প্রাণ_ভোমরা পর্ব ৪৪+৪৫

#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৪৪)

ভ্রমরের হাতের দিকে চেয়ে থেকে নিজের প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকাল হৃদ্য। বাম পকেটে বাম হাত, ডান পকেটে ডান হাত। দুই হাতের আঙুলগুলোতে একটা শক্ত ছোঁয়া অনুভব করল সে। সাথে সাথে স্থির চাহনি আঁকল ভ্রমরের হাসি-খুশি মুখটায়। কোন আংটিটা দিবে সে? নিজেরটা নাকি মীর সাহেবেরটা! সে দুই হাতে দুটো আংটি চেপে ধরে থাকল। শ্বাস-প্রশ্বাসে বিলম্ব ক্রমশ বাড়ছে!

ভ্রমর আনন্দ মিশ্রিত রাগ নিয়ে বলল,
“কী হলো দেও।”

হৃদ্য মৃদু কেঁপে উঠল। চোখের পলক পড়ল ঘন ঘন। কিছু একটা বলার জন্য উদ্যত হতে শরীফা খন্দকার এগিয়ে আসলেন। মেয়ের বাহুতে হালকা থাপ্পড় মেরে বললেন,
“এটা কেমন ব্যবহার,ভ্রমর?”

ভ্রমর মায়ের দিকে তাকালে তিনি শাসনের সুরে বললেন,
“রুমে যাও। আমি আসছি।”

ভ্রমর মুখ কালো করে চলে গেল। শরীফা খন্দকার হৃদ্যের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন। বললেন,
“তুমি এখনও বাইরে দাঁড়িয়ে আছো! এসো, ভেতরে এসো।”

স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“তুমি ওর সাথে জোর বেঁধে আছো কেন? যাও দেখ,মেহমানদোর কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাকি।”

মীর খন্দকার এক বার হৃদ্যের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলে গেলেন ভেতরে। সেই সুযোগে হৃদ্যকে সঙ্গে করে নিয়ে সোফায় বসালেন শরীফা খন্দকার। লিলিকে শরবত দেওয়ার কথা বলে একটু সরে আসলেন। কথপোকথনে ব্যস্ত স্বামীর দিকে তাকিয়ে আপন মনে প্রশ্ন গাঁথলেন,’এরা দুজন এক সাথে এলো কেন? কোনো ঝড় আসতে চলেছে কি?’

______________
মায়ের কাছে অস্থির মনে সাজা শেষ করল ভ্রমর। ভুলে যাওয়া কথাটা আবার মনে পড়েছে। মনে মনে নিজেকে বকাবকি করছে। এত গুরুত্বপূর্ণ কথাটা সে কেন ভুলে যায়? এই ভুলে যাওয়ার জন্য যদি হৃদ্যকে অন্য কেউ নিয়ে নেয়? ভ্রমর তজবিহ পাঠের মতো ঘন ঘন উচ্চারণ করতে লাগল, ‘হৃদ্য ভাইয়াকে আমি নিব।’ সে অবস্থায় মায়ের রুম থেকে বের হলো। ডানে-বায়ে না তাকিয়ে সোজা রিধির কাছে ছুটছিল। হঠাৎই এক হাতে ভ্রমরের মুখ চেপে ধরল কেউ। অন্য হাতে বাহু চেপে ধরল শক্ত চাপে। ভ্রমর কিছু বোঝার আগেই তাকে নিয়ে ছুটে এলো অন্য ঘরে। ভয়ে ভ্রমরের গলা শুকিয়ে আসে। তীব্র বেগে ছুটে চলে হৃদ স্পন্দন! কন্টিকার ন্যায় পশমসমূহ শক্ত হয়ে আসতে মুখ থেকে হাত সরায় হৃদ্য। ভ্রমর ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। পর মুহূর্তে কৌতূহলী হয়ে পড়ে। চোখ বড় বড় করে বলল,
“তুমি কি আমাকে কিডন্যাপ করলে?”

হৃদ্যের নজর ছিল দরজার দিকে। বন্ধ করবে নাকি খোলা রাখবে সে চিন্তায় ডুবে। ভ্রমরের প্রশ্নে চিন্তা ছুটে গেল। ভ্রূ জোড়া বেঁকে আসল। আশ্চর্য হয়ে বলল,
“কিডন্যাপ করব কেন?”

ভ্রমরের কৌতূহলপূর্ণ চোখ দুটো সরু হয়ে আসল। মন খারাপের সুরে বলল,
“কিডন্যাপ করোনি?”
“না।”

ভ্রমর ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। শুকনো গলায় বলল,
“তাহলে আমাকে এখানে টেনে আনলে কেন?”

হৃদ্যও কথা ঘুরাল না। সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
“নীরব কে?”

প্রশ্নটা শুনে ভ্রমর হেসে ফেলল। সেই হাসি আর থামার জোঁ নেই। হৃদ্য কতক্ষণ থ হয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,
“হাসছিস কেন? হাসার মতো কী বললাম?”

ভ্রমর হাসি থামাতে গিয়েও পারল না। হাসতে হাসতে বলল,
“আমি ভাবছিলাম উনি আমার বাজানের ছেলে। পরে দেখি বাজানকে আংকেল বলে ডাকে।”

হৃদ্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“এখানেও হাসির কিছু দেখছি না।”

ভ্রমর হাসি থামিয়ে সুধাল,
“কিছু নেই?”
“না।”
“তাহলে হাসব না?”
“না।”

ভ্রমর আর হাসল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে হৃদ্য বলল,
“নীরব তোর বাজানকে আংকেল বলে ডাকে শুধু এইটুকু জানিস নাকি আরও কিছু জানিস?”
“আর কী জানব?”

হৃদ্য প্রশ্নের জবাব দিল না। সে যা ভেবেছিল তাই। বিয়ের আয়োজন ভ্রমরকে না জানিয়েই হচ্ছে। হৃদ্যের ভাবনার মধ্যে ভ্রমর আচমকা বলল,
“আরও কিছু জানি।”

হৃদ্য আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল,
“কী জানিস?”
“উনার বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন, চায়তেন আমি বাজানের বাড়িতে গিয়ে থাকি। ওখানে আমার দাদিও থাকেন। উনি বলেছেন আমাকে দাদির কাছে নিয়ে যাবেন।”
“উনি নিয়ে গেলেই তুই যাবি?”
“হ্যাঁ। আমার দাদিকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”

হৃদ্য আর কিছু বলতে পারল না। আহত চোখে ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে থাকল। ভ্রমরও চাপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল কতক্ষণ। তারপর জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি এগুলো জানতে আমাকে টেনে এনেছ?”
“না।”
“তাহলে?”

হৃদ্য ডান পকেটে হাত ঢুকল। নিজের কেনা আংটিতে স্পর্শ করে বলল,
“ধর, তোর চকলেট খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তোর বাজান বলছে চিপস খেতে। তাহলে তুই কী করবি চিপস খাবি নাকি চকলেট খাওয়ার জন্য বায়না ধরবি?”

ভ্রমর কপাল কুঁচকে ফেলল। কপট রাগ নিয়ে বলল,
“সেদিন না এই প্রশ্নের উত্তর দিলাম? এক প্রশ্ন বার বার করছ কেন?”
“রাগ করছিস কেন? উত্তরে কী বলেছিলি ভুলে গেছি।”

ভ্রমর সন্দেহ চোখে তাকিয়ে থাকল। রাগটা পড়ল বলে মনে হলো না। তবুও সহজ স্বরে বলল,
“চিপস খাব। বাসায় গিয়ে আম্মুকে বলব চকলেট কিনে দিতে।”

হৃদ্য হতাশ হলো। পকেট থেকে হাত বের করে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমার কথা শেষ। তুই এখন যা। ”

ভ্রমর চলে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে এগুচ্ছিল। হঠাৎ থেমে পেছন ঘুরে বলল,
” মি. প্রতিবেশী?”

হৃদ্য চড়কি বেগে পেছন ঘুরলে ভ্রমর সুধাল,
“আমাকে কেমন লাগছে?”

হৃদ্যের এই এখন মনে পড়ল এখানে আসার পর ভ্রমরকে ভালো করে দেখেনি। এবার দেখল। লাল রঙের জামাটায় তাকে তাজা গোলাপের মতো লাগছে। এলোকেশগুলো আজ সুবিন্যস্ত! হৃদ্য বিমুগ্ধ দৃষ্টি রেখে বলল,

” খুব সুন্দর লাগছে। ”
” তাহলে চুমু খাও। ”

হৃদ্যের মুগ্ধ দৃষ্টি হারিয়ে গেল। আঁতকে উঠে সুধাল,
” কী খাব? ”

ভ্রমর দ্রুত পদে হৃদ্যের নৈকট্যে এসে দাঁড়াল। দৃষ্টি নিচে রেখে মাথা বাড়িয়ে বলল,
” চুমু খাবে। সুন্দর লাগলে প্রিয় মানুষদের চুমু খেতে হয়। আম্মু খেয়েছে, বাজান খেয়েছে, এখন তুমি খাবে। ”

হৃদ্য বিস্ময়াবিষ্ট! কথা হারিয়ে চুপ। কর্মযজ্ঞ হারিয়ে বিমূঢ় শরীর! ভ্রমর চোখ তুলে বলল,

” চুমু খাচ্ছো না যে? আমি তোমার প্রিয় মানুষ না? ”

কথাটা উচ্চারণ করতে করতে ভ্রমরের গলা বসে গেল। চোখ জলে টলমল। কান্না করে দিবে এমন ভাবে চলে আসতে হৃদ্য বিমূঢ়তা কাটিয়ে উঠল। ভ্রমরের মুখের দুই পাশ আলতো চেপে ধরে কপালে গভীর চুমু খেল। সে অবস্থায় বলতে চাইল, ‘ তুই শুধু আমার প্রিয় মানুষ না প্রিয় অনুভূতি। ‘ বলা হলো না তার আগে শরীফা বেগমের গলার স্বর ভেসে এলো। হৃদ্য ভয়ে সরে দাঁড়াল। ভীত চোখে দরজার দিকে তাকাল। ঠিক সেই সময় দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন শরীফা খন্দকার। দুজনের দিকে সন্দেহি দৃষ্টি ছুড়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমরা এখানে কী করছ? ”

হৃদ্য কিছু বলার আগে ভ্রমর বলল,
” হৃদ্য ভাইয়ার কাছ থেকে চুম…”

ভ্রমরের কথার মধ্যে হৃদ্য অকস্মাৎ বলল,
“আমি আসছি।”

________________
শ্রাবণের চাপাচাপিতে রিধি বসা থেকে উঠতে পারল না। জায়গা থেকেই ভ্রমরকে খুঁজছিল। যার জন্য আসা তার দেখাটাই এখনও মিলল না। এটা কিছু হলো? রিধি বিরক্তে কাহিল হয়ে পড়ল। বিরস মুখে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ শ্রাবণের হাতের উপর হাত রাখল। হালকা চেপে ধরে ধীরে বলল,
” আমার দিকে কি কেউ তাকিয়ে আছে? ”

শ্রাবণ প্রথমে বুঝতে পারল না। বলল,
” তাকিয়ে আছে বলতে? ”

রিধি দৃষ্টি মেঝের কার্পেটে ফেলে শ্রাবণের দিকে খানিকটা চেপে আসল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
” কয়েক দিন ধরে মনে হচ্ছে কেউ আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। এখানে আসলে সেই মনে হওয়াটা অনেক গুন বেড়ে যায়। ”

রিধি অনুরোধের সুরে বলল,
” আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। আমি একটু ভেতরে যাই? ”

ততক্ষণে শ্রাবণ চারপাশে পর্যবেক্ষণ শুরু করে দিয়েছে। রিধির কথামতো তেমন কাউকে পেল না। সন্দেহজনক কোনো চোখের দেখাও মিলল না। হতাশ মনে রিধির দিকে চোখ ফিরিয়ে আনতে গিয়ে আটকাল সামনের আসনে বসে থাকা নীরবের উপর। মীর সাহেবের সাথে কোনো জরুরি আলাপ সারছে মনে নয়। সেই আলাপের মধ্যেও চোখের চাহনি বার বার রিধির উপরেই পড়ছে যেন। শ্রাবণ সেই দিকে চেয়ে থেকে বলল,
” না। আরেকটু বসুন। ”

_________________
খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষ করে সকলে যখন ভ্রমরকে ঘিরে দাঁড়াল তখন হৃদ্য খুব সাবধানে বলল,
” তখন যদি সত্যি কিডন্যাপ করতাম। তাহলে তুই কী করতি? ”

ভ্রমর বিস্ময় চোখে তাকাল। পর মুহূর্তে হেসে উঠে বলল,
” কিছুই না। ”
” কাঁদতি না? ”
” কেন কাঁদব? ”
” এই যে তোর মা-বাবাকে ছেড়ে আমার কাছে থাকতে হতো। ”

ভ্রমরের হাসি মিলিয়ে গেল। বলল,
” কেন? তোমার বাসা আর আমার বাসা তো কাছেই। ছুটে আসতাম। ”
” যদি আসতে না দিতাম? ”

ভ্রমর শান্ত চোখে তাকাল। পরক্ষণে পূর্বের মতো হেসে বলল,
” তুমি আমাকে আসতে দিতে। ”
” তুই এতো নিশ্চিত হচ্ছিস কিভাবে? ”
” কারণ,আমি জানি তুমি আমাকে কষ্ট দিবে না। ”
” কিডন্যাপাররা কষ্ট দেয়। ”
” তুমি তো কিডন্যাপার নও। ”

হৃদ্য আর ভ্রমরের কথপোকথন এখানে সমাপ্ত হলো। মীর খন্দকার আর নীরব পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভ্রমর অভিমান নিয়ে বলল,
” বাজান, তুমি আমাকে উপহার দেওনি। ”

মীর খন্দকার হাসলেন। বললেন,
” এনেছি তো। ”
” তাহলে দেও। ”

এ পর্যায়ে তাঁর চোখ আটকাল হৃদ্যের উপর। সে দিকে চেয়ে বললেন,
” হৃদ্যের কাছে দেওয়া আছে। তুমি বললে দিবে। ”

ভ্রমরের চোখ,মুখ ঝলমলিয়ে উঠল। হৃদ্যের দিকে ঘুরে বলল,
” আমার উপহার তোমার কাছে কেন? দেও বলছি। ”

হৃদ্য অসহায়বোধ করল। করুণ চোখে তাকাল মীর খন্দকারের দিকে। তার দিক থেকে কোনো সহানুভূতি না পেয়ে বাম পকেটের আংটির কৌটোটা ভ্রমরের হাতে দিল। সে খুশিতে আত্মহারা! আংটি খুলে আঙুলে পরতে নিলে হৃদ্য রুদ্ধশ্বাসে বলল,
” ওটা তোর জন্য নয়। ”
” তাহলে? ”

উত্তরটা দিলেন মীর খন্দকার,
” নীরবের জন্য। পরিয়ে দেও, মা। ”

তারপরের ঘটনাগুলো চোখের পলকে ঘটে গেল। গায়ে হলুদ, বিয়ে, বৌ-ভাতের জন্য আলাদা আলাদা তারিখ পড়ল। ভ্রমর নির্বাক হয়ে সব শুনল। অবিশ্বাস্য চোখ দুটো বার বার বাবার উপরেই নিবদ্ধ হচ্ছিল।

______________

মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায় রিধির। এপাশ থেকে ওপাশ হতে দেখে শ্রাবণ বিছানায় নেই। সে উঠে বসে। সন্ধানী দৃষ্টি রাখে পুরো রুমে। গোসলখানার দরজা খোলা দেখে রুম থেকে বের হয়। কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে বসার রুমে পৌঁছায়। এখানে না পেয়ে চিন্তারা দুশ্চিন্তার রূপ ধারণ করে। সে ভেবেই পাচ্ছে না এত রাতে মানুষটা উধাও কী করে হলো। বসার রুমে কতক্ষণ থম মেরে বসে থাকতে মনে পড়ে ফোনের কথা। বাইরে গেলে নিশ্চয় ফোন নিয়ে গেছে। কল দিলেই ঝামেলা শেষ। চিন্তা দূর! রিধি রুমে ফিরে যেতে পা ফেলতে হঠাৎ কানে কারও কণ্ঠ আসে। অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর বাবার বলে বোধ হচ্ছে। এত রাতে উনি কার সাথে কথা বলছেন? রিধি শব্দ অনুসরণ করে মা-বাবার রুমের সামনে পৌঁছে গেল। সেই সময় শ্রাবণের কণ্ঠ স্পষ্ট শোনা গেল,
” কী বলছেন! আপনার মেয়ে যদি সত্যি সাইন করে দেয় তখন? অভিনয় করতে গিয়ে তো আমার সত্যি সত্যি ডিভোর্স হয়ে যাবে! ”

এবার আজিজুল হকের গলার স্বর ভেসে এলো,
” তাহলে আরও ভালো। তুমি মুক্তি পেয়ে যাবে। ”
” বাবা! ”
” রাগ করো না। আমরা চেষ্টা কি কম করেছি? তোমাকে রুম থেকে বের করে দেওয়া থেকে শুরু করে কত কী-ই না করলাম। তাও কিছু হলো না। এভাবে আর কতদিন চলবে? এক সময় তো এর ইতি টানতেই হবে। তাহলে এখন কেন নয়? মাঝখান থেকে শুধু সময় নষ্ট। একজন ব্যাংকার হিসেবে আমি জানি সময়ের মূল্য কত। ”
” কিন্তু বাবা..”

এবার শায়লা হকের কণ্ঠ স্বর শোনা গেল,
” কোনো কিন্তু নয়। রিধির বাবা একদম ঠিক বলছে। তুমি কালকেই ডিভোর্সের কথা বলবে। ওর একটা বড় ধাক্কা পাওয়া প্রয়োজন। হয় তোমার সাথে সংসার করবে নাহয় ছেড়ে দিবে। নিজের মেয়ের সামনে আমার মিথ্যে অভিনয় করতে ভালো লাগে না। তাছাড়া..”

শায়লা হকের কথার মধ্যে দরজা খুলে গেল। সম্মুখে রিধিকে দেখে সকলে চমকে ওঠে। শ্রাবণ বসা থেকে সটাং দাঁড়িয়ে পড়ল। শ্বশুর-শাশুড়ির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে রিধির নিকট হেঁটে আসল। সভয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে সজোরে চড় বসিয়ে দিল রিধি। চেঁচিয়ে বলল,
” এই মুহূর্তে এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন। ”

শ্রাবণ কোনো প্রতিবাদ করল না। এক বারের জন্য অন্য দিকে তাকাল না। সোজা সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল,
” আপনাদের মেয়ে যদি আমার পেছন পেছন আমাদের বাড়িতে হাজির না হয় তাহলে কাল ডিভোর্স পেপার অবশ্যই পাঠাব। ভুলেও ভাববেন না আমি অভিনয় করছি কিংবা পরীক্ষা নিচ্ছি। ”
#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান

(৪৫)

আজ অনেক দিন বাদে মায়ের পাশে ঘুমাবে ভ্রমর। চোখের তারায় খুশি উপচে পড়তে পড়তে হারিয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে আনন্দের জায়গায় বিষন্নতা চেপে বসেছে। বিমর্ষ মুখে বিছানার এক কোণে বসে থাকল। শরীফা খন্দকার মেয়ের দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছেন আর বিছানা ঝাড় দিচ্ছেন। বালিশ দুটো ঠিকঠাক করে বললেন,
” আয়, শুয়ে পড়। ”

ভ্রমর মায়ের দিকে এক পলক তাকাল। পরক্ষণে চোখ নামিয়ে চুপচাপ বসে থাকলে শরীফা খন্দকার এগিয়ে আসলেন। মেয়ের পাশে বসলেন। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন মেয়ের মলিন মুখে। গালে হাত দিয়ে বললেন,
” কিছু বলবি? ”

ভ্রমর পূর্ণ চোখে তাকাল। ধীরে ধীরে পানি জমতে থাকল চোখের কোলে। নাকের পাটা কাঁপছে। ঠোঁট কামড়ে ধরেও কান্না আটকে রাখতে পারল না ভ্রমর। মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে চোখের পানি ছেড়ে দিল। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল,
” আমার কেন মনে হচ্ছে বাজান আমাকে ভালোবাসে না? ”

কথাটা শেষ হতে শব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ল। কতক্ষণ পর বলল,
” আম্মু,বলে দেও আমার মনে হওয়া ভুল। ”

শরীফা খন্দকার নিরুত্তরে মেয়ের চুলে হাত রাখলেন। শূন্য দৃষ্টি ফেলে উদাসীন হয়ে বললেন,
” আমি মাধ্যমিক শেষ করে যখন উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ঠিক সেই সময় আমার বিয়ের সম্বন্ধ এলো। ভালো ঘরের ছেলে, শিক্ষিত, তার উপর নিজের ব্যবসা আছে। আমার পরিবার হ্যাঁ বলে দিলেন। ব্যস! পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে আমাকে শ্বশুর বাড়িতে পা রাখতে হলো। মন খারাপ হলেও আশা হারাইনি। মনে মনে ধরে রেখেছিলাম সুযোগ বুঝে তাঁর কানে পড়ালেখার কথা তুলব। সেই সুযোগ আর এলো কোথায়? বিয়ের পরের দিন শুনতে পেলাম এই বিয়েতে তাঁর মত ছিলো না। মায়ের জোরাজুরিতে রাজি হয়েছেন। এরপরও কি তাঁর কাছে শখ,আহ্লাদের কথা বলা যায়? মন যুগিয়ে চলতে চলতে যখন হাঁপিয়ে উঠছিলাম তখন শাশুড়ি আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন, ‘ আর কত? এইবার নাতির মুখ দেখাও বউমা।’ আমি সাথে সাথে নাতির মুখ দেখাতে পারলাম না। বিয়ের বয়স দুই বছর পার হতে তিনি অধৈর্য্য হয়ে পড়লেন। দিন-রাত কথা শুনাতে লাগলেন। এমন করে আরও একটা বছর পার হয়ে গেল। এবার তোর বাবাও বলতে শুরু করল, ‘ ডাক্তার দেখাতে হবে নাকি,শরীফা? ‘ আমি উত্তর দিতে পারলাম না। বলতে পারলাম না, ‘আমি আরেকটু পড়তে চাই।’ দীর্ঘ তিন বছরেও যে কথাটা বলার সাহস করে উঠতে পারলাম না তা কি আর কখনও বলা হবে? ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিলাম। লেখাপড়ার শখ মাটিতে চাপা দিয়ে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করলাম। সুখবরও চলে এলো। শ্বাশুড়ি খুশি, স্বামীও। তাদের আনন্দ দেখে আমার মনের দুঃখ ভুলে গেলাম। তবে সেই খুশি বেশি দিন স্থায়ী হলো না। পৃথিবীর আলো দেখার পূর্বে সে পরকালে চলে গেল! কষ্ট পেয়েছিলাম খুব। একটা প্রাণ পেটে বসে আমার রক্ত, মাংস খেল অথচ এক বার মা বলে ডাকল না! রাগে, দুঃখে, শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কষ্টটা বুঝি তোর বাবার চোখে পড়ল। মানুষটা হঠাৎ করে অনেক পালটে গেল। আগের মতো আমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে না। সান্ত্বনা দেয়, ভরসা দেয়। তার সেই ভরসাতে পরের বছর আমি আবার অন্তঃসত্ত্বা হই। দীর্ঘ নয় মাস পর কোল জুড়ে তুই এলি। তোর প্রথম স্পর্শে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। মুখ দেখে এত আফসোস হলো! কেন যে এতগুলো বছর নষ্ট করলাম। তোকে বুকে চেপে ধরার পর উপলব্ধি করলাম মায়ের স্বপ্ন, ইচ্ছে, শখ, আহ্লাদ এসবের সম্মিলিত গড়ন হলো তার সন্তান। বাস্তব প্রাণ। সেই প্রাণ যখন চোখ মেলে তাকাবে তখন মনে হবে মরে যাওয়া স্বপ্ন আবার জীবিত হয়েছে। যখন কথা বলবে তখন মনে হবে ইচ্ছেরা কথা বলছে। যখন ভূমিতে পা ফেলে আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়বে তখন মনে হবে শখ,আহ্লাদ পূর্ণতা পাচ্ছে।

আমার সেই উপলব্ধিও মিথ্যে প্রমাণ করে দিলেন তোর দাদি। তোর মুখ দেখে নাক, মুখ কুঁচকে বললেন,
” এসব কী বউমা? এই এত বছর পর মা হইলা তাও মাইয়ার মা? বংশের আলোডা জ্বালবে কে শুনি? জলদি হাসপাতাল ছাড়ো! ” তোকে নিয়ে বাড়িতে উঠতে তিনি জানিয়ে দিলেন, তার নাতি চাই। বংশের প্রদীপ চাই। এ বছরের মধ্যেই। এবার আমার অবহেলার সিংহ ভাগই পড়ল তোর উপর। আমি চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম আর কেউ ভালোবাসুক বা না বাসুক তোর মা বাসে। তোর বাবা বাসে। এতেই চলবে। কিন্তু আমার সেই ভাবনাও বদলে দিল তোর বাবা। দিন যত গড়াচ্ছিল তোর প্রতি তার উদাসীন, অযত্ন, অনাদর তত বাড়ছিল। এক দিন তো বলেই বসলেন, ‘ মেয়ের কথা ছাড়ো এবার একটা ছেলের কথা ভাবো।’ ঐ একটা কথা আমার সব ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিল। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। আমি মনে মনে ঠিক করছিলাম আমার কোলে আর কেউ আসবে না। সময়ের সাথে সাথে নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেললাম। ভয় পেতে শুরু করলাম। যদি ভুল করে কেউ চলে আসে? ফেলে দিতে পারব কি? সেই ভয় দূর করতে এক দিন হাসপাতালে যাই। ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করি। তার পরামর্শে জন্মনিয়ন্ত্রণ রোধের চিরস্থায়ী সমাধান করতে একটা অপারেশন করি। সব কিছু লুকিয়ে চললেও তোর দাদি কীভাবে যেন বুঝে গেলেন। এরপর সব শেষ! ”

________________
রিধি টিভি দেখতে গিয়ে রিমোট খুঁজে পাচ্ছিল না। সোফার চিপায় খুঁজতে খুঁজতে চেঁচাল,
” আম্মু, রিমোট কোথায় রাখছ? ”

শায়লা হক টি-টেবিলের উপর তাকিয়ে গরম কণ্ঠে বললেন,
” চোখ কি আকাশে রেখে এসেছিস? ”

রিধি বোকা চোখে তাকালে শায়লা হক রিমোট তুলে নিলেন। তারপর শব্দ করে আগের জায়গায় রেখে গট গট শব্দ তুলে চলে গেলেন। রিধি ভ্রূ কুঁচকে রিমোটের দিকে তাকিয়ে থাকল। স্বগোতক্তি করল, ‘ এখানেই ছিল? তাহলে আমি দেখলাম না কেন? ‘

টিভি চালিয়ে খুব একটা আরাম বোধ করল না রিধি। বরঞ্চ বিরক্তই হলো। কতক্ষণ বিরতিহীন চ্যানেল পালটে উঠে পড়ল। হেঁটে চলল নিজের রুমের দিকে। চেয়ার টেনে একটা বই মেলে বসল। প্রথম দিকে পড়ায় মন না বসলেও ধীরে ধীরে মনোযোগ গাঢ় হচ্ছিল। সেই গাঢ় মনোযোগের সুতো কাটল হঠাৎ। ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল। সাতটা বেজে কুড়ি। সে ব্যস্ত পদে রান্না ঘরে ছুটল। হাড়িতে চাল মেপে নিয়ে জলে ডুবালে শায়লা হক বললেন,
” কার জন্য রাঁধছিস? ”

রিধি ভেজা চালে হাত ডুবিয়ে বলল,
” কার জন্য আবার? উনার জন্য। ছুটি হয়ে গেছে। একটু পরই চলে আসবে। ”
” তোকে বলেছে? ”
” কী? ”
” শ্রাবণ আসবে এ কথা তোকে বলেছে? ”

রিধির চাল ধোয়া শেষ। চুলায় বসিয়ে বলল,
” বলতে হবে কেন? রোজ এ সময়েই আসেন। ”

এ পর্যায়ে শায়লা হক চুপ থাকলেন। মেয়ের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকলেন। রিধি সেই চোখের দিকে তাকাতে কালকের ঘটনা মনে পড়ল। অস্বস্তিতে কুঁকড়ে গেল। মাথা নিচু করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলে শায়লা হক বললেন,
” আমার রাগ হচ্ছে আবার আফসোসও হচ্ছে। এত ভালো একটা ছেলে.. ”
” উনি মোটেও ভালো না। ”

শায়লা হক আগুন চোখে তাকালে রিধি বলল,
“এভাবে তাকালে সত্য মিথ্যে হয়ে যাবে না,আম্মু। যার কথার সাথে কাজের মিল নেই সে কখনও ভালো মানুষ হতে পারে না। ”
” কোন কথার সাথে কাজে মিল পাসনি তুই? ”

রিধি সাথে সাথে উত্তর দিল না। নিজের রুমের দরজার সামনে গিয়ে বলল,
” তার কথানুযায়ী আজ ডিভোর্সের কাগজ চলে আসার কথা। এখনও আসেনি। ”

রিধি ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। শক্ত হয়ে বিছানায় বসল। সাথে সাথে বুক ভার হয়ে আসল। গলার ভেতরটায় ব্যথা অনুভব হলো। চোখে যন্ত্রণা শুরু হলো। বালিশে মাথা রাখতে রাখতে বলল, ‘ আমার কি কান্না পাচ্ছে? কষ্ট হচ্ছে? আপনার জন্য? ‘

_____________
ঘড়ির বেঁটে কাঁটা যখন তিনটায় পৌঁছাল তখন কলিংবেল বেজে উঠল। শ্রাবণ শোয়া অবস্থায় চমকে উঠল। এত রাতে তাদের বাসায় কে আসবে? ঠিক শুনল নাকি ভুল শুনল দ্বিধায় পড়ে গিয়েছে। দ্বিধা কাটাতে বুঝি দরজায় ঠকঠক শব্দ শুরু হলো। শ্রাবণ আর শুয়ে থাকতে পারল না। দ্রুত কদমে এগিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াতে মুখ হাঁ হয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখে বলল,
” আপনি? ”

রিধি মাথা নিচু করে ছিল। দৃষ্টি নিচে রেখে বলল,
” আমার একা একা ঘুম আসছে না। ”

চলবে
চলবে

বিঃদ্রঃ কাল দিতে পারিনি তাই দুঃখিত। আজ বড় করে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here