#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১৬
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
আম্বরখানা পয়েন্ট শাহজালাল রহঃ এর মাজারের গেইটের সাথে। নবাব একবার ভেবেছিল মাজার পরিদর্শন করবে কিন্তু পরক্ষণেই মত বদল করে সিএনজি স্টেশনে চলে এসেছিল।
“আচ্ছা, হাদারপার বাজারে তো অনেকগুলো নৌকার ঘাট আছে।” নবাব সিএনজি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতেই ড্রাইভার মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো, “জি।”
নবাবের বয়সী ড্রাইভারকে চোট করে সে কী সম্বোধন করবে বুঝতে পারছিল না। তাই সম্বোধন বিহীন কথোপকথন চালালো, “তাহলে যেখানে নৌকার ভাড়া কম আমাদের সেখানেই নিয়ে চলুন।”
“ঠিক আছে।” অতি সংক্ষিপ্ত বাক্যে ড্রাইভার কথোপকথনে ইতি টানলো।
নবাব সিটে হেলান দিতে গিয়ে মিষ্টির দিকে একবার তাকালো। নিশ্চুপ হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। মিষ্টি যতটা শৃঙ্খল এবং শান্তশিষ্ট, ওর জীবন ঠিক উল্টো; বিশৃঙ্খল আর ঝামেলাযুক্ত। নবাব ওকে ডাকতে গিয়েও চুপ করে রইলো। হালকা হেসে ফোন বের করে তাতে মত্ত হলো আর সেই ফাঁকে একটু বিড়বিড় করলো,
“আমি দৃষ্টিগোচর হলে যদি
তোমার হৃদয় করে আমায় স্মরণ।
তবে দু’জনার দুর্বোধ্য এবং সুপ্ত অনুভূতিতে
সৃষ্টি হবে অমোঘ প্রীতিকাহন।”
.
হাদারপার বাজারে এসে সিএনজি থামিয়ে ড্রাইভার নবাবের উদ্দেশ্যে বললো, “এই ঘাটে নৌকার ভাড়া কম। আপনারা যান।”
সৌজন্যের হাসি হেসে নবাব বললো, “ঠিক আছে।” এরপর মিষ্টিকে বললো, “এসো।” মিষ্টি নিঃশব্দে সিএনজি থেকে নেমে নবাবকে অনুসরণ করতে শুরু করলো।
মাঝির সাথে সবকিছু বলে কয়ে নিলো নবাব যেন একসাথে বিছানাকান্দি, পান্থুমাই আর লক্ষণছড়া ঘুরে দেখা যায়। কিন্তু মাঝি জানালো এতে অনেক সময় ব্যয় হবে হয়ত রাত হয়ে যেতে পারে। নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নবাব সিদ্ধান্ত বদল করে শুধু পান্থুমাই যাওয়ার জন্য মনস্থির করলো।
নদীতে স্রোত তেমন নেই তবে নৌকা দুলছে। নবাব প্রথমে নৌকায় উঠলো এরপর মিষ্টিকে বললো, “উঠে এসো।”
দুলতে থাকা নৌকার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি বললো, “ভয় করছে।”
“ভয় নেই।… ঠিক আছে, হাত দাও।”
হাত দাও– এই শব্দযুগলে স্তম্ভিত হলো মিষ্টি। যেন মাঝ নদী থেকে রুই মাছ ভেসে উঠার মতো লজ্জা ভেসে উঠলো ওর চোখে। মূহুর্তেই লজ্জায় চঞ্চল হলো চোখ আর স্তব্ধ হলো মিষ্টির নির্বাক কন্ঠ ও মন।
“কী হলো? জলদি এসো।” নবাব তাড়া দিতেই মিষ্টি এবার বাধ্য হলো মিষ্টি। মেহেদী রাঙা হাতখানা সে রাখলো নবাবের শক্ত-পোক্ত হাতে। আর মূহুর্তেই নবাব মিষ্টিকে টানলো নিজের দিকে। নৌকার উপর রাখা ডান পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে নবাবের খুব কাছাকাছি এসে থামলো। এত কাছ থেকে সে নবাবকে আগে দেখেনি তাই অস্বস্তি হতে শুরু করলো। কিন্তু নবাবের মাঝে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না মাস্ক পড়ে থাকায়। মিষ্টির হাত ছেড়ে সে সাধারণ কন্ঠে বললো, “এবার বসে পড়ো।”
মিষ্টি বসে পড়লো নৌকার একপাশে আর বিপরীত পাশে নবাব বসলো। নৌকার মাঝি তার নিজ কাজে ব্যস্ত হলো। ইঞ্জিন চালিত নৌকা ধীরে ধীরে নদীর বুকে ভাসতে শুরু করলো তীব্র শব্দে।
ছোটবেলায় একবার ইঞ্জিন বিহীন নৌকায় চড়ে ভ্রমণে গিয়েছিল মিষ্টি। এরপর আর কখনও নৌকায় উঠার সৌভাগ্য হয়নি তার। তবে আজকে নৌকায় উঠতে পেরে কিঞ্চিৎ ভালো লাগছে তার।
টলমল করা পানির দুইপাশে সবুজ সমারোহ। আকাশে হালকা রোদ আর স্রোতের বিপরীতে ছুটছে মৃদুমন্দ বাতাস। প্রকৃতির নিজস্ব ঘ্রাণে মাদকতা খুঁজে পাচ্ছে। এমন নেশায় যখন মত্ত সে, তখন হুট করে নবাব এসে তার পাশে বসলো। এতে খানিকটা চমকে সে নবাবের মুখের দিকে তাকালো। এখন নবাবের মুখে মাস্ক নেই। তাই হাড় ভাসা মুখের প্রশন্ন হাসি দেখতে পেল মিষ্টি।
“এই মিষ্টি, কী এতো ভাবছো?” পূর্ণ দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে মিষ্টি নবাবের দিকে। ওর প্রতি নবাবের সম্বোধন আগের মতোই আছে। আগে ডাকতো ‘এই আপু’ বলে আর এখন ‘এই মিষ্টি’ বলে। সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কের পরিবর্তন হলেও ভালোবাসা হয়ত এক জায়গায়ই স্থির থাকে। যদি সেই ভালোবাসা প্রকৃত হয় তবে যুগের পর যুগও তাতে ভাঁটা পড়ে না।
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসলো মিষ্টি, “কিছু না।”
“বললেই হলো? এমন সুন্দর একটা জায়গায় এসেও মুখ ভার করে আছো। কীসের চিন্তায় যেন বিভোর হয়ে আছো।”
“তুমি সাহিত্য পছন্দ করো?” মিষ্টির হঠাৎ করা প্রশ্নে নবাব একটু বিস্মিত হলো। হাসবার চেষ্টা করে জানতে চাইলো, “হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করছো?”
“বিদেশে থাকো অথচ তোমার কথাবার্তায় সেই ভাবটা আসে না। মনে হয় যেন বাংলাদেশ থাকো আর বাংলা বিষয়ে পড়াশোনা করেছো।”
নৌকার বেঞ্চে হেলান দিয়ে দুইহাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে নবাব বললো, “বিদেশে থাকলেই ঠাশঠাশ ইংরেজি বলতে সেটা তোমায় কে বললো?”
“এমনি জানতে চাইলাম।” স্পষ্ট জবাব দিলো মিষ্টি।
“ওহ… সাহিত্য পছন্দ কি-না জানি না। তবে উপন্যাস, কবিতা এসব মোটামুটি পড়া হয়েছে।” মিষ্টি উত্তর না দিয়ে আবারও চিন্তায় মত্ত হলো। বিষয়টা নবাবের ভালো লাগছে না বিধায় সে সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে এমন দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না। কী হয়েছে তোমার?” নবাবের আদুরে গলায় মিষ্টি চোখ ছলছল করতে শুরু করলো। ও চোখে তাকিয়ে মিষ্টি বললো, “আমার খুব ভয় করছে নবাব, খুব ভয় করছে।”
“হয়ত এই অনেক বছর পর নৌকায় উঠেছো বলে।”
“তোমাকে নিয়ে ভয় হচ্ছে আমার।” এই বলে মুখ ফিরিয়ে কাঁদতে শুরু করলো মিষ্টি। হঠাৎ ওর এমন কথা এবং কর্মে ঘাবড়ে গেল নবাব, “এই মিষ্টি, কাঁদছো কেন?” বৃথা হাসিতে নিজেকে এবং মিষ্টি সামলে নেওয়ার চেষ্টায় নবাব বললো, “আরে আমার কী হবে? তুমি শুধু শুধু ভাবছো।”
চকিতে মিষ্টি তাকালো নবাবের দিকে। মিষ্টির চাহনি নবাবকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, মিষ্টির ভাবনা হয়ত মিথ্যা নয়। তাই অচিরেই নবাবের হাসি বিলীন হলো। মনের খচখচানিতে চোখ আপনা থেকে নেমে গেল। মিষ্টি বিষয়টা লক্ষ্য করে বললো, “তোমার নিজের কথার ওপর নিজেরই ভরসা নেই, তাই না?”
চোখ তুলে নবাব বললো, “বিষয়টা তা নয়।”
“বিষয়টা যে কী সেটা তুমিও জানো আর আমিও।… শোনো না, আমি বলি কি? তুমি বিদেশে ফিরে যাও। ওখানে দুই-তিন বছর থেকে এসো। আমাকে নিয়ে তো আর ভয় নেই। তাই আমি বাবা-মায়ের কাছেই থাকতে পারবো।”
“দুই-তিন বছর পরে কি আমি আমার মিষ্টিকে এমনই পাবো?” মুখ ফিরিয়ে নিলো মিষ্টি। নবাবের প্রশ্নের উত্তর নেই তার কাছে। কারণ বাড়ি ফেরার পর অনেক কিছুই হতে পারে। তার বাবা-মা তাকে ডিভোর্স করিয়ে বিয়ে দিতে পারে, নবাবের জেল হতে পারে তাকে অপহরণ করে বিয়ে করবার জন্য, এমনকি ঐ দানবরূপী মানুষের হাতে নবাবের প্রাণও যেতে পারে।
“চুপ করে কেন গেলে মিষ্টি? তোমার কাছেও বুঝি উত্তর নেই?”
“নবাব, একটু বোঝার চেষ্টা করো। কালকে আমি মাঝরাতে স্বপ্ন দেখেছি। তোমার সামনে ঘোরতর বিপদ আছে আর…” মিষ্টি নবাবকে বোঝাতে চাইলো কিন্তু নবাব ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “ঐসব দুঃস্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না।” হঠাৎ কিছু মনে পড়তে নবাব বললো, “তারমানে ঐ স্বপ্ন দেখে তুমি আমাকে সারা রাত পাহারা দিলে আর সকাল থেকে ভাবনায় অস্থির হচ্ছো?”
কাঁধ নাচিয়ে মিষ্টি আবার নবাবকে বোঝাতে চাইলো, “আমি কারোর বউ হতে পারি না নবাব। আমার মা বাবা আমাকে বিয়ে দেওয়ার যত চেষ্টাই করুক না কেন? আমার কপালে সেই বিধবা হওয়াই লেখা আছে।”
“কিন্তু আমি তো চাই না তুমি আমার বউ হও।”
“মানে?” মিষ্টির কন্ঠে স্পষ্ট বিস্ময় ভেসে উঠলো।
“মিষ্টি, বিয়ে যদিও একটা পবিত্র সম্পর্কের বন্ধন। কিন্তু বিয়ের পর সম্পর্কগুলো চোখের পলকে বদলে যায়। ভালোবেসে বিয়ে করলেও বিয়ের পর সেই ভালোবাসা আর দেখা যায় না। দু’টো মানুষ সংসারধর্ম পালন করে ঠিকই কিন্তু সেটা দায়ে পড়ে। বিয়ের প্রথম প্রথম বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে আর এরপর সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে। দায়িত্ব, দায় আর মেনে নেওয়ার মাঝেই বাকি জীবন পার হয়ে যায়। অথচ বিয়ের আগে একে অপরের প্রতি যে ভালোবাসা থাকে, সম্মান থাকে সেটা আর যেন খুঁজেই পাওয়া যায় না; এ যেন কেবল দায়বদ্ধতার ভিড়ে নিশ্বাস ফেলা। আর পিতামাতার পছন্দে বিয়ে করলে তো আরও বেশি দায়বদ্ধতার পথে হাঁটতে হয়। হ্যাঁ, কিছু সম্পর্ক ব্যতিক্রমও হয় আর সেই ব্যতিক্রমী সম্পর্কটাই আমি চাই।”
“আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
হালকা হেসে নবাব আবার বলতে শুরু করলো, “মিষ্টি, আমি এমন কোনও সম্পর্কে জড়াতে চাই না যেখানে ঠেকায় পড়ে মানুষ জীবন কাটাবে। বরং এমন একটা সম্পর্ক চাই, যেখানে ভালোবাসার গভীর সমুদ্র থাকবে, একটু মান অভিমান থাকবে, তীব্র ঝগড়ার মাঝেও সুপ্ত মায়া জড়ানো থাকবে। আমি মনের সুখের ঝগড়া করে বিছানায় পড়ে থাকলেও সে যেন আমার চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়ে। নির্ঘুম একটা রাত যেন সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে পার করতে পারে, আমাকে খাওয়ানোর জন্য যে নিজে খেতে পারে; এমন আরও অনেককিছুই আছে।” নবাবের কথা শুনে মিষ্টির নিজের করা কর্ম মনে পড়ে গেল। আর এতে লজ্জার জালে সে আবদ্ধ হলো কিন্তু নবাব বলে চলেছে, “ছোট্ট বেলা থেকে এখন অবধি তোমার সাথে আমার সম্পর্ক যেমন ছিল, তেমন সম্পর্ক আজীবন থাকুক সেটাই আমি চাই। তোমাকে আমার বউ হিসেবে নয়, রানী হিসেবে দেখতে চাই। তবে আমি রাজা নয়, নবাব হিসেবেই থাকতে চাই। তোমার সেই ছোট্ট নবাব।” শেষ কথাগুলো বেশ মজা নিয়ে বললো নবাব।
গম্ভীর ভাব এনে লজ্জায় ধরে আসা গলা উপেক্ষা করে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “তুমি সত্যিই সাহিত্য পছন্দ করো না?”
মৃদু শব্দে হেসে নবাব বললো, “হাসালে মিষ্টি। আমার কথাগুলো কি সাহিত্যিকদের মতো শোনাচ্ছে?”
“এমন কথা সাহিত্যেই যথোপযুক্ত, বাস্তবে নয়।”
“চাইলে বাস্তবেও সম্ভব।” হঠাৎ নবাব মিষ্টির দিকে ঝুঁকে আসতে মিষ্টি আঁতকে উঠলো। মিষ্টি পিছনে একটু হেলে গিয়ে চোখ পিটপিট করলো আর নবাব বললো, “প্রমাণ চাও?”
কাঁপা স্বরে মিষ্টি জানতে চাইলো, “কীসের?”
“প্রীতিকাহন-এর।”
এই ধারাবাহিক হয়ত আপনাদের কাছে খাপছাড়া মনে হচ্ছে। আসলে এতে বর্তমান কাহিনির সাথে অতীতও উল্লেখ করা হচ্ছে। তাই একেক কাহিনিতে নবাব এবং মিষ্টিকে একেক বয়সের দেখা যাবে। কালকে পেইজের একটা পোস্ট নিজে থেকে মিউট হয়ে গেছে। পেইজের অবস্থাও দিনদিন নিম্নমুখী হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে এই পোস্টে সকলের মন্তব্য আশা করছি। পেইজটা সচল করতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা অনেক গুরুত্ব বহন করবে)
…চলবে কি?
হবে ইন শা আল্লাহ)