প্রাণ_ভোমরা পর্ব ৪২+৪৩

#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৪২)

সন্ধ্যা নামো নামো ভাব। চারপাশের শেষ বিকেলের মৃদু আভা কুয়াশার বুকে হারিয়ে যাচ্ছে৷ শীতের শিরশির বাতাসে কাঁপছে দুটো প্রাণ। চোখে,মুখে উদাসী ভাব। পা ফেলছে আলস্য চালে। মোড় ঘুরার জন্য বাঁকা পদক্ষেপ ফেলতে নীরব বলল,
“এখানেই দাঁড়াই।”

ভ্রমর বুঝি সেই কথাটা শুনল না। আরও দু কদম এগিয়ে যেতে নীরব খানিকটা উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি আরও কিছুক্ষণ হাঁটবে?”

এবার ভ্রমরের কর্ণদ্বয় কেঁপে উঠল। চমকে পেছনে তাকাল। নীরব না চায়তেও ঠোঁট দুটো হেসে উঠল। ভ্রমর এদিকে চলে আসার আগে সেই হাসি উধাও। মুখজুড়ে ফিরে এলো কঠোর গাম্ভীর্য।

ভ্রমর খানিকটা দূরত্ব টেনে দাঁড়াল। গায়ের গরম চাদরটা বুকে টেনে নিল ভীষণ জড়তায়। ভ্রমরের মনে হলো রেষ্টুরেন্টে প্রথম দেখা হওয়ার দিনও এমন অস্বস্থি হয়নি। চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না!

“তোমার বয়স কত?”

নীরবের আকস্মিক প্রশ্নে ভ্রমর চোখ তুলে তাকাল। খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলল,
“উনিশ।”

নীরব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমার থেকে পুরো এগারো বছরের ছোট তুমি।”

ভ্রমর ভেবেই পেল না হঠাৎ বয়স নিয়ে কথা হচ্ছে কেন। গুণে গুণে কত বছরের ছোট-বড় তা উল্লেখ করার কারণও খুঁজে পেল না। সহসা বলল,
“তাহলে কি এখন থেকে আপনাকে আংকেল বলে ডাকব?”

ভ্রমরের প্রশ্ন শুনে নীরবের হতবুদ্ধি অবস্থা! অপ্রতিভ হয়ে জানতে চাইল,
“কেন?”

ভ্রমরের চটপটে উত্তর,
“কারণ আপনার ভাইয়া ডাক পছন্দ হচ্ছে না। অথবা বয়সের সাথে যাচ্ছে না।”
“আমি তোমাকে এ কথা বলেছি?”
“না।”
“তাহলে?”

ভ্রমর চোখ নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“আমি ভাবলাম আপনাকে হয়তো কখনও ভাইয়া ডেকেছি যেটা আপনার ভালো লাগেনি। কারণ আপনি আমার থেকে এগারো বছরের বড়।”

শেষ কথাটা একটু স্পষ্ট ও জোরাল স্বরে বলল ভ্রমর। নীরব কতক্ষণ বিমূঢ় থেকে হেসে ফেলল। হাসির শব্দে ভ্রমর মাথা তুলল। বিরক্ত হয়ে বলল,
“হাসছেন কেন?”

নীরব হাসি থামিয়ে বলল,
“আমার মনে হয় তুমি এখন পর্যন্ত আমাকে ভাইয়া ডাকোনি। ডাকলেও আমি খেয়াল করিনি।”
“তাহলে বয়স গুণলেন কেন?”

মুহূর্তে নীরবের মুখের রঙ পাল্টে গেল। বিষাদের ঢেউ আছড়ে পড়ল মনের তীরে। ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে সব!

নীরব প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
“তুমি আমার বাবাকে চেনো?”
“আমি তো আপনাকেই চিনি না। আপনার বাবাকে কিভাবে চিনব?”

নীরব মাথা নেড়ে ভ্রমরের কথার সম্মতি জানাতে জানাতে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। তার মধ্য থেকে পাসপোর্ট সাইজের একটি ছবি বের করে বলল,
“আমার বাবা।”

নীরবের বাড়িয়ে দেওয়া ছবিটা গ্রহণ করল ভ্রমর। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
“আগে কখনও দেখিনি।”
“আমার বাবাও তোমাকে দেখেনি।”

ভ্রমর ছবি থেকে চোখ সরিয়ে নীরবের মুখে রাখল। তার হুটহাট কথার মানে বুঝতে পারছে না সে। এই কথার বিপরীতে কী বলবে তাও ভেবে পাচ্ছে না। তার সমস্যা কাটিয়ে নীরবই বলে উঠল,
“তবুও তিনি তোমাকে খুব ভালোবাসতেন।”

ভ্রমর বিস্ময় নিয়ে তাকালে নীরব একপেশে হেসে বলল,
“আশ্চর্য লাগছে না? একটা মানুষ তোমাকে না দেখেই ভালোবেসেছে,স্নেহ করেছে। চোখের সামনে দেখতে চেয়েছে।”

ভ্রমর বিশ্ব মাপের বিস্ময় নিয়ে সুধাল,
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। ”
“তাহলে উনাকে নিয়ে আসলেন না কেন?”

নীরবের সেই একপেশে হাসিটা মিলিয়ে গেল। চোখের কোণে উষ্ণ জলেরা উপস্থিত হলো। বাবার ছবিটা মানিব্যাগে ভরতে ভরতে বলল,
“তিনি বেঁচে নেই।”

নীরবের অপ্রকাশিত ব্যথাটা ভ্রমরের হৃদয়ে ধাক্কা দিল। বিষন্ন উঁকি দিল চোখের তারায়। শুষ্ক ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল সহানুভূতি প্রকাশের জন্য। তার আগেই নীরব বলল,
“তিনি বেঁচে থাকলেও এখানে আসতেন না।”
“কেন?”
“কারণ উনি তোমাকে এখানে নয় তোমার বাবার বাড়িতে দেখতে চায়তেন।”
“বাবার বাড়ি!”

ভ্রমরের কণ্ঠে বিস্ময়, কুণ্ঠা, আনন্দ। নীরব ততক্ষণে মানিব্যাগ পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। ভ্রমরের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে বলল,
“হ্যাঁ। বাবার বাড়ি। যেখানে তোমার বাবা থাকেন,দাদি থাকেন।”
“আমার দাদিও আছে?”

নীরব সাথে সাথে উত্তর দিল না৷ ভ্রমরের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে ভারী নিশ্বাস ফেলল। চোখ সরিয়ে বলল,
“হ্যাঁ। যাবে দাদির কাছে?”

ভ্রমর উচ্ছসিত কণ্ঠে বলল,
“আপনি নিয়ে যাবেন?”

নীরব আর কিছু বলতে পারল না। গভীর নিশ্বাস টেনে বিড়বিড় করল, ‘আমার বাবার শেষ চাওয়াই তো ছিল এটা। না নিয়ে যাওয়ার উপায় আছে কি?’ সামনাসামনি বলল,
“তুমি রাজি থাকলে অবশ্যই নিয়ে যাব।”

খুশিতে ভ্রমরের চোখ,মুখ ঝলমলিয়ে উঠল। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে নীরবের দিকে একপা এগিয়ে আসল। প্রকাশ করা হলো না। দৃষ্টি অন্য দিকে রেখে স্বগোতক্তি করল, ‘রিধি আপু না?’

নীরব ভ্রমরের দৃষ্টি অনুসরণ করতে দেখল একটা মেয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে এদিকে এগিয়ে আসছে। চোখে,মুখে বিষন্নতার ছাপ। ভ্রমর নীরবকে রেখে একটু সামনে এগিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“রিধি আপু,কোথাও যাচ্ছো?”

রিধি খানিকটা চমকাল। এই সময় এমন জায়গায় ভ্রমরের দেখা পাবে তা তো ধারণাতীত। সে আশেপাশে হৃদ্যকে খুঁজতে গিয়ে চোখ আটকাল নীরবের উপর। সেই সময় ভ্রমর বলল,
“তোমরা পরিচিত হবে?”

রিধি উত্তর দল না। নীরব এদিকে এগিয়ে আসল। ভ্রমর দুজনের দিক থেকে সাড়া না পেয়ে নিজেই বলল,
“রিধি আপু,উনার নাম নীরব। বাজানের আত্মীয়।”

কথাটা শেষ করে ভ্রমর নীরবকে দ্রুত জিজ্ঞেস করল,
“আপনি তো বললেন না,আপনাকে ভাইয়া বলব নাকি আংকেল!”

নীরব জবাবে বলল,
“তোমরা কথা বলো,আমি আসছি।”

কথাটা শেষ করে নীরব হাঁটা ধরলে ভ্রমর পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল,
“আম্মুকে বলে দিয়েন আমি পরে আসব।”

__________________

হাতে বেশ কয়েকটি কাগজ নিয়ে হৃদ্যের রুমে ঢুকলেন আজিজুল হক। হৃদ্য বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতে তিনি বিছানার এক কোণে বসলেন। কাগজে চোখ রেখে বললেন,
“রিধির থেকে তোমার ব্রেইন অনেক বেশি শার্প ছিল। মুখস্থ বিদ্যাই খুব পারদর্শী। অংক কষায় ওস্তাদ। ইংরেজি উচ্চারণে চটপটে। পরীক্ষার নাম্বারও সব সময় বেশি পেতে। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার ছাড়া বাসায় ফিরেছ কখনও এমন মনে পড়ছে না।”

আজিজুল হক থামলেন। কাগজ থেকে নজর সরালেন না। হৃদ্য মাঝে কিছু বলল না। আজিজুল হক নিজেই বললেন,
“অথচ এই কাগজগুলো বলছে অন্য কিছু!”

হৃদ্য ভয়ে ভয়ে বলল,
“এগুলো কিসের কাগজ,আব্বু?”

আজিজুল হক চোখ তুললেন। ঠোঁট টেনে হেসে বললেন,
“কাল বললে না চাকরি করবে? তার জন্য তো তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগবে। তাই তোমার স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট তুলে আনলাম।”

হৃদ্য থম মেরে গেল। মাথা ঝুকিয়ে নিলে আজিজুল হক বললেন,
“ভালো চাকরির জন্য সনদপত্রে ভালো নাম্বারেরও প্রয়োজন।”

আজিজুল হক বসা থেকে উঠতে উঠতে বললেন,
“চাকরির কথা ভুলে যাও। ওটা তোমার দ্বারা হবে না।”

হৃদ্য অসহায় চোখে তাকালে আজিজুল হক কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন,
“ব্যাংকে আমার জমানো টাকার অংক খুব বড় না হলেও একদমই ছোট নয়। নার্সারিটা পরিচর্যা কর। শখের বশে শুরু করলেও ক্যারিয়ার গঠনে দারুন ভূমিকা রাখবে। মূলধন নিয়ে ভাবিস না। জমানো টাকায় না হলে লোন নিব। ব্যাংকে চাকরি তো আর এমনি এমনি করছি না!”

হৃদ্য বিস্ময় চোখে বাবার দিকে তাকাল। তিনি মৃদু হাসলেন। আস্থা দিয়ে বললেন,
“তোর উপর আমার বিশ্বাস আছে।”

সেই সময় ভ্রমর হুড়মুড়িয়ে ঢুকল। কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। চুপচাপ চলে যেতে নিলে আজিজুল হক দ্রুত বললেন,
“আমি যাই।”

তিনি চলে যেতে ভ্রমর বলল,
“তোমার কাছে দড়ি হবে?”
“দড়ি? দড়ি দিয়ে কী করবি?”
“আগে দেও তারপর বলছি।”

হৃদ্য বিছানায় বসতে বসতে বলল,
“নেই।”
“শিকল?”

হৃদ্য জবাব না দিয়ে ভ্রূ বাঁকিয়ে তাকাল। বসা থেকে উঠে এসে বলল,
“কী হয়েছে বল তো। হঠাৎ দড়ি,শিকল খুঁজছিস কেন?”

ভ্রমর হৃদ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার হাত,পা বাঁধব।”
“আমার হাত,পা বাঁধবি?”
“হ্যাঁ। ”
“কেন? আমি কী করেছি?”
“এখনও করোনি। করবে।”
“কী করব?”
“পালাবে। আমাকে গিফট দেওয়ার ভয়ে পালাবে।”
“গিফট! তোকে হঠাৎ গিফট দিতে যাব কেন?”

ভ্রমর মন খারাপ করে বলল,
“কাল যে আমার জন্মদিন ভুলে গেছ?”

হৃদ্য খানিকটা ভাবনায় ডুব দিতে ভ্রমর বলল,
“তোমার গিফট দিতে হতে হবে না। শুধু উপস্থিত থাকলেই হবে। বলো না থাকবে?”
“কোথায়?”
“কোথায় আবার আমাদের বাসায়। বাজান বলছে কাল অনেক বড় অনুষ্ঠান হবে।”

হৃদ্য কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেল। অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়াতে ভ্রমর সামনে এসে দাঁড়াল। নিজের হাতের উপর হৃদ্যের হাত রেখে বলল,
“আমাকে ছুঁয়ে কথা দেও তুমি কাল থাকবে।”

হৃদ্য হাত সরিয়ে বলল,
“থাকব। এর জন্য ছুঁয়ে কথা দেওয়ার কী আছে?”

ভ্রমর জোর করে হৃদ্যের হাত ধরে বলল,
“নাহলে তুমি কথা রাখবে না। প্রতি বছরই তুমি কথার খেলাপ করো। গত বছরও করেছ। এ বছর করা যাবে না। এবার আমি বাজানের সাথে তোমার কাছ থেকেও দোয়া নিব।”

হৃদ্য আবারও হাত সরিয়ে নিতে চাইলে ভ্রমর জোর করে ধরে রাখল। কঠিন স্বরে বলল,
“কথা না দিলে আমি তোমাকে ছেড়ে যাবই না। সারা রাত পাহারা দিব।”

হৃদ্য মুগ্ধ চোখে তাকাল। পর মুহূর্তে হেসে ফেলল। সহাস্যে বলল,
“এত কষ্ট করতে হবে না। যা কথা দিলাম।”
#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৪৩)

তখন হৃদ্যের বয়স সতেরো কী আঠারো। ভ্রমরের সাথে সম্পর্ক সহজ ও স্বাভাবিক। আলাদা দুটো বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুজন দুষ্টুমিতে মাখামাখি খেত ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু ইচ্ছে হলেই বাইরে দেখা করতে পারত না। স্কুলের গেইটের সামনে দাঁড়াতেও পারত না। বেশ কয়েক দিনের পরিকল্পনার পর আঁতকা দেখা করত। তাও কয়েক মিনিটের জন্য। পাছে আম্মু দেখে ফেলে সে ভয়ে আধমরা হয়ে থাকত ভ্রমর! তেমনি এক আঁতকা দেখাতে ভ্রমর বলল,
“তুমি কাল আমাদের বাসায় আসবে?”

হৃদ্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কেন?”
“আমাদের বাসায় মিলাদ হবে।”
“হঠাৎ মিলাদ?”
“হঠাৎ নয়। প্রতি বছরই হয়।”
“তাই? আগে কখনও বলিসনি তো।”
“আগে তো ভাবিনি,আম্মুকে তোমার বাসায় দাওয়াত পাঠাতে বলব।”

হৃদ্য চুপ থাকলে ভ্রমর আগ্রহ নিয়ে সুধাল,
“আসবে?”
“আগে তো শুনি মিলাদের উপলক্ষ্য কী।”

ভ্রমর চট করে বলল,
“আমার তেরো তম জন্মদিন।”

হৃদ্য বিস্ময় চোখে তাকাল। তাকিয়েই থাকল। হঠাৎ মনে হলো,এই এত বছর দুজন এক সাথে চলাফেরা করছে অথচ ভ্রমরের জন্মদিনটাই জানা হয়নি। না মেয়েটা বলেছে। না সে জানতে চেয়েছে। তাহলে তারা দিবা-নিশি কী কথা বলে? এত কথার ফাঁকে বিশেষ কথাগুলোই বলা হয়নি!

হৃদ্য আফসোস ঢেলে দেয় নিশ্বাসে। বিস্ময় কাটিয়ে বলল,
“তাহলে তো তোর জন্য উপহার কিনতে হবে!”

ভ্রমর হালকা হাসল। আহ্লাদী সুরে বলল,
“হ্যাঁ। সব থেকে চমৎকার উপহারটা দিবে কিন্তু। আমি সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলব,এটা আমার হৃদ্য ভাইয়া দিয়েছে।”

ভ্রমরের কথায় হৃদ্যও হেসে ফেলল। খানিকটা চিন্তায়ও পড়ল। কী এমন দেওয়া যায় যা দেখে ভ্রমর আনন্দে ফেটে পড়বে। চোখের তারায় শুধু খুশিরাই ভেসে থাকবে।

উপহারের চিন্তায় সে রাতে হৃদ্যের ঘুম হলো না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মার্কেটে চলে যায়। কিছু একটা কিনে বাসায় ফিরল। ভীষণ উশখুশ নিয়ে বারান্দায় আসতে দেখে ভ্রমর রেলিংয়ে গাল ফেলে বিকেলের মলিন আকাশে চেয়ে আছে। হৃদ্যের মনে ধাক্কা লাগল। ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল,
“পুচকির কি মন খারাপ?”

ভ্রমর নড়ল না। সেভাবেই বলল,
“হ্যাঁ। ”
“কেন?”

ভ্রমর মুখ তুলল। হৃদ্যের দিকে তাকাতে চোখ ছেড়ে জল গড়িয়ে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“বাজান এবারও আসল না।”

সেই প্রথম ভ্রমরের কণ্ঠে ‘বাজান’ শব্দটা শুনেছিল হৃদ্য। তারপর কথায় কথায় অনেক কিছু জেনেছিল। যত জানছিল তত বিষাদের ভারী চাপ অনুভব করছিল বক্ষঃস্থলে। সব শেষে সন্তর্পণে আওরাল, ‘তোর সেই চমৎকার উপহারটি কি বাবা? এই জন্যই তোর পছন্দের সবচেয়ে সুন্দর পুতুলটা কিনেও শান্তি পাচ্ছিলাম না!’ সেদিন আর ভ্রমরের জন্মদিনে যাওয়া হয়নি হৃদ্যের। ভ্রমর তার আম্মুকে হৃদ্যকে দাওয়াত দেওয়ার কথা বলেছিল নাকি তাও জানা হয়নি। মনে মনে শপথ করছিল ভ্রমরের চমৎকার উপহারটি একদিন দিবেই। হোক আজ অথবা কাল।

তারপর থেকে ভ্রমরের বাবার সাথে দেখা করার জন্য কত কী-ই না করেছিল হৃদ্য। বছরের বিশেষ তিনটি দিন চব্বিশ ঘন্টা পাহারায় থেকে এক দিন মীর হকের দেখা পায়। কথা বলার সুযোগ পায় না। তার আগেই গাড়ি নিয়ে ছুটে চলে যায়। পিছু নিয়েও কাজ হয় না। কিছু দূর পরই গাড়ি চোখের আড়াল হয়ে যায়। হৃদ্য ভাবে। নতুন পরিকল্পনা করে। একদিন সফল হয়। গাড়ির পেছনের ডিক্কিতে লুকিয়ে পড়ে। রাত বাড়ে,গাড়ি স্টার্ট হয় না। অপেক্ষা করতে করতে হৃদ্য ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ঘুম ভাঙে তখন সে মীর খন্দকারের বিশাল বাড়ির সামনে! তারপর কত অপদস্তই না হতে হয়েছিল হৃদ্যকে। মীর খন্দকার মুখের সামনে মুক্ত স্বরে যখন বলেছিলেন তার কোনো মেয়ে নেই তখন হৃদ্যের ভেতরটা ফেটে গিয়েছিল! সেও কম কিসের? জেদে শরীর,মন ভরপুর! দাড়োয়ান ঘাড় ধাক্কা দিয়ে যখন বের করে দিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিল, ‘আমি আপনাকে ভ্রমরের কাছে না নিয়ে যাব না। দরকার হলে দিনরাত এখানে পড়ে থাকব!’

হৃদ্য কথা রেখেছিল। দিন শেষে রাতে ধূলোর উপর ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরের দিন মীর খন্দকার তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যখন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন দূর থেকে একটি ইট ঢিল মেরেছিল। সাথে সাথে পেছনের কাচ ভেঙে যায়। গাড়ি থামিয়ে মীর খন্দকার এক বার পেছন তাকিয়েছিলেন শুধু। শরীর ভর্তি রাগ নিয়ে সেদিন হৃদ্য ফেরত আসলেও তার শপথ থেকে এক চুলও নড়েনি। প্রতি বছর ভ্রমরের জন্মদিনের আগের রাতে সে মীর খন্দকারের বাড়ির সামনে উপস্থিত হত। নানা ভাবে তাকে মানাতে চেষ্টা করত। কিন্তু মীর খন্দকার তার সিদ্ধান্তেই অটল ছিলেন। একে অপরের কাছে হারতে নারাজ!

“নেও, ধরো।”

আচমকা কারও গলা পেয়ে হৃদ্যের সম্বিৎ ফিরে। মীর খন্দকারের হাতে বড়সড় একটি পাথর দেখে চমকে যায়। জিজ্ঞেসা দৃষ্টিতে তাকালে তিনি বললেন,
“তোমাকে সাহায্য করতে নিয়ে এলাম। উপহারও ভাবতে পারো।”

কথাটা শেষ করে কুটিল হাসলেন। বেঞ্চের উপর হৃদ্যের পাশে বসে চারপাশে চোখ বুলালেন। বললেন,
“এই পার্কে প্রায় আসো নাকি?”

হৃদ্য উত্তর দিল না। পাথরটার দিকে তাকিয়ে থেকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
“কেন ডেকেছেন?”

মীর খন্দকার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনলেন হৃদ্যের দিকে। হেয়ালি করে বললেন,
“আর সময় তো নিজেই আমার দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়াও। আজ দাওয়াত দিয়ে আনলাম বলে সহ্য হচ্ছে না? ‘কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না’ প্রবাদটা কে আওড়েছিলেন বলো তো?”

হৃদ্য রেগে গেল। কটমট চোখে তাকালে তিনি বললেন,
“এত অধৈর্য্য হচ্ছো কেন? তোমাকে মানাচ্ছে না। বরাবরই তো তোমাকে ধৈর্য্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে দেখেছি।”

মীর খন্দকারের কণ্ঠে আফসোস ঝরলেও চোখে অন্য কিছু খেলছে। মুহূর্তে হৃদ্যের রাগ মিলিয়ে গেল। ভয়েরা ছুটোছুটি করছে ভেতরে-বাহিরে!

মীর খন্দকার বুঝি হৃদ্যের ভেতরটা পড়ে ফেললেন। ঠোঁটের কোণে দাম্ভিকতা ফুটে উঠল। হাসি ধরে রেখে স্বাভাবিক স্বরে বললেন,
“তুমি চাইলে আজ আমাকে হারিয়ে দিতে পারো।”

হৃদ্যের ভ্রূ বেঁকে আসল। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“মানে?”

মীর খন্দকার হৃদ্যের দিকে খানিকটা ঘুরে বসলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন,
“তোমার ইচ্ছে পূরণ করা হবে। ভ্রমর পিতৃ-আলয়ে থাকার সুযোগ পাবে। ভ্রমরের মা শ্বশুর বাড়িতে স্থান পাবে। তাদের বাকি জীবনের দেখাশুনার ভারটাও আমি নিব।”

হৃদ্যের চোখে,মুখে আনন্দ খেলে যেতে মীর খন্দকার বললেন,
“কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”
“শর্ত?”
“হ্যাঁ, আমার মেয়ের জীবন থেকে তোমাকে চিরতরে সরে যেতে হবে।”

হৃদ্য বিস্ফারিত চোখে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো তার প্রাণটা কেউ কেড়ে নিয়েছে! চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে ক্রমশ! সে হারিয়ে যাচ্ছে। পা ফেলছে এক নতুন পৃথিবীতে। যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব নেই,সূর্যের দেখা নেই। চারধারে শুধু জড়বস্তু আর অন্ধকারের মেলা।

“আমি তোমাকে জোর করব না। কোনো বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি করব না। শুধু আগের মতো ভুলে যাব আমার একটা মেয়ে আছে।”

মীর খন্দকার পকেট থেকে একটা লাল রঙের ছোট্ট কৌটো বের করলেন। হৃদ্যের হাতে দিয়ে বললেন,
“এই আংটিটা আমি ভ্রমরের জন্য কিনলেও দিবে তুমি। যদি তুমি জিততে চাও তাহলে আংটিটা নীরবকে পরাতে বলবে। হারতে চাইলে তুমি পরাবে।”

কথাটা বলেই মীর খন্দকার উঠে দাঁড়ালেন। পাথরটা তুলে হৃদ্যের হাতে দিয়ে বললেন,
“মনে রেখ,এটাই যেন আমাদের শেষ দেখা ও শেষ কাচ ভাঙা হয়।”

______________
রিধি যখন ধরেই নিল শ্রাবণ আর এ বাড়ির মুখো হবে না ঠিক সে সময় শ্রাবণ নীঃশব্দে রুমে ঢুকল। প্রতি দিনের মতো জামা ছেড়ে গোসল করতে ঢুকল। বের হতে রিধি বিস্ময় কাটিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কাল রাতে কোথায় ছিলেন?”

শ্রাবণ উত্তর দিল না। রিধি পুনরায় প্রশ্নটা করতে চাইল। তার আগে হুড়মুড়িয়ে ঢুকলেন শায়লা হক। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন,
“তুই এখনও রেডি হোসনি?”

রিধি ভারি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“রেডি হব! কেন?”
“এর মধ্যে ভুলে গেলি? সকালে তোর সামনেই তো ভ্রমরের মা দাওয়াত দিয়ে গেল।”

রিধির হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল,
“ও হ্যাঁ। একদমই ভুলে গিয়েছিলাম,আম্মু। আমি দুই মিনিটে তৈরি হয়ে আসছি। তুমি একটু বাইরে বসো।”

মায়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে শ্রাবণের দিকে তাকাল রিধি। তাড়া দিয়ে বলল,
“আপনি ভালো দেখে একটা পাঞ্জাবি পরে ফেলুন তো।”
“কেন?”
“আমাদের সাথে আপনিও যাবেন তাই।”

কথাটা শেষ করতে না করতে শায়লা হক দরজা থেকে বললেন,
“ভ্রমরের মা শুধু আমাদেরকে যেতে বলেছেন। বাইরের কাউকে না। শ্রাবণ কোথাও যাবে না। রিধি একদম ঝামেলা করবি না।”

রিধি তাৎক্ষণিক কিছু বলল না। মায়ের কাছে এসে দৃঢ় স্বরে বলল,
“উনি যাবেন।”

তারপরেই মায়ের মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল। নিজে একটা বেগুনি রঙের শাড়ি পরে,শ্রাবণকে জোর করে পাঞ্জাবি পরাল। দরজা খুলে বাইরে বের হতে শ্রাবণ বেঁকে বসল। বলল,
“আমি কোথাও যাব না।”
“কেন যাবেন না?”
“কেন যাব?”

শ্রাবণের পাল্টা প্রশ্নে রিধি থতমত খেল। আমতা আমতা শুরু করলে সে আগের প্রশ্নটাই জোর গলায় করল,
“বলুন,কেন যাব?”

রিধি চোখ তুলে তাকালে শ্রাবণ আবার বলল,
“আমি আপনাদের কিছু হই? আপনার কিছু হই?”
“হোন তো।”
“কী হই?”
“আমার ব..”

রিধি মাঝ পথে আটকে গেলে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করল,
“আপনার কী?”
“আমার বন্ধু।”

কথাটা বলে রিধি হাসল। মা-বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
“আজ থেকে ইনি আমার বন্ধু।”

_______________

ভ্রমরদের বাসায় ঢুকে প্রথমে ভ্রমরের খোঁজ চালাল রিধি। বসার রুম পার হয়ে কয়েক কদম ফেলতে হঠাৎ নীরবের মুখোমুখি পড়ল। অস্বস্থিতে সরে যেতে নিলে নীরব বলল,
“টিপটা বাঁকা হয়েছে। ঠিক করে নিন।”

রিধি চমকে তাকাল নীরবের দিকে। মৃদু কম্পন শুরু হলো হৃদয় কুঠরিতে। কিছু একটা মনে করার তুমুল ঝড় শুরু হতে একটা হাত এগিয়ে আসল রিধির কপালে। টিপটা তুলে নিয়ে ঠিক জায়গায় বসিয়ে শ্রাবণ বলল,
“আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন? আমার সাথে আসুন।”

রিধি এক রকম ঘোরের মধ্যেই শ্রাবণের সাথে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো,এক জোড়া গভীর চোখ তাকেই দেখছে। শুধু তাকে! সে চট করে পেছন তাকাল। আপনমনে বলল, ‘ছেলেটি কোথায় গেল? মাত্রই তো এখানে ছিল!’

_____________

ভ্রমর মায়ের কাছে সাজছিল। সহসা বলল,
“এই যা! রিধি আপুকে তো বলাই হলো না হৃদ্য ভাইয়াকে আমি নিব। এখন যদি অন্য কাউকে দিয়ে দেয়?”

শরীফা খন্দকার কিছু বুঝার আগেই ভ্রমর ছুটে বেরিয়ে এলো। চুলের আরেকপাশ আঁচড়ানো হলো না। অগোছাল সাজে বসার রুমে উপস্থিত হতে মীর খন্দকার ডাকলেন,
“মামনি?”

ভ্রমর পাশ ফিরল। দরজার সামনে বাবাকে দেখে পুলকিত হলো। আপ্লুত হেসে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে হৃদ্যও পাশে এসে দাঁড়াল। খুশিতে ভ্রমরের চোখ,মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চঞ্চল পায়ে ছুটে গিয়ে দুজনের মাঝে দাঁড়াল। উচ্ছল হেসে দুই হাত দুজনের সামনে বাড়িয়ে বলল,
“আগে গিফট দিবে তারপর ভেতরে ঢুকবে।”

চলবে
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here