প্রেম পর্ব -২৫

প্রেম 💙❤️ (Love has no limits)

#পর্ব: ২৫

আজ চার দিন পর স্পর্শিয়ার জ্ঞান ফিরলো। নিজেকে আবিস্কার করলো হসপিটালের বেডে। আশেপাশে ওর বাবা, মা, আরাধ্য, আর নিশাত চৌধুরীকে দেখতে পেল। কিন্তু সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত, আর আরাধ্য শুকনো মুখে স্পর্শিয়ার একটা হাত ধরে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। স্পর্শিয়া মনে করতে পারছে না কি হয়েছিল ওর সাথে। যতদূর মনে পড়ছে ওর বিয়ে ছিল, ও পার্লার থেকে বাসায় ফিরছিলো। তারপর, তারপর কি হলো? ওর কি বিয়ে হয়েছে? ও এখানে এলো কি করে? কোন এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল? সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা স্পর্শিয়ার। অনেক কষ্টে স্পর্শিয়া ওর আরেক হাত আরাধ্যর হাতের ওপর রাখলো। আরাধ্য ওর দিকে ফিরে তাকালো। আরাধ্যর চোখে মুখে খুশি ঠিকরে পড়ছে।
– স্পর্শ, তোমার জ্ঞান ফিরেছে? স্পর্শ ঠিক আছো তো তুমি? স্পর্শ, আমার স্পর্শ..
আরাধ্য সাথে সাথে স্পর্শিয়ার কপালে চুমু খেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। তৎক্ষনাৎ যেন স্পর্শিয়ার সবকিছু মনে পড়ে গেল। সেদিন ও পার্লার থেকে ভেন্যুতে যাচ্ছিল। হঠাৎ কিছু ছেলে এসে ওকে তুলে নিয়ে যায়। অনেক জোরাজোরি করেও ও ছুটতে পারেনি। মনে মনে বারবার আরাধ্যকে ডাকছিল ও৷ ছেলেগুলো একটা পুরনো বাড়িতে নিয়ে ওর ওপর শুরু করে অমানবিক শারিরীক নির্যাতন। ছেলেগুলোর কাছে নিজের ইজ্জত ভিক্ষা চেয়েছিল ও, কিন্তু দেয়নি ভিক্ষা। কতক্ষন এ নির্যাতন চলেছিল ওর ওপর ও জানে না। শুধু এটুকু মনে আছে যে, ব্যথা সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।
সবকিছু মনে পড়তেই ও ধাক্কা দিয়ে আরাধ্যকে দূরে ঠেলে দেয়। ওর এ শরীর আরাধ্যর শরীরের সাথে মেশাতে চায় না ও। স্পর্শিয়ার এরূপ ব্যবহারে আরাধ্য কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। কিন্তু স্পর্শিয়ার মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে নিজেকে সামলে নেয়৷
সবাই স্পর্শিয়ার বেডের কাছে এসে বসে। বাইরে যারা ছিল তারাও কেবিনের ভেতরে চলে আসে। স্পর্শিয়ার লজ্জা করছে কারও সাথে নজর মেলাতে। ঘৃণা লাগছে ওর এই শরীর নিয়ে সবার সামনে থাকতে। স্পর্শিয়া নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলে। কারও সাথে নজর মেলানো ওর পক্ষে সম্ভব না। আরাধ্য স্পর্শিয়ার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ইশারা করে সবাইকে বাইরে চলে আসতে। ও নিজেও বাইরে চলে আসে। ভেতরে শুধু স্পর্শিয়া আর ওর মা।
আরাধ্যর কেমন যেন ভয় ভয় করছে। মনে হচ্ছে স্পর্শিয়া দূরে চলে যাচ্ছে ওর কাছ থেকে। বুকের ভেতর একরাশ শূণ্যতা গ্রাস করে রেখেছে ওকে। ভাবতেই পারছে না ও কিভাবে কি হয়ে গেল । কোথায় আজ স্পর্শিয়ার সাথে ওর ম্যারিড লাইফ শুরু করার কথা ছিল, আর কোথায় আজ স্পর্শিয়া হসপিটালের বেডে। নিজের উপর নিজেরই রাগ উঠলো আরাধ্যর। ও ই বা কি করতে পেরেছে স্পর্শিয়ার জন্য? ওর স্পর্শর এতো বড় ক্ষতি করলো সায়ান, আর ও কিছুই করতে পারলো না। নিজেকে ওর স্পর্শিয়ার যোগ্যই মনে হলো না। যে প্রেমিক নিজের ভালোবাসার মানুষের হেফাজত করতে না পারে সে আবার কেমন প্রেমিক? নিজের হাত দিয়ে সজোরে আঘাত করলো দেয়ালে, কান্নায় ভেঙে পড়লো আরাধ্য।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
গভীর রাতে স্পর্শিয়ার ঘুম ভেঙে গেল । কাত হয়ে শুতে গিয়েও শুতে পারলো না সারা শরীরে ব্যথার কারণে। পায়ের কাছে কিছু অনুভব করতেই নিচে তাকালো। আরাধ্য ওর পায়ের কাছে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আরাধ্য রাতে হসপিটালে থাকবে সেটা ও এক্সপেক্ট করেনি৷ আরাধ্যর একটা হাত স্পর্শিয়ার পায়ের উপরে, চোখের পাপড়িগুলো ভেজা। স্পর্শিয়া বুঝতে পারলো হয়তো কান্না করতে করতে কিছুক্ষন আগেই ঘুমিয়েছে আরাধ্য। স্পর্শিয়ার এই মূহুর্তে নিজের চেয়ে বেশি অসহায় আরাধ্যকে মনে হচ্ছে। ছেলেটা কতটুকু পাগল হলে একটা রেপ হওয়া মেয়েকে এখনো এভাবে ভালোবেসেই যাচ্ছে। মূহুর্তেই ভয় ঢুকে গেল স্পর্শিয়ার মনে। এটা আরাধ্যর সহানুভূতি, দয়া বা ক্ষনিকের মোহ না তো? সারাজীবন কি আরাধ্য এভাবেই ওকে ভালোবাসবে? আগের মতো কি আরাধ্য ওকে কাছে টেনে নিবে? ডুকরে কেঁদে উঠলো স্পর্শিয়া। শুয়ে থাকাতে কান্না আটকে কাশি আসতে লাগলো । স্পর্শিয়ার কাশির শব্দ শুনে আরাধ্য জেগে উঠলো। তাড়াহুড়ো করে পানি নিয়ে স্পর্শিয়াকে খাইয়ে দিলো। স্পর্শিয়ার ভেজা চোখ দেখে আরাধ্য বুঝতে পারলো ও কাদছিল । ওর কষ্ট হচ্ছে স্পর্শিয়াকে এভাবে দেখতে। স্পর্শিয়ার দুঃখ আরাধ্যকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে। আরাধ্য খেয়াল করলো পুরো সময়টাতে স্পর্শিয়া একবারও ওর দিকে তাকায়নি, একটা কথাও বলেনি, আরাধ্যর কাছ থেকে নজর এড়ানোর খেলায় ব্যস্ত স্পর্শিয়া। আরাধ্যও স্পর্শিয়াকে কিছু বললো না। স্পর্শিয়াকে পানি খাওয়ানো শেষ করে ওকে শুইয়ে দিল। স্পর্শিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আরাধ্য। স্পর্শিয়া আরাধ্যর হাত সরিয়ে বললো,
– আমি এমনিতেই ঘুমাতে পারবো, হাত বুলিয়ে দিতে হবে না।
আরাধ্য কিছুক্ষন স্পর্শিয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো । স্পর্শিয়া আরাধ্যকে ভুক্ষ্রেপ না করে অপরদিকে কাত হয়ে শুয়ে নিরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। ওর মনে এখন একটাই ধারণা আরাধ্য ওকে করুনা করছে, বা সাময়িক মোহে আছে।
.
.
.
.
.
.
.
.

৭ দিন পর…
সায়ান আর ওর যেসব ফ্রেন্ডরা মিলে স্পর্শিয়ার সাথে এরকম জঘন্য কাজ করেছে সবাই জেলে আছে। আরাধ্য ভেবে পাচ্ছে না সায়ান ওর ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এতো বড় একটা অমানবিক কাজ কি করে করলো? এতো দীর্ঘ পরিকল্পনা ছিল সায়ানের অথচ ও একটা বারের জন্য তা আচও করতে পারলো না।

আজ সকালেই স্পর্শিয়াকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। স্পর্শিয়া এখন শারীরিকভাবে আগের চেয়ে অনেক সুস্থ। হসপিটালে জ্ঞান ফেরার পর প্রথম দু দিন স্পর্শিয়া কারও সাথে কথা বলতে চাইতো না। ওর বাবা, মা, আর আরাধ্য ছাড়া অন্য কেও ওর সাথে দেখা করতে আসলেই মুখ ফিরিয়ে রাখতো। ওর মনে হতো সবাই ওকে করুণার চোখে দেখবে, অথবা ঘৃণার চোখে। কিন্তু ওর এই মনোভাব আরাধ্য দূর করতে সক্ষম হয়েছে। আরাধ্য ওকে বুঝাতে পেরেছে যে সবাই ওর ভালো চায়, কেও ওর শত্রু না, বা কেও সহানুভূতিও দেখাতে আসে না ওর কাছে। তারপর থেকে সবার সাথে টুকটাক কথা বলে স্পর্শিয়া। আরাধ্য সবাইকে স্ট্রিক্টলি মানা করে দিয়েছে স্পর্শিয়াকে সায়ান বা সে ঘটনার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করতে।

কিন্তু আজকাল আরাধ্য মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। যতই দিন যাচ্ছে ওর মনে হচ্ছে স্পর্শিয়া ওর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। নিজ থেকে স্পর্শিয়া কোন কথাই বলে না ওর সাথে, শুধু আরাধ্য কিছু জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর দেয়। আরাধ্য সিদ্ধান্ত নিল স্পর্শিয়ার সাথে আজই এ ব্যাপারে সরাসরি কথা বলবে।

স্পর্শিয়া বসে বসে ওর ছোটবেলা থেকে শুরু করে জীবনের এ অধ্যায় পর্যন্ত সবকিছু মনে করছিল। কতই না সুখের ছিল ছোটবেলাটা। আর এখন ও জীবনের সবচেয়ে কষ্টের সময়টুকু পার করছে।
দরজায় নক পড়তেই স্পর্শিয়া হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছলো। আরাধ্য এসে রুমে ঢুকেছে। আরাধ্য এসেছে তা ও বুঝতে পারলো ঠিকই, কিন্তু আরাধ্যর দিকে তাকালো না। স্পর্শিয়ার কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আরাধ্য স্পর্শিয়ার পাশে বসে স্পর্শিয়াকে দেখতে লাগলো। হাসিখুশি মেয়েটার চেহারা কেমন শুকনো, মলিন হয়ে গিয়েছে। চোখ দুটো সবসময় ফুলে লাল হয়ে থাকে। আরাধ্যর বুঝতে সমস্যা হয় না যে স্পর্শিয়া সুযোগ পেলেই কাদে।

আরাধ্য স্পর্শিয়ার সামনে বসে আছে কয়েক মিনিট যাবত কিন্তু স্পর্শিয়া এরমধ্যে একবারও আরাধ্যর দিকে তাকায়নি। আরাধ্য গলা ঝাড়া দিয়ে বলল,
– স্পর্শ, আমাকে কি এখন আর তোমার ভালো লাগে না?
আরাধ্যর এমন প্রশ্নে স্পর্শিয়া আরাধ্যর চোখে চোখ রাখে। আরাধ্যর চোখের ভাষা স্পর্শিয়া বুঝতে পারছে না।
– বলো স্পর্শ। এখন আর আমাকে ভালো লাগে না তোমার?
– এটা আবার কেমন প্রশ্ন?
– তবে প্রশ্ন কেমন হওয়া উচিত? তোমার বিগত কয়েকদিনের ব্যবহার তো এটাই প্রমাণ করছে যে আমাকে এখন আর ভালোবাসো না তুমি, ভালো লাগে না এখন আর আমাকে তোমার।

স্পর্শিয়া কোন উত্তর দিচ্ছে না। আরাধ্য স্পর্শিয়ার হাতের উপর হাত রাখলো।
– বলো না স্পর্শ, এমন করছো কেন আমার সাথে তুমি?
স্পর্শিয়া সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিল।
আরাধ্য আবারও বললো,
– স্পর্শ, আজ তুমি জবাব না দেওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাচ্ছি না।
– কিসের জবাব চাও আরাধ্য? আমি তোমার সহানুভূতি চাই না।
– সহানুভূতি?
– হ্যা, সহানুভূতি নয়তো কি? তোমার এই সহানুভূতি আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় আই ওয়াজ রেপড।
– চুপ স্পর্শ, একদম চুপ। কে বলেছে তোমাকে এ কথা? রেপ? রেপ কি? একটা মেয়ের সতীত্ব ই কি সব?
– আমি কিছু শুনতে চাই না আরাধ্য। প্লিজ যাও এখান থেকে। প্লিজ। আমার মতো মেয়ের জন্য মানুষের শুধু সহানুভূতি ই আসে, ভালোবাসা না।
– তবে এতোদিন তোমার প্রতি আমার যা ছিল সেটাকে তুমি সহানুভূতির নাম দিতে চাচ্ছ?
– সেটা ভালোবাসা হলেও এখন আমার প্রতি তোমার যে টান সেটা ভালোবাসা না। এতদিনের একটা সম্পর্ক, তাই মায়ায় পড়ে গিয়েছ তুমি। এখন আমার প্রতি তোমার দয়া হয়, ভালোবাসা আসে না। আর এই দয়া আমি চাই না।
– ভালোবাসি তোমাকে স্পর্শ। তুমি যেমনই হও না কেন আমি তোমাকেই ভালোবাসি। তোমার সতীত্ব আমার জন্য সব না। তোমার শরীরকে আমি ভালোবাসিনি, তোমাকে ভালোবেসেছি, তোমার মনটাকে ভালোবেসেছি। আমি তোমাকে চাই, তোমার শরীর না। সতীত্ব আমার কাছে খুবই ছোট্ট একটা বিষয়৷ তোমার একটা মন আছে, বাচ্চামিতে ভরপুর, ফুলের মতো পবিত্র একটা মন। সে মনটাকে আমি ভালোবাসি। তোমার শরীরের যদি দুই একটা অঙ্গ নাও থাকে তবুও আমি তোমাকে ঠিক ততোটাই ভালোবাসবো যতটা আগে ভালোবাসতাম, যতটা এখন ভালোবাসি।
– আর সমাজ? সমাজকে কি বলবে?
– তুমি আমার পাশে থাকলে সমাজ দিয়ে কি করবো আমি? ওই নোংরা সমাজ আমার লাগবে না যে সমাজ মানুষের মনটাকে মূল্য না দিয়ে শরীরটাকে প্রাধান্য দেয়৷ আমি সমাজ ছাড়া বাচতে পারবো, কিন্তু তোমাকে ছাড়া তো বেচে থাকার কথা চিন্তাও করতে পারবো না স্পর্শ।

আরাধ্য স্পর্শিয়াকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
– প্লিজ স্পর্শ৷ এতো বড় শাস্তি আমাকে দিও না। ভালোবাসি তোমাকে। মরে যাবো তোমাকে ছাড়া। তুমি আগে আমার কাছে যেমন ছিলে এখনো আমার কাছে ঠিক তেমনই আছো। এতদিন যা হয়েছে তা শুধু একটা কালো অধ্যায় ছিল আমাদের জীবনের। এ অধ্যায়টাকে ভুলে যাও স্পর্শ। খোদা জানে আমি তোমার, খোদা জানে আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি। যে কোন কিছুর বিনিময়ে আমি শুধু তোমাকেই চাই, শুধু তোমার ভালোবাসা চাই, শুধু তোমার সঙ্গ চাই। ভালোবাসা কি এতই সস্তা জিনিস যা একটা মাত্র তুচ্ছ ঘটনার কারণে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে? তাও সে জিনিসের জন্য আমি আলাদা হবো যেখানে তোমার কোন হাত নেই, যেখানে তোমার কোন দোষ নেই। তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমি তোমাকে ভালোবাসি, এর চেয়ে বড় সত্য আমার জন্য আর কিছুই না স্পর্শ। প্লিজ আমাকে ভুল ভেবো না। আমার আগের সেই বাচ্চা স্পর্শকে আমার কাছে আবার ফিরিয়ে দাও। জীবনের প্রতিটা মূহুর্ত আমি তোমার সাথে কাটাতে চাই। জীবনে যতো তুফানই আসুক না কেন দুজন একসাথে মোকাবিলা করবো, কিন্তু কখনো আমাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার কথা ভেবো না স্পর্শ, আমি মরে যাবো।
স্পর্শিয়াও আরাধ্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। স্পর্শিয়ার চোখের পানিতে আরাধ্যর শার্ট ভিজে গেল। স্পর্শিয়াকে আবারো নিজের করে পেয়ে আরাধ্য যেন দীর্ঘদিন পরে মনে শান্তির পরশ পেল। এ মূহুর্তটা হারাতে চায় না ও। আরাধ্যর ইচ্ছে করছে স্পর্শিয়াকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে যাতে সারাজীবনের জন্য ওর সাথে মিশে যায় ওর স্পর্শ, কেও যাতে ওর স্পর্শকে খুজে না পায়।

দুইমাস পর…

আরাধ্যর মনটা আজ খুব খুশি খুশি । আজ স্পর্শিয়ার ফাইনাল রিপোর্ট এসেছে, ও এখন পুরোপুরি নরমাল। ডাক্তার বলেছে যতটুকু সম্ভব ওকে হাসিখুশি রাখতে। আরাধ্যর খুব ভালো লাগছে সব শুনে। স্পর্শিয়া আগের মতো ব্যবহার করে এখন ওর সাথে। যদিও স্পর্শিয়ার মাঝে জড়তা এখনো স্পষ্ট, কিন্তু আরাধ্যর বিশ্বাস খুব শীঘ্রই স্পর্শিয়ার এ জড়তাটাও কেটে যাবে। যেহেতু স্পর্শিয়া এখন অনেকটাই সুস্থ, তাই বিয়েটা করে ফেলার প্ল্যান চলছে আরাধ্যর মাথায়। বিয়েটা একবার হয়ে যাক, স্পর্শিয়া পুরোপুরিভাবে ওর হয়ে যাবে৷ আর কিচ্ছু চাই না ওর, শুধু স্পর্শিয়াকে নিয়ে একটা সুখের সংসার চাই। অফিস থেকে বাসায় ফিরছে আর এসবই ভাবছে। আজই বাসায় গিয়ে বিয়ের ব্যাপারটা আগানোর জন্য কথা বলবে।

আরাধ্যর রুমে যাওয়ার আগেই ওর দাদার রুম পড়ে। ওর রুমে ঢোকার সময় ওর দাদার রুম থেকে কিছু কথা ওর কানে ভেসে এলো। দাদার রুমে উকি দিয়ে দেখলো সবাই তার রুমেই বসে আরাধ্যকে নিয়ে কিছু একটা আলোচনা করছে। আরাধ্য দাড়িয়ে দাড়িয়ে শুনতে লাগলো কথাগুলো ।

মিনহাজ চৌধুরী বলছেন,
– আরাধ্যকে তো বুঝাতে হবে, দুইমাস হয়ে গেল স্পর্শিয়ার সাথে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার৷ আর কতদিন এভাবে চলবে? আর কতদিন এভাবে পড়ে থাকবে আরাধ্য স্পর্শিয়ার পেছনে? এখন তো ওর লাইফে মুভ অন করা উচিত। এতোদিন স্পর্শিয়া অসুস্থ ছিল ভেবে কিছু বলিনি, আর তাছাড়া আরাধ্যও ওর প্রতি দুর্বল, কিন্তু এ দুর্বলতা নিয়ে আর কতদিন বসে থাকবে? স্পর্শিয়ার সাথে যা হয়েছে তা নিয়ে আমরা সবাই ই খুব কষ্ট পেয়েছি, আমরা সবাই ই ভালোবাসি ওকে খুব, কিন্তু তারপরেও তো এসবের পর ওকে আর আমাদের বাড়ির বউ করে আনতে পারি না।
নিজের কানকে আরাধ্য বিশ্বাস করতে পারছিল না। ওর বাবা স্পর্শিয়াকে এতটা ভালোবাসতো, আর সেই আজকে এ কথা বলছে?
মিনহাজ চৌধুরীর কথায় আরাধ্যর দাদাও সায় দিলেন।
– ঠিক বলেছিস তুই। এমন একটা মেয়েকে তো আর নাত বৌ করে আনা যায় না। স্পর্শিয়ার সাথে যা হয়েছে সেই আফসোস আমাদেরও আছে, তাই বলে তো…
আরিয়ান মুখের কথা টেনে নিয়ে বললো,
– আফসোস! কিসের আফসোস দাদু? তুমিই চিন্তা করো স্পর্শিয়ার সায়ানের সাথে রিলেশন ছিল বলেই তো আজ এমন একটা সিচুয়েশন তৈরি হয়েছে।
মিনহাজ চৌধুরী বললেন,
– হ্যা, আরিয়ান ঠিকই বলছে। আজ স্পর্শিয়ার জন্য সায়ানের ফ্যামিলির সাথে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে, ওর জন্যই আজ আমাদের আরাধ্য আমাদের চেয়ে দূরে সরে গেছে৷ ওকে বিয়ে করার জন্য কি পাগলটাই না হয়ে গিয়েছিল আরাধ্য।

সবাই কিছু না কিছু বলছে, শুধু চুপ করে আছে নিশাত চৌধুরী আর পায়েল৷ আরাধ্য জানে দুনিয়া এ পিঠ থেকে ওপিঠ হয়ে গেলেও এ দুটো মানুষ সবসময় ওর আর স্পর্শিয়ার সাথে আছে। নিশাত চৌধুরী স্পর্শিয়ার সাপোর্টে কিছু বলার সুযোগ খুজছেন।

মিনহাজ চৌধুরী আবারও বলতে লাগলেন,
– এতো কথা বাদ। আমরা আজই আরাধ্যর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবো।
আরাধ্য আর কন্ট্রোল করতে পারছে না নিজেকে। দরজার আড়াল থেকে নিজেই সবার সামনে এসে বলল,
– কি ব্যাপারে কথা বলবে আমার সাথে?
আরাধ্যকে দেখে সবাই চুপ হয়ে গিয়ে নড়েচড়ে বসলো।
আরিয়ান নিজ থেকেই বললো,
– স্পর্শিয়ার ব্যাপারে কিছু কথা ছিল তোর সাথে আমাদের।
– আমি সব শুনেছি রুমের বাইরে থেকে।
মিনহাজ চৌধুরী বললেন,
– তবে তো শুনেছিস ই সব।
– কিন্তু আমারও যে কিছু বলার আছে।
– বল৷
– স্পর্শিয়াকে যে আমি ভালোবাসি তোমরা জান না?
– স্পর্শিয়া কি করেছে তা তুই জানিস না?
– কি করেছে ও? ইচ্ছা করে নিজের রেপ করিয়েছে?

আরিয়ান গর্জে উঠলো।
– মুখ সামনে কথা বল আরাধ্য, ড্যাডের সাথে কেও এভাবে কথা বলে?
আরাধ্য মাথা নিচু করে বলল,
– সরি। আজ এতোগুলো বড় মানুষের সামনে আমার এভাবে কথা বলতে হচ্ছে। তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি সবার কাছে। আমি সবার আগে তোমাদের কাছে একটাই প্রশ্ন রাখতে চাই, প্রায় দেড় বছর যাবত স্পর্শিয়াকে চেনো তোমরা, কখনো কি ওর মধ্যে খারাপ কিছু তোমাদের নজড়ে পরেছে? বা ও কি কখনো তোমাদের সাথে কোন বেয়াদবি করেছে?
কিছু সময় চুপ থেকে সবার উত্তর ই “না” এলো।
আরিয়ান বলল,
– বেয়াদবি করেনি তো কি হয়েছে, সায়ানের সাথে রিলেশন থাকার কারণেই আজ ওর এই অবস্থা তা কি তুই অস্বীকার করিস?
– যদি আমি বলি আজ আমার জন্য স্পর্শিয়ার এই অবস্থা, ওর জীবনটা শুধুমাত্র আমার কারণে নষ্ট হয়েছে?
– কি বলতে চাচ্ছিস তুই?
– সায়ান সেদিন সবার সামনেই বলেছে ও যা কিছু করেছে আমার ওপর ওর ক্ষোভ থেকে করেছে, আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য করেছে। আমি যদি স্পর্শিয়ার লাইফে না থাকতাম তবে আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য সায়ান কখনো স্পর্শিয়ার ক্ষতি করতো না। আজ স্পর্শিয়ার এ অবস্থা শুধুমাত্র আমার কারণেই। যেই মেয়ের জীবন আমার কারণে নষ্ট হলো, আজ সেই মেয়েকেই তোমরা আপন করে নিতে চাচ্ছ না?
– আর স্পর্শিয়া যা করেছে? ওর সায়ানের সাথে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে৷ এই মেয়ে যে পরবর্তীতে আবার অন্য কোন ছেলের সাথে রিলেশন করবে না তার কি গ্যারান্টি?
– কি আজেবাজে বকছো ভাইয়া? স্পর্শিয়ার সাথে সায়ানের সম্পর্ক শেষ হওয়ার পরেই ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়। স্পর্শিয়া তো কোন কিছুই আমার কাছে লুকায়নি, ওর আর সায়ানের ব্যাপারে সবই জানতাম আমি। আর এ যুগে এসে এখনো এসব কথা বলছো? মানুষ তো একসাথে কয়েকটা সম্পর্ক করে, তারপরেও একটা সময় বিয়ে করে সংসার করে৷ আরও একটা কথা বলে রাখি, অষ্ট্রেলিয়া থাকাকালীন আমারও গার্লফ্রেন্ড ছিল। দীর্ঘ দু বছরের সম্পর্ক ছিল আমাদের। রিলেশন করাটা কি দোষের কিছু?

আরাধ্যর শেষের কথা শুনে সবার চোখ কপালে। কিন্তু আরাধ্য কথাটা মিথ্যা বলেছে। সায়ানের সাথে সম্পর্ক ছিল বলে স্পর্শিয়াকে যাতে কেও কখনো ছোট করে না দেখে সেজন্যই নিজেকে নিয়ে এ মিথ্যা কথাটা বলেছে আরাধ্য।

এতক্ষনে নিশাত চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন,
– কি বলছিস তুই? দুই বছরের সম্পর্ক ছিল মানে?
– ইয়েস আম্মু। সত্যি বলছি। আমার সিনাদা নামের এক ইন্ডিয়ান মেয়ের সাথে দু বছরের সম্পর্ক ছিল। আমাদের দুজনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো না হওয়ায় আমাদের দুজনের ব্রেক আপ হয়ে যায়। তোমরা চাইলে রোহানকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে পারো।
– কখনো আমাদের কিছু জানাসনি কেন?
– এটা সে সময়ের ঘটনা আমি যখন মাত্র ভার্সিটিতে নতুন এডমিশন নেই। সব ই জানাতাম তোমাদের সময় হলে, কিন্তু তার আগে তো সব শেষ ই হয়ে গেল। তারপরে আমি ফোকাস করলাম আমার ক্যারিয়ারে, আর দেশে ফিরে আমি পেলাম আমার স্পর্শিয়াকে৷ আরো একবার ভালোবাসা হারানোর কষ্ট আমি পেতে চাই না৷

আরাধ্যর কথা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। কে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।

আরাধ্য নিজেই আবার বলা শুরু করলো,
– এটা সেই স্পর্শিয়া যাকে কখনো তোমরা এ বাড়ির বউ না, বরং মেয়ে মনে করেছ। তোমাদের মেয়ের দুঃখের সময় আজ তোমরাই ওকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ? নিজেদের মেয়ে কষ্টে থাকলে কি কেও এভাবে দূরে সরিয়ে দেয় মেয়েকে?
নিশাত চৌধুরী আরাধ্যর সাথে যোগ দিয়ে বললেন,
– হ্যা বাবা, তুই ঠিক বলেছিস। স্পর্শিয়া আমাদের মেয়ে। আর আমাদের মেয়েকে আমরা কখনো দূরে সরিয়ে দিব না। যে যা-ই বলুক, আমি আমার মেয়েকে এ বাড়িতে নিয়ে আসবোই।

আরাধ্য ওর বাবার আর দাদার পায়ের কাছে গিয়ে বসলো। তাদের দুজনের হাত নিজের হাতে নিয়ে করুণ চোখে তাকিয়ে রইলো দুজনের দিকে। এক পর্যায়ে আরাধ্যর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আরাধ্য এমন চেহারা দেখে আরাধ্যর দাদা আর বাবা দুজনেরই মন নরম হয়ে যায়। কিছুক্ষন চুপ থেকে মিনহাজ চৌধুরী বললেন,
– বিয়ের ডেট ফিক্সড করার জন্য স্পর্শিয়ার বাসায় কবে যাওয়া যায় বল?
আরাধ্যর চোখেমুখে খুশির বন্যা বয়ে গেল, আর মনের মধ্যে প্রশান্তির ঢেউ খেলে গেল। আজ অনেকদিন পরে অন্যরকম একটা শান্তি লাগছে।

(চলবে)

লিখা: Dewan Oishi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here