প্রেম সায়রের ছন্দপাত পর্ব ১৯

#প্রেম_সায়রের_ছন্দপাত

#সাদিয়া_নওরিন

পর্ব—-১৯

রাতের অন্ধকারে প্রিয়জনের জন্য কাতর দু’টি হৃদয়, কাছে থেকেও আজ বহু ক্রোশ দূরে। একে অন্যের অস্তিত্ব অনুভব করেও তারা আজ কাছে আসতে অক্ষম ! মানুষ যখন অনেক বেশী অসহায় হয় তখনই তাদের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস । আর আজ তো এখানে দীর্ঘশ্বাসের মেলা বসেছে!
রাত দশটা তিরিশে উঠে বসলো ইরহাম। শরীরটা অনেকটাই ভালো লাগছে এখন তার। হালকা একটু ন্যাপে যেন নিজেকে ঝরঝরে অনুভব করছে সে। সে উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙতেই ফয়েল পেপারে মোড়ানো রাতের খাবার দেওয়া হলো তাদের৷ তারা যেহেতু ননভেজ ক্যাটগরীতে অর্ডার করেছে তাই তাদের দেওয়া হলো রুটি, ভাত, সবজি, ডাল আর চিকেন মাসালা । সবাই যার যার প্লেট নিয়ে খাওয়ায় মন দিল। খাবারটা খেয়ে পেট ভরলেও মন ভরলো না তাদের। সত্যিই অসাধারণ হয়েছে প্রতিটি খাবার। বিশেষ করে চিকেন মাসালাটি তার যে কোন তুলনায় নেই।

সবার মাঝে কেবল আরশীর গলা দিয়ে যেন খাবারই নামছে না আজ। সে মুখ ভচকে কোন রকম পানি দিয়ে গিলতে লাগলো খাবারগুলো! ইরশাদ আড়ঁচোখে তাকালো সেদিকে। আরশীর শুকনো মুখটির দিকে তাকিয়ে যেন তার নিজের হৃদয়ের অন্তঃর্স্থে ব্যাথা অনুভব করছে সে!হুট করে মুখটাও যেন তার বড্ড তেঁতো ঠেকতে লাগলো। আর তাই, বাকি খাবারগুলো সে না খেয়েই উঠে গেল! আর তারপরই নিজের সিটে গিয়ে শুয়ে পড়লো সে।

রাত্রি দ্বিপ্রহর, ঘুম নেই আলাদা বিছানা শুয়ে থাকা দুটি প্রানীর আজ! আরশী বারবার নড়াচড়া করতে ব্যাস্ত। আর ইরশাদ নিজের কপালের ওপর হাত ঠেকিয়েই ঘুমের ভাব ধরে আছে! কিছুসময় পর পর আঁড়চোখে আরশীর দিকে তাকাচ্ছে ইরশাদ। মেয়েটির এমন অস্হিরতা যেন তাকেও এলোমেলো করে দিচ্ছে! সে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে ব্যাস্ত রাখতে চায়লো।শেষে ধর্য্যের বাধ ভেঙে গেল তার। আর সে নাক ফুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো ,
—- কি সমস্যা? এতো নড়ছো কেন?
—– আপনার ওপর তো আর নড়ছি না। আমি আমার বেডের ওপর নড়ছি। আপনার তো সমস্যা হওয়ার কথা না।
—- তাও হচ্ছে। মাথা ভিতর টুকটুক করছে আমার৷ তাই তো জিজ্ঞেস করছি। তো এতো বেডের ওপর নড়ছোই বা কেন?
—- কেন বেড কি তোমায় বিচার দিয়েছে? আমি নড়ছি তা নিয়ে? নয় তো? তো তোমার এতো সমস্যা কেন?
—- দেখ আরশী, মুখে মুখে তর্ক করবে না একদম। ঘুমিয়ে পড় কাল খারাপ লাগবে। তোমার তো আবার না ঘুমুলে বমি হয়
—– কে বলল? আমি বলেছি হয়? আর তাছাড়া আপনার কেন আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে? আমার শরীর, আমার বমি আমি দেখবো।ওকে
—– হুম পরে তো আমাকেই ভেজাবে।

হঠাৎ চুপ হয়ে গেল আরশী। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো তার মুহূর্তেই। সে একদম চুপটি মেরে গেল। হঠাৎ ইরশাদের আংশিক খোঁচাটিও বড্ড বেশী মনে হলো তার কাছে। অন্যদিকে ইরশাদ জিভ কেটে চুপ মেরে গেল। কিছু সময় পর আলতো হাতে নিজের মাথায় গাঁট্টামেরে বলল,
—– আমি ওভাবে মিন করি নি আরশী। আসলে
—- ঘুমিয়ে পড়ুন মিঃ ইরশাদ। আমি ঠিক আছি।
—- আরশী আমি

আরশী অন্যপাশ ফিরে শুয়ে গেল।আর ইরশাদ আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে ওকে ডাকতে চায়লো। কিন্তু ইরশাদের হাতের চেয়ে যে অনেক দূরে আরশীর সিট।

নিজের সিটে শুয়ে উপরে চলমান ঘটনা ভালোভাবে অবলোপন করছে ইরহাম! কিছুক্ষণ আগে ঘুমানোর কারণে তার ঘুমভাবটা অনেকটাই হালকা হয়ে এসেছিল আর তাই আরশী আর ইরশাদের কন্ঠস্বর শুনে ভালোভাবেই কান পেতেছিল সে! হুট করেই ইরশাদের উপর খুব রাগ উঠে গেল তার! আকাশ পাতাল ভাবতে গিয়ে রাগে মুষ্টিমেয় হয়ে এলো তার হাত!

সকালের সূর্যের আলো চোখের ওপর পড়তেই ঘুম ভাঙ্গলো ইরশাদের। আর চোখ খুলেই সর্বপ্রথম সে দেখলো আরশীর মিষ্টি চেহারাটিকে। ঘুমন্ত আরশীকে একদম বাচ্চাদের মতো মনে হলো তার কাছে। সূর্যের আলোয় নাক কুঁচকে ফেলেছে সে।আর এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে কোন স্কুল পড়া পিচ্ছি মেয়ে, যে পছন্দের চকলেট না পেয়ে মুখ ভার করে আছে।
কথায় আছে, ঘুমন্ত কন্যার ঘামার্ত চেহারায় সূর্যের রশ্মি তাকে অদ্ভুত সৌন্দর্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়! ইরশাদের কাছে কথাটির মর্মত্ত যেন আজ দৃশ্যমান!
একগুচ্ছ চুল ছড়িয়ে আছে আরশীর গাল জুড়ে।আর তার মাঝখান দিয়ে উঁকি দিচ্ছে তার হলদে গালটি যা ইরশাদকে কেবল ঘোরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়!

হঠাৎ নড়েচড়ে উঠে বসে আরশী। ইরশাদ তা দেখে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নেয় তার থেকে। তারপর আনমনেই বলে ও উঠে,
” আর একটু ঘুমালে ক্ষতি কি !”

বন্যা পেপারে মুখ গুঁজে আছে। আর সাগর তাঁকিয়ে আছে তার দিকে একদৃষ্টিতে। সবুজ কুর্তিতে অসম্ভব মায়াবী লাগছে আজ বন্যাকে, আর এতেই যেন চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়েছে সাগরের জন্য। একদম সাদাসিধে থাকে মেয়েটি, একদম সাজগোছ বিহীন। আর এতেই অতুলনীয় বন্যা! মাঝে মাঝে সাগরের ইচ্ছে হয় বন্যাকে নিজ হাতে সাজায় সে।লাল সবুজ শাড়ি পড়িয়ে বৌ সাজাবে সে, আর সাথে থাকবে লাল একগাছি কাচের চুড়ি। যা রিনিঝিনি শব্দ তুলে তার ঘুম ভাঙ্গাবে! চুলে করবে সে বাঙ্গালী খোঁপা, আর কপালে থাকবে ছোট একটি সবুজ টিপ,চোখে গাড় কাজল আর ঠোঁটে পড়াবে রানী গোলাপি লিপস্টিক! বন্যাকে এই রুপে মনে মনে সাজিয়েই যেন শিহরিত হয় সে!মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে যেন তার কল্পনায় বন্যাকে দেখে।

তার মাঝে মাঝে আবার এইটাও মনে হয়, এইসাজে সে বন্যাকে দেখলে নির্ঘাত হার্টঅ্যাটাক করবে! আর তাই হয়তো বন্যা এভাবেই কিউটি।
আচমকা তার কল্পনায় একমুঠো ছাই দিয়ে, ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠলো বন্যা,
—— কিরে, পেপার কি আমার মুখে? আমি কি আয়না যে আমার মুখে তাকালেই পেপারের প্রতিচ্ছবি দেখবি তুই?
—- আরে তা না আসলে
—- আসলে কি?
ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ার আগেই তাদের সকালের নাস্তা দিয়ে গেল একজন। আর তার বদৌলতে এই যাত্রায় বন্যার নাক ফোলানো থেকে রেহাই ও পেয়ে গেল সাগর! খাবার রান্নাকারীদের মনে মনে শুকরিয়া আদায় করে এবার খাবারের দিকে মন দিল সে।

পাউরুটি, ডিমের অমলেট, চা-বিস্কুট সকালের খাবার হিসেবে দেওয়া হয়েছে তাদের। সাথে দিয়েছে কিছু চকলেটও। বন্যা একটি চকলেট নিয়ে বাড়িয়ে দিল ইরশাদের দিকে। কিন্তু ইরশাদের সোজা উত্তর চকলেট সে খায় না। বন্যা নাক ফুলিয়ে তাকালো তার দিকে।তারপর বলল,
—– ইরশ, এমন কেন তুই! আমার যা পছন্দ তাতেই দেখি তোর যতো অপছন্দ। এভাবে হলে কিভাবে হবে?
—- কি হবে বন্যা?
ব্রু কুঁচকে বন্যাকে প্রশ্ন করতে করতে আরশীর গা ঘেঁসে বসে পড়লো ইরহাম। আচমকা এমন পাশাপাশি বসায় বড্ড ইতস্ততবোধ হতে লাগলো আরশীর। সে ঈষৎ সরে যেতে চায়লো তার থেকে। কিন্তু ইরহাম, সে যেন আরো গা ঘেঁসে বসলো তার! তারপর মুচকি হাসি টেনে, আরশীর পিঠ ছুঁইয়ে কাঁধের বিপরীতপাশে হাত রেখে বলল,
—— কি হলো? তোমার কি আবার ইরশাদকে বিয়ে করার ইচ্ছে নাকি বড় আপু?
—- বড় আপু?
কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়লো ইরশাদ। কিন্তু তার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠলো ইরহাম,
—- তো! বৌ এর বড় বোন তো আপুই হয়। তাই না আরশী?
আরশী ইতস্ততভাবে চোখ তুলে তাকালো। ইরহামের স্পর্শ কেন যেন আজ সুচের মতো বিঁধছে তার গায়ে। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো ইরহাম পাশ থেকে। তারপর নিজের বেডেই বসে পড়লো।
ইরহাম অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো সেদিকে।তারপর আরশীর মুখের দিকে তাকিয়েই বলে উঠলো,
—- তো ইরশাদ, বিয়েশাদি করবে কখন? বয়স তো অনেক হলো। আর আপুও হয়তো তোমাকে পছন্দ করে।
এক ঝটকায় মাথা তুলে সামনে তাকালো আরশী। আর সাথে সাথে যেন তার চোখাচোখি হলো ইরহামের সাথে!

আর ঠিক তখনই থেমে গেল তাদের ট্রেন। তাদের এবার নামতে হবে৷ সময় দশটা বেজে ত্রিশ।পাহাড়গঞ্জ স্টেশন তাদের গন্তব্য। আর তারা সবাই নেমে গেল সেখানে ট্রেন ছেড়ে।তারপর তারা মেইনগেইট থেকে বেরিয়ে ফুটওভার ব্রিজ ক্রাস করে রাস্তায় নামলো।একটু সামনে এগিয়ে তারা আরকাশন রোডে যাওয়ার লক্ষ্যে দুইটি ট্যাক্সি ভাড়া করলো। তারা আরকাশন রোডের কাছেই একটি হোটেল বুক করেছিল আগে। ভাড়া ২৭০০ রুপি সেখানে প্রতিটি রুমের৷ কলকাতার চেয়ে দিল্লিতে হোটেলভাড়া তুলনামূলক বেশী। আর তাই কোন কথা না বলে হোটেলে ডুকে পড়লো সবাই।

হোটেলে রুম বিভাজনের ক্ষেত্রেই যেন বাধলো সব বিপত্তি! ইরহাম গো ধরে বসলো সে আরশীর সাথেই এক রুমে থাকবে! ইরশাদ বাধা দিতে চেয়েও বাধা দিতে পারলো না, দু হাত মুটো করেই তাকিয়ে রইলো সে তাদের দিকে!
অন্যদিকে রাগে লাল হয়ে উঠছে আরশী।শেষ পর্যন্ত দুইটা সিঙ্গেল বেড আর একটি ডবল বেডের রুম বুক করলো ইরহাম।আর তারপর একপ্রকার জোর করেই আরশীকে নিজের কক্ষে নিয়ে এলো সে!

রাগ সপ্তআসমান অতিক্রম করেছে আরশীর। আর তার ছটফটানি দেখে হার্ডবিট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে উঠছে ইরশাদের। শেষে একদম ইরহামের মুখোমুখি দাড়ালো ইরশাদ।তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার মুখপানেই তাকিয়ে রইলো সে। কিন্তু তার সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে, ডান হাতে আলতো ব্রু চুলকে বলে উঠলো ইরশাদ,
—– কোন মেয়েকে জোরাজোরি করাটা বেআইনি।
—– সে আমার হবু বৌ ইরশাদ। আর নিজেদের পারশোনাল লাইফে কোন বাইরের মানুষের কথা শুনি না আমি
—— বিয়ে এখনো হয়ে যায় নি তোমাদেট
—- তিশা তিতাসের ও তো হয়নি। ওরা থাকতে পারলে, আমি কে পারবো না?
—– সবার সবকিছু সেইম না৷ আরশী তোমার সাথে এখনো ইজি হতে পারে নি। আর তাই

ইরশাদকে শেষ করতে দিল না ইরহাম।বরং আরো রেগে গেল সে! সে ইরশাদের কথার মাঝেই নাক ফুলিয়ে বলে উঠলো,
—– আমাদের সম্পর্ক কি বা কতোটুকু তা কি তোমার থেকে জানতে হবে আমার? আর আমাদের মাঝে এতো নাক গলাও কেন তুমি সেইটা আগে বল?

বন্যা, সাগর আর তিতাসের কাছে বিষয়টি মোটেও ভালো ঠেকছে না এখন৷ তারা যেন ঘোর বিপদের আভাস পাচ্ছে এখন৷ বন্যা সাত পাঁচ ভেবে তাড়াতাড়ি চেপে ধরলো ইরশাদের ডান হাঁতটি তারপর বলল,
—– বাদ দে না ইয়ার৷ ওদের লাইফ ওরা দেখুক তুই চল
বন্যার কথায় যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো জ্বলে উঠলো ইরশাদ। সে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নাক ফুলিয়ে বলল,
—- তোর কোন সমস্যা না হলেও আমার আছে। তুই স্বার্থপর তাই নিজের বোনের সমস্যা দেখছিস না। কিন্তু আমি তোর মতো না
—- হু। কেউ দেখে না৷ কেবল তুই দেখিস সব তাই না? সবকিছুতেই তোর সমস্যা
তারপর আচমকা ইরশাদের কলার চেপে ধরে ইরহাম! আর ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠে
——– আমার বৌয়ের ব্যাপারে এতো মাথা ব্যাথা কেন তোর?বল, কেন এতো মাথাব্যাথা?

—– কারণ সেইটা ওর ও বৌ তাই!
আরশীর চিৎকারে সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকালো তার দিকে! বিষ্ময়ে যেন হা হয়ে আছে সবাই! আর সাথে ইরহামও। কিন্তু আরশীর চোখ দিয়ে কেবল আগুনের ফুলকি বেরিয়ে আসছে এখন! সে নাক ফুলিয়ে একদম ইরহামের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
—— ইয়েস, মিস্টার ইরহাম হাসান । ইরশাদ মেহতাবের বৌ আমি৷ তাও আবার সেই কবুল বলা ভাইরাল বৌ! মনে আছে আমার কথাগুলো যা বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে বলেছিলাম আমি আপনাকে? নাকি আবারও বলতে হবে?

ইরহাম যেন বাকরূদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো আরশীর পানে! আর সাথে বাকি সবাইও যেন ভাষাহীন! হুট করে যেন থমকে গেল সময়টি তাদের! আর আরশী কারো দিকে না তাকিয়েই হনহনিয়ে অন্য রুমে ডুকে বন্ধ করে দিল দরজা!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here