‘আপনার পরে থাকা শাড়িটা খুলে আমায় দিন।’ ওয়াশ রুমের বাহিরে হবু বরের বন্ধুর পুরুষালি কন্ঠের আকুতিতে ভ্রু জোড়া বাকিয়ে এলো সায়াহ্নের। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বিমূর্ত দাঁড়িয়ে আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। আবছা অন্ধকারে আবৃষ্ট চারদিক। কোনো মানুষের রেশ মাত্র চোখে পড়া দুরূহ। এই অচেনা জায়গায় একা একটা মেয়েকে পেয়ে কেউ নিশ্চয়ই ছাড় দিবে না। তাই হয়তো এই লোকটাও সুযোগ নিতে এসেছে। সায়াহ্নের কল্প রাজ্যের ভাটা পড়লো পেছন থেকে বলা কথার রেশে। আকুতি ভরা কন্ঠেই আবারো পুরুষালি কন্ঠের অধিকারী লোকটি বলল,
‘প্লিজ! আপনার শাড়িটা আমায় দিন।’
সায়াহ্ন ঘামছে। গুমোট পরিবেশে সে তরতর করে কাঁপছেও। লোকটি তার শাড়ি নিতে চাইছে। এরমানে তার মনের কোণে হাজারো ভীতিকর পরিবেশের উদয় হলো। নিশ্চয়ই কাল নিউজ পেপারের ফ্রন্ট পেজের হেডলাইনে তার নাম আর বিবস্ত্র ছবি সহ লেখা থাকবে,
‘রেস্টুরেন্টের পাশে সায়াহ্ন আফরা নামক এক যুবতীর লাশ উদ্ধার।’
উদ্ভট সব চিন্তা করে শাড়ি খামচে ধরে কন্ঠনালী দিয়ে শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়েও ব্যর্থ হলো সায়াহ্ন । পেছনে থাকা পুরুষটি নিশ্চয়ই তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। যত্রতত্র ভেবে হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। আশ্চর্য ভাবে সে কথা না উচ্চারণ করতে পারলেও বিনা বাধায় উচ্চস্বরে কাঁদছে ঠিকই। এইটা ভেবেও খানিক প্রশান্তি পেলো সে। অত্যন্ত কান্নার আওয়াজ শুনে লোকটার যদি মায়াদয়া হয়। তারথেকে বড় কথা কিয়ৎক্ষণ পূর্বেও সায়াহ্ন ভেবেছিলো ও হয়তো বোবা হয়ে গিয়েছে। বোবা হয় নি ভেবে আনন্দ হলেও প্রকাশের বদলে আরো জোর পূর্বক কান্নার বৃথা চেষ্টা চালালো। পেছনের সেই মানুষটি বিরক্তির সহীত বলল,
‘ আরে,আশ্চর্য তো ! আপনি এমন ব্যাঙের মতো কান্না করছেন কেন। আপনার কাছে আমি শাড়িটা চেয়েছি আর কিছু নয়।’
‘ আপনি শাড়ি কি জন্য চাইছেন বুঝি না যেন আমি। খারাপ মতলবে আমাকে একা পেয়ে শাড়ি চাইছেন খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছি।’ সায়াহ্ন টেনে হিচড়ে কথাটি বলল।
‘ খারাপ মতলব!’ লোকটি ভারী কন্ঠেই অবাক হয়ে বলল। সায়াহ্ন সাহস সঞ্চার করে তীব্র গতিতে কান্না করতে করতে বলল,
‘ অবশ্যই খারাপ মতলব। একা একটা মেয়েকে এই ফাঁকা রেস্টুরেন্টের ওয়াশরুমে পেয়ে শাড়ি খুলতে চাইছেন এইটা কি খুব ভালো মতলব?’
সায়াহ্নের ভাঙ্গা ভাঙ্গা কান্নার রেশের কথায় লোকটির নেত্রদ্বয় যেন ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইলো কোটর থেকে। সে কখন এই বাচ্চা মেয়ের শাড়ি খুলতে চাইলো ভেবে পাচ্ছে না। কপালের চিনচিনে ব্যথায় তার দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে যাচ্ছে। তবুও সে কপাল হাত দিয়ে চেপে ধরে ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,
‘ আপনার শাড়ি খোলার মতো নিকৃষ্ট কাজ আমি করবো না। যাস্ট আপনার শাড়িটা দিন।’
‘ এইযে..এইতো আপনি আবার চাইছেন শাড়ি।’
সায়াহ্ন শাড়ি আরো আঁকড়ে ধরে সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল। ভয়ে সে পেছনে তাকানোর সাহস সঞ্চার করতে পারছে না। লোকটি অনুনয় করে বলল,
‘ শাড়ি না। আই মিন ওইযে যে অংশটা ঝুলে আছে। আই মি আ..জলা। আপনার আজলার কিছু অংশ ছিড়ে আমায় দিন।’
‘ কে আজলা কিসের আজলা। হোয়াট ডু ইয়্যু মিন বাই আজলা। এইটা কি!’ সায়াহ্ন কান্না থামিয়ে একনাগাড়ে প্রশ্ন করে অক্ষিকোটর গোল করে পেছন ফিরে তাকিয়ে মৃদু চিৎকার করে বলল,
‘ আপনার কপাল থেকে পানি বের হচ্ছে।’
‘ এইগুলা রক্ত।’ লোকটি হাপিয়ে যাওয়া সুরে বলল। সায়াহ্ন রক্ত শুনেই থামিয়ে দেওয়া কান্নার সুর আরো দ্বিগুণ করে বাড়িয়ে দিলো।
লাল রঙের শাড়ি পরিহিতা হালকা গড়নের খোলা চুলের এই মেয়েটির কান্নার সুর লোকটির কাছে ভুতের মুভির ডায়নীর মতো লাগছে। সে ভদ্রতা বাদ দিয়ে কপাল থেকে হাত নামিয়ে সায়াহ্নের দিকে এক পা এগিয়ে গেলো। সায়াহ্ন তখনো রীতিমত ভয়ংকর ভাবে চিৎকার করছে।
লোকটি একহাতে তার ভাষ্যমতে সায়াহ্নের আজলা টান দিতেই সায়াহ্ন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। আবছা আলোয় একজোড়া শীতল চোখ সেই সাথে রক্তাক্ত ভ্রুর চাহনী দেখেই তার দম ফুরিয়েছে। সে লাফালাফি,কান্না-কাটি বাদ দিয়ে অজ্ঞান হবার প্রস্তুতি নিতে চাইলেও পারছে না। এই লোক নিশ্চয়ই তাকে খুন করবে তার শাড়ির আজলা মানে আচল দিয়ে। সায়াহ্ন নানা জল্পনা কল্পনা করে ছোট ছোট করে বলল,
‘ আপনি আমায় এখনি মেরে দিবেন বুঝি?’
লোকটি প্রত্যুত্তর করলো না। পকেট হাতড়ে মোবাইল বের করে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে সায়াহ্নের মুখমণ্ডল বরারবর রাখলো। ঘর্মাক্ত মুখে ভয়ের আনাগোনা দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার । নেহাৎ রক্ত ফেরানোর জন্য তার কিছু একটা চাই বলেই এই মেয়ের কাছে আসা। নচেৎ সে ভুলেও কারো ভয়ার্ত মুখের কারণ হতো না। কপালে ব্যথার অনুভব হতেই মাথা নীচু করে সায়াহ্নের আচলের কিছু অংশ দাত দিয়ে ছিড়তে গেলেই সায়াহ্ন পেছানোর চেষ্টা করে ভীতিগ্রস্ত হয়ে বলে উঠে,
‘ দয়া ক…’
‘ প্লিজ ডোন্ট মুভ মিস.শাড়িওয়ালি।’
লোকটির জড়ানো কথার তারতম্য যেন সায়াহ্ন কে স্থির করে দিলো। সে বাধ্য মেয়ের মতো দাঁড়িয়ে লোকটিকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী শ্যাম বর্ণের ঝাঁকড়া চুলের ব্যক্তিটিকে সায়াহ্নের নিকট এখন কম ভয়ংকর লাগছে।
শাড়ির কিছু অংশ হাতে আসতেই লোকটি দ্রুত সায়াহ্নের নিকট থেকে প্রস্থান করে। মোবাইল অফ করে পকেটে গুজে দ্রুত হাতে পাশে থেকে বোতল উঠিয়ে কপালে পানি ছিটিয়ে শাড়ির অংশ টুকু কপালে বেঁধে সায়াহ্নের দিকে তাকিয়ে আবছা অন্ধকারের মতো আবছা কন্ঠেই বলল,
‘ আপনার সাথে যদি আবার কখনো দেখা হয় নিশ্চয়ই একটা লাল রঙের শাড়ি আপনার জন্য উপহার সরূপ থাকবে।’
‘ আমি খুব ভুল না হলে কালকেই তো দেখা হবে নিশ্চয়।’
সায়াহ্নের স্বাভাবিক স্বরে বলা কথাটি লোকটির কর্ণগোচর হতেই সে শীতল কন্ঠে বলল,
‘ কেনো বলুন তো? আমি কি আপনার নিকট আত্মীয় যে কালকেই দেখা হবে এমন শর্তে বেধে রেখেছেন।’
লোকটার বলা কথায় বিরক্তির আভা সায়াহ্নের কপালে ফুঁটে উঠলেও সে স্বাভাবিক ভাবে প্রত্যুত্তর করলো,
‘ আমার আত্মীয় না হলেও আমার হবু বরের তো আত্মীয় ।’
‘ পড়াশোনায় মনোযোগ দিন মিস.পিচ্চি।আপনার এই বিয়ে হচ্ছে না এইটা গ্যারান্টি।’
সায়াহ্ন অবাক হলো। বেশ আশ্চর্য হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করার পূর্বেই লোকটি বলল,
‘ বাসায় ফিরে যান। বাবা-মায়ের সাথে জেদ করা ভালো নয়।’
‘ আপনি জানলেন কি করে!’
লোকটি অন্ধকারে হয়তো মৃদু হাসছে। যে হাসির খানিক ঝলক সায়াহ্ন বুঝে আরো উৎকন্ঠা নিয়ে পরের প্রশ্নটি করার জন্য উদ্ধত হতেই লোকটি বলে উঠলো,
‘ আবার কোনোদিন দেখা হলে অবশ্যই বলবো।’
উক্ত কথা বলেই লোকটি দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে। কিয়ৎ মুহূর্তে আকস্মিক ঘটনায় সায়াহ্ন থমকে দাঁড়িয়ে রইলো ফাঁকা রেস্টুরেন্টের আবছা আলোয়।
তার বাবা জামিল আলমের সাথে অভিমান করেই কিছুদিন পূর্বে পেপারে বিয়ের বিজ্ঞপ্তি সে নিজেই প্রকাশ করে। সেই সূত্র ধরেই আজ পাত্রের সাথে দেখা করতে আসা। তবে পাত্র বিকেলে দেখা করতে আসার কথা থাকলেও মহাশয় বিকেল গড়িয়ে যখন ঘড়ির কাটা রাত নয়টা বেজেছে তখন উপস্থিত হয়েছে। তার সাথে এই বন্ধু নামক আগুন্তুক।
সায়াহ্নের তখন ইচ্ছা হয়েছিলো পাত্রকে খুন করে রেস্টুরেন্টের সামনে ঝুলিয়ে দিতে। নেহাৎ বাবার সাথে রাগের পাল্লা ভারী তাই মুখ বুজে হাসি ফুঁটিয়ে পাত্রের সামনে ভদ্রতা বজায় রেখেছিলো।
এক ঘন্টার আলাপ আলোচনার পর বাহিরে ঝড় উঠতেই পাত্র মহাশয় ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে তাকে রেখেই চলে গিয়েছিলো বন্ধু সমেত। রাতের মাত্রা ভারী হতেই রেস্টুরেন্টের মানুষের পাল্লা কমে। সেই সাথে বাহিরে ঝড়ের তান্ডবে গাড়ির দেখা সায়াহ্নের চোখে মেলে নি। তাই বাধ্য হয়েই রেস্টুরেন্টের বাহিরে ওয়াশরুমের বাহিরে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার ধারণা ছিলো মহিলা ওয়াশরুমের ধারে কাছে কোনো পুরুষ আসবে না। তবে তার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে আধঘণ্টার মাঝেই এই লোক এসে হাজির।
সায়াহ্নের কিছুটা খারাপ লাগছে লোকটার ব্যথাতুর মুখমণ্ডল ভেবে । তবে লোকটা ব্যথা পেলো কী করে?
উক্ত কথা মাথায় উদয় হতেই নিজেকে নিজেই কিছুটা শাসিয়ে হাত ঘড়িটির দিকে চোখ বুলালো সে। রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। এই সময়ে মোবাইলের চার্জটাও নেই তার। যা বহু আগে পাত্র মহাশয়ের জন্য অপেক্ষার দরুণ সে গেইম খেলে শেষ করেছে। সব দোষ পাত্র নামক লোকটিকে দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে সে ধাতস্থ হলো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি আকাশকক্ষ হতে ধরণীকে প্রানবন্ত করছে। সায়াহ্ন কিছু একটা ভেবে বাহিরে পাঁ বাড়ালো বাইরের দিকে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা তার জন্য নিরাপদ নয় সে উপলব্ধি করতেই আরেকবার শিউরে উঠলো।
বাইরে পাঁ বাড়াতেই ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি যেন সমান তালে নৃত্যের প্রতিযোগিতায় নামলো। রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টের যেন তার মতোই ভীতিকর অবস্থা। নিভু নিভু হয়ে বন্ধ হবার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণছে হয়তো। সায়াহ্ন নিজের প্রতি নিজে বিরক্ত হয়ে বৃষ্টির মাঝেই রাস্তার ধার ধরে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত উপনীত হলেও তার আশা এক নিমিষেই ভেঙ্গে দিলো পেছনে থাকা কারো শক্ত হাতের টানে।
সায়াহ্ন ভয়ে জমে গেলো মুহূর্তেই। আবারো সেই ভয় মনে উদয় হতেই চিৎকার করে বলল,
‘ ক..কে! আমার হাত ছাড়ুন।’
শক্ত পুরুষালি হাতজোড়া সায়াহ্নের ঠোঁটের উপর হাত চেপে ধরে তাকে টেনে নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। সায়াহ্ন লোকটির বাহুবন্ধনে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে তার সুদূর অন্ধকারাবৃত ভবিষ্যৎ ভেবেই ভয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠলো। আজকেই বুঝি তার শুরুটা সমাপ্তে রুপান্তর হবে?
চলবে………
#প্রিয়_প্রেমাসক্তা
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
সূচনা পর্ব