প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব -০১

নিজের ইচ্ছেতে দ্বিতীয় বিয়ে করে প্রথম স্ত্রীর নিকট বাসর রাতের অনুমতি চাইতে এল আদ্রিশ,ছাঁদের এক প্রান্ত ঘেঁষে অগোছালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আঁখি,চোখে নেই কোনো জলের আকারনিকার,হাসিখুশি মেয়েটা আজ যেনো পাথরে পরিণত হয়ে গেছে।হুট করে এসেই পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল আদ্রিশ আঁখিকে,অতঃপর আহ্লাদী কন্ঠে বলতে লাগল।

রাগ করেছ আমার উপর?জানো তো আমি তোমাকে কত ভালোবাসি।আমি যাই করেছি শুধুই আমাদের ভালোর কথা ভেবে করেছি,আমি তোমাকে কখনো অবহেলা করি নি আর করবও না,আমার তোমার প্রতি ভালোবাসায় কোনো কমতি থাকবে না কখনো,সর্বদা যেমন ছিলো তেমনই থাকবে,শুধু আমাদের জীবনে নতুন একজনের আগমণ ঘটেছে যে আমাদের জীবনের আসল খুশি দান করবে,আমি বাবা ডাক শুনবো আর তুমি মা,তাছাড়া মা ও নাতি নাতনীর মুখ দেখতে চান,তোমার মন খারাপ হবে বলে কখনো বলেন না হয়তোল,কিন্তু আমি বুঝতে পারি।সব দিক বিবেচনায় নিয়েই আমি পদক্ষেপ টা নিয়েছে,সত্যি বিশ্বাস করো আমি শুধু তোমায় ভালোবাসি।আর তাছাড়া ও তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড,ওকে বিয়ে করার মাধ্যমে ওরও সমস্যা দূর হয়ে গেলো আর আমাদেরও।এই অল্প বিষয়ে মন খারাপ করে থাকলে চলবে?আমার লক্ষিটি আমার সাথে রাগ করে থাকতে পারে না আমি জানি,তাই এবার মন খারাপ করে না থেকে আমাকে অনুমতি দাও,বাসর ঘরে অন্য একজন যে আমার অপেক্ষায় বসে আছে।এমনিতেই ও অনেক কিছু সহ্য করেছে জীবনে,এখন যদি তুমি রাগ করে থাকো আর আমি ওকে অবহেলা করি তখন ওর কেমনটা লাগবে বলো?তাই অনুমতি টা দিয়ে দাও।

কথাগুলো শুনে গা জ্ব**লে উঠল আঁখির,কেউ কতোটা বেহায়া ও নির্লজ্জ হলে এমন কিছুর আশা করতে পারে কারো কাছ থেকে,রা**গে,অভি**মা**নে নিজের থেকে ছাড়ালো আদ্রিশকে আঁখি,ধা**ক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলে খানিকটা দূরে,অতঃপর মুখে বাণী ফোঁটাল।

″লাইক সিরিয়াসলি আদ্রিশ,তুমি বাসর রাতে যাওয়ার জন্য আমার অনুমতি নিতে এসেছ,অথচ বিয়ে করবে তাও আমি জানতাম না,কাকে বিয়ে করছ সেটা তো আমার জন্য স্যারপ্রাইজ রেখেছিলে,এম আই রাইট বে**বি?কতো ভালো তুমি, সবার কথা ভেবে নিলে,তুমি বাবা ডাক শুনবে সাথে আমাকেও মা ডাক শোনার যোগ্যতা দিয়ে দিলে,মায়ের মুখে বলা কথাও হয়তো তুমি অনেক সময় বুঝতে সক্ষম হও না আজ উনার মনে কথা বুঝে গেলে।কি গ্রেট না তুমি,সবার কথা ভেবে আমাদের জন্য স্যারপ্রাইজ নিয়ে আসলে,সবার সমস্যার সমাধান করলে,রিদিকা কে দিলে তার হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীর মর্যাদা, হোক না তার স্বামী এখন নতুন কেউ,হোক না সে অন্য কারো স্বামী। ″

″আঁখি তুমি ভুল বোঝছো আমায়।আমি কিন্তু সব আমাদের ভালোর জন্যই করেছি।″

″না ভুল কই বোঝলাম এটা বলতে পারো যে আজ প্রথম বোঝতে পারলাম তোমায়,ইশ কথাটা কেনো আগে আমার মাথায় আসলো না,আমিও তো পারতাম তোমাকে এভাবে স্যারপ্রাইজ দিতে,নতুন কাউকে বিয়ে করে নিতে,হয়তোবা তোমার বা**চ্চার মা না হতে পারলেও তার বা**চ্চার মা ঠিকই হতে পারতাম,তখন তুমি বাবা ডাক শুনতে আর আমি মা।″

আঁখি…..

ডন্ট সা**উট আদ্রিশ,যে কথাটা শুনতেও তোমার খারাপ লাগছে, সেই কথাটা মেনে নিতে আমার কতোটা খারাপ লাগছে আন্দাজ করে নিতে পারছো তো?

কথাটা শুনে চু**রে**র মতো চোখ লুকালো আদ্রিশ।

আমাকে বোকা ভাবতে এসো না আদ্রিশ,মা বাবা পরে কেউ যদি আমায় ভালো করে জানে সেটা হলে তুমি,আফসোস একটাই এতো বড় একজন উকিল হয়েও নিজের জীবনের ন্যায় অ**ন্যা**য়ের পার্থক্য টা ভুলে গেলে,শরীরের নতুন চাহিদা মেটাতে পর করে দিলে সব পুরানো সুন্দর সম্পর্ক,সব সুন্দর ভালোবাসার অনুভুতি। আজ একজন ডাক্তার হয়েও আমি একটা বাচ্চার জন্য এমন নাটক দেখতে পাবো কখনো ভাবি নি।জীবনে প্রতিটা ধাপে তুমি আমার সাথে ছিলে আদ্রিশ,প্রতিটা ধাপে নতুনভাবে আমার বিশ্বাস জয় করেছিলে,এমনিতেই তোমার জন্য মা বাবা বংশপরিচয় ছেড়ে চলে আসি নি।কথায় আছে না যে যা করবে তা তার উপরই ফিরে আসবে,আজ আমার টাও ফিরে এলো।তোমারও এমন দিন আসুক তা আমি কখনো চাইবো না।ভালো থাকো দোয়া করি।
আর দাঁড়ালো না আঁখি সেখানে,আদ্রিশের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা যে আর জুটিয়ে উঠতে পারছে না।

ছাঁদ থেকে নেমে এসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে রইল আঁখি,খেয়াল করলো আদ্রিশও নেমে আসছে,ওর দিকে তাকালে দু’জনেরই চোখে চোখ পরল,চট করে চোখ নামিয়ে ফেললো আঁখি,দরজা লাগানোর শব্দে চোখ তুলে আবারও তাকালো সেদিকে,চোখ ছিটকে এবার বেড়িয়ে এলো জল,সাথে মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি,নতুন সুখের ঠিকানায় চলে গেলো তার ভালোবাসার মানুষটি,যে কি না একটু আগ অব্দি তার কাছে বাসর ঘরে যাওয়ার অনুমতি চাইছিল, তার এখন সেই অনুমতিটাই আর লাগলো না।

আদ্রিশ এসে বিছানায় বসতেই রিদিকা বলে উঠল।

নিশ্চয়ই আঁখি রাগ করেছে তাই না?

করবে না?এমন জিনিস কেউ কিভাবে মেনে নেয়?

কিন্তু আমরাই বা কি করবো আদ্রিশ?মনের উপর তো আর কারো জোর চলে না,আমরা নিজেদের অজান্তেই একে অপরকে ভালোবেসে ফেললাম।তাছাড়া তোমাদের বাচ্চা হচ্ছে না এর কমতি আমি পূরণ করে দিতে সক্ষম আর তোমরা বদৌলতে সমাজে আমার সম্মান বাঁচালে, এতে তো ওর কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না,আমরা তো একসাথে মিলেমিশে থাকতে পারি,যেমনটা সবসময় ছিলাম,আমার তো এ বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই।কিন্তু ও কেনো মেনে নিচ্ছে না?এমনটা জানলে আমি কখনো বিয়ে করতাম না তোমায়।

কথাগুলো বলে শুধু শুধু হেচকি তুলে কান্না শুরু করলো রিদিকা,তাতে বুকে মো**চড় দিয়ে উঠলো তার নতুন স্বামীর।

আরে কাঁদছো কেনো তুমি?সবার মানসিকতা তো একই হয় না,আমি ওকে ঠিকই মানিয়ে নিবো,তুমি চিন্তা করো না।তাছাড়া কান্না করে এতো সুন্দর রাত নষ্ট করতে চাও তুমি?আসো একটু আ*দ*র করে তোমার সব কষ্ট মিটিয়ে দিই।

অতঃপর আদ্রিশ তার নতুন বউকে নিজের কাছে টেনে নিলো।

এখনও সেই বন্ধ দরজার দিকে দৃষ্টি স্থীর রয়েছে আঁখির।ভিতরে হয়তো চলছে এক সুখের খেলা,রঙিন স্বপ্ন বুনছে নতুন দাম্পত্য জীবনের এক জোড়া নর নারী,কিন্তু সেই নতুন স্বপ্নের রঙ আঁখির স্বপ্নের পোঁ**ড়া ছাঁ**ই দিয়ে দিয়ে বানানো তিক্ত এই সত্য কিভাবে মেনে নিবে এই রমণী।চোখ যে আর বাঁধা মানছে না ,মুখ টিপে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে সে।

১৯ বছরের চেনাজানা,এর মধ্যে ৫ বছরের ভালোবাসার সম্পর্ক আর ৩ বছরের সংসার সবকিছুই আজ কিছু স্বা**র্থ সংবলিত জিনিসের নিচে চাপা পরে গেলো,একেই হয়তো বলে নিয়তির খেলা।রিদিকা আঁখির বেস্ট ফ্রেন্ড,অনেক ভাইবোনের মধ্যে থেকে মধ্যভিত্ত এক পরিবারে বেড়ে উঠেছে সে।রিদিকা আঁখির সাথে কোনো স্কুল কলেজে পড়ে নি,কারণ রিদিকার কখনো সেই যোগ্যতাই ছিলো না আঁখির সমতুল্য মান পাওয়ার,ড.আশরাফ খানের একমাত্র মেয়ে আঁখি,সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম যার,কখনো আভিজাত্যের কোনো কমতি হয় নি,তারই সমবয়সী ছিলো রিদিকা,তাদের এক ড্রাইবারের মেয়ে,প্রায়ই তার বাবার সাথে আঁখিদের বাড়িতে আসতো।সেখান থেকেই আঁখির সাথে তার পরিচয়,আঁখি কখনো কাউকে ছোটো ভাবতো না,তাই রিদিকার সাথে সে নিজের সুন্দর এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলে খুব সহজে।তখন থেকেই রিদিকার সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক,আদ্রিশের সাথে ছোটো বেলা থেকেই পরিচয় আঁখির,আঁখির দুই বছর সিনিয়র ছিল আদ্রিশ তবে তার সাথে ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল সবসময়কার,একসময় তা ভালোবাসায় রুপান্তরিত হয়,আদ্রিশের যথেষ্ট সম্পত্তি থাকলেও আঁখির বাবার তাকে পছন্দ ছিলো না কারণ তার বংশ পরিচয় ভালো ছিলো না,ওর দাদা তিন বিয়ে করেছিলেন,যেটা নিয়ে সমাজে ওর দাদার নামে অনেক দু**র্না**ম রয়ে গেছে,তারপর ওর বাবাও দুই বিয়ে করেন।সেসব বিয়ের পিছনে ছিলো তাদের অনেক কু**কি**র্তি যার ফলস্বরূপ আঁখির বাবা এমন ঘরে নিজের একমাত্র মেয়েকে দিতে চাননি।কিন্তু আঁখি ছোটোবেলা থেকেই স্বাধীন ব্যক্তিত্বের অধিকারি।তাই সে তার পছন্দ নিয়ে নিজের পরিবারের সাথে অনেক দ্বিমত করে,অতঃপর পরিবারকে রাজি করতে না পেরে ভালোবাসার টানে সব ছেড়ে আদ্রিশের কাছে চলে আসে আঁখি,দু’জনে শুরু করে নিজেদের এক সুন্দর সুখের ঠিকানা,যে ঠিকানা আজ বদলে দিলো অন্য কেউ।রিদিকার বাবা অভাবের তাড়নায় মেয়েগুলোকে যেভাবে যেখানে পেরেছেন বিয়ে দিয়েছেন।রিদিকাকেও দিয়েছিলেন কোথাও,বিয়ের পরও আঁখি রিদিকার বেশ খোঁজ রাখতো,রিদিকা প্রায়ই বলতো ওর স্বামী ওর সাথে খা**রা**প আচরণ করে,ওকে ভালো রাখে না কিন্তু আঁখি যখনি তার স্বামীকে দেখত বা তার সাথে কথা বলত তার কখনো এমন কিছুই মনে হত না,বরং ওই লোকটাকে যথেষ্ট ভালো বলে মনে হত,সেদিন হঠাৎ রিদিকা ফোন করে বলে ওর স্বামী ওকে মা**র**ছে,আঁখি আদ্রিশকে নিয়েই ছোটে গিয়েছিলো নিজের বান্ধবী কে বাঁচাতে,ওখানে গিয়ে রিদিকাকে র**ক্তা**ক্ত অবস্থায় পরে থাকতে পায় ওরা,কিন্তু ওর স্বামীকে পায় না,রিদিকাকে ওরা হাসপাতালে নিয়ে যায়,রিদিকা বলে ওর স্বামী যৌতুকের জন্য ওর উপর প্রায়ই জু**লু**ম করে,আজকেও না কি ওকে অনেক মে**রে বেড়িয়ে গেছে,তখন রিদিকা প্রেগন্যান্ট ছিল,সেই মা**রে সে তার বাচ্চা হারায়।আঁখি রেগে গিয়ে ওর স্বামীকে পুলিশে দেয় আর রিদিকাকে ওদের সাথে করে ওদের বাড়িতে নিয়ে আসে,রিদিকার ডি**ভো**র্সও আঁখি নিজ দায়িত্বে করায়।তারপর থেকে রিদিকা ওদের সাথে থাকতে শুরু করে।রিদিকা আসার আগ অব্দি আদ্রিশ আর আঁখির সম্পর্কের ভালোবাসায় কোনো কমতি ছিল না,দু’জন যতই ব্যস্ত থাকুক না কেনো দিন শেষে দু’জন দু’জনের জন্য ঠিকই সময় বের করে নিত,কখনো দু’জনের ঝগড়া হত না,একে ওপরের সাথে সব কিছু মিলিয়ে নিয়েছিলো ওরা,কখনো কোনো অমিল বা অমত থাকত না ওদের ওকে ওপরের কোনো বিষয়ে।কিন্তু রিদিকা আসার পর থেকেই সব ল*ন্ডভ*ন্ড হয়ে গেলো।বেশ কয়েকদিন ধরে আদ্রিশের মধ্যে খাপছাড়া একটা ভাব লক্ষ্য করতে পেরেছিল আঁখি,সবকিছুতেই আঁখির কোনো না কোনো দোষ খুঁজে বেড়াত,এটা ওটা নিয়ে ঝগড়া শুরু করত,যথারীতি অবহেলা করত ওকে,তাছাড়া যে একসময় নিজেই বাচ্চা নিতে চায়নি সেই হুট করে বাচ্চার আবদার করতে শুরু করল আর ৬ মাসের প্রচেষ্ঠায় সে হাঁপিয়ে গেল,বাচ্চার জন্য তার নতুন বিয়ে করতে হল তাও রিদিকাকে,কথাটা ভাবতেই তাচ্ছিল্যের হাসিটা আরও প্রখড় হল আঁখির ঠোঁটে। চোখে জল নিয়ে পাগলের মতো হাসতে লাগল আঁখি।মা বাবার অবাধ্য সন্তানদের পরিণতি হয়ত এমনই হয়ে থাকে।

চলবে……

প্রমত্ত অঙ্গনা
আরোহী নুর
(১)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here