#প্রেমাসক্তি
#পর্ব__১১
#অদ্রিতা_জান্নাত
রুমের মধ্যে পাথরের মতো বসে আছে ইশিতা ৷ নিজেকে একটুও সামলাতে পারছে না আজ ৷ মনের মধ্যে বারবার ওর বাবার বলা কথাগুলো বাজছে ৷ কি বলে গেল সেটা ওর মাথায় ঢুকছে না ৷ ওর মাথা কাজ করছে না ৷ কি করবে এবার ও? এতো স্বার্থপর মানুষ কি করে হতে পারে? সেটা তো বাহিরের কেউ না ৷ ওর নিজেরই বাবা ৷ ও কি করে নিজের ভালোবাসার জন্য সবার ক্ষতি করে দিবে ৷ এতোটা স্বার্থপর হলে তো ওর আর ওর বাবার মধ্যে কোনো পার্থক্যই থাকবে না ৷
কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো ইশিতা ৷ পিছনে তাকিয়ে ইতিকে দেখে ওকে জড়িয়ে ধরে জোরে শব্দ করে কেঁদে দিল ৷ এতোক্ষন যেই কান্নাটা আটকে ছিল সেটা কাছের মানুষের স্পর্শ পেয়ে বেরিয়ে এলো ৷ ইতি ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগল,,,,,,,,
ইতি : কান্না থামা বোন ৷ প্লিজ কাঁদিস না ৷ দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে ৷ আর কান্না করিস না ৷
ইশিতা হেচকি তুলে বলতে লাগলো,,,,,,,,
ইশিতা : কি ঠিক হবে আপুই? সব শেষ হয়ে গেল ৷ বাপি এতোটা নিষ্ঠুর কি করে হতে পারে আপুই?
ইতি : ইশিতা পালিয়ে যা তুই ৷ এবার ইশানকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যা ৷ যেখানে বাপি তোদের কোনো খোঁজ পাবে না ৷
ইশিতা মুখ তুলে বলতে লাগল,,,,,,,
ইশিতা : না আপুই ৷ আমি পারবো না ৷ আমি আমার জন্য তোদের ক্ষতি করতে পারবো না ৷ আমি পালাতে পারবো না ৷
ইতি : ক্ষতি মানে? তুই কি বলছিস?
ইশিতা : কিছু না ওসব ছাড় ৷ আমি আর পালাবো না ৷ দেখি বাপি কি কি করে আমার সাথে ৷
ইতি : কথা ঘুরাস না বোন ৷ তুই বল বাপি তোকে কি বলেছে? এটা বলেছে যে তুই পালিয়ে গেলে বাপি আমাদের ক্ষতি করে দিবে?
আপুর কথায় অবাক হয়ে তাকালাম ৷ এতোটা সহজে কি করে বুঝে গেল? বললাম,,,,,,,,,,,
ইশিতা : তুই কি করে…এই এক মিনিট…বাপি কি তোকেও বলেছে? তুই বাপির কথা শুনে বিয়েতে রাজি হয়েছিলি আপুই??
ইতি : পপপাগলের মতো এসব কি বলছিস? আমি কেন বাপির কথায় রাজি হবো? আমার ইচ্ছা ছিল তাই…
ইশিতা : না তোর ইচ্ছা ছিল না ৷ তুই বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছিস ৷ এবার সবটা বুঝেছি আমি ৷ অনিক ভাইয়া তোকে ভুল বুঝেছে আপুই ৷ তুই যেটা করিস নি সেটার শাস্তি কেন পাবি? অনিক ভাইয়াকে সব বলে দিব আমি ৷ সব বলে দিব ৷
বলেই উঠে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে আপু আমার সামনে এসে বললো,,,,,,,
ইতি : তুই যাবি না কোত্থাও ৷ তুই ওনার কাছে যাস না প্লিজ ৷ দেখ আমার বিয়ে হয়ে গেছে তো নাকি?
ইশিতা : বিয়ে? এটাকে বিয়ে বলে? তুই ভালো নেই আপুই ৷ তোকে দেখে কষ্ট হয় আমার ৷ অনেক বেশি কষ্ট হয় রে ৷
বলেই আপুকে জড়িয়ে ধরলে আপু ‘আহ’ করে উঠলো ৷ বিচলিত হয়ে বলতে লাগলাম,,,,,,,,
ইশিতা : কি হয়েছে তোর? কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস? দেখি…
বলেই আপুর কাঁধের দিকে হাত দিতে গেলে আমাকে আটকে দিয়ে বলে উঠলো,,,,,,,,
ইতি : কিছু হয় নি ৷ আমি আসছি ৷
আপু চলে যেতে নিলে আপুর কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচল টেনে সরাতেই দেখতে পেলাম জায়গাটা কেঁটে গেছে ৷ লাল হয়ে আছে আর রক্ত জমাট বেঁধে ফুলে আছে ৷ যেন কোনো মারের চিহ্ন ৷ আপুকে ঘুরিয়ে বলতে লাগলাম,,,,,,,,,
ইশিতা : কি এটা? কে মেরেছে তোকে?
ইতি : ককে মারবে? আমার কাজ আছে ছাড় ৷
ইশিতা : ছোট বেলা থেকে সব সময় তুই আমাকে আগলে রেখেছিস ৷ আমার কোথাও কষ্ট হলে নিজে পাগল হয়ে যেতিস ৷ তাহলে আজ কেন নিজের কষ্ট দেখে পাগল হচ্ছিস না? আবার আমার থেকে লুকাচ্ছিস? তুই আমার কষ্ট সহ্য করতে না পারলে আমি কি করে পারবো আপুই? আমারও যে কষ্ট হয় ৷ তোকে জিজু মেরেছে সেটা বলতে পারলি না আমায়?
ইতি : শশুভ কেন মারবে আমায়?
ইশিতা : ওই ছেলের সাহস কত তোর উপরে হাত তুলে? নিজের শ্বশুড়বাড়িতে থাকে, খায় আবার সেই বাড়ির মেয়ের গায়েই হাত তুলে? ওই ছেলেকে আজ এই বাড়ি থেকে বের করবো আমি ৷
বলেই ইশিতা যেতে নিলে ইতি ওকে ধরে বলতে লাগলো,,,,,,,,,,
ইতি : বোন প্লিজ এরকম করিস না ৷ দেখ কিছু হয় নি তো ৷ এমনিতেই বাড়িতে একটা অশান্তি লেগে রয়েছে আর বাড়াস না প্লিজ ৷
ইশিতা : আপুই তুই…
ইতি : একটু মলম লাগিয়ে দিবি? আমি না লাগাতে পারছি না তাই ৷
আমি নিজের চোখ মুছে আপুকে বিছানায় বসিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসে কাঁটা জায়গায় মলম লাগিয়ে দিতে দিতে বললাম,,,,,,
ইশিতা : খুব ব্যথা করছে না?
ইতি : মনের ব্যথার কাছে এসব ব্যথা কিছুই না ৷
ইশিতা : অনিক ভাইয়ার কাছে ফিরে যা ৷ আমি জানি উনি তোকে ফিরিয়ে দিবেন না ৷ তুই সত্যিটা বলে দিস ৷
ইতি : যে আমার মনের ভাষা বুঝে নি ৷ আমার ভালোবাসা বুঝে নি তার কাছে আর ফিরে যাবো না আমি ৷ দেখি আমার ভাগ্যে আর কি আছে ৷ কিন্তু তুই পালিয়ে যা নাহলে বাপি তোকেও বিয়ে দিয়ে দিবে ৷
ইশিতা : আমি এতোটাও স্বার্থপর হতে পারবো না আপুই ৷ আচ্ছা একটা কথা বল তুই জানিস? বাপিকে কে ফোন করে আমার কথা বলেছে?
ইতি : হুম ৷
ইশিতা : কে?
ইতি : রবিন ৷
বাপি আমার বিয়ে যার সাথে ঠিক করেছিল সেই ছেলেটার নাম রবিন ৷ যেই বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম আমি ৷ আপুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ৷ আপু বলতে লাগলো,,,,,,
ইতি : রবিন তোকে রাস্তায় দেখে কিছুটা সন্দেহ করেছিল ৷ তুই বোরখা পরে ছিলিস তবুও ৷ তোর চোখ দুটো ওর চেনা চেনা লাগছিল ৷ পরে ও তোদের কাছে গেলে তোদের মধ্যকার কথাবার্তা শুনতে পায় ৷ বিশেষ করে তোর গলা ও চিনতে পেরেছিল ৷ আর ইশানের মুখে তোর নাম শুনে ও আরো নিশ্চিত হয়ে যায় ৷ তৎক্ষনাৎ ফোন করে বাপিকে জানায় ৷ শুভ লোক নিয়ে তোদের কাছে চলে যায় তোকে ধরার জন্য ৷ রবিন শুভকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তোকে ৷ আর শুভ সেই দেখানো পথ অনুসরণ করে ৷
ইশিতা : তুই জানলি কি করে?
ইতি : শুভ মাত্র বললো আমায় ৷ তুই পালিয়ে যা ৷ দেখ আমরা নিজেরাই নিজেদের সামলাতে পারবো ৷ তুই প্লিজ বাপির কথা শুনে নিজের জীবনটা নষ্ট করিস না ৷ পালিয়ে যা তুই ৷
ইশিতা : বাদ দে ভালো লাগছে না ৷ ইশান চলে গেছে?
ইতি : জানি না রে দেখতে পাই নি ৷
ইশিতা : ওহ ৷
ইতি ইশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে ওর মাথা তুলে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো,,,,,,
ইতি : পালিয়ে যেতে চাইলে বলবি ৷ তোর জন্য সব করতে পারবো আমি ৷ এখন আসছি ৷ সাবধানে থাকিস৷
ইশিতা মাথা নাড়িয়ে ‘আচ্ছা’ বললো ৷ ইতি রুম থেকে চলে গেলে ও বেলকনিতে চলে গেল ৷ সেই জায়গার দিকে তাকিয়ে রইল যেই জায়গায় ইশান ওর জন্য পাগলের মতো কাঁদছিল ৷ এখন সেই জায়গাটা ফাঁকা ৷ কোনো মানুষ নেই সেখানে ৷ ওর কাছে ফোনও নেই যে ও ইশানকে ফোন দিয়ে জানবে ইশান ঠিক আছে কি না? বাসায় পৌঁছিয়েছে কি না? ফোন তো ওর বাবা নিয়ে গেছে ৷ কখনও ইশানের সাথে কথা হবে কি না এও জানে না ৷ একটু স্বার্থপর হলে কি হবে আর? এই শহর ছেড়ে বহুদূরে চলে যাক ৷ এরকম বিষাক্ত শহর ছেড়ে গেলে কি অনেক বড় ভুল হয়ে যাবে? চোখের কার্নিশ বেয়ে পরছে অজস্র অশ্রু বিন্দু ৷ প্রত্যেকটা বিন্দু ওর প্রতিটা ভালোবাসার মানুষের জন্য ৷ ইশিতা ইশানকে যেমন ভালোবাসে তেমনও তো ও ওর মা, বোনকেও বাসে ৷ সবাইকেই তো কাছে চায়, পাশে চায় ৷ সেখানে ও ওদের বিপদে ফেলে কি করে যেতে পারে?
_________________________________
বিছানায় চোখে মুখে হাত দিয়ে বসে আছি আমি ৷ চিন্তা, রাগে, কষ্টে নিজেকে শেষ করে ফেলতে হচ্ছে ৷ ফোনও নেই আমার কাছে ৷ কি করে কথা বলবো ইশানের সাথে? জানালা দিয়ে কারো ফিসফিসানির আওয়াজ পেয়ে পেছনে তাকালাম ৷ ফুপ্পি দাঁড়িয়ে আছে আর এদিক ওদিক দেখছে ৷ আমি তার কাছে চলে গেলাম ৷ ফুপ্পি আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,,,,,,,,,,
—- শোন ভেঙ্গে পরবি না ৷ শক্ত হতে হবে এখন তোকে ৷ কাঁদবি না আর প্লিজ ৷ আর নে এটা ধর ৷
হাতে নিয়ে দেখি মোবাইল ৷ সেটা দেখে আমি বললাম,,,,,,,,
ইশিতা : মোবাইল??
—- ইশানের সাথে কথা বলে নে তুই ৷ আর মোবাইলটা তোর কাছেই রাখিস ৷ লুকিয়ে রাখিস যাতে ভাইয়া দেখতে না পায় ৷
ইশিতা : কিন্তু এটা তো তোমার?
—- তুই রাখ না ৷ আমি একটা কিনে নিব ৷ এটা রাখ ৷ আর কাঁদবি না একদম ৷ আমরা তোর সাথে আছি তো নাকি? যখন যা লাগবে বলিস আমি এনে দিব ৷
ইশিতা : থ্যাঙ্কিউ ফুপ্পি ৷
—- আমার মা’টা যা কথা বল এবার ৷ দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে নিস ৷ আর শোন তুই পালিয়ে যা ৷
ইশিতা : তোমরা…
—- আমাদের চিন্তা করিস না তুই ৷ আমরা নিজেদের সামলাতে পারবো ৷ আমি তোর আপু আর আম্মুর সাথে আছি তো নাকি? তুই ইশানের সঙ্গে অনেক দূরে চলে যা ৷ আর ইশানের ফ্যামিলিকে ইশান যেন সুরক্ষিত রাখে সেটাও দেখিস ৷ চলে যা না ইশু ৷ তোর কষ্ট আমি দেখতে পারছি না ৷
ইশিতা : আচ্ছা দেখা যাবে ৷
—- যা কথা বলে নে ৷ আমি আসছি নয়তো কেউ দেখে ফেলবে ৷
আমি শুধু মাথা নাড়ালাম ৷ ফুপ্পি আশে পাশে তাকাতে তাকাতে চলে গেল ৷ ছোটবেলা থেকেই আম্মুর থেকে সবচেয়ে বেশি ফুপ্পির সাথে থেকেছি আমি ৷ ফুপ্পি আমাকে আর আপুকে সবসময় একসাথে ঘুম পারাতো, খাওয়াতে, খেলাতো, পড়াতোও ৷ দু দুটো মায়ের সংস্পর্শে বড় হয়েছি আমরা ৷ কতো সুখের ছিল সেই মূহুর্ত গুলো ৷ আমাদের কষ্ট দেখলে ফুপ্পি দৌঁড়ে এই বাড়িতে চলে আসে ৷ যেমনটা আজ এসেছে ৷ আলাদা ফ্লাট ভাড়া করে থাকে ৷ একটা প্রাইমারি স্কুলের টিচার সে ৷ মাঝেমাঝে এখানে আসে ৷ এখনো বিয়ে করে নি ৷ বাপি জোর করেছে, ভয় দেখিয়েছে তবুও করেনি ৷ তাই এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল ৷ মাঝেমাঝে আসে বাপি একবারও মুখ তুলে তাকায় না ৷ একটা কথাও বলে না তার সাথে ৷
জানালা লাগিয়ে দরজাও ভেতর থেকে লাগিয়ে দিলাম ৷ দরজাটা বাহির থেকেই মূলত লক করা ৷ তবুও ভিতর থেকে লাগালাম ৷ মোবাইলটা নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম ৷ কল লিস্টে যেতেই ইশানের নাম্বার দেখতে পেলাম ৷ কিন্তু ফুপ্পির কাছে ইশানের নাম্বার কোথা থেকে আসবে? সেটাই বুঝলাম না ৷ ইশানকে কল দিলাম ৷ প্রথম দুবার ধরলো না, কেটে গেল ৷ পরে দুবার রিং হওয়ার পরই রিসিভ হলো ৷ ওপাশ থেকে ভেসে এলো,,,,,,,,,,,,,
ইশান : কে??
ইশানের গলাটা ভেজা মনে হলো ৷ নিজেকে সামলিয়ে বললাম,,,,,,,,,,,
ইশিতা : বাড়িতে পৌঁছিয়েছো? ব্যথা কি কমেছে? মেডিসিন নিয়েছো?
ইশান : এসব জেনে তুমি কি করবা? আমার দরকার আছে কোনো?
ইশানের অভিমানি সুরে কথা শুনে নিজের কষ্টটা আরো বেড়ে যাচ্ছে ৷ ঠোঁট কামড়ে কান্নাটা আটকানোর চেষ্টা করছি ৷ আমাকে চুপ থাকতে দেখে ইশান আবার বললো,,,,,,
ইশান : কতবার বললাম আমার কাছে আসতে ৷ আসলে না কেন? কি এমন হতো বলো? আমাকে কষ্ট দিতে তোমার ভালো লাগে অনেক তাই না? এভাবে কষ্ট কেন দিচ্ছো ইশুপাখি?
আমি চুপ করে আছি এখনো ৷
ইশান : কথাও কি বলবে না এখন? আমি আর পারছি না ৷ কেন এভাবে দূরে সড়িয়ে দিলে আমাকে?
ইশিতা : তততুমি কখন বাড়ি গিয়েছো?
ইশান : আমি কি বলছি আর তুমি কি বলছো? ধুর তোমার সঙ্গে কথা বলাই বেকার ৷
বলেই রেগে ইশান ফোন কেটে দিল ৷ ইশিতা মোবাইলটা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো ৷
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,