাগামহীন কথা শুনে জারিফ আয়নার হাত আরো শক্ত করে ধরল।ফলস্বরূপ আয়নার শরীরের অতিরিক্ত তাপমাত্রা জারিফ অনুধাবন করতে পারল। তারমানে কি আয়না সুস্থ হয়নি? জারিফ মনে মনে ভাবলো।

– রোম্যান্স করতে হলে কবুল পড়ে বউয়ের সাথে করবো। মিথ্যা নামহীন সম্পর্কের সাথে নয়। আর রইলো জারিনের সাথে বিয়ের কথা, সেটা কিছুদিন পরই জানতে পারবে।

জারিফের একটা কথাও আয়নার কানে পৌঁছেছে নাকি তা সন্দেহ কারন সে জারিফের স্পর্শ পেয়ে অনেক আগেই জ্ঞান হারিয়েছে।

– আয়না, এই বোম্বাইমরিচ চোখ খুলো দেখো না! মা, সাজিয়া রুমে এসো।
এত সকালে জারিফের ঘর থেকে চিল্লানোর আওয়াজ পেয়ে সাজিয়া আর জারিফের মা এসে দেখেন আয়নার রক্তিম মুখখানা। জারিফের মা বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

– আয়না এখানে কিভাবে? কি করেছিস মেয়েটার সাথে? মানলাম মেয়েটার সাথে তোর দ্বন্দ্ব রয়েছে তুই পছন্দ করিস না তাই বলে এভাবে মারবি? এই ছিলো তোর মনে?

জারিফের মায়ের আহাজারি শুনে জারিফ খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করল।

– উফ মা থামবে! আমি আয়নাকে মারতে রাবো কেন? জ্বরে আবল তাবল বকে জ্ঞান হারিয়েছে। এত সকালে আমার রুমে এসেছে দেখোনি তুমি? কষ্ট দিবো কেন আয়নাকে তুমি তো জানো আমি এই মেয়েকে ভালোবাসি।

– ভালোবাসি না ছাই; যদি ভালোবাসতি তো ঐ বেয়াদব মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হতি না।

– মা থামো তো এবার! এই মেয়েটার জ্ঞান ফেরাতে সাহায্য করো।

জারিফের মা আয়নার মাথা নিজের কোলে রেখে মাথায় জল পট্টি দিচ্ছেন। এদিকে জারিফ আয়নার হাতে আর সাজিয়া আয়নার পায়ে গরম তেল মালিশ করছে। খানিকক্ষণ পরে আয়নার জ্ঞান ফিরে নিজেকে অচেনা রুমে দেখে ঘাবড়ে যায়। পুরো কক্ষে চোখ বুলিয়ে দেয়ালে জারিফের ছবি দেখে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে। ছোট বেলা থেকেই আয়নার অভ্যাস জ্বর আসলে কি করে নিজেও জানে না।

– আমি আপনাদের খুব কষ্ট দিলাম তাই না! আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, জানিনা কিভাবে এখানে এলাম।

– এত জ্বর বাঁধালে কিভাবে? কাল তো ঠিক ছিলে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এত অসুস্থ হয়ে গেলে কিভাবে?

আয়না জারিফের এমন চিন্তিত কথা শুনে মুচকি হাসে। চোখ বন্ধ করে উত্তর দেয়।

– একজনকে আঘাত করার শাস্তি নিজের ওপর নিয়েছি তাই আজ এই অবস্থা। যাইহোক বিবাহের জন্য শুভকামনা রইল আর আর আমি এখন ঠিকঠাক ভাবে বাসায় পৌঁছাতে পারব না। আপনি কি আমাকে কষ্ট করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবেন?

আয়নার এমন করুণ আবদার ফেলতে পারেনি জারিফ। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। আর এদিকে জারিফের হাবভাব দেখে আয়না বাঁকা হাসে।

———-

কাজী অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আয়না আর জারিফ। জারিফ বিস্ময়কর চোখে তাকিয়ে আছে আয়নার পানে। জারিফ মনে মনে ভাবে কি করতে চাচ্ছে মেয়েটা? এখানে নিয়ে আসলো কেন? আমিতো চাইনা এত তাড়াতাড়ি কিছু হোক।

– আয়না আমাকে এখানে এসেছ কেন?

– কেন আবার বিয়ে করতে। কালই না বললাম যে আমার আপনার বিয়ে কিন্তু আপনি তো পালিয়ে চলে আসলেন। আজ সকালে তো বললাম।

– সকালে মানে তারমানে তুমি জেগে ছিলে?

– উহু জেগে ছিলাম বলতে ভুল হবে। আমি স্বজ্ঞানে ছিলাম না কিন্তু কিছু কিছু মনে আছে।

– তোমাকে কি এমনিতেই বোম্বাইমরিচ ডাকি? এসো তোমার সাথে আমার কথা আছে বিয়ে শাদি পরেও হতে পারবে।

– আমি কোন বাহানা শুনবো না। আপনি কি চান আগের আয়না ফিরে আসুক আবার?

নানান বাহানা একপাশে রেখে আয়না জারিফের বিয়ে হয় কাজী অফিসে। জারিফের মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। আয়নাকে এর শাস্তি দিবে তা মনে মনে ভেবে রেখেছে।

– কাজটা তুমি ঠিক করোনি আয়না। এর প্রতিদান তোমাকে দিতেই হবে। জারিফ শুধু আমার আর কারোর না।

জারিন এসেছিলো জারিফকে নিয়ে শপিং করতে যাবে। জারিফের বাসায় সদর দরজা খোলা দেখে জারিন প্রবেশ করে। সোফার রুমে আয়নাকে ইয়া লম্বা ঘোমটা আর গলায় মালা দেখে ভরকে যায়। তাৎক্ষণিক জারিফের পানে চেয়ে দেখে জারিফের গলায়ও মালা ঝুলছে। জারিনের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে জারিফ আর আয়নার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। জারিন প্রতিহিংসায় আয়নার দিকে তেড়ে আসে এবং এসব বলে।

– আরে ননদিনী যে, আসুন বড্ড দেরি করে ফেললেন। এখন আমরা বাসর করতে যাবো তো তাই কথা বলার সময় নেই। আপনি বরঞ্চ সাজিয়ার সাথে ঘরে বিশ্রাম নিন। কাল কথা হবে আপনার সাথে।

আয়না এতক্ষণ লাজুক ভঙ্গিতে সোফায় বসে ছিলো। জারিনকে দেখা মাত্রই মাথা উঁচু করে পায়ের উপর পা তুলে সোফায় আয়েশ করে বসে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে জারিনের উদ্দেশ্যে বলে। এদিকে জারিফের মা আয়নার রুপ পরিবর্তনে ভরকে যায়। জারিফের কাছে এসে কানে কানে বলতে থাকে।
– হ্যাঁরে বাবা, সত্যিই তোর বউ আস্ত একটা বোম্বাইমরিচ কখনও লাল টকটকে তো কখনও সবুজ হলদে। দেখ একটু আগে কি লাজুকভাবে বসে ছিলো কিন্তু এখন দেখ ধানী লঙ্কা মনে হচ্ছে।

জারিফের মায়ের কথা শুনে জারিফ ললাট কুঁচকে ফেলল। খানিকটা বিরক্তির সহিত মায়ের উদ্দেশ্যে বলল।

– এজন্যই বলেছিলাম এই মেয়েকে ঘরে আনবো না কিন্তু তুমি মানলে কই! ধরে বেঁধে গলায় ঝুলালে।

– যাই বলিস, মেয়েটা মাশাআল্লাহ। আমি মানিয়ে নিবো চিন্তা করিস না।

জারিফের মায়ের কথা শুনে জারিফের ইচ্ছে হচ্ছে কচু গাছের সাথে ফাঁসি নিতে। জারিনের কথায় আবার মনোনিবেশ করে দুই রমণীর যুদ্ধ দেখতে।

– আমি তোকে মেরে ফেলব ইউ স্টুপিট গার্ল।

জারিন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে তাই তেড়ে যায় আয়নাকে মারতে। আয়নার দিকে জারিনের অগ্রসর হওয়া দেখে জারিফ উদ্যোগ নেয় জারিনকে থামাতে কিন্তু তাঁর আগেই আয়না জারিনের হাত শক্ত করে মুচরে ধরে। বেচারি জারিন ব্যথায়ে শুধু আর্তনাদ করতে থাকে।

জারিন চলে যেতেই আয়না অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জারিফের পানে। জারিফের মা অবস্থা বেগতিক দেখে বলে উঠে।

– আয়না মা আমার, বিশ্রাম নাও আগে পরে এ বিষয়ে কথা হবে।

আয়না উপর দিয়ে যতই স্ট্রং থাকুক না কেন সে যে খুবই অসুস্থ তা নিছে বুঝতে পেরেছে। কাউকে কিছু না বলে জারিফের কক্ষে যেতে অগ্রসর হয়।
আয়নার পিছু পিছু জারিফ যেতে নিলে জারিফের মায়ের কথায় থেমে যায়।
– হ্যাঁরে জারিফ, মোহরানা কত দিয়েছিস?

– দুই হাজার দুইশত দুই টাকা মাত্র।

– এত কম? আয়না কি ভাববে।

– আমি তো ধেই ধেই করে বিয়ে করতে যাইনি। কনে জোর করে বিয়ে করেছে সুতরাং তাৎক্ষণিক পকেটে যত ছিলো ততই মোহরানা দিয়েছি।

জারিফের মা এবার বিরক্তি প্রকাশ করে বলল

– মান সম্মান কিছু রাখলি না।

প্রত্যুত্তরে জারিফ বেঙ্গ করে বলল।

– লে যেই লাউ হেই কদু। এতক্ষণ গর্ভধারিণীকে কি বোঝালাম আর সে কি বুঝলো। এজন্যই বলি মানুষের ভালো করতে নেই।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here