প্রেমজাল পর্ব ২১+২২

#প্রেমজাল
পর্ব ২১
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন

ঘুমের ঘোরে কপালে ভেজা শীতল কাপড়ের আচ করতে পারায় ঘুমের রেশ কেটে গেলো আমার। সেই সাথে অনুভব করছি কারো উষ্ণ আলিঙ্গন। কেও তার বলিষ্ঠ বাহুদ্বয়ে নিবদ্ধ করে রেখেছে আমাকে। খানিকটা হতভম্ব হলাম আমি। ভারাক্রান্ত নয়ন দু’টো আস্তে আস্তে প্রসারিত করলাম। নিজের অবস্থান আশ্বাসন করতে পারলাম আয়ানের বুকে। উনার প্রতিটি নিশ্বাসের হৃদ স্পন্দন আমার কানে ‘দ্রিম দ্রিম’ করে তরঙ্গিত হচ্ছে। উনি আমায় উনার দু’হাত দিয়ে শক্তভাবে আকড়ে ধরে আছেন। উনার দিকে আমি মুখ উঁচু করে তুলতে নিতেই একটু নড়ে-চড়ে গেলেন আয়ান। কিন্তু এখনো উনার চোখ দু’টো নিমীলিত আছে। উনার তপ্ত শ্বাস আমার মুখমন্ডল গ্রাস করছে। উনার চুলগুলো অগোছালোভাবে কপালে পরে আছে। ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলে নিঃসন্দেহে নিষ্পাপ শিশু। কিন্তু বাস্তবে জাগ্রত অবস্থায় সহজাতভাবে হিটলার। ক্ষণিকের মধ্যে আরেকটু এলোমেলো করার ইচ্ছা প্রকাশ পেলেও সুপ্ত রাখাই শ্রেয়। উনার সাথে এতোটা নিকটবর্তী অবস্থায় থাকাটা নিতান্তই খুবই বিস্ময়কর! খানিকটা অস্বস্তিবোধও কাজ করছে আমার মধ্যিখানে। শরীরটাও বেশ দুর্বল লাগছে। নিজ থেকে ছাড়ানোর শক্তি টুকুও পাচ্ছি না। তাও হাত হেলিয়ে দুলানোর সাপেক্ষে আড়মোড়া দিয়ে বৃথা প্রয়াস করলাম।

আয়ান আমার মৃদু মোচড়া-মুচড়িতে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে তুললো। যা উনার ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুচনোর দ্বারা প্রদর্শন করছে। এখনো উনার চোখের পাতা আবৃত। আমি হাত দিয়ে আলতো ভাবে উনার বুকে চাপ দিলাম। মহাশয় এবার চরম বিরক্ত নিয়ে চোখ খুললেন। উনার কপালের গভীর ভাজ তাই ইঙ্গিত করছে। উনার দৃষ্টি আমার চোখে আপতিত হতেই আমি আমার চাহনি অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলাম।

আয়ান আমাকে তার বাহু বেষ্টনী থেকে মুক্ত করতেই আমি ফটাফট আমাদের মাঝে দুরত্ব বারিয়ে উঠে বসলাম। উনি আমাদের মাঝের দূরত্ব অবজ্ঞা করে আবারো আমার নিকটবর্তী হলেন। উনি উনার হাতের শীতল স্পর্শ একবার আমার কপালে, একবার গলায়, একবার গাল ছুয়ে দিতে লাগলেন। আমি উনার এমন কান্ডে পীলে চমকালাম। উনার এমন উদ্ভট আচরণের কারণ কি? আমি মৌনতা কাটিয়ে যখনি কিছু বলতে যাবো উনি থার্মোমিটার জাতীয় কিছু আমার মুখে পুরে দিলেন। আমি উনার এমন কান্ডে রীতিমতো হতবাক। স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার ভ্রু সংকোচন হলো। উনার মুখে স্পষ্ট চিন্তিতের ছাপ বিদ্যমান।

আকস্মিক ভাবে উনি আমার মুখ থেকে থার্মোমিটার জাতীয় জিনিসটা গম্ভীরভাবে লক্ষ্য করতে লাগলেন। আমি এবারো কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না। কিছু বলার লাগেই উনি আমার কাছে এক গ্লাস পানি আর একটা স্বচ্ছ শুভ্র রঙ্ এর ট্যাবলেট ধরলেন। আমি যেনো নিরব দর্শক। কিছু না পারছি বলতে আর না কিছু পারছি করতে। কেবল মাত্র দৃষ্টিপাত করছি।

আয়ান আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো। আমি তাও নিস্তবদ্ধতা পালন করলাম। আমার এক হাতে সেই ট্যাবলেট টা ও আরেক হাতে গ্লাস জোরপূর্বক ভাবে ধরিয়ে দিয়ে দিলো। রীতিমতো আমার হাত কম্পিত হচ্ছে। আমি নিজেই কিছুটা বিব্রত! আমি যেনো গ্লাস ধরে রাখার ভারসাম্যতা হারিয়ে ফেলেছি।

আয়ান সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। আমার কপালে চিপকে থাকা খন্ড কাপড় ও বেড সাইড টেবিল থেকে পানি ভর্তি ছোট্ট বোল জাতীয় বস্তুটা নিয়ে হনহন করে ওয়াসরুমের দিকে অগ্রসর হলেন। আমি নির্বাক!! আচ্ছা আমার কি তাহলে জ্বর এসেছিলো? উনি আমাকে জলপট্টি দিয়েছেন? হাতে থাকা কম্পিত গ্লাসের দিকে চেয়ে মনে মনে আওড়াতে লাগলাম আমি। আমি ধীরহস্তে একটু পানি পান করলাম। খানিকটা তৃষ্ণাও পেয়েছিলো বটে। পানির স্বাদ যেনো পাওয়া যাচ্ছে না। ক্ষণিক সময় ঔষধের দিকে চেয়ে রইলাম। খাওয়ার মতো সাহস পাচ্ছিনা। আর এতো বড়ো হয়েও এখনো ঔষধ খেতে পারি না। যতটুকু মনে পরে দাদিমণি চামচে নিয়ে গুলিয়ে খাওয়াতো। আগের দাদিমণি আর এখনকার দাদিমণির মধ্যে যেনো আকাশ পাতাল ফারাক। কত আদর-স্নেহ করতো। আর এখন? হাহ!! সেই রাতের বিষাক্ত ঘটনার পর আমার ছায়াও মারাতে হয়তো ঘৃণা করে।

আমার হাত থেকে গ্লাসের টান অনুভব করতেই মুখ তুলে উপরে দৃষ্টিপাত করলাম। আয়ান গম্ভীরভাবে তাকিয়ে আছে। ইদানীং আমি উনার কোনো কর্মকান্ডেই বুঝে সক্ষম হতে পারছি না। আদৌ উনি চাইছে টা কি? হুটহাট করে রেগে যায়, অপ্রত্যাশিত অবস্থায় ধমক দেয়, কাছে টেনে নেয়, আবার অবহেলা করে দূরে ঠেলে দেয়। এমনকি আজকে তো আবার জরিয়ে ধরে শুয়েও ছিলো। এইটা ছেলে নাকি কোনো গোলকধাঁধা?

আয়ান ঔষধটা নিয়ে নিতেই চরম অবাক হলাম। শুধু নেয় নি সাথে খেয়েও নিয়েছে। আশ্চর্য তো!! নিজেই যখন খাবে আমার কাছে দিয়েছিলো কেনো? স্ট্রেঞ্জ লোক!! প্রেমিকার শোকে পাগল টাগল হয়ে গেলো নাকি?

আয়ান তার বাম হাত আমার ডান গাল আলতো করে ছুয়ে দিলো। আমি অবাক দৃষ্টিতে উনার মুখপানে তাকালাম। আমি এবার বাধ্য হয়ে মুখ খুললাম।

-‘ আপ… ’

পুরো শব্দ বলার আগেই উনি উনার ঠোট আমার ঠোটে মিলিয়ে দিলেন। কিছু বুঝার আগেই আকস্মিকতায় এমন হয়ে গেলো। রীতিমতো বমি পাচ্ছে আমার। ইসস!! কি তিতা রে বাবা। আমি ইতিমধ্যে চোখ মুখ খিচে উনার টি-শার্ট খামচে ধরেছি। উনি সবটুকু ঔষধের দ্রবণ আমাকে দিয়েই ক্ষ্যান্ত হলেন।

আয়ান স্বাভাবিক হয়ে আমার ওষ্ঠ্যদ্বয় থেকে উপচে পরা ঔষধ দ্রবণের অবশিষ্টাংশ পরম যত্নে উনার বুড়ো আঙুলের প্রান্ত ভাগ দিয়ে মুছে নিলেন।

আমি এখনো চোখ আবৃত রেখেছি। সারা শরীর কাটা দিয়ে যাচ্ছে। আমার যেনো দম যায় যায় অবস্থা। আমার শ্বাস প্রগাঢ় হয়ে আসছে। উনাকে আমার এতোটা কাছে আশা কখনো করি নি। অপ্রত্যাশিতভাবে এতোটা কাছে এসে এভাবে ঔষধ খাওয়ানোতে আমি নিতান্তই বিস্মিত। জরিয়ে ধরা, গালে কপালে চুমু দেওয়ার সীমা পেরিয়ে শেষ মেষ ঠোটে এসে ঠেকলো। ছিঃ আমার কাছে নিঃসন্দেহে উনিই দুনিয়ার অশ্লীলের সাথে অসভ্য লোক। মনে মনে হাজারো কথা ডালা সাজাতে পারলেও মুখে কুলো পেতে রইলাম।

আয়ান আবারো তার বাম হাত আমার ডান গালে রেখে খানিকটা থুতনি উঁচু করতেই হকচকিয়ে গেলাম। অতি তীব্র বেগে চক্ষু ধার নির্বাধ করলাম। আয়ান আমার চোখের মাঝে নিবদ্ধ হয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বলে উঠলো,

-‘ কান্না করছিলে কেনো? তুমি জানো না কান্না করলে তোমার জ্বর আসে? আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানো?’

আমি উনার কথায় বেশ অবাক হলাম। উনি কিভাবে বুঝলেন আমি কান্না করেছি? আবার কান্না করলে আমার জ্বর আসে? আর উনার আবার কিসের ভয়? ভয় মানুষ তখনি পায় যখন নিজের কিছু হয় কিংবা আপন কারোর কিছু হয়। উনি তো ফিটফাট আছেই। আর না আমি উনার আপন মানুষ! শুধুই দায়িত্ববোধে আবদ্ধ চুক্তি করা বউ। ৬ মাস হলে তাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য থাকবো। নিস্তব্ধে এক গাল তাচ্ছিল্য হেসে অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে নিলাম।

আয়ান গালের স্পর্শ গভীর করে চেপে আবারো তার মুখোমুখি করলো।
-‘ তোমার যদি কোনো কিছু হয়ে …’

আমি উনার দিকে খানিকটা ঝুকে মৃদু স্বরে বললাম,

-‘ কি আর হতো? বেশি তো বেশি মরেই যেতাম। তাতে কার কি?’

আয়ান একবার আমার চোখের দিকে আরেকবার আমার ঠোঁটের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আমি কিছুটা ব্রিবতবোধ করে স্বাভাবিকভাবে বসলাম।

এবার আয়ান খানিকটা সামনে ঝুঁকে বিদ্রুপ মিশ্রিত গলায় বললো,

-‘ ১ মাস হতে চললো বিয়ে করলাম কিন্তু ঠিকমত মন ভরে আদরও করতে পারলাম না। এতো তাড়াতাড়ি মরতে দেই কি করে? এখনো তো ক্রিকেট টিম বানানো বাকি! তাই না?’ বলে চোখ টিপ মারলো আয়ান।

এমন লাগামহীন কথা বার্তা শুনে ইতিমধ্যে আমার গাল রক্তিম রূপ ধারণ করলো। চক্ষু কোটর থেকে চোখ বের হয়ে গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম।

আয়ান আরো খানিকটা ধাপ এগিয়ে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

-‘ ঔষধের ভিত্তিতে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে চুমু দিলেই তো আর বাচ্চা হবে না’

এই কথা শুনার পর আমাকে আর পায় কে? আমি নাক-মুখ খিচে ওয়াশরুমের দরজা আবদ্ধ হয়েই ক্ষ্যান্ত হলাম। দরজা ভেদ করে উনার হাসির শব্দ ভেসে আসছে। আসলেই এই লোক আস্ত অসভ্য!! আমাকে লজ্জায় না ফেললে হয় না তার?
#প্রেমজাল
পর্ব ২২
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন

রুহি আধার আচ্ছন্নতায় গৃহে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে অবস্থান করে অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে সে ক্লান্ত। বক্ষ পিঞ্জর কষ্টে গাথা মালায় অভিতপ্ত। খানিকটা ব্যবধানে পরে আছে খন্ড বিখন্ডে বিভক্ত হওয়া তারই মুঠোফোন। ক্ষণিক আগেই সে নিজেই মাটিতে স্বজোরে নিক্ষেপ করেছিলো। মূলত ক্রোধে-ক্ষোভে বশে এমন কান্ড বাধায় সে। নিজেকে আজ বড্ড অসহায় লাগছে যে তার। কিছুক্ষণ আগে তার কাঙ্খিত মানুষের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তার অনাগত বাচ্চার বাবা তাকে প্রত্যাখান করে দেয়। তাদের অনাগত সন্তান অস্বীকার করে সে। পরিস্থিতি যে বেসামাল হয়ে পরেছে। যদিও সে একা নিজের বাচ্চা লালন পালন করতে কখনোই অর্থের দিক দিয়ে হিমশিম খাবে না। তবুও সমাজ তো আর তাকে পতিতা-কলঙ্কিনী ও তার বাচ্চাকে জারজ সন্তান উপাধি থেকে রেহাই দিবে না। তাহলে কি তার বাচ্চা বাবা থাকতেও পরিচয় মিলবে না? না এটা হতে পারে না। কখনোই হতে পারে না। সে এটা মানতে নাকোজ।

-‘ আজ তুমি ভালোবাসা শব্দটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে প্রিয়? ভালোবাসা শব্দটাকে মুছে ফেললে নিজের মন থেকে! অথচ একদিন সে তার ভালোবাসা রক্ষা করার জন্য পাগলের মত নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিলে তোমার কাছে। আজ তুমি হাত ছেড়ে পালাচ্ছো, ভয় পাচ্ছো তার আঙ্গুল ধরতে, বুক ধরফর করছে ? অথচ একদিন তুমিই তার হাত ধরে টেনে তুলে এনেছিলে তার নিজের সাজানো গোছানো ব্যস্ত জীবন থেকে । তোমার ভালোবাসা মোড়ানো রঙ্গীন শহরে! আজ তুমি তাকে একলা ঘরে ফেলে আলো নিভিয়ে চলে যাচ্ছো? পাল্টে ফেলছো তোমার নিজের শহর! অথচ একদিন জোনাকি ধরে এনে তার মুখে হাসি ফোটাতে মাঝ রাতে। শেষ পাতাটা যখন এতোটাই বিষাদ বর্ণহীন ছিলো তাহলে তোমার রঙে রাঙানো কি খুবই দরকার ছিলো? আজ তুমি তার জীবন্ত লাশের উপর দিয়ে চোখ বন্ধ করে চলে যাচ্ছো। অথচ তুমিই একদিন এই অচেনা মানুষটিকে তুলে এনেছিলে তার সাজানো গোছানো জীবন থেকে। আদর যত্ন ভালোবাসার সম্মোহন নিয়ে দাবি করেছিলে তার কাছে নিজের ভালোবাসা। আজ যে মানুষটা নিজের কাধে নিজে মাথা রেখে মধ্যরাতে চোখের পানি ফেলছে, একটুক্ষানি মানসিক শান্তির জন্য হাসফাস করছে, নিজের মাথায় নিজেই হাত বুলিয়ে শান্তনা দিচ্ছে অথচ তুমিই তাকে একদিন তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে শিখিয়েছিলে। আজ যে মানুষটা ভুলে গিয়েছে নিজের সেই একলা সাজানো গোছানো জীবন, অভ্যস্ত হয়ে পরেছিলো তোমাতে, তোমার রঙ্গীন শহরে আজ তার শেষ আশ্রয় টুকু হারিয়ে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে তার অন্ধকার ঘরের কোনায়। অথচ একদিন তুমিই নিজে থেকে ভয়ঙ্কর ভাবে তার বাঁধন আঁকড়ে ধরেছিলে তোমার জীবনে। আজ যে মানুষটা কাজল কালো চোখ মুছতে মুছতে ক্লান্তিতে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে, একটা বার তোমার কণ্ঠ শোনার জন্য চিৎকার করছে অথচ একটা সময় তুমি সারা রাত ফিসফিসিয়ে তোমার আর তার সাথে গড়া সংসার গোছানোর কথা বলতে। আজ তার কাছে থেকে মুখ ঘুরিয়ে একলা ফেলে দূরে সরে গেলে! অথচ একদিন তোমার কাঁধে নিজে হাতে ঠেকিয়ে দিয়েছিলে তার মাথাটা।মনে পরে কী, প্রিয়?’ বলে মনে মনে আওড়াতে লাগলো রুহি।

রুহি তার অশ্রুসিক্ত নয়ন মুছে উঠে দাঁড়ায়। আজ থেকে সব বিপদ সম্মুখীন হয়ে লড়বে রুহি। লড়বে সে তার অনাগত বাচ্চার জন্য। নিজেই নিজের কাছে শপথ করলো রুহি। আজ থেকে নিজেকে গড়ে তুলবে নতুন রূপে। নতুন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হবে তার মাঝে। যে হবে কঠোর নির্দয়বান! যাকে প্রতারিত করা মানে সাপকে দংশ’ন করার ন্যায়। নিজেই নিজের অপর তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে রুহি ওয়াসরুমে যায় ফ্রেশ হতে।

_______________________
প্রভাতের আবেশ পেরিয়ে মধ্যাহ্ন হতে মধ্যাহ্নের মধ্যবর্তিকালীন সময় চলমান। দ্বিপ্রহরের ঔষধের অনাকাঙ্খিত ঘটনার পর আর আয়ানের ত্রি সিমানায় যায়নি। জ্বরের আমেজে শরীরটাও বেশ দৃঢ়তাশূন্য। পরিশেষে নিষ্ক্রিয়তা কাটিয়ে ধীরহস্তে সিড়ি বেয়ে নিচে অগ্রসর হলাম। মনচিত্তে দোয়া দরূদ পাঠ চলমান। অই অসভ্য লোকের সঙ্গে যেনো আপাতত সাক্ষাৎ না হয়। নিচে নামতেই দেখলাম মালতি টিভিতে নাটকে অভিনিবিষ্ট। খানিকটা বিস্মিত হলাম। মালতি তো ছুটিতে ছিলো। এই পরিপেক্ষিত তো আমি আসি। আমি তার কাধে হাত রেখে মনোযোগের ব্যঘাত ঘটলাম।

প্রথমে মনোযোগ ছিন্ন করায় মালতির চোখ মুখে বিরক্তির আভাস দেখা গেলেও ক্ষণিকের মধ্যিখানে হকচকিয়ে অস্থির হয়ে উঠে। কথায় আছে না চোরের মন পুলিশ পুলিশ। কাজ ফাকি দিয়ে টিভি সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত।

আমি মনোনিবেশ করলাম তাকে ফাকি দেওয়ার জন্য কিছু বলবো না। কারণ আমি কতোই তো পড়াশোনায় ফাকি দেই। আমি মৃদু হেসে বললাম,

-‘ কখন এলে? তোমার না ছুটি চলছে’

মালতি অস্বস্তি নিয়ে আমতা আমতা করে বললো,

-‘ একটু আগেই আইসি। আফনের ফুফিমণি কাল রাইতে (রাত) ফোন দিসিলো। এইলিগা আইজ ভোর বেলা বাস ধইরা আইলাম। ছোট্ট সাহেব বাইরে যাওয়ার আগে কইলো আফনার নাকি শরীর ভালা না, তাই আর আফেনেরে ডাক পারি না’

ব্যপারটা আমার কাছে খানিকটা পরিষ্কার হলো। আমি প্রতিত্তোরে শুধু ‘অহ’ বললাম। সাথে সাথে মালতি প্রশ্ন ছুড়লো,

-‘ আফনে কিছু খাইবেন নি? কিছু রাইন্দা দিমু?’

আমি ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে নাকোজ করলাম। শুধু শুধু খাটিয়ে লাভ কি? আমাদের জন্য দূর থেকে এসেছে জার্নিং করলো। টাকার বিনিময়ে কাজ করে বলে কি সবসময় খাটানো দরকার? কালকে থেকে অনুষ্ঠান শুরু হলে এভাবেই বিশ্রাম নেওয়ার জোয়ার থাকবে না।

আমি মালতির উদ্দেশ্য মোলায়েম কণ্ঠে বললাম,

-‘ আজ না হয় বিশ্রাম নাও। সকালে অনেক খেয়েছি। এখনো অনেকটা পেট ভরা। আমি দেখি অন্যকিছু বানানোর’

মালতির চোখ মুখ উৎফুল্লতায় ভরে গেলো। আমি ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রান্না ঘরের দিকে অগ্রসর হলাম। স্ব্যংক্রিয়ভাবে সূর্যীমামা ঢলে পরছে, তাহলে হালকা-পাতলা কিছু বানানোই শ্রেয় হবে। লেগে গেলাম কোমর বেধে। রান্না ঘর কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে, প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিয়ে নিলাম।
একটা বাটি তে ২টা ডিম হ্যান্ড মিক্সারের সাহায্যে বেল্ড করলাম। আরেকটা হাফ-বোল টাইপ জিনিসে ১ কাপ গুড়ো দুধ, ০.৫(Half) কাপ ময়দা, ১ চামচ বেকিং পাউডার, ১ কাপের চারভাগের একভাগ পরিমান সুজি একসাথে চালনির সাহায্যে চেলে নিলাম। উপকরনীয় মিশ্রণে ২ চামচ ঘি, বেল্ডেট ডিম গিয়ে কালোজাম(কালো মিষ্টি)এর জন্য ডো তৈরি করে ফেললাম। তারপর একটা বড় পেল্ট জাতীয় কিছু দিয়ে প্রায় আধা ঘন্টার জন্য ঢেকে রেখে দিলাম। এমন ভাবে ঢাকলাম যাতে কোনোভাবে বাতাস না যায়।

আরেকটা মিক্সিং বোলে ১ কাপ ময়দা, ১ কাপ কোকো পাউডার, ১ চামচ বেকিং পাউডার এবং পরিমাণ মতো লবণ চালনির মাধ্যমে চেলে নিলাম। তারপর অন্য একটা বাটিতে ৪টা ডিমের সাদা অংশের সাথে ১ কাপ চিনি হ্যান্ড বেল্ডারের সাহায্যে বেল্ড করতে লাগলাম। যে পর্যন্ত পাফের মতো না ফুলে। সাদা ফোমের মতো হয়ে গেলে অইখানে ৪টা ডিমের কুসুম ও ওয়ান ফোর্থ কাপ তেল দিয়ে আবার বেল্ড করে নিলাম। মিক্সিং বোলে ডিমের ফোম টা ঢেলে দিলাম। সাথে ১ কাপের চারভাগের একভাগ সমপরিমাণ দুধ দিয়ে সবকিছু ভালোভাবে মিশিয়ে নিলাম। তারপর কেক বেকিং ট্রে তে সংমিশ্রণ টা ওভেনে দিয়ে প্রয়োজনীয় সময় সেট করে দিলাম।

তারপর চুলায় এক পেনে ৩ কাপ পানির মধ্যে ২কাপ চিনি ও ৩ এলাচি দিয়ে সিরাপ তৈরি করতে দিলাম। অন্য আরেকটা চুলায় পেনে মিষ্টি ভাজার জন্য পর্যাপ্ত তেল গরম বসিয়ে দিলাম। পরক্ষণে হাতে সামান্য ঘি হাতে মেখে, ঢেকে রাখা ডো থেকে ছোট ছোট অংশ নিয়ে হাতের তালুর সাহায্যে গোল করে গরম করা তেলে একে একে সব মিষ্টি গুলো ছেড়ে দিলাম। মিষ্টিগুলো লালচে ভাব ধারণ করলে আস্তে আস্তে মিষ্টি গুলো তুলে চিনির সিরাপে ভিজিয়ে রাখলাম।

কালোজাম ডেকোরেট করার জন্য প্রায় ৪/৫ চামচ গুড়ো দুধের মধ্যে ১ চামচ ঘি মিশালাম। সিরাপে ভিজানো মিষ্টিতে রস ভরে গেলো দুধ-ঘি মিশ্রণে গড়াগড়ি করিয়ে সার্ভিং ট্রে সাজালাম।

বেকিং করা কেক কে চকলেট, ক্রীম, জেমস দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে সেটাও সার্ভিং ট্রে তে রাখলাম। উদ্দেশ্য একটাই সন্ধ্যায় নাস্তা হিসেবে পরিবেশন করা হবে।

ইতিমধ্যে অনেকটা ক্লান্ত লাগছে। দুই গ্লাস ঠান্ডা পানির সংমিশ্রণে লেবুর শরবত বানিয়ে হলরুমে চলে আসলাম। এক গ্লাস মালতিকে দিয়ে আমি আরেকটা গ্লাস নিলাম। মালতির চোখ মুখে ছিলো প্রশান্তি মাখা চাহনি। আমি মুচকি হেসে তার সাথে টিভি দেখার সাথী হলাম।

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here