প্রেম প্রিয়জন পর্ব ৩

#প্রেম__প্রিয়জন🌸
#Writer_Sumaiya_Karim

~তৃতীয় পর্ব~

আমি আল্লাহ বলে চিৎকার দেয়ায় জেঠি আরো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন। হিংস্র চোখে যেনো আগুনের ফুলকি ঝরছে।

–‘দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে! তোর ছায়া ও যেনো না দেখি!’

চোখের পানি চুক্ষুকোটর জুড়ে টইটম্বুর হয়ে আছে। সামনের পথ টাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না। সব অস্পষ্ট! এলোমেলো পায়ে অগ্রসর হতে থাকলাম সামনের দিকে। পথ আটকে দাঁড়ালো পুষ্পা। ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে আমার দিকে একবার স্ব-নজরে তাকিয়ে ভেঙ্গচি মেরে বললো,

–‘হুহ ঢং!’

হাত টা কে যেনো গরম উত্তপ্ত আগুনের উপর ধরে রেখেছি। আর সেই আগুনে হাতের ভেতরের মাংস পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এক্ষুনি যেনো সিদ্ধ হওয়া হাতের মাংস গুলা ঝড়ে পড়া শুরু করবে। এক পর্যায়ে দৌড়ে ফ্রিজের সামনে যাই। বরফ রাখার ছোট বক্স টা হাতে নিতেই পুষ্পা সেটি আমার থেকে ছোঁ মেরে কেড়ে নেয়। না পারতে বললাম,

–‘প্লিজ ওটা আমাকে দাও। হাত টা ভীষণ জ্বলছে!’

–‘আমার সামনে এসব ন্যাকামো বন্ধ কর। আমার বরফ দরকার আছে। আমি নিয়ে গেলাম। তোর এতোই দরকার হলে ফ্রিজের মধ্যে ঢুকে বসে থাক! যত্তসব ফালতু!’

অসহায় কাতর চোখ দুটো দিয়ে শুধু চেয়ে থাকলাম। শক্তি কুলালো না ওর থেকে বরফ খন্ড গুলো কেড়ে নেই। আর বলি ‘তোমার থেকে আমার দরকার বেশি!’ রুমে চলে আসলাম। ফ্যান টা ফুল স্পিডে ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ি। তবুও যেনো জ্বলা বন্ধ হচ্ছে না। কি করবো বুঝতে ও পারছি না। দৌড়ে যাই ওয়াশরুমে ট্যাপ টা ছেড়ে দিয়ে হাত টার উপর পানি দিতে থাকি। এতো অসহ্য ব্যথা হৃদয় টাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে বারংবার! অন্তরে স্মরন হচ্ছে একটা কথা ‘আমার মা বাবা থাকলে হয়তো আজ আমাকে এভাবে অত্যাচার করতে পারতো না!’ পরক্ষণেই মনে পড়লো আমি তো এতিম। বুক টা অসহনীয় এক ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। পূর্বের ন্যায় ফ্লোরে এসে বসে হাটু তে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকি। চাপা কান্না! যার অর্থ বহুল কিন্তু আওয়াজ নেই। মাথা উঠিয়ে একবার হাত টার দিকে তাকিয়ে দেখি লাল বর্ণ ধারণ করে আছে। থেমে থেমে যেনো জ্বলছে। ফুঁ দেওয়ার চেষ্টা করি জ্বলা তাও কমে না। চোখের পানি ও বন্ধ হয় না। বড্ড আজব সব! কষ্ট পেলেই কি চোখের পানি আসতে হবে? জানতে বড় ইচ্ছে হয় আমার জীবনে কি এই কান্না ছাড়া আর কিছুই লেখা নাই? এই অসময়ে প্রিয়জনের তালিকায় নাম উঠিয়ে নেওয়া একজনের কথা খুব মনে পড়ছে। নিরা! হ্যাঁ ও আমার প্রিয়জন। শত দুঃখ কষ্টের সঙ্গী। আজ সেও আমার পাশে নাই। হোস্টেলেই রেখে এসেছি ওকে! আচ্ছা ও কি আমার কষ্ট টের পাচ্ছে? কষ্ট পেলেই কি মানুষ প্রিয়জন দের হাতড়ে বেড়াতে থাকে? তাহলে সর্বপ্রথম বাবা মা কে কেন খুঁজছি আমি? উনারা তো আমার কেউ না! প্রিয়জন না ঘোর অপছন্দের মানুষ তারা। আজ আমার এই দুঃখ দুর্দশা ও শুধু মাত্র ঐ দুজন মানুষের জন্য। উনারা আমার মাথার উপর ছায়া হওয়ার বদলে আগুনের দিকে ঠেলে দিলেন আমাকে। কক্ষনো ক্ষমা করবো না আপনাদের! কক্ষনো না!
.
–‘পরি এই পরি? পরি কথা বল! ঠিক আছিস তুই? ফ্লোরে বসে বসে কেউ ঘুমায়? কি হলো শুনতে পারছিস আমার কথা!’

আচমকা কেউ আমাকে ডাকছে শুনতে পেয়ে ভয় পেয়ে হকচকিয়ে চোখ খুলে তাকাই। চোখের সামনে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন পূর্ণ ভাই। ভয় পেয়েছি কিছুটা। নিজের দৃষ্টিকে ফিরিয়ে নিই। কোনো জবাব দিলাম।

–‘কি হয়েছে তোর? কেঁদেছিলি কেন?’

দু হাত চেপে ধরে উত্তেজিত কন্ঠে কথা টা বলে পূর্ণ ভাই। গরম পানি পড়া হাত টার উপর উনার হাতের ছোঁয়া হালকা পড়তেই ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে ‘আহ’ বলে শব্দ করে উঠি। এতে করে উনি যেনো আরো ঘাবড়ে যান আর তড়িঘড়ি করে আমার হাত ছেড়ে দেয়।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে পা বাড়ালেই পূর্ণ ভাই আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।

–‘কোথায় যাচ্ছিস?’

–‘আ-মা-র কা-জ আছে!’

–‘হাত টা দেখা!’

কঠিন কন্ঠস্বর শুনে যেনো ভয়ে কাঁপছি। হাত টা আস্তে করে পেছনে সরিয়ে নিই। কি উত্তর দিবো ভেবে পাচ্ছিনা।

–‘হাত টা দেখাতে বলছি আমি!’

চিল্লিয়ে বলায় ভয় পেয়ে যাই। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

–‘ক-কেন?’

–‘তুই না দেখালে আমি দেখতে পারবো না এমন কিছুই না। আমি ই দেখছি!’

পূর্ণ ভাই হাত টা সামনের দিকে নিয়ে আসেন। নিজের সব শক্তি যেনো উবে গেলো।

–‘কি অবস্থা করেছিস হাত টার?’

জোড়ে বলায় চোখ বড় বড় করে হাত টার দিকে তাকিয়ে দেখি লাল টুকটুকে হয়ে হাতে ফোঁসকা পড়ে গেছে।

পূর্ণ ভাই খুন রাগি। সত্যি কথা টা যদি বলি তাহলে এই বাসায় কিছুক্ষণের মধ্যেই তান্ডব শুরু হয়ে যাবে। তাই বললাম,

–‘ক-কই কি-কিছু না তো। এমনি! আমি যাই!’

সামনে পা বাড়াতেই বাম হাত টা টেনে ধরে রুম থেকে নিচে নিয়ে আসতে লাগলেন।

–‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছন আমাকে?’

কথা কানেই তুললো না। নিচে গিয়ে সবাই কে উচ্চস্বরে ডাকতে শুরু করকেন। জেঠি আর পুষ্পা কোথা থেকে দৌড়ে আসলো।

–‘ওর হাতের এই অবস্থা কে করেছে?’

সবাই চুপ। আমি রিতিমত ভয়ে ঘামছি। এতোটা রেগে গেছেন যে উনার চেহারা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।

–‘কি হলো আমার কথা কারো কানে যাচ্ছে না!’

জেঠি মার দিকে তাকিয়ে দেখলাম চোখ গরম করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। মুখে কিছু প্রকাশ করতে পারছেন না এই যা! সত্যি বলার সাহস নাই। তার উপর আমার জন্য উনাদের মা ছেলের মধ্যে খারাপ কিছু হোক চাই না। তাই ডাহা মিথ্যা একটা কথা বলে দিলাম!

–‘আসলে পূর্ণ ভাই আমার জন্য ই এমন হয়েছে। অসাবধানতা বশত চা ঢালতে গিয়ে হাতের উপর পরে গেছে!’

আড়চোখে জেঠি আর পুষ্পা কে দেখলাম হাফ ছেড়ে বাঁচলেন মনে হলো। এবার জেঠি গর্জে বললেন,

–‘এখানে এতো চিৎকার করার কি আছে পূর্ণ? তোর কি মনে হয় আমি বা পুষ্প ওর সাথে এমন করেছি?’

হা হয়ে গেলাম জেঠির কথা শুনে। মানুষের এতো রূপ কই থাকে? এতো সাধু-ই বা মানুষ কি করে সাজতে পারে?

–‘তোমারা না করলে দেখো নি যে ওর হাত পুড়ে গেছে। বলো নি কেন আমাকে?’

পুষ্পা বললো,

–‘আমরা দেখি নি!’

জেঠি বললেন,

–‘পরির জন্য তুই আমাদের উপর চেঁচাচ্ছিস কেন? এমন ভান করছিস যেনো ব্যথা তোর!’

–‘পরির জায়গায় পুষ্পা হলে সেবা যত্নের কম পড়তো না। পরির ব্যপারে তো তার এক চুল ও দেখছি না।’

–‘পূর্ণ!’

–‘গলা উঁচিয়ে কথা বলো না মা। তোমার সাথে ঠিক যায় না!’

আমি পুরো সময় চুপ করে মা ছেলের কথা শুনছি। শেষ কথা টা বলেই পূর্ণ ভাই কোথায় যেনো চলে গেলো। জেঠির দিকে তাকিয়ে দেখি উনি দাঁতে দাঁত চেপে আমার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই পুষ্পা উনার হাত টা খপ করে ধরে ফেললো। দমে যায় উনি। আর মা মেয়ে রেগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে চলে যায় ওখান থেকে।

শেষের কথা টার কোনো অর্থ খুঁজে পেলাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পূর্ণ ভাই ফিরে আসে। পূর্বের ন্যায় আবার আমাকে টেনে নিয়ে যায় উনার রুমে। ঠাস করে দরজা টা বন্ধ করে দেয়। দরজা কেন বন্ধ করলো? ভয়ে ভয়ে যে মুখ ফুটে প্রশ্ন করবো তার সাহস নাই। এতো ভিতু কেন আমি নিজেও জানিনা। রুম টার মধ্যে মাতাল করা এক স্মেল বাতাসে দোল খেয়ে যাচ্ছে। সেই স্মেল নাকে আসতেই যেনো মাতাল মাতাল লাগছে নিজেকে। এতো সুন্দর সুবাস টা। খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এই নিয়ে তৃতীয় বার আসলাম পূর্ণ ভাইয়ের রুমে। কারণ উনি উনার রুমে কারো আসা পছন্দ করেন না। সব কিছু খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো। শুনেছি ছেলেদের রুম গুলো অগোছালো পরে থাকে। কিন্তু এখন দেখছি আমার ধারণা ভুল। ভাবতে ভাবতে পূর্ণ ভাই আমাকে টেনে উনায় পাশেই বসান। কয়েক হাত দূরত্ব আমাদের মাঝে।

হাত পা অজান্তেই কাঁপছে। উনার শরীর থেকেও সেইম স্মেল টা বেরোচ্ছে। বলতে ইচ্ছে করছে,

–‘এটা কি সেন্টের ঘ্রাণ? অনেক দামী তাই না? আমার তো খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে! আচ্ছা বোতলের গায়ে কি কোথাও লেখা আছে এটা খাওয়া নিষিদ্ধ?’

চোখ দুটো বন্ধ করে স্মেল টা শুঁকে নিচ্ছিলাম আর মনে মনে এসব ভাবছি। ঝট করে হাত ধরায় কিছু টা কেঁপে উঠি। পূর্ণ ভাই সযত্নে কিছু একটা হাতের ক্ষত স্থানে আলতো করে লাগিয়ে দিলেন। মলম হবে খুব সম্ভবত। টাচ্ করায় হালকা ব্যথা লাগে আর আমি হাত টা সরিয়ে নিই!

–‘বেশি ব্যথা করে হাত টা?’

–‘উহুঁ!’

–‘একটা চড় মেরে ৩২ টা দাঁত ফেলে দিবো। ব্যথা না করলে হাত সরিয়ে নিস কেন বারবার?’

ধমক খেয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে মন চাচ্ছে। কারণ হচ্ছে আমার এখনো বত্রিশ টা দাঁত উঠে নি ফেলবে কই থেকে? চুপ করে থাকা ছাড়া উপাই নেই। ব্যথা দাঁত চেপে সহ্য করবো তাও হাত সরাবো না নাহলে দাঁত যে কয়টা আছে ঐ টাও অকালে হারিয়ে বসবো!

যখন ঔষধ লাগিয়ে দেওয়া শেষ হলো আমি বললাম,

–‘আমি যাই?’

কোনো উত্তর নেই দেখে পা টিপে টিপে চলে যেতে থাকলাম।

–‘আমি যেতে বলেছি তোকে?’

রাগী কন্ঠে এই কথাটা শুনে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে ঐ জায়গায় ই দাঁড়িয়ে পড়ি। চলে যাওয়া খুব দরকার কারণ এমনিতেই হয়তো পূর্ণ ভাইয়ের ব্যবহারে জেঠি আর পুষ্পা কি না কি ভাবছেন। তার উপর এখন পূর্ণ ভাই দরজা ও বন্ধ করে দিয়েছেন। এসব উনারা দেখলে কি ভাববেন! ছিঃ ছিঃ!

পূর্ণ ভাই এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি উনার সামনে। আর সামনে এগুতে পারবো না কখন জানি ঠ্যাং ও ভেঙ্গে দেয়। এনার কোনো বিশ্বাস নেই!

–‘এদিকে তাকা!’

–‘মানে!’

নিচের দিকে তাকিয়েই বললাম কারণ উনার কথা বুঝতে বিন্দু পরিমান সমস্যা হলো!

–‘বাংলায় বলেছি হিন্দি তে না!’

আমার কোনো উত্তর না পেয়ে আবারো বললেন,

–‘ফ্লোরে আঙ্গুল ঘষলে ফ্লোর ফাঁকা হাতে যাবে না। এদিকে তাকাতে বলেছি তাকা!’

ভয়ে ভয়ে চোখ উঠিয়ে উনার দিকে একটু তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলাম। এই চোখের দিকে চোখ রাখার সেই অঘাত সাহস টা আমার মতো ভিতু রানীর মধ্যে নেই।

দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই হুট করে পূর্ণ ভাই আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। নিশ্বাস যেনো হঠাৎ ই থমকে গেলো। বরফের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। মাতাল করা স্মেল টা নাকের সামনে মৌমাছির মতো ভো ভো করতে থাকলো। মানুষ টার সামনে দাঁড়াতেই ভয় হয়! ভয় হয় চোখে চোখ রাখতে! সেখানে উনি আমার মতো কাছে যে উনার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি আমি। আর গুনতে পারছি উনার গরম নিশ্বাস প্রশ্বাস। মরে যাবো আমি! এটা কেমন অনুভূতি? এই প্রথম কোনো ছেলে এতো টা কাছে আমার। যেখানে আজ ওবধি কোনো ছেলের হাত ওবধি ধরি নি সেখানে পূর্ণ ভাই..! সারা শরীর কাঁপছে। কথা বলার শক্তি নেই। হাত দুটো নিথর হয়ে আছে। আর পূর্ণ ভাই আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছেন উনার সাথে। নিজেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার ও উপায় নেই। মিনিট দুয়েক এভাবেই জাপটে ধরে রাখলেন। অতঃপর পূর্ণ ভাই আধো ধরা গলায় বললেন,

–‘পরি আ-আ’ম এক্সট্রিমলি ভেরি সরি!’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here