প্রীতিকাহন পর্ব ৩২

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৩২

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

“নবাব… এই নবাব?” মিষ্টি ডাকলো নবাবকে কিন্তু নবাব একটিবারের জন্য ফিরেও দেখলো না। ভারাক্রান্ত মনে মিষ্টি হঠাৎ-ই অনুভব করলো তার গাল ভিজিয়ে কিছু একটা গড়িয়ে পড়েছে। ডান হাতে সেটা ছুঁয়ে চোখের সামনে ধরে বলে উঠলো, “সবাই আমাকে চোখের জল উপহার দিয়ে কেন সরে যায়?” এরপর আকাশের দিকে মুখ করে সেই স্বাতী নক্ষত্রের উদ্দেশ্যে বললো, “তোমার মতো আমিও একা, না?”

.

“কী হয়েছে তোমার বলো তো? একটু বাদে মেয়ের বিয়ে আর তুমি একা ঘরে অস্থির হয়ে উঠছো। আরে মেয়ে তো সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছে না। পাশের শহরেই বিয়ে হচ্ছে। তাছাড়া ইফাদ খুব ভালো ছেলে।” নিঝুম অনর্গল বললেন কিন্তু সোবহানের পায়চারি থামবার নাম নেই। ঘরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে হেঁটে চলেছেন। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নিঝুমের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললেন, “ইফাদকে নিয়ে কে ভাবছে? আমি তো ভাবছি ঐ কবিরকে নিয়ে।”

“কবির?” হা হয়ে গেলেন নিঝুম।

“হ্যাঁ, কবির। মেয়েকে যখন পাত্রপক্ষ দেখতে এলো, তখন থেকেই আমাকে হুমকির মুখে রেখেছে। তবে আমি মামুলি বিষয় ভেবে গায়ে তুলিনি। কিন্তু আজকে সকালে ফোন করে বললো মেয়ের বেনারসি সাথে কাফনের কাপড় তৈরি করে রাখতে।”

“কী বলছো গো তুমি?” আঁতকে উঠলেন নিঝুম।

“ঠিকই বলছি।”

“এখন কী হবে? মেয়েটা বিয়ের আসরে এমন কলঙ্কিত হলে লোকে কী বলবে গো?” এই বলেই আঁচলে মুখ ডাকলেন নিঝুম।

“তুমি বিয়ে নিয়ে পড়লে? মেয়েটার যদি উনিশ-বিশ কিছু হয়ে যায় তখন? আমাদের কি আট-দশ জন ছেলে-মেয়ে? একটা মাত্র মেয়ে আর তার যদি কিছু হয় তাহলে সেই কষ্ট বইতে পারবে সারাজীবন?” বেশ উঁচু গলায় কথাগুলো বললেন সোবহান। দোতলার ঘরে এখন কেউ নেই। সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত। তাই গলার স্বরের দিকে নজর রাখেননি সোবহান অবশ্য উত্তেজনার ফলে তার মনে আসেনি অন্য কেউ এসব শুনতে পারে।

“কী হয়েছে ভাবী?” হঠাৎ মিনারার কন্ঠ শুনে স্বামীস্ত্রী দু’জনেই চমকে উঠলেন। সোবহান এই বিষয়ে বোনকে কিছু বলতে নারাজ। তাই পুনরায় পায়চারি করার সিদ্ধান্ত নিলেন কিন্তু নিঝুম সবটা বলে দিতেই আঁতকে উঠলো মিনারা, “এখন উপায়? দুই ঘন্টা বাদেই তো বরযাত্রী আসবে।” এরপর ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, “ভাইজান, এসব বিষয় নিয়ে আপনার আরও আগে আলোচনা করা উচিত ছিল।”

খেঁকিয়ে উঠলেন সোবহান, “আমি কি জানতাম না-কি মেম্বারের ঐ পাতি মাস্তান ছেলে এসব করতে পারে?”

“ভুল বললেন ভাইজান। জল কি একদিনে গড়ায়? ছোটবেলায় মিষ্টিকে কিন্তু শাসিয়ে ছিল, ওকে বড় হলে দেখে নিবে৷ আল্লাহর অশেষ রহমতে আজ অবধি মেয়েটার কিছু হয়নি। আপনি যদি আগে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন তবে আজকেও এসব শুনতে হতো না।”

“আমি জানি না। মাথায় কিছু ঢুকছে না আমার।” হাত নেড়ে সোবহান আবার পায়চারি শুরু করলেন। এদিকে নিঝুম মেয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছেন। কিছু সময় ভাই-ভাবীকে দেখে নিঃশব্দে ঘর ত্যাগ করলেন মিনারা।

নিজের স্বামীকে খুঁজতে খুঁজতে বিরক্ত প্রায় মিনারা একলা মনে বিড়বিড় করলেন, “কাজের সময় মানুষটা যে কোথায় থাকে? আর ছেলে তো বিদেশে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করেছে। দিনের পর দিন এমনিই চলে যায়। না কোনও ফোন না কোনও খবর নেওয়া। কত করে বললাম বিয়েতে আসার জন্য। আজকে বিয়েতে এলে কি এতসব দেখতে হতো আমায়?”

“কার সাথে কথা বলছো নবাবের মা?” আরমানের কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো মিনারা। পিছনে ফিরে ভ্রু জোড়া কুঁচকে স্বামীকে জবাব দিলেন, “আমার ভাগ্যের সাথে।”

“তার আবার কী হলো?”

“কী আবার হবে? বিয়ের পর তুমি সৌভাগ্য এনে দিলে আর এখন তোমার ছেলে দিচ্ছে।”

“আহা! চটছো কেন? কী হয়েছে বলবে তো?”

আশেপাশের মানুষদের শুনিয়ে কিছু বলতে চান না মিনারা। তাই স্বামীকে বললেন, “বলছি আগে এসো আমার সাথে।” বলেই হাত ধরে টানতে টানতে হাঁটতে শুরু করলেন। আরমান কিছু বলতে গিয়েও চুপচাপ হাঁটতে লাগলেন।

ফাঁকা ঘরে বউয়ের মুখে সবটা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন আরমান, “কী বলছো তুমি? হ্যাঁ?”

“দেখো, এছাড়া কোনও উপায় নেই। তোমাকেই ব্যবস্থা করতে হবে।”

“আমি কী ব্যবস্থা করবো? জহির আমার বন্ধু বলে কি নিজের কাজ ফেলে বিয়ে বাড়ি পাহারা দিবে?”

“আশ্চর্য! পাহারা দিতে আমি কখন বললাম?” বিরক্ত হলেন মিনারা।

হাত নাড়িয়ে আরমান বললেন, “না, না, আমি এসব করতে পারবো না। জহির আমার বন্ধু বলে আমি যা খুশি তাই আবদার করতে পারি না।”

“তুমি কী? হ্যাঁ? মিষ্টি যদি তোমার নিজের মেয়ে হতো আর এমন বিপদে থাকতো তাও কি তুমি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে? আরে আমি কি অন্যায় কিছু করতে বলছি? পুলিশের একটু নজরদারিতে বিয়েটা চুকে যেত। এতে কি আর দিন-রাত পাহারা দিতে হবে?”

একটু ভেবে আরমান জিজ্ঞেস করলেন, “বিয়ের পর কিছু হবে না তার কোনও নিশ্চয়তা আছে?”

মিনারা বললেন, “আমাদের নিশ্বাসেরও তো নিশ্চয়তা নেই। তাই বলে কি আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি? তা তো নয়। তাহলে বিয়েটা হলে সমস্যা কোথায়?”

ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে আরমান বললেন, “জানি না কিন্তু ওর হয়ত বিয়েটা না হলেই ভালো হতো। ওর বিয়ে নিয়ে অনেকেই বোধহয় অখুশি।”

“এসব কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি বরং জহির ভাইয়ের সাথে কথা বলে একটা কিছু ব্যবস্থা করো।”

আরমান গম্ভীর গলায় বললেন, “ব্যবস্থা করছি কিন্তু পরে দেখো আবার না পস্তাতে হয়।” মিনারা অবাক হলেন, কিছু বলতেও চাইলেন কিন্তু কথা খুঁজে পেলেন না বিধায় চুপ করে রইলেন।

আরমান জহিরের সাথে আলাপ করতেই জহির রাজি হয়ে বলে উঠেন, “সমস্যা নেই। আসলে আজকে একটু ফাঁকা আছি। তুই ভাবিস না। আমি দেখছি কী করতে পারি?”

জহিরের সহায়তায় বিয়ে বাড়িতে কোনও গোলযোগ দেখা দেয়নি। বরপক্ষ যথা সময়ে এসেছে। সবার খাওয়াদাওয়া চুকে যেতে এখন কাজি সাহেবকে নিয়ে বিয়ে পড়ানোর ধুমধাম চলছে। বরপক্ষের কথানুযায়ী দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়েছে একুশ লক্ষ টাকা। এমন বেমিল টাকার পরিমাণ নিয়ে নিঝুম আপত্তি করলেও সোবহান বলেছিলেন, “তারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী দিচ্ছে। আমাদের সেখানে কথা বলা উচিত নয়।” স্বামীর কথার বিপরীতে নিঝুম কথা বাড়ায়নি কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট নন সেটা সোবহান ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন।

হালকা কেশে কাজি সাহেব মিষ্টিকে বললেন, “তোমার মত আছে মা বিয়েতে? থাকলে কবুলটা বলে ফেলো।”

নববধূর সাজে মিষ্টি নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। তার চিবুক ভেজানো চোখের জলকে হয়ত সবাই স্বাভাবিক বিষয় মনে করছে। কারণ বিয়েতে প্রায় সকল মেয়েই পরিবার হারানোর ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে। কিন্তু মিষ্টির চোখের অশ্রুর নামটা যে সবার অজানা। কেউ হয়ত জানবেও না তার চোখের জলের নাম নবাব।

…চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here