প্রেমজাল পর্ব ১১+১২

#প্রেমজাল
পর্ব ১১
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন

ধরণীর বুক জুড়ে আধার নেমে সন্ধ্যা থেকে রাত হতে চলেছে। দূর আকাশ থেকে এশার আযান শুনা যাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলাম মাত্র রাত ৮ঃ১৫ টা ছুই ছুই। জানালা দিয়ে আসা বহমান ফুরফুরে হাওয়ায় আমার শাড়ির আচল অকপটে উড়ে চলছে। আবহাওয়ার স্নিগ্ধ আবেশে বোঝা যাচ্ছে হয়তো বৃষ্টি আসবে। আমি এবার একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে আয়নায় শাড়ির কুচি ঠিক করতে উদ্যোগী হলাম। এক জোড়া গম্ভীর চোখ ড্রেসিং টেবলের আয়নার প্রতিফলকে আমাকে যে দেখছে তা না বুঝতে বোধগম্য হলো না। হঠাৎ করে উনার এমন গাম্ভীর্যতার উদ্ভব কেনো ঘটলো কে জানে। সকালে তো ভালোই সবার সাথে খুশ-আলাপ করলো। দুপুরেও তো সব ঠিক-ঠাকই ছিলো। তাহলে উনার এমন গাম্ভীর্য সুলভ আচরণের মানে কি? মাঝে মাঝে মন চায় তো এই ব্যাটাকে আস্ত দাফন করে দেই।

আমি শাড়ি সেট-আপ করতে করতে আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই আয়ান থমথমে স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো,

-“আর কতক্ষণ?”

আমি পিছনের ফিরে এক হাত দিয়ে আরেক হাত মোচড়া-মুচড়ি করতে করতে শুকনো একটা ঢোক গিলাম। এদিক-অদিক চাহনি নিয়ে মিহি গলায় উনাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

-“আজকে ফিরে না গেলে হয় না? মানে যাওয়াটা কি খুব জরুরি?”

আয়ান শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে শান্ত গলায় বললো,

-“বাইরে অপেক্ষা করছি” বলে বেরিয়ে যেতে নিয়েও কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে আসলো।

-“ঠিক ৫ মিনিট। ১ মিনিটও যাতে হেল-ফেল না হয়” খানিকটা কড়া গলায় বলে আবার বেরিয়ে গেলো আয়ান। মাঝে মাঝে এই অসহ্যকর লোকের ঘাড়ত্যাড়ামির জন্য নিজের কপাল নিজেরই ফাটাতে মন চায়। জাস্ট রিডিকুলাস পারসন (Just ridiculous person)!

মনের মধ্যে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে চোখে হালকা কাজল টানলাম আর একটু ঠোটে লিপজেল দিলাম। পার্সে ফোনটা নিয়ে একবার চারপাশটায় চোখ বুলালাম। হয়তো আর এখানে আসা হবে না। সাহেবের যেই ভাব-সাব। শৈশব-কিশোরী অংশ এই ঘরেই কেটেছে। ভারী শ্বাস নিয়ে বেরিয়ে আসলাম বাইরে।

বাইরে বের হতেই দেখলাম আয়ান বিরক্তিমিশ্রিত ভাব নিয়ে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। কি ব্যাপার? ৫ মিনিট তো পুরা হয়নি। তাহলে এমন থমকা আচরণের কারণ কি? আমি কিছু বুঝার আগেই দাদিমণি অনুনয় বিনয় স্বরে বললো,

-“একট্টু খানি খাওয়ানোর সময়ে তোর কি টেরেন ছুইটা যাইবো, নানাভাই?….(একটু থেমে) দুগা খানি খাইয়া লো”

-“মা এতো করে বলছে, আয়ান। একটু খেয়ে যা। খালি মুখে বাড়ি থেকে বের হতে হয় না বাবা” আয়ানের উদ্দেশ্য আদুরে গলায় বললো ফুপিমণি।

দাদিমণি আর ফুপিমণির মাঝে কথার ফোড়ন কেটে ছোট কাকিমণি কেটে বললো,

-“আচ্ছা। তুমি না খেলেও আহানা খেয়ে নিক…(একটু থেমে) দুপুরে অতিথিদের আপ্যায়নের চাপে তেমন কিছু খেতে পারে নাই”

আয়ান শান্ত গলায় বললো,

-“হুম। দেখলাম তো কীভাবে অতিথি আপ্যায়ন করেছে”

উনার শান্ত গলায় কেমন জানি ঘাপলা আছে। এতো স্মুথ বিহেভার হলেন কীভাবে! পাত্র-পক্ষ যাওয়ার পর থেকে এমন খাপছাড়া আচরণ করছে এবার একটু একটু বুঝতে লাগলাম।

ছোট কাকিমণি হাত ধরে টেনে খাবার টেবিলে আমাকে বসিয়ে দিতেই ফুপিমণি আয়ানের দিকে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলো।

আয়ান বাধ্য ছেলের মতো খেতে বসলো। বসতেই দাদিমণি হুমড়ে পরলো নাতিকে সোহাগ করতে। সবচেয়ে ভালো আইটেম গুলো এগিয়ে দিচ্ছে উনার সামনে।

পাশ থেকে রিমি আমাকে ফিসফিস করে বললো,

-“দেখো আহানাপু, আয়ান ভাইয়াকে এমন ভাবে খাওয়ানো হচ্ছে মনে হয় শ্বশুর বাড়ি জামাই আদর দিচ্ছে”

আমি রিমির কথার প্রতিত্তোরে আলতো হাসলাম।

উনার দিকে আড়চোখে এক পলক তাকালাম। উনি তো আরামসে দিব্যি খাচ্ছে। হোক বিয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে সম্পর্কে তো এখন এই বাড়ির নাত-জামাই এই। মনে মনে নিঃশব্দে হেসে আবার খাওয়ায় মনযোগ দিলাম।

বড় কাকিমণি তাচ্ছিল্য স্বরে ছোট কাকিমণিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“ছোটো, তোর নিজের মেয়ের প্লেট তো খালি প্রায়, দে কিছু। এই মেয়েকে নিয়ে এতো আদিক্ষেতা করে খাওয়ানোর কি আছে বাপু? কয়দিন পরেই আবার উড়ে এসে জুড়ে বসবে” বলে মুখ ব্যঙ্গ করে প্রস্থান করলো। আমি এবারো নিঃশব্দে হাসলাম। এই আর নতুন কি? জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই কমবেশি এমন কটু কথা উঠতে বসতে শুনতে হয়। বড় কাকিমণি আমার আর সুপ্পুর সাথে কি শত্রুতা আল্লাহ মাবুদই জানে। কিন্তু এদিকে ছোট কাকিমণির সাথে অনেক সখ্যতা। এমনকি উনি তো একবার বলেছিলেও যদি রিমি, অরিন বাদে বড় কোনো ছেলে সন্তান থাকতো তাহলে আমার সাথে বিয়ে এখানেই আজীবন রাখতো। নতজানু হওয়ার পর বেশ বুঝলাম আয়ান দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চুপচাপ খেয়ে উঠে আসলাম। খাওয়ার পর্ব শেষ করে সবার থেকে বিদায় নিতে নিতে ১০টা বেজে গেলো।

_________________

এতোক্ষণ আকাশটা পরিষ্কার থাকলেও এখন মেঘের ছায়ায় ডুবে যাচ্ছে। গাড়ি পরিমিত সীমা নিয়ে ছুটে চলছে আধ-কাচা রাস্তার লোকবিহীন সবুজের সমারোহের মধ্য দিয়ে। গাড়ির জানালা ভেদ করে বৃষ্টির মিষ্টি সৌরভ আমাকে প্রাণবন্ত করছে। আমি জানালার দিকে মনোনিবেশ হয়ে হাওয়া গুলো অনুভব করতে লাগলাম। পরিবেশের উন্মোদনায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। আমি খানিকটা আবেগীময় হয়ে বাম হাতটা জানালা পার করে অগ্রসর করলাম। তখনি আমার ওয়ান এন্ড অনলি দি গ্রেট আয়ান চৌধুরী রামধমক দিয়ে হাত ভিতরে নিতে বললো। আমি সাথে হাতটা গুটিয়ে নিলাম। আমি মনের কোণে একরাশ অভিমান নিয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনি গাড়ির স্টেয়ারিং সামলাতে ব্যস্ত। এতোই ব্যস্ত যে আমার দিকে এক পলক তাকানো গেলো না? আমি মুখ ফিরিয়ে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলাম। অনুভব করতে লাগলাম কেও জানালার সাটার অনেক খানি খুলে দিয়েছে। যার ফলস্বরূপ আমার কপালে সন্তপর্ণে পরে থাকা অবিন্যস্ত চুলগুলো দোল খাচ্ছে। আমি নিশ্চুপে অনুভবই শ্রেয় মনে করলাম। উনার হঠাৎ এমন সো কল্ড বিহেভার কেনো উপচে পরছে? চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো কিছু সময়ের আগের ঘটনা।
.
.
.
আসরের ওয়াক্তে শেষ পর্যায় পাত্র-পক্ষ বিদায় হয়েছে। সব কিছু গোজ-গাজ করতে করতেই সন্ধ্যা হলো। ড্রয়িং রুমের একপ্রান্তে পরিবারের সদস্যরা বিয়ের আলোচনা করছে। তাদের অদূরে এক প্রান্তে আমরা পরিবারের ছোট সদস্যরা গোল হয়ে মাদুর বিছিয়ে বসেছি। সুপ্পু লাজুক লাজুক চাহনি নিয়ে মুচকি হাসছে। আজ থেকে ঠিক ৩ দিন পর এনগেজমেন্ট। এরপরেই ধুমধাম করে সানাই বাজবে বিয়ের। নিলয় ভাইয়া সুপ্পুকে নিয়ে ফরেন চলে যাবে তাই কিছুটা তাড়াহুড়ো করেই বিয়ে হচ্ছে। একদিক দিয়ে মজা হবে বলে খুশি আরেকদিক দিয়ে চলে যাবে বলে কষ্ট হচ্ছে। রিমি তার ননস্টপ বকাবকানি ইতিমধ্যে শুরু করছে। এজ লাইক বিয়েতে কি করবে, কি পরবে, কই সাজবে, কীভাবে যাবে তার প্লেনিং। আর আমি হাদারামের মতো কথা গিলছি। টুং করে আওয়াজে আমার ধ্যান ভঙ্গ হলে, ফোনে তাকাতেই নোটিফিকেশনে “রিয়ান” নামটি ভাসছে। আমি ইগ্ননোর করে রিমির কথায় মন দিলাম। আবারো টুং করে শব্দ হতেই সুপ্পু সন্দেহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। মনে হচ্ছে আমি কি জানি করে ফেলছি। আমি ইগ্ননোরনেস জারি রাখলাম।

সুপ্পু দুষ্টুমি মাখা কণ্ঠে বললো,

-“কীরে, আহানা। প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি। প্রেম-ট্রেম করিস নাকি?”

আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নাক-মুখ ছিটকে নিয়ে বললাম,

-“তুমি তোমার বয়ালির মুরগিকে সামলাও। আমি কি করি দেখতে হবে না, হুহ” বলে একটু ভেংচি কাটলাম।

আমার কথার প্রেক্ষিতে সুপ্পু যখনি কিছু বলতে যাবে তখনি আকস্মিক ভাবে আয়ানের গলার আওয়াজ শুনে পিছনে তাকালাম। উনার এমন কথায় অনেকখানি অবাক হলাম।
#প্রেমজাল
পর্ব ১২
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন

আমার কথার প্রেক্ষিতে সুপ্পু যখনি কিছু বলতে যাবে তখনি আকস্মিক ভাবে আয়ানের গলার আওয়াজ শুনে পিছনে তাকালাম। উনার এমন কথায় অনেকখানি অবাক হলাম।

-“মাম্মাম! আমি এখানে আর এক মূহুর্ত থাকতে চাই না। আমি এখনি ব্যাক করছি”

-“একি আয়ান এটা আবার কেমন কথা? আজকেই তো এলি। পরশুদিন না হয় সবাই একসাথেই ফিরলাম”

-“আমি আজকেই ফিরে যেতে চাই এট এনি কস্ট” কাটকাট গলায় বললেন আয়ান।

আমি এবার বসা ঠিক রেখেই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকালাম। মহাশয় দুই হাত বুকে গুজে ঠাই হয়ে দাঁড়ীয়ে আছে। কথার এমন ধাচ মনে হচ্ছে আজকেই উনার যেতে হবে। না হলে বোধ হয় উনার বউ আরেক ব্যাটার সাথে ভেগে যাবে, হুহ।

-“কি হইসে নানাভাই? আমারে কো? তুই ফিরা যাইতে চাস ক্যান? তোর কি বুকে রেহেম-দেহেম নাই? আইজ বাদে কালেই তো আমরা সব্বাই মিল্লা টাউনে যাইতাসি। আর তুই…”

আয়ান দাদিমণির কথা থামিয়ে গা ছাড়া ছাড়া ভাব দিয়ে বললো,

-“আমি কিছু জিজ্ঞেস বা কোনো ধরনের আবদার করতে আসি নি। আমি আমার সিদ্ধান্ত জানাতে এসেছি”

-“বললেই হলো নাকি? খাবি কি শুনি? বাসি জিনিস খাস? বাইরের খাবারও তো ছুয়ে দেখিস না। মালতিও ছুটিতে আছে। কে রান্না করবে তোর জন্য?” খানিকটা ধমকের স্বরে বললো ফুপিমণি।

-“সেটা আমার ব্যাপার না। তাছাড়া তোমার অতি আদরে গড়ে তোলা বাদর ফাজিল ভাতিজী আছে কি করতে? কয়েকদিন পর সেমিস্টার পরিক্ষা কিন্তু তার তো কোনো পড়ার নামে খবর নাই, ফাকিবাজদের মতো সারাদিন গাল গল্প করে বেড়ায়…(একটু থেমে) আমার সাথে ব্যাক করতে বলো” ভরাট গলায় বললো আয়ান।

-“আবার আহানা কেনো? এই মেয়ে গিয়ে কি করবে, আয়ান?” চোখ সরু করে কৌতূহল স্বরে জিজ্ঞেস করলো আদ্র ভাই এর মা ওরফে বড় কাকিমণি।

আয়ান তাচ্ছিল্য একটা হাসি দিয়ে ঘড়ি দেখতে দেখতে বললো,

-“যাকে দু’দানা খাওয়ার আগেই খোটা দেওয়া হয়, তার থাকার চেয়ে না থাকাই শ্রেয় নয় কি? তার থেকে আমার বাড়িতে থাকলে অনন্ত খেতে পারবে”

দাদিমণি কটমট চাহনি নিয়ে কড়া গলায় বললো,

-“কি শুনতাসি আমি এইসব বউমা? তুমি আবার…”

সাথে সাথে কাকিমণি মুখের রঙ উড়ে গেলো। আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই আয়ান বাধ সাধলো। আয়ান হঠাৎ করে তীর্যক ভাবে আমার দিকে তাকাতেই আমাদের চোখাচোখি হয়। আমি উনার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। আমি চোখ সরিয়ে আনতেই আয়ান ফুপিমণিকে খাকাড়ি গলায় বললেন,

-“মাম্মাম! আ’ম গেটিং লেট”

ফুপিমণি মুখে একরাশ বিরক্তি ফুটে ওঠলো। সে খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছে তার লক্ষ্মী মন্ত্র ছেলে যা বলেছে তাই করবে। আয়ান তার সিদ্ধান্ত সবসময় অটল থাকে। তাই বাধ্য হয়ে আর বেশি কথা বাড়ালো না।

-“আমি যাচ্ছি না। আহানাকেই নিয়ে যা। আমি কিছু আর শুনতে বা বলতে চাইছি না” বলে আবার নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা রটিয়ে দিলেন।

এতোক্ষণ মনে মনে দোয়া-দুরূদ পড়লাম যাতে ফুপিমণি রাজি না হয়। কিন্তু উরিম্মা ফুপিমণি নিজে যাবে না কিন্তু উনার সাথে সাথে আমাকেও নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিলো। হায়! ইয়া আল্লাহ মাবুদ! আমি মনে মনে এক মহামারী সিদ্ধান্ত নিলাম। যাই হোক আজকে উনার সাথে যাবো না, মানে যাবোই না। কিন্তু এজ ইউজেল আমার সিদ্ধান্ত বেশিক্ষণ টিকলো না।

আয়ান তেড়ে এসে আমার বাহু চেপে দাড় করালেন। আমি উনার দিকে প্রশ্নসূচক দিকে তাকিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলাম। উনার দৃষ্টি চাহনির অর্থ মাথা নামক পদার্থ বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না। এখন যদি সবার সামনে ঠাডায় একটা থাপ্পড় মারে? এদিক-অদিক তাকালাম। আদ্র ভাই, সুপ্পু, রিমি সবাই আমাদের কি তাকিয়ে আছে। রীতিমতো আমার অবস্থা “ছেড়ে দে মা, কেদে বাচি” টাইপ।

-“আহানা আমি তোকে কাল ড্রপ করে দিবো নে। রাত হয়ে যাচ্ছে, এখন ফিরে যেয়েই বা কি করবি?” স্বাভাবিকভাবেই বললো আদ্র ভাই।

আদ্র ভাই এর কথা শেষ হতে দেরি আমার হাতের বাহুতে আক্রমণ করতে দেরি হলো না। এই বুঝি আমার হাড়-গর ভেঙ্গে গেলো। ব্যথায় জ্বলে যাচ্ছে। উফ! আমি বাধ্য হয়ে মিছে হাসি দিয়ে বললাম,

-“এখানে যে কারণে আসা হয়েছিলো তা তো মিটে গেলো। আবার অই বাড়িতে সব অনুষ্ঠান হবে, প্রস্তুতি তো নিতে হবে তাই না? আবার আমার পড়াশোনাও তো আছে” বলে আলতো করে একটা শ্বাস নিলাম। বাহুতে চাপ কম অনুভব হতেই বাম-ডান দিক আর দেখে আমার রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। পিছন থেকে রিমি দুষ্টুমি মাখা কণ্ঠে নিয়ে বলতে লাগলো,

-“আয়ান ভাইয়া, তুমি না হয় আহানাপুকেই বিয়ে করে নাও। তোমার সব কথা শুনে। সব কথায় উঠবে আর বসবে”

মনে হচ্ছিলে এখনি মাথা ঘুরিয়ে পরে যাবো। নিজেকে তাড়াতাড়ি সামলিয়ে ঘরে আসলাম…
.
.
.
চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় চোখের পাতায় বিন্দু বিন্দু পানি কণা অনুভব করতে আমার ভাবনার জগৎ খন্ড বিখন্ড হয়ে গেলো। আমি পিট পিট করে থাকাতেই অনেকটা হতবাক হলাম। আয়ান আমার দিকে ঝুকে হন্তদন্ত হয়ে গাড়ির গ্লাস লাগাচ্ছে। আমি হঠাৎ এমন ভাবে দেখে আহাম্মকের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে উনার তাকিয়ে আছি। উনি আমার দিকে তাকাতেই সারা শরীর শিরশির করতে লাগলো। বুকের হৃদ মাঝারে প্রাণ পাখি ডানা ঝাপটাতে লাগলো। আমি আনমনেই জিভ দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলাম।

আয়ান আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। উনি আমার মুখে ফুক মারলো। উনার মুখ ও নাকের গরম নিশ্বাস আমার মুখে উথাল-পাতাল ভাবে আছড়ে পরছে। আমি সাথে সাথে চোখ মুখ বন্ধ করে ফেললাম। যখনি এমন আমার মুখে ফুক মারে, তখনি উল্টা পাল্টা কান্ড করে। এই মূহুর্তে আমার জন্য শ্বাস নেওয়া থেকে দুষ্কর জিনিস দু’টো আছে বলে মনে হচ্ছ না। উনার কাছ থেকে আগত কার্বন ডাই অক্সাইড এর অদৃশ্য আবেশে আমার অক্সিজেনের ঘাটতি হতে লাগলো। আমি উনার বুকে হাত দিয়ে আলতো ভাবে ধাক্কা দিলাম। উনি সরে না গিয়ে খানিকটা এগিয়ে আসতেই উনার শার্ট খামচে ধরলাম। আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতেই শার্ট ছেড়ে দিলাম। মনে হচ্ছে যেনো দেহে প্রাণ ফিরে আসলো। কয়েকবার চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাই গভীর নিশ্বাস নিলাম। গাড়ির চলার আবেশ করতে চোখ আস্তে আস্তে খুললাম।

চারদিকে পর্যবেক্ষণ করতেই বুঝলাম বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু বেশ অবাক হলাম। চারদিকে সবুজ গাছ-পালা হাতছানি দিচ্ছে। এতোক্ষণে তো গ্রাম পেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। আমার আগডুম-বাগডুম ভাবনার মাঝেই গাড়ির স্টেয়ারিং সামলাতে সামলাতে উনি থমথমে গলায় বললো,

-“তুমি লজ্জাও পাও”

সাথে সাথে আমি যেনো সপ্তম আকাশ থেকে পরলাম। অনেকটা আবাকের সাথে রাগও লাগছে।

আমি তেজি গলায় বললাম,

-“কি বলতে চান? আমার লজ্জা নেই? লজ্জা কি পানিতে গুলানো জিনিস? যে ধুয়ে খেয়ে ফেলবো?”

উনার আমার কথার প্রতিত্তোরে কিছু বললেন। ধাম করে ব্রেক কষলেন। আকস্মিকভাবে হওয়ায় খানিকটা সামনে ঝুকে পরলাম। স্বাভাবিক হয়ে বসতেই দেখলাম উনি আমার বিরক্তমিশ্রিত ভাবে তাকিয়ে আছে। এই ব্যাটার হাব-ভাব বোঝা বরই মুশকিল। এক্কেবারে অসাধ্য জিনিস! উনি উনার হাত থেকে ঘড়ি, মোবাইল, মানিব্যাগ সব গাড়ীর বক্সে রেখে দিলেন। উনি উনার শার্টের প্রথম দু’টো বোতাম খুলে ফেললেন। উনি একচুয়েলি কি করতে চাইছে তা আমার মাথায় ঢুকেও ঢুকতে চাইছে না। আমি কি জিজ্ঞেস করতে নিবো তার আগেই আয়ান গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে আমার সাইডের দরজা টেনে স্মিত গলায় বললো,

-“নামো”

আমার মনে হচ্ছে আমি ভুল কিছু শুনছি। চাঁদের আবছা আবছা আলোয় উনার দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালাম। আয়ান এবার খানিক জোরে বললো,

-“আমি নামতে বলেছি তোমাকে”

আমি ইতস্তত হয়ে এদিক-অদিক চাহনি চঞ্চল করে নেমে পরলাম। উনি গাড়ির দরজা লাগিয়ে লক করে চাবি পকেটে গুটিয়ে নিলো। সামনে এগিয়ে যেতেই পুকুরের পানির কলকলানি শব্দ কানে এলো। পুকুরের পাড় ঘেষে ঢালু পথে নেমে গেছে কাচা রাস্তা। দূর থেকে ছনের বাড়ির আঙিনায় হারিকেনের আলো টিমটিম করে জ্বলছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলেও আকাশে মেঘ ডাকছে। আয়ান আস্তে আস্তে হাটছে। এখন তাকে অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে লাগছে। আমি পিছন পিছন তাকে অনুসরণ করছি। বড় দু’তিন পা ফেলে পাশাপাশি এগিয়ে গেলাম। বুকের মধ্যে সাহস নিয়ে কাপা কাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,

-“আ..আমরা কোথায় যাচ্ছি”

আয়ান ভাবলেশহীন ভাবে বললো,

-“হানিমুন করতে”

“হানিমুন” শব্দটা শুনতেই আমার বুকে হিমপ্রবাহ বইতে লাগলো। আমি থ মেরে দাঁড়িয়ে পরলাম। উনি আমার দিকে প্রশ্নসূচক ভাবে তাকাতেই আমি তার দিকে প্রশ্ন ছুড়লাম।

-“আ..আপনার মাথা ঠিক আছে তো? মদ খেয়েছেন নাকি?”

আয়ান মুচকে হেসে বললো,

-“না তবে তোমাকে খাবো”

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here