প্রেমের খেয়া পর্ব ২২

#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_২২

মায়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সেলিনা মালিকের দিকে..

–আজ থেকে চার বছর আগে আমি আমার সামরান এর জন্য একটি পাত্রী দেখেছিলাম। যেই মেয়েকে আমার সামরান পছন্দ করতো। আমার সামরান খুব শান্ত ছিলো। নিজের মনের কথা সে প্রকাশ করতে পারতো না৷ আর অপরদিকে শেহের তারই বিপরীত ছিলো। চঞ্চল, হাসি, খুশি। সামরান পড়ালেখা শেষ করে তার বাবার ব্যবসার হাল ধরে। সব ঠিকই চলছিলো। একদিন একটি মেয়েকে দেখে আমার ছেলে এসে বলেছিলো যে, মা এই মেয়েটিকে
আমার অনেক ভালো লাগে। আমি ওকে ভালোবাসি। নিজের মনের কথা আমার সামনেই আমার সামরান বলতো। আমি আমার সামরান কে বোবা বলতাম। কারণ আমার সামরান সারাদিন বাসায় পড়ে থাকলেও একটু টের পেতাম না কি সে বাসায় আছে কি নেই? আমার সেই বোবার মুখে বুলি ফুটেছে দেখে আমি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। ধুমধাম করে আমি বিয়ের বন্দোবস্ত করলাম। আমার ছেলের বিয়ে। বিয়ের আগে মেয়েটির সাথে সামরান নিজেও অনেক বার দেখা করেছে। কোনো খুঁত মেয়েটির মাঝে আমার সামরান দেখেনি। মেয়েটির ম্যাট্রিক পরিক্ষার জন্য আমরা বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করিনি। ম্যাট্রিক পরিক্ষার পরই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়। এর আগে মেয়েটির সমস্ত চাওয়া পাওয়া আমার সামরান পূরণ করে গেছে। আমার ছেলে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলেছিল সেই মেয়েটিকে। ও কি খাবে,কিসে ওর ভালো লাগবে সব আমার ছেলে খেয়াল রাখতো। মেয়েটিরও কোনো আপত্তি ছিলো না। মেয়েটি বুঝতেই দিলো না যে সে সামরান কে পছন্দ করে না। বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। আমার ছেলে খুব সুন্দর করে বর সেজেছিলো। আমি আমার ছেলেকে সেদিনের মত এত খুশি আর দেখিনি। ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করে ঘরে আনবে বলেই হয়তো আমার ছেলে এত খুশি ছিলো।

সেলিনা মালিকের চোখ ছলছল করছে। গলা ধরে আসছে। চোখ বন্ধ করে কয়েকবার শ্বাস টেনে নিল। মায়া সেলিনা মালিকের হাতের উপর হাত রাখলো–

–বিয়ে হয়নি আম্মা?

–নাহ হয়নি। আমার ছেলে খালি হাতে ফিরে এসেছিলো। ভরা মজলিসে মেয়েটি আমার ছেলেকে অপমান করেছিলো কুৎসিত বলে। বলেছিলো বিয়ের আগে এতদিন ঘোরাফেরা করেছে অথচ আমার ছেলের মাঝে কোনো পুরুষত্ব সে দেখতে পায়নি। এমন ব্যাকডেটেড ছেলের সাথে আর যাই হোক সারাজীবন কাটানো যায় না। সুন্দর হলেও একটা কথা ছিল। যার গায়ের রঙ কালো সে আর যাইহোক একজন ভালো মানুষ হতেই পারে না। মেয়েটির শেষ কথা ছিল “নিজেকে কখনো আয়নায় দেখেছেন”? একবার দেখবেন আয়নাও আপনাকে ধিক্কার দেবে। ভরা মজলিসে আমার সামরান মাথা নিচু করে ছিলো। শুধু সেই মেয়ে না তার পরিবারও আমার ছেলেকে কম অপমান করেনি। হ্যা আমি প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার ছেলে আমাকে বাধা দেয়। সে বার বার বলেছিলো আমি তোমার জন্য নিজেকে বদলে দেব। তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। কিন্তু মেয়েটি অপমানের পর অপমান করেই গেল। আশেপাশের লোকরাও কম অপমান করে নি। সেদিনের পর থেকে আমার নরম মনের ছেলেটা পাথরে পরিণত হয়েছিলো। বাসায় এসে নিজের রুমের সমস্ত আয়না সে ভেঙ্গে দিয়েছিলো। দেখবে না সে তার সেই কুৎসিত চেহারা। নিজেকে চারদেয়ালের ভেতর বন্দি করে নিয়েছিলো। মেয়েটির বেস্ট ফ্রেন্ড কে ছিলো জানিস? ছলছল নয়নে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল সেলিনা মালিক।

–কে?

–সিমি। হ্যা সিমি ছিলো মেয়েটির বেস্ট ফ্রেন্ড। শেহেরজাদ যখন বাসায় এসে বলে যে সে সিমিকে পছন্দ করে সামরান তখন বাধা দেয়। কারণ যদি শেহেরজাদও এমন কিছুর মুখোমুখি হয়। কিন্তু শেহেরজাদ মানলো না সে বলে দিলো, এই মেয়েকেই তার লাগবে। অথচ সিমি নিজেও শেহেরজাদকে পছন্দ করতো না। সামরান বলেছিলো “এই মেয়ে তোকে বিয়ে করবে না”। শেহেরজাদ বড় মুখ করে বলেছিলো “বিয়ে আমি ওকেই করবো”।সামরানের সাথে রাগারাগি করে শেহেরজাদ বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। আর ফিরে আসে সিমিকে নিয়ে। বিয়ে করেই নিয়ে এসেছিলো। সিমিকে ব্ল্যাকমেইল করে মিথ্যা কথা বলিয়ে শেহেরজাদ বিয়ে করিয়ে নেয়। যার কারণে সিমি আমীর সাহেব এর সামনে বলতে বাধ্য হয়েছিলো ” আমি তোমাদের কাছে নিজের কোনো শখ পূরণ করতে পারিনি। কি দিয়েছ তোমরা আমাকে? আমি যাকে বিয়ে করেছি তার লাখ লাখ টাকা”। নিজেকে মা বাবার চোখে খারাপ প্রমাণিত করে এক নিমিষেই। শেহেরজাদ সিমিকে নিয়ে বাসায় আসার পর সামরান বলেছিলো “হয় আমাকে নাহয় এই মেয়েকে বেছে নিতে হবে..আমি এই মেয়েকে কিছুতেই মেনে নেবো না। আর শেহেরজাদ বলেছিলো ভালোবাসার আগে কিছু না। সিমিকে আমি অনেক কষ্টে নিয়ে এসেছি। নিজের ভালোবাসা আমি হারাতে পারবো না। তুই নিজের ভালোবাসা পাস নি তাই আমাকে দেখে তোর সহ্য হচ্ছে না। ব্যস! দুই ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ লেগে গেল। ফাটল ধরে গেল দুই ভাইয়ের সম্পর্কে। সামরান যখন নিজেকে একটু একটু করে গুছিয়ে নিচ্ছিলো তখনই শেহেরজাদ এমন করেছিলো। একটা বছরে নিজেকে অনেক কষ্টে গুছিয়ে নিয়েছিলো। আর শেহেরজাদ তখনই এই কাজ করে। যার কারণে দুই ভাই আলাদা হয়ে যায়। শেহেরজাদ চলে গেল লন্ডন আর সামরান এখানেই রইলো। তবে সম্পূর্ণ অচেনা।
আমার যেই ছেলে মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাতো না সেই ছেলেই দিনে রাতে হাজারো নারীতে মত্ত্ব হয়ে পড়ে। সবার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় সে। আমার সামরান তার বাবাকে বাবা বলে ডাকেনা আজ ৪বছর। কারণ যখন সবাই মিলে সাপোর্ট করেছিলো তখন সামরানের বাবা বার বার সামরান কে তার ভুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলো। শুধু তাই না, শেহেরজাদ আর সামরানের মাঝে যখন ঝামেলা হচ্ছিলো তখন শেহেরজাদকেই সমর্থন করেছিলো উনি। যার কারণে আজ পর্যন্ত সে তার বাবাকে বাবা বলে ডাকে না। এক ছেলের মন রক্ষা করতে গিয়ে অন্য ছেলের মন বিষিয়ে দিল। মানুষটাই বা কি করতো? শেহেরজাদ কাজটাই এমন করেছিলো। সিমি সবার চোখে খারাপ হয়ে যায়। সেই মেয়েকে কিভাবে ফিরিয়ে দিত? আঁচল দিয়ে চোখ মুছে মায়ার দিকে তাকালো সেলিনা মালিক। মায়া তাকিয়ে আছে সেলিনা মালিকের দিকে। চোখের পলক পড়ছে না। মেয়েটি কি সেলিনা মালিক কে ভুল বুঝলো?

–তুই কিছু বলছিস না কেন? তুই আমাকে স্বার্থপর ভাবছিস তাই না? হ্যা আমি স্বার্থপর। স্বার্থপর আমি। আমি দেখেছি, আমার যেই ছেলে আয়না দেখতো না সে তার মুখ টা দেখার জন্য ছটফট করতে থাকে। আমার ছেলে নিজেকে নিয়ে ভাবতো না সেই ছেলে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে বলেছে,আমি কুৎসিত নই,আমি মায়াবী। বিশ্বাস কর,এসব আমাকে স্বার্থপর হতে বাধ্য করেছে। আমার ছেলে নিজের দিকে তাকিয়ে হেসেছে। আমার যেই ছেলে ঘরে দুই-তিন দিনে একবার আসতো না সেই ছেলে বাসায় থেকে নিজের রুমটা নিজের হাতে সাজিয়েছে। ওর এমন পরিবর্তন দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। শুধু তাই নয়,ড্রাইভার ও আমাকে বলেছিলো,কলেজ এর অনুষ্ঠান শেষ করে ফেরার পথে ও হেসেছে। একা একাই! তারপর তুই যেদিন ওকে বাড়ির সামনে পর্যন্ত এনে দিয়ে গেলি সেদিন আমি ছাদে ছিলাম। আমি দেখেছি। সব দেখার পর আমি বুঝতে পেরেছি তুই সেই মেয়ে যে আমার পাথরের মত ছেলেটিকে মোম বানিয়ে দিলি। তাই আমি স্বার্থপর হয়েছি। আমার সন্তানের জন্য! আমার সেই ছেলেটা আমার ফেরত চাই। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে। তাই আমি স্বার্থপর হয়েছি। হ্যা আমার ছেলের একটা বাজে স্বভাব ছিলো। সেটা আমি গোপন করেছি। এটা ভুল! কিন্তু কি করতাম আমি আমার ছেলেকে ভালো থাকতে দেখেছি। আমার ছেলেকে আমি হাসতে দেখেছিলাম। আমার ছেলের বাজে স্বভাব আছে,সে নারী নেশায় আসক্ত। কিন্তু কেউ এটা জিজ্ঞেস করেনি আমার শান্ত ছেলেটি কেন এমন হলো? কেন সে নিজেকে ঘৃণা করে? কেন সে নিজেকে এত অবহেলা করে? তুই জানিস? তুই ওর জীবনে আসার পর কোনো মেয়ের দিকে ও আর চোখ তুলে তাকায় নি। আমি আমার ছেলের সব খোঁজ নিয়ে তবেই তোর দিকে হাত বাড়িয়েছি। তুই দূরে সরে গেলে আমার সামরান মরে যাবে মায়া। আমার ছেলেটা না জানি এর পর আর কি করবে?

মায়া চুপ করে রইলো। সেলিনা মালিক মায়ার নিরবতা মেনে নিতে পারছে না। মায়া কেন কিছু বলছে না? তবে কি মায়াও ছেড়ে চলে যাবে?

–তুই কেন কিছু বলছিস না মায়া? তুই কেন চুপ করে আছিস।

–আম্মা! উনি কালো না। ওনার চেহারায় মায়া আছে। ওনার হাসিতে মায়া আছে। ওনার বলা কথা গুলোই মায়া জড়িয়ে থাকে। ওনার স্পর্শে মায়া মিশে আছে। ওনার সব কিছুতেই মায়া মিশে আছে। সেখানে মায়া কি করে তাকে ছেড়ে চলে যাবে? একজনের দেওয়া আঘাতের কারণে আপনার ছেলে নিজেকে এইভাবে নষ্ট করে দিয়েছে। আমি নাহয় সোনা-রুপার পবিত্র পানি হয়ে তার জীবন শুদ্ধ করে দেব। আমি তার সঙ্গ ছাড়বো না। যেই কালোকে উনি ঘৃণা করে সেই কালোকেই উনি চরমভাবে ভালোবাসবে। উনি কালো না। আপনার ছেলেকে আমি আবার আগের মত করে দেব। যাকে আপনি চান আমি তাকেই ফিরিয়ে আনবো। আমি বুঝেছি। সব বুঝেছি। কলেজের কম্পিটিশন থেকে শুরু করে সব। আড়ালে থেকে উনি এত কিছু করেছে আর আমি বুঝতেই পারিনি।
আমি ছেড়ে যাবো না। মৃত্যু ছাড়া আমাকে ওনার কাছ থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। কেউ না।

সেলিনা মালিক মায়াকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো।

–আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। চুমোই ভরিয়ে দিলো মায়ার মুখ।

সারাদিন সামরানকে দেখেনি মায়া। পার্লারের মেয়েরা এসে হাজির হয়েছে। আসরের নামাজ পড়ে মায়া বসতেই মায়াকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মেয়েরা। এত সাজ গোজ এর জিনিস দেখে মায়া ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো,

–এইসব যদি আমার মুখে দেওয়া হয় নির্ঘাত দশ কেজি ওজন হবে। মায়ার এই কথা শুনে পার্লারের মেয়েরা হেসে দেয়।

বিঃদ্রঃ রি-চেইক করিনি। গল্প কালকে দিইনি তাই দুঃখিত। রেগুলার দেওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু হয়ে ওঠে না। সামনেই আমার এক্সাম। পড়ালেখার চাপ বেড়েছে। তার উপর সংসারের কাজ, সব মিলিয়ে আমি ঘেটে আছি। তাড়াহুড়োতে পর্ব গুলোও কেমন এলোমেলো হচ্ছে। তার জন্য সরি। ভুল ক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

হ্যাপি রিডিং ❤️

চলবে…….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here