প্রেম পর্ব -২৪

প্রেম 💙 (Love has no limits)

#পর্বঃ ২৪

বাসর ঘরে বসে আছে স্পর্শিয়া। বুক ঢিপঢিপ করছে ওর। ভয়ও করছে, আবার লজ্জাও লাগছে । ভয়ে এসির মধ্যেও ঘামতে শুরু করে দিয়েছে। কি করবে এখন ও? স্নিগ্ধাকে কি একটা কল দিবে? নাহ, কেমন দেখায়। স্নিগ্ধাও উল্টো আরও কতো কি বলে ফেলবে কে জানে! স্নিগ্ধা তো পারেই শুধু ওকে নিয়ে মজা নিতে ৷

স্পর্শিয়াকে রুমে রেখে গিয়েছে অনেকক্ষন হয়েছে। কিন্তু এখনো আরাধ্য আসছে না। অপেক্ষা করতে করতে স্পর্শিয়া চোখ লেগে এলো। বসে বসেই ঝুমতে শুরু করলো ও। আর যাই হোক, ঘুম কন্ট্রোল করা ওকে দিয়ে কখনো হয় না। আরাধ্য রুমে ঢুকে দেখে স্পর্শিয়া চোখ বন্ধ করে ঝুমছে। বিয়ের শাড়ি পড়ে নতুন বউ বাসর ঘরে ঘুমে ঢুলুঢুলু, এর চেয়ে মজার দৃশ্য আর কি হতে পারে? স্পর্শিয়ার গালে আরাধ্য আলতো ছোয়া দিয়ে স্পর্শিয়াকে ডাকতে লাগলো,
– স্পর্শ, এ্যাই স্পর্শ, ঘুমাচ্ছ তুমি?
স্পর্শিয়া চোখ খুললো। খুলেই খুব লজ্জায় পড়লো। এর চেয়ে তো চোখ বন্ধ করে রাখাই ভালো ছিল।
– স্পর্শ, ঘুমাচ্ছিলে তুমি?
স্পর্শিয়া চটপট উত্তর দিল,
– কই, না তো। ঘুমাবো কেন? বাসর রাতে কি কেও ঘুমায় নাকি?
– লজ্জার হাত থেকে বাচতে তুমি মিথ্যে বলছ আমি জানি৷
– না, আমি মোটেও মিথ্যে বলছি না। বাসর রাত কি ঘুমানোর জায়গা নাকি?

মুখের উপর পানির ঝাপটা পড়তেই স্পর্শিয়া ধড়ফড় করে উঠে বসলো। সামনে স্নিগ্ধা, অনন্যা, প্রিতি, আনিকা আরও সব ফ্রেন্ডরা ওর সামনে বসে হিহিহি করে হাসছে। চারপাশে নজর বুলালো স্পর্শিয়া। এটা তো বাসর ঘর না, বরং ওর নিজের রুমেই আছে ও। এতক্ষনে ওর খেয়াল এলো ওর এখনো বিয়ে হয়নি, বিয়ে তো আজ রাতে। তারমানে ও এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। নিজে নিজেই হেসে ফেললো লজ্জায়।

প্রিতি মুখ চোখা করে বলল,
– কিরে স্পর্শিয়া, এভাবে লজ্জা পাচ্ছিস কেন?
প্রিতির কথায় সবাই তাল মেলালো।
স্পর্শিয়া ঘাবড়ে গেল।
– ক…কই লজ্জা পেলাম? তোরা অযথাই যা তা বলিস।
– আমরা যা তা বলি? তুই ঘুমের মধ্যে যে বারবার বলছিলি আরাধ্য আজ বাসর রাত, বাসর রাতে কেও ঘুমায় নাকি? এ কথার মানে কি? হুম?
স্নিগ্ধা সুর টানলো।
সবাই একসাথে জোরাজুরি করলো,
– হুম, বল এবার আরাধ্যকে এ কথা কেন বলছিলি স্বপ্নে? নিশ্চয়ই আরাধ্য ঘুমাতে চেয়েছিল আর তুই নটি নটি চিন্তায় ছিলি তাই এ কথা বলছিলি ওকে।
স্পর্শিয়া চেচিয়ে উঠলো,
– আরে তোরা যা ভাবছিস তা না।
– তাহলে বল কি এমন স্বপ্ন দেখায় বিভোর ছিলি যে তোর ওপর পানি ছিটিয়ে জাগাতে হলো ঘুম থেকে ।
– আসলে… আসলে আমি স্বপ্নে দেখি যে বাসর ঘরে বসে বসে আমি ঘুমে ঝুমছিলাম। আরাধ্য আমাকে এ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করে ঘুমাচ্ছিলাম নাকি। আমি সাথে সাথে অস্বীকার করি, নয়তো লজ্জা পেতে হবে৷ তখনি বলছিলাম যে বাসর রাতে কি কেও ঘুমায় নাকি।
সবাই একসাথে জোরে হেসে উঠলো,
– ওওওও এই খবর! মাথায় তবে বাসর রাতের চিন্তা ঘুরে, সেজন্যই তো এসব স্বপ্ন দেখিস।
– মোটেও না। আমি তোদের মতো নাকি?
– আমার তো মনে হচ্ছে তুই আজ রাতে বাসর ঘরে ঘুমিয়ে পড়বি, তারই একটা অগ্রিম বার্তা স্বপ্নে পেয়ে গেছিস তুই। খবরদার ঘুমাবি না কিন্তু, নাক কাটা পড়বে।

সবাই একসাথে হৈ চৈ শুরু করে দিল, আর স্পর্শিয়াকে ঘুম থেকে বাচার টিপস দিতে লাগলো।

সবার হৈ চৈ শুনে স্পর্শিয়ার মা চলে আসলেন। সব মেয়েদেরকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন ৷ ফ্রেশ হতে বললেন সবাইকে আর পার্লারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বললেন।

আরাধ্যর বাসায়ও তোড়জোড় করে প্রস্তুতি চলছে। স্পর্শিয়ার খুব শখ ছিল ঘোড়ার গাড়ি, আর পালকি দুটোতে করেই ও শ্বশুরবাড়ি যেতে চায়। যদিও স্পর্শিয়া ওর এই শখের কথা কখনো আরাধ্যকে বলেনি, আরাধ্য জানতে পেরেছে স্নিগ্ধার কাছ থেকে। বিয়ে নিয়ে স্পর্শিয়ার কোন ইচ্ছা অপূর্ণ না থাকুক সে চেষ্টাই করছে আরাধ্য। বরযাত্রার জন্য ঘোড়ার গাড়ি, পালকি, আর গাড়ি তিনটার ব্যবস্থাই করা হয়েছে। স্পর্শিয়াকে নিয়ে আসার সময় কিছুটা রাস্তা পালকিতে করে আনা হবে, আর বাকি রাস্তাটুকু ঘোড়ার গাড়িতে, আর বরযাত্রীরা সবাই প্রাইভেট কার, মাইক্রোতে করে ফেরত আসবে। এতো জাকজমক করে স্পর্শিয়াকে বরযাত্রা নিয়ে যাবে এ সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি ওকে। আরাধ্য স্পর্শিয়াকে সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছে, যাতে বিদায়ের মতো কষ্টের মূহুর্তেও স্পর্শিয়া একটু সুখকর অনুভূতি পায়।

আরাধ্যর এক অন্যরকম ফিলিংস হচ্ছে আজ। ভালোবাসা, ভয়, লজ্জা, সব অনুভূতি একসাথে হচ্ছে আজ ওর । আগে তো কখনো এমন ফিল হয়নি ওর। স্পর্শিয়াকে আজ ও নিজের করে পাবে, সারাজীবনের জন্য স্পর্শিয়া আজ ওর হয়ে যাবে ভাবতেই মনটা আনন্দে নেচে উঠছে। মুখে হাসির রেখা দেখা দিচ্ছে বারবার ।

ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। স্পর্শিয়ার কল।
– হ্যালো মাই ডিয়ার উড বি ওয়াইফ।
– আই লাভ ইউ।
– ওরে বাবা! মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। ভেবেছিলাম সারাদিন ব্যস্ত থাকবে আজ, অথচ সাত সকালেই তোমার কল পেলাম, সাথে আবার আই লাভ ইউ ফ্রি তে।
– হ্যা, কারণ আজ রাত থেকে আই লাভ ইউ শুনবে ওয়াইফের মুখে, তখন তো আর এই ফিল টা পাবে না। তখন মিস করবে প্রেমিকার আই লাভ ইউ বলাকে।
– প্রেমিকা?
– দুই মাস প্রেম করেও কি আমাকে প্রেমিকা বলতে চাচ্ছো না?
– হ্যা, অবশ্যই চাই। কিন্তু প্রেমিকাকে মিস করলেও বিয়ের পরে ভালোই হবে। যখন ইচ্ছে হবে তখনি আই লাভ ইউ শুনতে পারবো, আর আদরও করতে পারবো যখন তখন।
– কথায় লাগাম দাও। দিন দিন দুষ্টু হয়ে যাচ্ছ। ভালো কথা তো বের ই হয়না মুখ দিয়ে।
– দুষ্টুমির দেখলে কি? দুষ্টুর বই তো আজ রাতে খোলা হবে।
স্পর্শিয়ার কোন পালটা জবাব না পেয়ে আরাধ্য বলল,
– লজ্জা পেয়ে গেলে নাকি স্পর্শ? এখনি এতো লজ্জা পেলে কি করে হবে? রাতের জন্য একটু রেখে দাও।
– আরাধ্য, আমি কিন্তু ফোন রেখে দিব।
– না, প্লিজ ফোন রেখো না। আমি তো মজা করছিলাম সোনা। আচ্ছা, আগে বলো গতকাল হলুদে এতো নাচানাচি করার পরেও আজ এই সময় ঘুম ভাঙলো কি করে তোমার?
– আমি কি তোমার মতো নাকি যে সারাদিন নাক ডেকে ঘুমাই?
– এই যে মিস. ঘুমন্তী, আমি আরও দু ঘন্টা আগে উঠেছি ঘুম থেকে।
– মিথ্যে কথা।
– আরাধ্য মিথ্যা বলে না।
– বলে। অবশ্যই বলে।
– না, বলে না।
– আমার মুখের উপর কথা? চান্দু, বিয়েটা হয়ে নেক, তোর একদিন কি আমার যতদিন লাগে।
দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে দিল।
– আচ্ছা স্পর্শ, পার্লারে কখন যাবে?
– ঘন্টাখানেক পর।
– একটা রিকুয়েষ্ট আছে।
– কি, বলো।
– রেডি হওয়ার পর কয়েকটা ছবি তুলে সাথে সাথে আমাকে সেন্ড করবে। আমি চাই আমার বউটাকে সবার আগে যেন আমিই দেখি, অন্য কেও না।
– এটা কি করে সম্ভব? যারা আমাকে সাজাবে তারা তো আমাকে দেখেই ফেলবে।
– ধুর বোকা মেয়ে। যারা তোমার সাথে থাকবে তারা তো তোমাকে দেখবেই। ভেন্যুতে কেও যাতে না দেখে, তার আগে আমি দেখতে চাই।
– ওকে ডান। তোমারও অনেক কাজ আছে, ফোন রাখ এবার।
.
.
.
.
.
.
.

আরাধ্য এখন বরবেশে পুরোপুরি তৈরি। কালো শেরওয়ানিতে সোনার সুতায় কাজ করা, মাথায় লাল পাগড়ি, গলায় মুক্তার হার, সাথে তলোয়ার। কোন রাজপুত্রই মনে হচ্ছে আরাধ্যকে আজ। সবার কাছ থেকে দোয়া নিচ্ছে আরাধ্য। ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসেছে এমন সময় স্পর্শিয়া ছবি সেন্ড করেছে। আরাধ্য তো খুব খুশি। ঠিক ওর মনের মতোই সেজেছে স্পর্শিয়া। সাথে সাথে স্পর্শিয়ার কলও এলো।
– হ্যালো স্পর্শ।
– কেমন লাগছে আমাকে?
– মাই স্পর্শ ইজ বেস্ট।
– মি. চৌধুরী, বিয়ের আগে এটাই আমাদের শেষ কথা।
– অপেক্ষা করো, শীঘ্রই আসছি তোমাকে নিতে।
– আচ্ছা, তবে ফোনটা রাখি এখন। আমি মাত্র বের হয়েছি পার্লার থেকে। বরযাত্রা যাওয়ার আগেই ভেন্যুতে পৌঁছে যাব আমি।
– আই লাভ ইউ মাই উড বি ওয়াইফ।
– আই লাভ ইউ টু মাই উড বি হাজবেন্ড।

এটাই ছিল স্পর্শিয়ার সাথে আরাধ্যর শেষ কথা, তারপর থেকে স্পর্শিয়ার আর কোন খোজ নেই।

.
.
.
.
.
.
.
.
.
কয়েক ঘন্টা পর…

সবাই চিন্তিত। কি থেকে কি হয়ে গেল কেওই কিছু বুঝতে পারছে না। আরাধ্যর চোখ বেয়ে গড়গড়িয়ে পানি পড়ছে। যেখানে আজ ওদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সেখানে এমন কিছু হবে এটা তো কেও চিন্তাও করেনি।

বরযাত্রা আসার পরে অনেক দেরি হয়ে গেলেও স্পর্শিয়া পার্লার থেকে বাসায় ফেরেনি। এমনকি স্পর্শিয়া, স্নিগ্ধা, অনন্যাকে বারবার কল করার পরেও ফোন বন্ধ পায় সবাই। চিন্তার আর কোন সীমা থাকে না সবার। স্পর্শিয়ার শরীরে এতো গহনা ছিল, রাস্তাঘাটে কখন কি হয় তা বলা যায় না। সবাই তা নিয়েই চিন্তিত ছিল। বরযাত্রারাও সবাই কানাঘুষা করছিল বর চলে আসার পরেও বউ না ফেরাতে।

কিছু সময়ের মধ্যেই স্নিগ্ধা আর অনন্যা বাসায় আসে। ওদের দুইজনকে দেখে সবার চেহারা শুকিয়ে যায়। দুইজনকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোন যুদ্ধ করে এসেছে। এতো মেহমানের সামনে কিছু না বলে দ্রুত ওদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। স্পর্শিয়ার কথা জিজ্ঞেস করাতে ওরা যে জবাব দিল তার জন্য কেওই প্রস্তুত ছিল না। নিরিবিলি একটা রাস্তায় আসতেই হঠাৎ করে ওদের গাড়ির সামনে কালো রঙের একটা মাইক্রো এসে থামে। মাইক্রো থেকে চারজন ছেলে বের হয়। সবার মুখ বাধা ছিল। ছেলেগুলো রাস্তা আটকানোতে ড্রাইভার বের হয়ে ছেলেগুলোকে বকাবকি করতে থাকে। ছেলেগুলো ড্রাইভারকে বেধড়ক মারধর করে। আর স্পর্শিয়াকে গাড়ি থেকে টেনে হিচড়ে বের করে। স্নিগ্ধা, অনন্যা ছেলেগুলোকে থামাতে চাইলে ওদেরও ছেলেগুলো থাপ্পড় মারে, আর ওদের ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ওদের গাড়িতে লক করে ছেলেগুলো স্পর্শিয়াকে মাইক্রোতে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

এখন রাত ১ টা বাজে৷ স্পর্শিয়ার কোন খবর নেই। সবাই বাড়ি ফিরে এসেছে। বউ আসতে দেরি হওয়ায় ভেন্যুতে থাকা অবস্থায় মেহমানদের মধ্যে একজন স্পর্শিয়ার ক্যারেক্টার নিয়ে খারাপ কথা বলে ফেলে। আরাধ্য মারামারি শুরু করে দেয় তার সাথে। তার পরপরই গেস্টরা সবাই চলে যায়। কয়েক জায়গা থেকে পুলিশ ফোর্স বের হয়েছে স্পর্শিয়াকে খোজার জন্য। কিন্তু এখনো কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না স্পর্শিয়ার।

স্পর্শিয়ার কিডন্যাপিং এর কথা শোনার পর সবার আগেই আরাধ্যর মাথায় সায়ানের কথা আসে। সায়ান স্পর্শিয়াকে কিছু করেনি তো? কিন্তু ও মনস্থির করতে পারেনি। গত কয়েকদিনে সায়ান বেশ কয়েকবার আরাধ্য আর স্পর্শিয়ার কাছে মাফ চেয়েছে। ওদের সম্পর্কটা এখন নরমাল। আর সায়ান মন থেকে স্পর্শিয়াকে নিজের ভাইয়ের বউ হিসেবে মেনে নিয়েছে। এমন অবস্থায় সায়ানকে সন্দেহ করা সাজে না। তাছাড়া এতো বড় একটা ঘটনা ঘটানোর সাহস সায়ানের নিশ্চয়ই নেই। সায়ান তো নিজেই আরাধ্যর সামনে ছিল, আর ওকে টেনশনেও লাগছিল, এমন অবস্থায় সায়ানের দিকে আরাধ্য আঙুল তুলতোই বা কি করে? তাছাড়া সায়ানকে এ ব্যাপারে কিছু বললে ওর আর স্পর্শিয়ার সম্পর্কের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেত সবার সামনে যা আরাধ্য কখনোই চায় না।

এক কোণায় বসে আছে আরাধ্য। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না । একটু পর পরই পুলিশ ফোর্সদের কাছে ফোন দিচ্ছে আপডেট জানার জন্য। কিন্তু কেওই কোন ইনফরমেশন দিতে পারছে না স্পর্শিয়ার ব্যাপারে। উল্টো তারা বলছে যদি টাকার জন্য কিডন্যাপ করা হয় তবে কিডন্যাপারের কল আসবে। সবার মনে এখন একটাই আসা, কিডন্যাপারের কল যেন অন্তত আসে। আরাধ্যর ফ্যামিলির অনেকেই অনেক কিছু বলতে চাইলেও আরাধ্যর ভয়ে কেও কিছু বলতে পারছে না। তাদের মনে বিরাট খটকা লেগে আছে যে স্পর্শিয়াকে কেও কিডন্যাপ করবেই বা কেন? কোন দোষ না থাকলে তো একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করে না কেও। আর কিডন্যাপ হলেও ওকে সেফ পাওয়া যাবে কি না সেটাও তো কথা। এতগুলো মানুষের সামনে দুই ফ্যামিলিরই সম্মানহানি হলো তারই বা কি হবে?

হঠাৎ রোহান সায়ানকে টানতে টানতে গজগজ করে হল রুমে ঢুকলো। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক। কেও কেও চেচিয়ে উঠলো। রোহান আরাধ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
– আরাধ্য, স্পর্শিয়াকে আর কেও না বরং সায়ান কিডন্যাপ করিয়েছে ৷ আমি বাগান ক্রস করে যাচ্ছিলাম তখন ওকে ফোনে কথা বলতে শুনেছি।

সবার যেন বিস্ময়ের সীমা রইলো না। সবাই সবার দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে। রোহান এমন একটা কথা কেন বললো? আর সায়ান ই বা নিজের ভাইয়ের বউকে বিয়ের দিন কিডন্যাপ কেন করাবে? কেও কিছু বলতে পারবে তার আগেই আরাধ্য ছুটে গিয়ে সায়ানের মুখে, পেটে কয়েকটা কিল ঘুষি বসিয়ে দিল৷ সায়ান চেচিয়ে বারবার বলতে লাগলো ,
– আমাকে মারছো কেন ভাইয়া?

সবাই আরাধ্যকে সায়ানের কাছ থেকে টেনে নিয়ে আসলো। আরাধ্যর রক্তচক্ষু সায়ানকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে। আরাধ্যর ইচ্ছে করছে এক্ষুনি সায়ানকে মেরে ফেলতে। শান্ত বাড়িটা নিমিষেই হৈ চৈ এ গমগম করতে লাগলো।
আরাধ্যর এ রুপ কেওই আগে কখনো দেখেনি। ও এরকম ব্যবহার করতে পারে তা কখনো কেও চিন্তাও করেনি। তাই ওর এ রুপ সবার মনেই কিছুটা ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে।

আরাধ্য ঝাঝালো গলায় সায়ানকে জিজ্ঞেস করলো,
– বল, আমার স্পর্শ কোথায়? কোথায় রেখেছিস ওকে?
– আমি কিচ্ছু জানিনা ভাইয়া। আমি কেন স্পর্শিয়াকে কিডন্যাপ করাবো?
আরাধ্য জোরে চেচিয়ে উঠলো,
– মিথ্যা বলছিস তুই। আমি জানি তুই ই কিছু করেছিস। রোহান নিজের কানে শুনেছে।
– রোহান ভাইয়া মিথ্যা বলছে ভাইয়া। আমি স্পর্শিয়াকে কিডন্যাপ করাইনি ।
– আবারো মিথ্যা?
– আমি সত্যি বলছি। আমার তো মনে হয় রোহান ভাইয়াই স্পর্শিয়ার সাথে কিছু একটা করেছে । আমি অনেকবার রোহান ভাইয়াকে স্পর্শিয়ার দিকে খারাপ নজর দিতে দেখেছি। রোহান ভাইয়া তোমার সামনে ভালো মানুষির মুখোশ পরে থাকলেও বাস্তবে উনি একটা পশু৷

রোহান সব শুনেও চুপ করে থাকলেও আরাধ্য রোহানের ব্যাপারে এসব শুনে চুপ থাকতে পারলো না। দ্রুত সায়ানের কাছে গিয়ে ওর গালে দুটো চড় বসিয়ে দিল। সায়ানের কলার ধরে বলল,
– কার সম্পর্কে কি বলছিস কোন আইডিয়া আছে তোর? নিজের দোষ ঢাকার জন্য রোহানের ওপর দোষ দিচ্ছিস?
পেছন থেকে আরাধ্য আর সায়ানের বাবা দুজনেই ওকে ধরে থামিয়ে দিল। সবার একই প্রশ্ন সায়ান স্পর্শিয়াকে কিডন্যাপ কেন করবে, হয়তো রোহান ভুল শুনেছে। এবার আরাধ্য আর চুপ করে থাকতে পারলো না। সবাইকে স্পর্শিয়া আর সায়ানের সম্পর্কের ব্যাপারে সবকিছু জানিয়ে দিল ও নিজেই।

আরাধ্যর কথা শুনে কেওই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। সায়ান আর স্পর্শিয়ার সম্পর্ক ছিল এ কথাটা কারও ই যেন হজম হচ্ছে না। স্পর্শিয়া এইটুকুন একটা মেয়ে, ওর সায়ানের সাথে সম্পর্ক কি করে থাকতে পারে?

নিশাত চৌধুরী কেদে কেদে আরাধ্যকে বললেন,
– বাবা, এতো কিছু হয়ে গেল আর তুই আমাদের কাওকে কিছুই জানানো প্রয়োজন মনে করলি না?
আরাধ্য চেচিয়ে বলল,
– এখন এসব কথা বলার সময় না মা। তোমার আদরের ভাগ্নেকে জিজ্ঞেস করো আমার স্পর্শ কোথায়?
একমূহুর্ত দেরি না করে আরাধ্য আবারো সায়ানের শার্টের কলার চেপে ধরে ওর পেটে ঘুষি দিল৷
– সত্যি করে বল কি করেছিস আমার স্পর্শকে? নয়তো তোকে মেরে ফেলবো এক্ষুনি।
সায়ানে নরম মুখ এতক্ষনে শক্ত হলো। ও আরাধ্যকে ঝাড়া দিয়ে বলল,
– হ্যা, মেরে ফেল। ভাইয়া ভাইয়া করে ডাকতে ডাকতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। তুই আমার ভাই না, শুত্রু। ছোটবেলা থেকে সবার কাছে তোর গুনকীর্তন ই তো শুনে আসছি। সবার মুখেই শুধু আরাধ্য ইজ বেস্ট, সায়ান তো যেন কোন মানুষ ই না। আমার তো অনেক আগে থেকেই ক্ষোভ তোর উপর। আমি তো সুযোগ খুজতাম সবসময়ই তোকে কষ্ট দেওয়ার। কিন্তু এতো সুন্দর একটা সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিয়ে দিবে তা আমি কখনো কল্পনাও করিনি। তুই ভালোবাসলি তো বাসলি কাকে, যেই মেয়ে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে তাকে। এ্যাঙ্গেজমেন্টও করে ফেললি। যখন স্পর্শিয়ার ছবি আমাকে দেখিয়েছিলি তখন ইচ্ছে করেই তোকে কিছু বলিনি। সেই মূহুর্তেই আমার মনে হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা আমাকে কতো সুন্দর একটা সুযোগ করে দিয়েছে তোকে কষ্ট দেওয়ার। আমার প্ল্যান অনুযায়ী আমি ঠিক এক বছর পর দেশে ফিরে আসি। এইটুকু আমার বিশ্বাস ছিল, স্পর্শিয়া যে পরিমান পাগলামি আমার জন্য করেছে, যতটুকু আমাকে ভালোবেসেছে আমি ওকে আমার জালে আবারও ফাসাতে পারবো। ঠিক তা ই হলো। স্পর্শিয়া দ্বিধায় পড়ে গেল ও তোকে চুজ করবে নাকি আমাকে। একপর্যায়ে ও তোকে ছেড়েও দিলো। কিন্তু তার সাথে আমাকেও ছেড়ে দিল। ওর নাকি ততদিনে রিয়েলাইজ হয়েছে যে ও তোকেই ভালোবাসে, আমাকে ও আর চায় না। কত চেষ্টা করেছিলাম ওকে আমার কাছে ফেরানোর, কিন্তু পারলাম না। আমার ইচ্ছে ছিল স্পর্শিয়াকে আমার জালে ফাসিয়ে তোদের বিয়ে ভেঙে দিতাম, আর তার কিছুদিন পর আমি নিজেও স্পর্শিয়াকে ছেড়ে দিতাম। এর ফলে স্পর্শিয়াকে না পেয়ে ধুকে ধুকে মরতি তুই। তোর চোখে স্পর্শিয়া সবসময় কালপ্রিট হয়ে থাকতো। কিন্তু তা আর হলো কই? স্পর্শিয়া তোর ই রয়ে গেল। এত সহজে আমি সব কিছু ঠিক হতে দিতামই বা কি করে? তাই আবারো প্ল্যান করলাম তোর সুখ তোর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার। আর আজকের দিনটাকেই সিলেক্ট করলাম স্পর্শিয়াকে কিডন্যাপ করার জন্য।

সায়ানের মা এসে এবার ওর গালে জোরে চড় বসিয়ে দিলেন।
– আমার ছেলে হয়ে এমন কাজ করবি তুই, আমি ভাবতেও পারিনি৷ ছিঃ! ঘৃণা হচ্ছে তোর প্রতি আমার।
– সবসময় তো আরাধ্যকেই বেশি ভালোবেসেছ তুমি। আমি তোমার ছেলে ছিলামই বা কবে? আজীবন তো শুধু আমার দোষটাই দেখেছ তুমি। এখনো দেখছো। আমি যে আরাধ্যর জন্য সবসময় তোমাদের কাছে ছোট হয়ে থেকেছি সেটা একবারও ভাবলে না?

আরাধ্যর মুখ চোখ লাল হয়ে আছে। ভেতরে রাগ থাকা সত্ত্বেও সায়ানের দিকে ফিরে আরাধ্য নরম গলায় বললো,
– ভাই, তোর যত শুত্রুতা সব আমার সাথে। বলে দে আমার স্পর্শ কোথায়?
সায়ানও দ্রুত বলে দিল,
– আমাদের পুরনো ফাম হাউজে।
আরাধ্য দ্রুত চলে যেতে নিচ্ছিল কিন্তু সায়ান আরাধ্যকে হাত দিয়ে থামিয়ে দিল।
– যাচ্ছিস কোথায় আরাধ্য? সেখানে আর আছেই কি?
আরাধ্য কিছু বুঝতে না পেরে কপাল কুচকে সায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সায়ান হো হো হো করে ঘর কাপিয়ে হাসতে লাগলো।
– আরাধ্য, আমাকে কি তোর এতই বোকা মনে হয়? স্পর্শিয়াকে কিডন্যাপ করালে আজ না হোক কাল তুই ওকে বিয়ে করবি তা তো আমি জানি। তাই, আমি আমার ফ্রেন্ডদের দিয়ে ওর কিডন্যাপ করিয়েছি। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, আই হ্যাভ টোল্ড দেম টু রেইপ ইউর স্পর্শিয়া।

সায়ানের শেষের কথাটা যেন আরাধ্যর কানে বারবার বাজতে লাগলো। তার সাথে বাকি সবারও যেন কানে তাক লেগে গেছে। আরাধ্য সায়ানকেও কিছু বললো না, কারও দিকে এক নজর তাকালোও না। দ্রুত বের হয়ে গেল সায়ানদের পুরনো ফাম হাউজের উদ্দেশ্যে।

(চলবে)

লিখা: Dewan Oishi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here