প্রাণের_চেয়েও_প্রিয় পর্ব ৬১+৬২

#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_61
#Writer_TanhaTonu

আরশি মুচকি হাসল।ইনায়া আরশিকে দু হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল।আরশি নিজের চোখের জল আর আটকে রাখতে পারল না।টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল।মুন বলল…

—”আরশি..আমি সিহুর কথা শুনেছি।ছোট্ট একটা মেয়ের সাথে কিন্তু ইগো ওয়ার্ডটা যায়না।আমি জানি তুমি ওকে মিস করছ।ফিরিয়ে আনো সিহুকে”

আরশি করুণ চোখে মুনের দিকে তাকালো।মুন চোখের মাধ্যমে আরশিকে আশ্বস্ত করল।আরশির ঠোঁটের কোণে যেনো খুশির রেখা ফুটে উঠল….
________________________________________

সারাদিন গল্প-গুজব,মজা-মাস্তি করে মুনরা সন্ধ্যার পর ওদের বাসায় চলে যায়।আরশি সবকিছু গুছিয়ে রুমে যেতে যেতে আটটার মতো বেজে যায়।আরশি রুমে গিয়ে দেখে সিদ্রাত লেপ্টপে কি যেনো করছে।আরশি লম্বা একটা শ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে এসে সিদ্রাতের পাশে বসে বলে…

—”বিজি খুব?”

সিদ্রাত লেপ্টপে কাজ করতে করতেই জবাব দেয়…
—”একচুয়ালি আগামী এক সপ্তাহের সব কাজ আজ আর আগামীকালের মধ্যে এগিয়ে রাখতে হবে।তাই একটু প্রেসার বেশি”

আরশি ভ্রু কুচকে বলল…
—”কেন?আগামী এক সপ্তাহ কি শশুর বাড়িতে জামাই আদর খেতে যাবেন যে আজ সব কাজ করতে হবে?”

সিদ্রাত আরশির কথা শুনে আরশির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবারও কাজে মন দেয়।আরশি হতভম্ব হয়ে সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে থাকে।নাক ফুলিয়ে লেপ্টপটা সরিয়ে ও সিদ্রাতের কোলে বসে সিদ্রাতের গলা জড়িয়ে ধরে।সিদ্রাত মুচকি হেসে আরশির কোমর জড়িয়ে ধরে বলে…
—”আজ কি আমাদের পিচ্চি আরশির একটু বেশিই রোমান্স রোমান্স পাচ্ছে নাকি”

আরশি মুখ ফুলিয়ে বলে…
—”বাজে কথা বলবেন না।সত্যি করে বলুন কোথায় যাবেন যে কাজ দুদিনে শেষ করতে হবে?”

সিদ্রাত মুচকি হেসে বলে..
—”শুনতেই হবে?”
আরশি মুখ ফুলিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।সিদ্রাত মৃদু হেসে বলে…
—”এই সামার ভ্যাকাশনে ভাবছি হানিমুনটা সেড়ে ফেলব।আর শুভ কাজে দেরি করতে নেই”

আরশির অবাক হয়ে সিদ্রাতের দিকে তাকালো।পরক্ষণেই লজ্জায় লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নেতিয়ে গিয়ে সিদ্রাতের বুকে মুখ লুকালো।সিদ্রাত নিশব্দে হাসল আরশির লজ্জা দেখে।তারপর বলল…

—”খুশি তো আমার বউটা?”

আরশি সিদ্রাতের বুকে মুখ লুকিয়ে লাজুক হাসল কিন্তু মুখে কিছু বলল না।আরশির নিশ্বাসের শব্দেই যেনো সিদ্রাত উত্তর পেয়ে গিয়েছে।ও আরশির চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল।আরশি লাজুক কন্ঠে নিচু স্বরে বলল….
—”কোথায় যাবেন..”
—”তুমি কোথায় যেতে চাও বলো”

আরশি লাজুক হেসে বলল…
—”আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানেই যাবো..”

সিদ্রাত মুচকি হেসে আরশির চুলের ভাজে চুমু এঁকে দিয়ে বলল…
—”আমার আদুরী বউটা!”

আরশি আবারও মুচকি হাসল।তারপর নিজেকে সামলে কোমল কন্ঠে বলল…
—”আপনার উপর তো তাহলে কাজের চাপ বেশি পড়েছে তাইনা?”
—”না রে পাগলী..আমি মিস্টার আয়ুব আর রুহানকে বলে যাবো সামলে নিতে সব।সমস্যা হবে না..”

—”আয়ুব!মানে সিও স্যার?”
—”হুম..”
—”ওহ..আচ্ছা আপনি কাজ করুন মনোযোগ দিয়ে।আর আমার হেল্প লাগলে বলিয়েন”

সিদ্রাত কিছু একটা ভেবে বলল…
—”আচ্ছা তুমি সিওকে একটা ইমেইল করে দেও তোমার ফোনে আমার আইডি দিয়ে যে এক সপ্তাহ পর সব ডিজাইনারদের ওয়ার্ক লিস্ট এন্ড ইনকামটা যেনো আমাকে দেয়…”

আরশি মুচকি হেসে বলল…
—”আচ্ছা…”

————
—”উফফ ভালো লাগে না এসব আর!এই উনিটা যে কোথায় গেলেন?আমি এত কম সময়ে কিভাবে এতো কিছু প্যাক করব!মেডিকেল থেকে এসেই প্যাক করার কাজে লেগে যেতে হয়েছে..মাথাটা আমার শেষ আজ”

আরশি দাঁত কিড়মিড় করতে করতে প্যাক গুছাতে লাগল। আরশি সন্ধ্যার একটু আগে বাসায় এসেছে।সামার ভ্যাকাশন আগামীকাল থেকে শুরু।আজ মেডিকেলে ক্লাস ছুটি দিয়ে দিয়েছে।আগামীকাল সকালেই সিদ্রাত আর আরশি রওনা হবে সুইজারল্যান্ডের লুসার্নের উদ্দেশ্যে।আরশি জামা-কাপড় গুছাচ্ছিলো। সিদ্রাত ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হলো।আরশির পাশে বেডে বসে বলল….
—”প্যাকিং কি শেষ?কতটুকু বাকি আছে আর?”

আরশি সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে….
—”আপনি একটা খারুচ…”

সিদ্রাত আরশির কথায় হকচকিয়ে গেলো।বলল…
—”তোমার আবার কি হলো?এতো রেগে আছো কেন?”
—”রাগবো না তো কি করব?মেডিকেল থেকে এসে আমি একটু বসতেও পারিনি। এসেই কাজে লেগে যেতে হয়েছে।আমার মাথা চিনচিন ব্যথা করছে।ভালো লাগে না আর..”

আরশি বলতে বলতে কেঁদেই দিলো।সিদ্রাত আরশির অবস্থাটা বুঝতে পারল।আরশি দুগাল আলতো করে ধরে বলল…
—”সরি সোনা..আমি বুঝতে পারিনি তুমি টায়ার্ড।যাও তুমি রেস্ট নাও।আমি তোমার মাথা আর ঘাড় ম্যাসাজ করে দেই”

আরশি অসহায় চোখে তাকালো সিদ্রাতের দিকে।সিদ্রাত ইশারায় আরশিকে শুতে বলল।আরশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেডের এক সাইডে শুয়ে পড়ল।সিদ্রাত আরশির মাথার পাশে বসে মাথা ম্যাসাজ করে দিতে লাগল।আরশির ক্লান্তিগুলো যেনো একটু একটু করে কমে যাচ্ছে।সিদ্রাত মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল…
—”ভালো লাগছে?”
আরশি চোখ বন্ধ রেখেই বলল…
—”হুম…

আরশি কথাটা বলে ঘুরে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ল।সিদ্রাত আরশির না বলা কথা বুঝতে পেরে ঘাড় আর পিঠেও ম্যাসাজ করে দিতে লাগল।আরাম পেয়ে আরশি এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।সিদ্রাত মৃদু হেসে বলল…
—”পাগলী আমার!”

সিদ্রাত নিজেই আরশির আর নিজের বাকি প্যাকিংটাও সেড়ে নিলো…

আরশির যখন ঘুম ভাঙল তখন ও নিজেকে সিদ্রাতের শক্ত বাঁধনে আবিষ্কার করল।আরশি ঘুমু ঘুমু চোখে মুচকি হেসে সিদ্রাতের খোচা খোচা দাড়িওয়াল গালটায় হাত বুলালো।তারপর শুয়ে থেকেই একটা আড়মোড়া ভেঙে কাত হয়ে সিদ্রাতকে আরও ভালো করে জড়িয়ে ধরে সিদ্রাতের গলার ডানপাশে মুখ গুজল।সিদ্রাত ঘুম জড়ানো কন্ঠেই বলল…
—”ক’টা বাজে জান?আজান কি দিয়ে দিয়েছে?”
—”উহু..”

সিদ্রাত পুনরায় আর কিছু বলল না।আবারও হয়ত ঘুমের দেশে চলে গিয়েছে।আরশিও আবারও ঘুমিয়ে পড়ল।চোখটা হয়ত ভালো করে লাগেনি তখনই ও অনুভব করতে পারল কেউ ওর গালে কামড় দিচ্ছে।কেমন একটা জ্বলা অনুভব হলো আরশির।সাথে সাথে চোখ খুলে ফেলল ও।আর চোখ খুলতেই অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো কারণ সিদ্রাত আরশির গালে ঠোঁট বুলাচ্ছে,দাঁত দিয়ে ছোট ছোট বাইট দিচ্ছে।আরশি সিদ্রাতকে ধাক্কা দিয়ে সরে আসতে চাইল কিন্তু সিদ্রাতের শক্তির সাথে পেরে উঠতে না পেরে করুণ চোখে তাকালো।কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল…
—”আপনি আমার গালটায় স্পট ফেলানোর পায়তারা করছেন তাইনা?”

সিদ্রাত মোটামুটি মাঝারি আকারের একটা বাইট দিলো আরশির ডান গালে।আরশি চাপা কন্ঠে চিৎকার করে উঠল….
—”আহহ,,আউচ..”

সিদ্রাত টেডি হেসে বাইটের জায়গায় ঠোঁট বুলাতে বুলাতে বলল…
—”আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর যে তুমি রাতে বারোটার পর মুখে ফেইস প্যাক লাগিয়েছো তা আমি জানিনা ভেবেছো জানপাখি!হাহা..আমি তো সবই জানি!”

আরশি গোলগোল চোখে সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলল।কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল…
—”তাই বলে আপনি আমার গালে বাইটের স্পট লাগাবেন..মানুষ কি বলবে এখন?সিউর আমার গালটা কালচে হয়ে গিয়েছে”

সিদ্রাত ভাবলেশহীন ভাবে বলল…
—”তোমার সৌন্দর্য অন্য মানুষের জন্য নয়।শুধু আমার জন্য।তাই কে কি বলল তা নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর কথা না।কই আমার জন্য তো এই কয়দিনে একদিনও দেখলাম না আলাদা করে শরীরের যত্ন নিতে!যেই ঘুরতে যাবে শুনেছ ওমনি শুরু হয়ে গিয়েছে তাইনা..”

সিদ্রাত কথাটা বলেই আরশির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো।আরশি তাচ্ছিল্যময় হেসে বলল…
—”আপনাকে কাবু করার ক্ষমতা কি আমার সৌন্দর্যের আছে!তাহলে তো কবেই দুটো আত্মা এক হয়ে যেত।হয়ত আল্লাহ আমাকে আপনার মতো মূল্যবান মানুষের চোখ জুড়ানোর মতো সৌন্দর্যই দেইনি।আপনার এম্বিশন অনেক উপুর লেভেলের কিনা!”

আরশির কথাটা সিদ্রাতের বুকে গিয়ে বিঁধল।কিন্তু ও তা প্রকাশ করল না।বরং স্বাভাবিক গলায়ই বলল…

—”সেটা পরের কথা।আমার কথা বাদ দিলাম…ইসলাম কি বলেছে তা তো মানবে?তুমি যদি বাইরের মানুষকে দেখানোর জন্য নিজের সৌন্দর্যের যত্ন নাও তাহলে অবশ্যই তা পাপ।মেয়েদের সাজ তার হাজবেন্ডের জন্যই।সো এসব চিন্তা ভাবনা বাদ..পূর্ণ পর্দার সহিত তুমি আমার সাথে সুইজারল্যান্ড যাবে..”

আরশির চোখগুলো এবার বড় বড় হয়ে গেলো।ও কিছুটা অবাক হয়েই বলল…
—”হাও ইজ দিজ পসিবল?সুইজার ল্যান্ড আমি খিমার,জিলবাব পড়ে যাবো নাকি!মানুষ আমায় সার্কাসের জোকার ভাববে…”

সিদ্রাত শক্ত গলায় বলল…
—”তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো যে ক্ষেত্র বিশেষ আমরা ইসলামের বিধি-বিধান ও শরিয়তকে নিজদের মতো করে এডিট করে নিবো?”.

আরশির মুখটা এবার ছোট হয়ে গেলো।ও চোখ নামিয়ে ফেলল।নিজের কাছেই এবার খারাপ লাগছে এটা ভেবে যে পরোক্ষভাবে ও কথার মাধ্যমে ইসলামের অবমাননা করে ফেলল।সিদ্রাত আরশির অবস্থা বুঝতে পেরে মাথা ঠান্ডা করল।আরশিকে কাছে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে শীতল কন্ঠে বলল…

—”রিলাক্স পাখিটা…তুমি ব্যাপারটাকে হার্ডভাবে নিয়ো না…খিমার না পড়ো জিলবাব তো পড়তেই পারো.. দেখো ইন্টারনেটে তুমি দেখতে পাবে উন্নত উন্নত এরাবিক কান্ট্রিগুলোর মেয়েরা অনেক সুন্দর ও সিম্পলভাবে মাথায় হিজাব সেট করে রাখে।তুমিও ওভাবেই না হয় করো।এতে কিন্তু একটুও খারাপ লাগে না বরং ভালোই লাগে।আর তোমার সমস্যা হলে মুখ আর হাতের কবজি ঢাকতে হবেনা শুধু পায়ে মোজা আর শু পরবে..দ্যাট’স এনাফ..আমি প্রথমেই তোমার উপর কিছু চাপিয়ে দিবো না..ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?”

আরশি নিচু স্বরে বলল…
—”হুম..সরি আমি ইসলামের বিধান নিয়ে এতোটা ইলজিক্যালি বলতে চাইনি।কিভাবে যে,,,,”

—”শশশ…”
সিদ্রাত আরশির ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো।আরশি সিদ্রাতের গভীর চোখের দিকে তাকালো।ঘোলাটে পেস্ট কালার এই চোখজোরা যে সবসময়ই ওকে মোহে বন্দি করে ফেলে।আরশি সিদ্রাতের বুকে মাথা রাখল।সিদ্রাতও আরশিকে নিজের মাঝে বন্দি করে নিলো…
#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_62
#Writer_TanhaTonu

আরশি নিচু স্বরে বলল…
—”হুম..সরি আমি ইসলামের বিধান নিয়ে এতোটা ইলজিক্যালি বলতে চাইনি।কিভাবে যে,,,,”

—”শশশ…”
সিদ্রাত আরশির ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো।আরশি সিদ্রাতের গভীর চোখের দিকে তাকালো।ঘোলাটে পেস্ট কালার এই চোখজোরা যে সবসময়ই ওকে মোহে বন্দি করে ফেলে।আরশি সিদ্রাতের বুকে মাথা রাখল।সিদ্রাতও আরশিকে নিজের মাঝে বন্দি করে নিলো…
______________________________________

আরশি মন খারাপ করে সিদ্রাতের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে প্লেনে।একটু পরই হয়ত এই বিহঙ্গ উড়াল দিবে নীল-সাদা আকাশ পানে।আর এই উড়া আরশির লাইফেরও প্রথম অভিজ্ঞতা কিন্তু তা নিয়ে আরশির একটুও আগ্রহ নেই।মুখটা মলিন তার। মনটা অমবস্যার চাঁদে ঢাকা..সিদ্রাত আড়চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করল।মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল…
—”তুমি কি খুশি নও আমাদের হানিমুন নিয়ে?”

আরশির করুণ চোখে সিদ্রাতের দিকে তাকালো।মুখে কিছু বলতেও পারছে না মেয়েটা..ও চোখজোড়া বন্ধ করে মলিন কন্ঠে বলল…

—”আমি খুব খুশি..”
—”তাহলে?”

আরশিকে ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রেখে বলল…
—”তাহলে আবার কি!কিছু না..”

সিদ্রাত আরশিকে উঠিয়ে ওর গাল দুটো ধরে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো আরশির আঁখিপানে।আরশি সিদ্রাতের এমন চাহনীতে যেনো আরও গলে গেলো।ওর চোখ গলিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রুক্ণা বেরিয়ে এলো।আরশি ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে ফেলল।সিদ্রাত মায়াভরা কন্ঠে বলল…

—”কি হয়েছে আমায় বলবে না জানপাখি?আমাকে না বললে তো আমি সলভ করতে পারব না প্রবলেম”

আরশি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল…
—”সিহুর কথা খুব মনে পড়ছে।ওকে ছাড়া কোথাও কিছু ভালো লাগছে না।আমি সিহুর কাছে যাবো”

সিদ্রাত অবাক হলো আরশির কথায়।ওর ঠোঁটের কোণায় খুশির এক টুকরো হাসি ফুটে উঠলেও ও তা আরশির সামনে প্রকাশ করল না।আদুরী কন্ঠে বলল…..
—”সিহুকে খুব মিস করছ বুঝি তাইনা?আচ্ছা আমরা সুইজারল্যান্ড থেকে এসেই আগে সিহুর কাছে যাবো..ওকে ডিয়ার”

আরশি নাক টেনে কাঁদতে কাঁদতে বলল….
—”আমি সুইজারল্যান্ড গিয়ে শান্তিতে থাকতে পারব না।সিহুর ভাবনা আমায় খুব পুড়াচ্ছে।বাচ্চা মেয়েটা একা কি করছে কে জানে!”

আরশি এটুকু বলে শব্দ করে কেঁদে উঠল।সিদ্রাত আরশির মাথাটা নিজের বুকে নিয়ে আরশিকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।আরশি সিদ্রাতের বুকে মুখ গুঁজে কেঁদেই যাচ্ছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেন টেইক অফ করল।আরশি চমকে গেলো।মুখ তুলে অশ্রু সিক্ত অসহায় চোখে সিদ্রাতের দিকে তাকালো।এই চোখজোড়া যেনো বলছে সিহুকে ছাড়া কোথাও যাবে না সে।এখনই যেনো প্লেন থেমে যায়…

আরশি চোখটা মুছে বড্ড অভিমান নিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল….
—”আমি আপনাকে বললাম সিহুর কাছে যাবো।তাও আপনি আমায় নিয়ে গেলেন না..”

সিদ্রাত মুচকি হেসে আরশির অশ্রসিক্ত চোখজোড়ায় ঠোঁট ছোঁয়ালো।আরশি গভীর শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলল।সিদ্রাত বলল…

—”জানপাখি বাচ্চামো করলে কি হয় বলো!তখন কি আমরা চাইলেই প্লেন থেকে নামতে পারতাম?তুমি আমায় সিহুর কথা বলেছো প্লেন টেইক অফ করার পাঁচ-ছয় মিনিট আগে…”

আরশি নিজের ভুলটা বুঝতে পারল।তবুও ওর খুব বেশি সিহরাতের কথা মনে পড়ছে।মন কি আর কোনো বাঁধা মানে!মনই একমাত্র জিনিস যার পথে পাহাড়,মহাসাগর বা অসীম আকাশ-কোনোটিই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা।তার গন্তব্য যে অসীম সীমানায়…..

মন খারাপ নিয়েই আরশির জার্নিটা সম্পন্ন হলো।অনেক চেয়েও ও নিজের মনটা ভালো করতে পারলো না।সিহু যেনো প্রতিজ্ঞা করেছে আরশির এই ট্রাভেলে পানি ঢালবে।সিদ্রাত অনেক চেষ্টা করেও আরশির মন ভালো করতে পারেনি…

সাড়ে এগারো ঘন্টার জার্নি শেষে ওরা লুসার্নের এক হানিমুন রিসোর্টে উঠল।তখন লুসার্ন শহরে সন্ধ্যা নেমেছে মাত্র।সিদ্রাত আরশিকে নিয়ে নিজেদের বুক করা রুমে চলে এলো।রুমের ভিতর ঢুকে আরশির চোখ ছানাবড়া।যতটুকু ক্লান্তি আর মন খারাপ ছিলো সব যেনো উধাও হয়ে গেলো রুমটার ডেকোরেশন দেখে।লুসার্ন লেইকের সাথে গড়ে উঠা এই “গ্রান্ড হোটেল ন্যাশনাল” এর বাইরেরটা যেমন সুন্দর ভিতরটা আরও বেশি সুন্দর।একদম রয়াল অর্থাৎ রাজকীয় সাজে সজ্জিত পুরো রুমটা।বড় রুমটার দেয়াল থেকে বিছানার চাদর,ফার্নিচার সবই রুচিশীল ও গোল্ডেন কালারে ডেকোরেট করা।ডান পাশের ফুল গ্লাসের জানালাগুলো দিয়ে বড় স্বচ্ছ নীল লেইকটা অনায়াশেই দেখা যায়।আরশি জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।সিদ্রাত মুচকি হেসে আরশির পেছনে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে ঠুতনি ঠেকিয়ে বলল…

—”পছন্দ হয়েছে?”

আরশি মুচকি হেসে বলল…
—”হুমম..খুউউউবব..”

সিদ্রাত মৃদু হাসল।তারপর বলল…
—”ফ্রেশ হয়ে নেয়া যাক”

আরশি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।প্রথমে সিদ্রাত ফ্রেশ হয়ে এলো।তারপর আরশিও ফ্রেশ হয়ে নিলো।শাওয়ার নেয়ার পর যেনো শরীরটা আরও বেশি ছেড়ে দিচ্ছে।সব ক্লান্তি যেনো একসাথে হানা দিচ্ছে।
সিদ্রাত অলরেডি শুয়ে পড়েছে।আরশিও সিদ্রাতের পাশে শুয়ে ওর বুকে মাথা হেলিয়ে দিলো।সিদ্রাত আলতো হাতে আরশিকে জড়িয়ে ধরে বলল…

—”প্রচুর টায়ার্ড লাগছে।একটু ঘুমালে ফ্রেশ লাগবে…”
—”হুম…”

অতঃপর দুজনই ঘুমিয়ে গেলো….

আরশির ঘুম ভাঙলে ও প্রথমেই সিদ্রাতের ঘুমন্ত মুখটা দেখতে পেলো।অটোমেটিক্যালি ওর ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠল।আরশি মুখটা এগিয়ে নিয়ে সিদ্রাতের কপালে চুমু খেলো।তারপর লাজুক হেসে সিদ্রাতের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল…

—”আমার কিউট বরটা!উফফ এত্তো কিউট কেন এই লোকটা!আমার বুঝি কষ্ট হয়না উনার এই ফেয়ার এন্ড ফিট বডি,সিল্কি ব্লাকিশ ব্রাউন চুল আর পেস্ট চোখের মায়াজাল থেকে নিজেকে আটকাতে!হুহ..খারুচ লোক।বেশি সুন্দর মানুষ বিয়ে করলে এজন্যই সমস্যা!”

আরশির এসব ভাবনার মাঝেই সিদ্রাতের ফোনটা বেজে উঠল।আরশি চোখ কোণা করে মোবাইলটার দিকে তাকালো।সিদ্রাতের পিএস রুহানের নামটা ভাসছে স্ক্রিনে।আরশি সিদ্রাতকে একবার ডাকতে গিয়েও ডাকল না ঘুমটা নষ্ট হবে বলে।নিজেই ফোনটা নিয়ে রিসিভ করল।আরশি হ্যালো বলার আগেই ও পাশ থেকে রুহানের উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর ভেসে এলো…

—”স্যার আপনি কি সুইজারল্যান্ড চলে গিয়েছেন?সিহুর অবস্থা তো ভালো না।সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে।হাত-পাও ভীষণ ঠান্ডা।সেন্সলেস হওয়ার আগে বুকে ধরে অনেক্ষণ কেঁদেছে আর আরশি ম্যামের কথা বলছিলো মানে..আম্মু আম্মু করছিলো।আমি এখন কি করব ওকে নিয়েএতো রাতে?কোন হসপিটালে এডমিট করাবো?”

রুহানের কথা শুনে আরশির হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো।ওর মাথাটা যেনো চক্কর দিয়ে উঠল।অনর্গল অবিরাম অশ্রু গড়াতে লাগল আরশির চোখ জোড়া বেয়ে।বারবার কানে যেনো বাজছে সিহুর “আম্মু” ডাকটা।আরশি নিজে যেনো বাচ্চাটার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে।আরশি চিৎকার করে কেঁদে উঠল……

—”সিহুউউউ…”

চলবে…
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here