#প্রেমাসক্তি
#পর্ব__১৫
#অদ্রিতা_জান্নাত
“কি সম্পর্ক তোমার রিফাত আঙ্কেলের সাথে?”
সঙ্গে সঙ্গে ইশিতার গালে একটা থাপ্পর পরে ৷ ইশিতা গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে রিফার দিকে তাকালো ৷ রিফা ধপ করে খাটে বসে পরলো ৷ এই বাড়ির কেউ কখনও ইশিতার গায়ে হাত তুলে নি ৷ এমনকি ওর বাবাও না ৷ মাঝে মাঝে শাসন করেছে, কড়া কথা শুনিয়েছে, রাগ ঝেড়েছে তবুও ওর বাবা কখনোই ওর আর ইতির গায়ে হাত তুলে নি ৷ আর আজ হাত তুললো এমন একজন যার কাছে ও সবার থেকে প্রিয় ৷
রিফা কখনোই ইশিতাকে বকে নি, ধমক দিয়ে জোরেও কথা বলে নি ৷ সবসময় আদর করে বুঝিয়েছে ৷ তবে আজ ইশিতা কি এমন বললো যে ওর গায়ে সোজা হাত তুললো ৷
ইশিতা আস্তে আস্তে সামনে গিয়ে রিফার কোলে মাথা রাখলো ৷ রিফার হাত দুটো ধরে বলতে লাগলো,,,,,,,
ইশিতা : তুমি আমাকে মারলে ফুপ্পি? আমি কি এমন বলেছি ফুপ্পি? আমার কি জানার অধিকার নেই? আমি কি তোমার এতোটাই পর? যে আমাকে বলা যাবে না? বলো না ফুপ্পি কেন বলা যাবে না? কি এমন হয়েছিল ফুপ্পি? বলো না?
ইশিতার ফুপ্পি ঠোঁট কামড়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বসে রইল ৷ কিছুক্ষনপর ইশিতাকে নিচ থেকে উঠিয়ে ওকে খাটে বসিয়ে ওর গালে হাত রেখে বললো,,,,,,,
—- খুব লেগেছে না? আমি কি করে পারলাম এরকমটা করতে? খুব ব্যাথা পেয়েছিস না? সরি মা মাফ করে দে৷
ইশিতা : আমার ব্যাথা লাগে নি ৷ শুধু কষ্ট পেয়েছি ৷ কি এমন বললাম যার জন্য তুমি মারলে ফুপ্পি? আমি কি ভুল কিছু জিজ্ঞেস করেছি? বলবে না আমায়?
রিফা জোরে একটা দম নিয়ে বললো,,,,,,,
—- আমি ইশানের মা না ইশু ৷
ইশিতা : তাহলে কে?
রিফা নিজের চোখ মুছে বলতে লাগলো,,,,,,,
—- ইশান আমার বোনের ছেলে ৷
ইশিতা : মানে? (অবাক হয়ে)
রিফা বলা শুরু করলো,,,,,,,,,
—- আমরা দুই বোন ছিলাম ৷ জমজ দুই বোন ৷ পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য ছিলাম আমরা তখন ৷ আমরা দুই বোন পুরো বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখতাম ৷ ছোট থেকে আমরা এই বাড়ির প্রাণ ছিলাম ৷ আম্মু আব্বুও ছিল বেশ প্রাণোচ্ছল মানুষ ৷ আমাদের দুজনের নাম মিলিয়ে রেখেছিল তারা ৷ আমার নাম রিফা আর ওর নাম ছিল রাফা ৷ রাফা আমার থেকে ৫ মিনিটের বড় ৷ তবুও আমি ওকে নাম ধরেই ডাকতাম ৷ ভাইয়া ছোট থেকেই রাগি, বদমেজাজী আর অহংকারী টাইপের ছিল ৷ একদম আমার দাদুর মতো ৷ দাদুও ভাইয়ার মতোই ছিল ৷ আমাদের পরিবারে সবকিছুর বাঁধা হয়ে দাঁড়াতো শুধু এই দুইজন মানুষ ৷ তবুও কখনোই সেভাবে তাদের রাগ দেখি নি আমরা তখন ৷ বেশ ভালোভাবে চলছিল দিনগুলো ৷
আমি আর রাফা সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হই তখন ৷ দুই বোন সবসময় একসাথেই যেতাম আবার আসতাম ৷ কলেজের একটা স্যারকে আমার বেশ ভালো লাগতো ৷ ওই স্যারটা পড়া বেশ ভালোভাবে বোঝায় ৷ আবার তার ব্যবহারও বেশ সুন্দর ৷ আমার কাছে তাকে বেশ ইউনিক লাগে ৷ যেই পড়াটা বুঝতাম না স্যার সেটা খুটিয়ে খুটিয়ে বুঝিয়ে দিতো ৷ এভাবে পার করলাম কলেজ লাইফ ৷ আস্তে আস্তে স্যারটাকে আমার ভালোলেগে যায় ৷ ভালোলাগা থেকে কখন যে ভালোবেসে ফেলি সেটা বুঝতেও পারি নি আমি ৷ স্যার আমার সঙ্গে ডেইলি কথা বলতো ৷ অনেক ভালোভাবে কথা বলতো দেখে মনে হতো সেও আমাকে পচ্ছন্দ করে ৷ আমি মনে মনে খুব খুশি হই ৷ একদিন হঠাৎ রাফার বিয়ের প্রোপোজাল নিয়ে আসে আমার দাদু ৷ সেই প্রোপোজালে আব্বুও রাজি হয়ে যায় ৷ আমি খুব খুশি হই তখন ৷ আমার বোনের বিয়ে আমিই সবচেয়ে খুশি ছিলাম ৷ তবে খুশি ছিল না আমার বোনটা ৷
এতোগুলা কথা একবারে একসাথে বলে থামলো ফুপ্পি ৷ আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ৷ ফুপ্পি একটা দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো,,,,,,,,,,
—- বিয়ের আগের দিন রাফা আমাকে বলে ও রিফাত স্যারকে ভালোবাসে ৷ কথাটা শুনে আমার কি রকম লেগেছিল সেটা আমি বোঝাতে পারবো না ৷ ভাবতেও পারি নি আমার বোনটা আমার ভালোবাসার মানুষকেই ভালোবাসবে ৷ শুধু ও না ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসতো ৷ রাফা ওই দিন আমাকে ওর জন্য কিছু করতে বলেছিল ৷ ও এই বিয়েটা করতে চায় না ৷ তবে সেটা ও কাউকে ভয়ে বলে নি ৷ কারণ আমাদের পরিবারে প্রেম, ভালোবাসার কোনো প্রথা নেই ৷ তারা তাদের পচ্ছন্দের ছেলের সাথে তাদের মেয়েকে বিয়ে দিবে ৷ সেই মেয়েটারও এইটা মেনে নিতে হবে ৷ ‘না’ বলতে পারবে না ৷ একটা মেয়ের মতামতের বাহিরেই তাদের বিয়ে করিয়ে দেয়া হয় ৷ রাফা এই ভয়েই কাউকে কিচ্ছু বলে নি ৷ তবে আমাকে সেদিন হেল্প করতে বলেছিল ৷ বিয়ের দিন বিয়ের সাজে রাফাকে পালাতে সাহায্য করি আমি ৷ তবে সেই সাহায্য করার সময় নিজেকে অনেক অসহায় মনে হয়েছিল ৷ সেদিন পালিয়ে যাওয়ার আগে রাফা আমাকে জড়িয়ে ধরে একটা কথাই বলেছিল,,, “তোর মতো বোন যেন সব ভাই বোনেরাই পায়”
উত্তরে আমি কিছু বলি নি শুধু হেসেছিলাম ৷ কিছুই বলার ছিল না আমার ৷ বোনের ভালোবাসার জন্য নিজের ভালোবাসার বিসর্জন দিয়েছি আমি ৷
কথা গুলো বলে ফুপ্পি কাঁদতে লাগলো ৷ আমি ফুপ্পিকে জড়িয়ে ধরে বললাম,,,,,,
ইশিতা : ইউ আর দ্যা গ্রেট! তোমার মতো ফুপ্পিও যেন সব মেয়েরাই পায় ৷
উত্তরে রিফা শুধু হাসলো ৷ সেই হাসির আড়ালে কতটা কষ্ট রয়েছে সেটা ইশিতা বুঝলো ৷ ও আবার বললো,,,,,,,
ইশিতা : তারপর কি হয়েছে?
—- রাফার পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে আম্মু আর আব্বু অসুস্থ হয়ে পরে ৷ ভাইয়া আর দাদু রেগে যায় অনেক ৷ জায়গায় জায়গায় লোক পাঠায় ৷ তবে ফলাফল শূন্য ৷ আমাকে সন্দেহ করে সবাই ৷ কারণ আমি সব সময় রাফার সাথে থাকতাম ৷ তবুও কিছু বলি নি আমি ৷ ছোট বেলা থেকেই আমি রাফার থেকে একটু জেদী ছিলাম ৷ ভাইয়া, আব্বু আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে আমি এই একটা কথাই বলতাম,,,, “জানি না আমি ৷ তোমাদের মেয়ে কই গেছে আমি কি করে বলবো? বলে গেছে আমায়?”
ওরাও আর কিছু বলতো না ৷ আমার জেদ সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানে তারা ৷ জানে একটা কথা জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর আমার পেট থেকে কখনোই বের হবে না ৷ এভাবেই চলে যায় কয়েকটা মাস ৷ রাফার সঙ্গে এর মধ্যে একবারও কথা হয়নি আমার ৷ ভাইয়া অনেক খুঁজেছে কিন্তু পায় নি ৷ রাফার বিয়ের দিন আব্বু হার্ট এট্যাকে মারা যায় ৷ তার কয়েকদিন পর আম্মুও চলে যায় ৷ ভাইয়া আর আমি অনেক ভেঙ্গে পরেছিলাম তখন ৷ দাদু ভাইয়াকে সামলাতে পারতো না কারণ সেই দিনের পর থেকেই ভাইয়া আরো রেগে যায় রাফার উপর ৷ আগের থেকে আরো অহংকারী হয়ে উঠে ৷ রাগ সবসময় মাথার উপরে উঠে থাকতো ৷ কারো কথা শুনতো না ৷ সে যা বুঝবে তাই করবে ৷ নানাভাবে রাফাকে খুঁজতে থাকে ৷ আমি ভাইয়াকে সামলাতে পারতাম না দেখে দাদু ভাইয়াকে ভাবির সাথে বিয়ে দেয়৷
ইশিতা : রাফা ফুপ্পির খোঁজ পাও নি তুমি?
—- পেয়েছি ৷ তবে প্রায় দুই বছর পর ৷ এই দুবছরের মধ্যে ভাইয়া আমাকে বিয়ের জন্য অনেক জোরাজুরি করে তবে অামি জেদ ধরে অন্য জায়গায় ফ্লাট নিয়ে থাকতে শুরু করি ৷ সেই থেকে ভাইয়া আমার সঙ্গে আর কথা বলে না ৷ দুবছর পর হঠাৎ রাফার ফোন পাই ৷ জানতে পারি ও এতোদিন দেশে ছিল না ৷ দেশের বাহিরে ছিল ৷ দুদিন আগে দেশে এসেছে আর বলেছে আমাকে ওর সাথে দেখা করতে ৷
ওর সাথে দুবছর পর দেখা হয় আমার ৷ অনেক চেন্জ্ঞ হয়ে গেছে তখন ৷ ওকে একদম অন্যরকম লাগছিল আমার কাছে ৷ বেশ মোটা আর ফর্সাও হয়েছে ৷ এমনিতেই ও আমার থেকে একটু বেশিই সুন্দর ছিল তখন আরো সুন্দর লাগছিল ৷ আমাকে তখন অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছিল আমিও বলেছি এই দুই বছরের সব কথা ৷ আব্বু আম্মুর কথা শুনে ও কেঁদে দিয়েছিল ৷ তখন হঠাৎ কোথা থেকে রিফাত স্যার একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এলো ৷ তাকে দেখেই আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো ৷ তবুও নিজেকে সামলে নিলাম ৷ বাচ্চাটার নাম ছিল রোহান ৷ রাফা আর রিফাত স্যারের ছেলে ৷ জানতে পারি রাফার তখন তিন মাস চলছে ৷ মানে ও আবার মা হবে ৷ খুব খুশি হয়েছিলাম কিন্তু মনের মধ্যে একটা কষ্টও লেগেছিল ৷ রোহানকে কোলে নিয়ে ঐদিন প্রচুর আদর করি আমি ওকে ৷ ও যে আমার দুটো ভালোবাসার মানুষের সন্তান ৷ কি করে দূরে রাখতাম আমি? কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই দিন রাফার সঙ্গে আমাকে ভাইয়ার একটা বন্ধু দেখে নিয়েছিল ৷ সেটা সে সোজা ভাইয়াকে জানিয়ে দেয় ৷ ভাইয়াও খোঁজ খবর নিতে থাকে রাফার ব্যাপারে ৷
কথাগুলো বলে ফুপ্পি এবার পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে গলাটা হালকা ভিজিয়ে নিলো ৷ আমি বলতে লাগলাম,,,,,
ইশিতা : তারপর কি হয়েছে ফুপ্পি?
ইশিতার ফুপ্পি আবার বলতে লাগলো,,,,,,,
—- ভাইয়া তখন কিছু করে নি ৷ কিন্তু তার মনের ভিতর একটা রাগ চেপে বসেছিল যেটা রাফার প্রতি ৷ প্রায় কয়েক মাস পরের কথা, ভাইয়া রিফাত স্যারের গাড়ির ব্রেকফেল করায় তখন ৷ স্যার যখন অফিসে যাবেন তখন গাড়ি করে গেলে দুর্ঘটনা ঘটবে ৷ এটাই ভেবেছিল ভাইয়া ৷ কিন্তু হলো উল্টাটা ৷ রাফার তখন ৮ মাস চলছিল ৷ স্যার ওকে বাড়িতে রেখে পায়ে হেঁটেই অফিসে গেলো ৷ গাড়ি নেয় নি কারণ হঠাৎ করেই কোনো সিরিয়াস সময়ে গাড়ির দরকার পরবে তাই ৷ তখন তাদের কাছে এক্সট্রা গাড়িও ছিল না ৷ স্যার অফিসে গেলেই ফোন আসে বাড়ি থেকে ৷ স্যারের বাড়ির কাজের মেয়েটাই ফোন করে জানায় রাফার ডেলিভারি পেইন উঠেছে ৷ তবে সেটা নির্ধারিত টাইমের আগে ৷ মেয়েটা আর গাড়ির ড্রাইভার রাফাকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ৷ ঐদিকে স্যারও অফিসের গাড়ি নিয়ে হসপিটালের জন্য বেরিয়ে পরে ৷ তবে অন্যদিনের থেকে ঐদিন রাস্তার জ্যাম তুলনামূলক বেশি ছিল আবার স্যারেরও অজানা একটা কারণে অশান্তিও লাগছিল ৷ তবুও তাড়াতাড়ি করে ড্রাইভ করতে থাকে ৷ কিছুটা পথ আসতেই শোনে একটা গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়েছে ৷ স্যার আর গাড়ি নিয়ে আর সামনে যেতে পারবে না ৷ রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে ৷ মানুষজন চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ৷ স্যার গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেল কি হয়েছে দেখতে ৷ রাফাকে রক্তাত্ত অবস্থায় রাস্তায় পরে থাকতে দেখে স্যারের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল ৷ রাফার মাথায় বেশ গভীর ভাবে আঘাত লেগেছিল ৷ হাতে পায়েও হালকা কেটে গিয়েছিল ৷ পেটের সাইড দিয়ে ক্রমশ রক্ত ঝড়ছিল ৷ রিফাত স্যার চিৎকার দিয়ে উঠলো ৷ রাফাকে কোলে তুলে নিয়ে হসপিটালের দিকে যেতে লাগলো ৷ রাফার একটু একটু জ্ঞান ছিল ৷ নিঃশ্বাস একদম হালকা ৷ হসপিটালে এসে ডাক্তার ডাকতেই রাফাকে স্টেচারে করে ওটিতে নিয়ে যাওয়ার সময় স্যারের হাত ধরে রাফা একটা কথাই বলেছিল,,,,, “অআমার বাচ্চাটাকে বাঁচাও প্লিজ ৷ ওকে সসবসময় আগলে রাখবে ৷ ককখনো কষ্ট দিবে না ৷ আমার শূন্যতাও ওকে বুঝতে দদদিবে ননা ৷ ওকে বাঁচাও প্লিজ!”
স্যার সেদিন নিঃশব্দে কেঁদেছিল ৷ রাফার সামনে জোরে কাঁদলে ও আরো ভয় পেয়ে যেতে পারে তাই ৷
এতটুকু বলেই থামলো রিফা ৷ ওর ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে ৷ চোখ থেকে ক্রমশ পানি পরছে ৷ ইশিতা নিজের চোখ মুছে বললো,,,,,,,,
ইশিতা : তারপর কি হয়েছে ফুপ্পি?
রিফা জোরে একটা দম নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বললো,,,,,,,,,
—- রিফাত স্যার সেদিনের কয়েকদিন পর আমাদের বাড়িতে এসে ভাইয়াকে অনেক গুলো কথা শুনিয়ে গিয়েছিল ৷ নানাভাবে রেগে অপমান করেছিল তাকে ৷ ভাইয়াও চুপ করে থাকে নি ৷ পাল্টা উত্তর দিয়েছে ৷ একসময়ে দুজনের মধ্যে মারামারিও হয়েছিল ৷ সেই দিনই স্যার আমাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে চলে যায় ৷ আগে একটু হলেও কথা হতো আমার সাথে ৷ তবে সেদিনের পর থেকে আমার সাথেও কথা বলে নি সে ৷ কোনো ভাবে স্যার জানতে পারে যে ভাইয়া ইচ্ছাকৃত ভাবে তার গাড়ির ব্রেকফেইল করায় ৷ স্যার আমাকে সন্দেহ করে ৷ ভেবেছে আমিই তাদের খবর ভাইয়াকে বলেছি ৷ আর ভাইয়া তাই এরকম করেছে ৷ তারপর থেকে আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখে নি স্যার ৷ রাফার মৃত্যুর খবর শুনে স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম আমি ৷ রাফার দুই ছেলেকে বুক ভরে আদর করে ছিলাম ৷ একদিন একদিন করে প্রতিদিন যেতাম ৷ তবে স্যার সবটা জেনে আমাকে ভুল বুঝেছে ৷ আজও ওই বাড়ির কাছে যেতে পারি না আমি ৷ ভেবেছিলাম রাফার দুই ছেলেকে আমি আমার মমতা দিয়ে বড় করবো ৷ কিন্তু পারলাম না ৷ ওদের প্রতি একটা টান রয়েই গেছে ৷ তাই তো আজও ওদেরকে দূর থেকে দেখি আর মোবাইলে ওদের গলাটাও শুনে নেই ৷ তবে কখনো সামনে যাওয়ার সাহস পাই নি ৷ ওরাও যদি ভুল বুঝে আমায় ওদের বাবার মতো তাই ৷
রিফা চুপ করে বসে রইলো ৷ ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্নাটাকে আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলো ৷ ইশিতা ওর কোলে মাথা রেখে কাঁদছে ৷ কষ্ট হচ্ছে ওর ৷ ওর এতো কষ্ট হলে যারা নিজ চোখে দেখেছে তাদের কত কষ্ট হবে? আচ্ছা সবার কষ্ট হয়েছে? ওর বাপির কি এসবে কোনো কিছু আসে যায়? গেলে তো দ্বিতীয়বার একই কাজ করতে ভাবতো না ৷ রিফা ইশিতার মুখ তুলে ওর গালে হাত দিয়ে পানিটুকু মুছে দিয়ে বললো,,,,,,,,,,,,,
—- কাঁদছিস কেন হুম?
ইশিতা : তুমি জানলে কি করে রাফা ফুপ্পির কথা? কে বলেছে তোমায়?
—- স্যার ওই দিন বাসায় এসে আমাকে বলে গিয়েছিল সব কথা ৷ সে নাকি সব চাইতে বিশ্বাস করতো আমাকে ৷ কিন্তু আমিই নাকি সব করেছি ৷ যেই দোষ আমি করি নি সেই দোষ মাথায় নিয়ে বয়ে বেরাতে হচ্ছে আমাকে ৷ আমাদের দুই বোনকে একসাথে দেখলে সবাই সবসময় কনফিউজড হয়ে যেত ৷ কিন্তু স্যার কখনো হন নি ৷ সে এতোটাই ভালোবাসতো রাফাকে যে নিজের ভালোবাসা না চিনার ভুলটা কখনোই হতো না ৷
ইশিতা : বাপি তোমাদের কত কষ্ট দিয়েছে ফুপ্পি ৷ অনেক কষ্ট দিয়েছে ওই লোকটা তোমাদের ৷ এমনকি সে তার মেয়েদেরও ছাড়ে নি ৷ আপুইকেও কষ্ট দিয়েছে ৷ এবার আমার পালা ফুপ্পি ৷
—- ইশু কি বলছিস তুই? ইতি কষ্ট পেয়েছে মানে?
আপু যে অন্যকাউকে ভালোবাসে সেটা শুধু আমি জানি আর কেউ না ৷ এখন ফুপ্পিকে কি বলবো?
—- ইশু চুপ করে আছিস কেন? ইতি তো আমাকে বলে নি কিছু? ও কাউকে পচ্ছন্দ করতো?
ইশিতা : আব হ্যাঁ মানে না মানে…
—- কি মানে মানে করছিস বল প্লিজ ৷
ইশিতা মাথা নিচু করে বললো,,,,,,
ইশিতা : আপুই বলতে না করেছে আমাকে ৷
—- বল না এখন ৷
ইশিতা : হুম ৷ বাপির জন্য রাজি হয়েছে এই বিয়েতে ৷ বাপি জোর করেছে ওকে ৷
—- কিইই?
ইশিতা : হুম আমার মতো বাপি ওকেও ব্ল্যাকমেইল করেছে ৷ আমি জানতাম না সেটা ওর বিয়ের সময় ৷ গতকাল জানলাম ৷ বিয়ের দিন ওকে জিজ্ঞেস করলে ও আমাকে বলেছিল ও নাটক করেছিল এতোদিন ভালোবাসার ৷ সব ওর মোহ ছিল ৷ আমিও রেগে গিয়ে ওর সাথে কথা বলি নি কয়েকদিন ৷ কিন্তু কথা না বলেও থাকতে পারি নি ৷ জানো ফুপ্পি ও এখনো অনিক ভাইয়াকে ভালোবাসে ৷ কিন্তু সেটা বলতে দেয় না আমাকে ৷
—- ইশু এই কথা তুই আমাকে আজ বলছিস?
ইশিতা : আপুই বারন করেছিল আমাকে ৷ জানো ফুপ্পি? জিজু না আপুইকে মারে ৷ গতকাল ওর কাঁধে সেই মারের দাগ পেয়েছি ৷ আমার অনেক কষ্ট হয় ওকে দেখলে ৷ অনেক কষ্ট হয় ফুপ্পি ৷
ফুপ্পি আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,,,,,,,,,
—- আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ রে!
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখ মুছে নিল ইশিতার মা ৷ এই দিক দিয়ে যাওয়ার সময় সে ওদের সব কথাই শুনেছে ৷ রাফার ব্যাপারে পুরোটা জানে না ৷ কিন্তু এখন সবটা জেনে গেল ৷ নিজের মেয়েদেরও ছাড় দেয় নি তার স্বামী ৷ ঘৃণা হচ্ছে তার প্রতি ৷ ছিহ এরকম একটা মানুষের সাথে নাকি সে ঘর করছে ৷ এটা ভাবতেই ইশিতার মায়ের শরীর রাগে, ঘৃণায় রি রি করে উঠলো ৷ নিজের হাতে সে তার দুই বোনকে মেরেছে ৷ এখন তার নিজের দুই মেয়েকেও ছাড়ছে না ৷ এটা কেমন মানুষ!!
পেছনে কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলো ইশিতার মা ৷ পিছনে তাকিয়ে ইতিকে দেখে নিজের চোখ মুছে নিল ৷ ইতি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো ৷ ওর মা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,,,,,,,,
—- এই দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম ৷ ওদেরকে দেখে দাঁড়িয়ে ছিলাম ৷ তুই এখানে?
ইতি : ইশিতার রুমে যাচ্ছিলাম দেখি তুমি দাঁড়িয়ে আছো তাই ৷
—- হুম কাজ আছে যাই আমি ৷
বলেই চলে গেলেন তিনি ৷ ইতি রুমের দিকে তাকিয়ে ইশিতাকে ওর ফুপ্পির কোলে মাথা রেখে কাঁদতে দেখে একটা নিঃশ্বাস ফেললো ৷ এই পরিবারটা একটা অশ্রুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ৷ যেখানে কোনো হাসি নেই আনন্দ নেই ৷ আছে শুধু কষ্ট আর অশ্রু ৷ ইতি চোখ মুছে নিজের রুমে চলে গেল ৷ ওর দেখা হয়ে গেছে ৷ এর থেকে ভালোই বা আর কিভাবে কি দেখবে?
___________________
আমি দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে এলাম ৷ ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার অন করে তার নিচে ফ্লোরে বসে পরলাম ৷ একটু একটু করে পানি ভিজিয়ে দিচ্ছে আমায় ৷ যতবার ইশানের কথা মনে পরছে ততবার নিজেকে অপরাধী লাগছে ৷ ইশানের চোখে চোখ মিলাবো আমি কি করে? আমি তো একটা খুনির মেয়ে ৷ ওর মায়ের খুনির মেয়ে ৷ কি করে পারলো বাপি এরকমটা করতে? ইশানের বাবা কখনোই মেনে নিবে না আমাকে ৷ বাপিও মেনে নিবে না ইশানকে ৷ ইশান সত্যিটা জানলে আমাকেও ভুল বুঝবে ৷ কি করবো আমি? সব শেষ ৷ আজ থেকে ইশান আর আমার পথ আলাদা হয়ে গেল ৷ শেষ হয়ে গেল আমাদের ভালোবাসা ৷ আর কখনো ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবো না আমি ৷ সত্যিটা জানলে ইশানও ভুল বুঝবে অামায় যেটা আমি সহ্য করতে পারবো না ৷
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,