প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব -১৮+১৯

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ১৮
_________________________
ঘন্টার পর ঘন্টা সফর করে সকলেই বেশ ক্লান্ত। সেদিনের মতো আলাপ-আলোচনা বা গল্পগুজব করা হয়ে উঠেনি। মুক্ত করে রাখা কক্ষ গুলোতে যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। অরু তার দুবোন শাবিহা-রুবির সাথে ঘুমিয়েছিল। বেশ ভোর করেই ঘুম ভেঙে যায় তার। বিছানা ছেড়ে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। ভোরের স্নিগ্ধ অস্পষ্ট প্রভা’র দেখা মিললো। সে কি অমায়িক দৃশ্য। তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করলো। দু’হাতে চুল খোঁপা করতে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো। ফ্রেশ হয়ে, কাপড়চোপড় পরিবর্তন করে সুন্দর ভাবে তৈরি হয়ে নিলো। ঘড়ির কাঁটা এখন ছ’টায়। বিছানার সামনে গিয়ে শাবিহাকে ডেকে ওঠাল। শাবিহা নড়েচড়ে উঠে বসে আবারো হেলেদুলে পড়ে গেল। তারপর অরুর টানে পুনরায় উঠে বসে। দুলতে দুলতে বাথরুম চলে যায়। এই ফাঁকে অরু কক্ষের বাইরে উঁকি দিল। কেউ নেই! সম্পুর্ন নিস্তব্ধতা বিরাজমান চারপাশে। মনে হচ্ছে বাড়ির কেউ এখনো উঠেনি। ভালোই হয়েছে। শাবিহা আর সে বিনা দ্বিধায় চলে যেতে পারবে! কিন্তু অরুকে অবাক করে দিয়ে শাবিহা ফ্রেশ না হয়ে পুনরায় বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। তাকে আবারো ঠেলতে লাগলো অরু। শাবিহা অস্পষ্ট ঘুমন্ত স্বরে বলল,
–‘ মনু নদী আমরা ঢাকা ফিরে যাওয়ার দিন দেখে যাবো, কেমন? আজ মাদবকুন্ড জলপ্রপাত দেখতে যাবো। তুই বরং এখন ঘুমিয়ে পড়। গতকাল রাতে আমি ভাইয়ের সাথে কথা বলেছি। দুপুরের খাবার খেয়েই আমরা বেরোবো। ‘
–‘ সত্যি? ‘
–‘ আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে ঘুমোতে দে! ‘
বলতে না বলতেই শাবিহার সেলফোনে শব্দ করে বসলো। ঘুমুঘুমু চোখে স্ক্রিনে তাকাল। অয়নের মেসেজ। শাবিহা না দেখার ভান করে মরার মতো ঘুমিয়ে পড়লো। অরু অশান্ত মনে বিছানায় বসল। সিলেট সে বেশ কয়েকবার এসেছে। এতবার এসে শুধু শ্রীমঙ্গল ঘুরেছে পুরোটা। তবে মাদবকুন্ড জলপ্রপাত দেখা হয়নি। না সেদিকে তার যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আজ দেখতে পারবে। তারা ভ্রমণে বেরোবে। ভাবতেই অরুর মন থেকে মনু নদী বেরিয়ে গেল এখনকার জন্য। শাবিহার পাশে সেভাবেই গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো।

অরুর ঘুম ভেঙেছে যখন তখন ঘড়ির কাঁটা বারোটা বিশে। বাহ! ভালোই ঘুম দিয়েছে! বিছানায় নিজেকে একা পেলো। শাবিহা, রুবি কেউ-ই নেই৷ মুখ ধুয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়লো বৈঠক খানার উদ্দেশ্যে। সবাই বৈঠক খানায় উপস্থিত। উপর থেকে দেখতে লাগছে জনসভা।
অরুকে দেখে নাজমা বেগম হেসে বললেন,
–‘ তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। ‘
অরু আঁড়চোখে তন্ময়কে খুঁজল৷ আশেপাশে নেই। চেনাজানা মানুষদের সাথে দেখা করতে গিয়েছে হয়তো। খেয়েদেয়ে অরু পুরো বাড়ি ঘুরতে আরম্ভ করলো। সতেরো কক্ষ নিয়ে খান বাড়ি। একেকটি কক্ষের বিশালতা প্রখর। বাড়ি ঘুরে নেমেছে বাড়ির চারপাশ দেখতে। চারপাশে গাছ, গাছ আর গাছ। তবে বাড়ির বাম পাশে ফুলের বাগান দেখা গেল। অরু সেখানে কিছুক্ষণ বসে রইলো। উঠে হাঁটা ধরলো বাড়ির পেছনের পুকুর পাড়ের দিক। পুকুর পাড়ের জায়গা টুকু অরুর খুব পছন্দের। সে গতবার যখন এসেছিলো বেশিরভাগ সময় এখানেই বসে ছিলো। পুকুরের পানি, চারপাশের গাছ, পাখিদের ডাক, মাথার উপরের নীল আসমান, সবকিছুই আকৃষ্ট করে তাকে। পা’জোড়া থমকে গেল অরুর। পুকুরের সামনে তন্ময় দাঁড়িয়ে। শুধু দাঁড়িয়ে নয়, দাঁড়িয়ে সেলফোনে কথা বলছে। এখন বিষয়টি হচ্ছে, সে কি সামনে এগোবে নাকি চলে যাবে? ভাবতে না ভাবতে চোখ গেল দূরবর্তী একটি স্থানে। কেউ উঁকি দিয়ে আছে। অরু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে চিনতে পারলো কলিকে! এই মেয়ে এভাবে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কেন? তন্ময় হুট করে পেছনে তাকাল।
–‘ এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ‘
হঠাৎ কন্ঠে ভড়কে গেল অরু,
–‘ পুকুর পাড় দেখতে এলাম। ‘
–‘ উঁকিঝুঁকি মেরে? ‘
হু তন্ময় শুধু অরুকে দেখে। ওইযে লুকিয়ে থাকা কলিকে কেন দেখছে না? আর অরু তো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল না। সে তো সত্যি পুকুর পাড় দেখতে এসেছে। তন্ময় এখানে দাঁড়িয়ে এটা কি সে জানত নাকি?
–‘ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি না! ‘
কথাগুলো বলে পায়ের জুতো জোড়া খুলে নগ্ন পায়ে মাটিতে হেলেদুলে হাঁটতে লাগলো। ধীর পায়ে নামলো পুকুরের পানিতে। শুঁকনো সিঁড়িতে বসে পা-জোড়া ভিজিয়ে দিল। আহ, আরাম! এই সুখের কোনো বর্ননা নেই। শীতল উষ্ণতায় মন স্বাচ্ছন্দ্যে দুলছে। মাথা ঘুরিয়ে অরু তন্ময়কে হাতের ইশারায় ডাকল,
–‘ আসেন। ‘
অরুকে এখন কতটা আবেদনময়ী লাগছে তা সে একদমই উপলব্ধি করতে পারছেনা৷ এইযে বাতাসে উড়তে থাকা চুলগুলো দিশেহারা। ওড়না খানা সিঁড়িতে মেলে আছে। পুকুরের পানিতে বেসামাল ভাবে পা দুলিয়ে চলেছে। প্রাণ খুলে হাসছে। হঠাৎ করে ঘুরে তন্ময়কে ডাকছে। তন্ময় সাড়াশব্দ না করলে মুখ বেঁকিয়ে আবারো পা দোলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠছে। এই দৃশ্যটি একটি রোমান্টিক ফিল্মের মতো দেখতে লাগছে। তন্ময়কে কয়েকবার চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে দেখা গেল। পা বাড়িয়ে আবারো একই যায়গায় দাঁড়াচ্ছে। চলে যেতে নিয়েও যাচ্ছে না। অরু প্রশ্ন করলো,
–‘ আজ আমরা যাচ্ছি তো মাদবকুন্ড জলপ্রপাত দেখতে? ‘
তন্ময়ের জবাব এলো সময় নিয়ে,
–‘ হু। ‘
–‘ এক্সাইটেড! আপনি গিয়েছিলেন তন্ময় ভাইয়া? ‘
–‘ হু। ‘
–‘ কয়বার? শাবিহা আপু দুবার গিয়েছে। ‘
–‘ হিসেব নেই। ‘
–‘ কই আমাকে তো কখনো সাথে নিলেন না৷ আপনি আমাকে কোথাও নেন না৷ আচ্ছা, আপনি এতো দেরি করে জবাব দেন কেন? আমি কি প্রশ্ন করেছিলাম ভুলে যাই৷ ‘
পেছন থেকে শব্দ পেয়ে অরু মাথা ঘোরালো। কলি তন্ময়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাথায় লম্বা ঘোমটা দেওয়া। লজ্জায় মাথা উঁচু করছেনা। মাথা নিচু রেখেই বলল,
–‘ দাদাজান ডাকছেন আপনাকে! ‘
এই দৃশ্যটি স্বচক্ষে দেখে, একটা বাংলা নাটকের কথা মনে পড়লো অরুর। সেখানে এমন একটি দৃশ্য ছিলো,

” শহরের নায়ক পরিবারের কথায় বাধ্যতামূলক বিয়ে করে গ্রামের মেয়ে। তো বিয়ের পরের দিন নায়ক উদাসীন ভঙ্গিতে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে, নায়িকা ঠিক এভাবেই পাশে এসে দাঁড়ায়। ”

অরুর হাসি পেল, তবে সে হাসলো না। এতক্ষণ ধরে ভাবছিলো এই মেয়েটা কখন উঁকিঝুঁকি বন্ধ করে, বেরিয়ে আসবে! অবশেষে এসেছে। তার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো, কেন দাঁড়িয়ে ছিলো এভাবে লুকিয়ে। পরিস্থিতি লজ্জাজনক হবে বিদায় জিজ্ঞেস করলো না। বরং শুধালো,
–‘ কলি আপু আমাদে সাথে আসছ তো? তুমি তো নিশ্চয়ই প্রায়শই যাও? ‘
একইভাবে ধীর আওয়াজে জবাব দিল,
–‘ না যাওয়া হয়না। বাড়ি থেকে যাওয়ার অনুমতি নেই। এভাবেও মেয়েদের এতো ঘুরাফেরা করতে নেই। মা বলেছেন বিয়ের পর শুধু স্বামী নিয়েই যেতে। ‘
–‘ দারুণ ব্যাপার। ভালো কথা বলেছে আপু। আমিও একমত এবিষয়ে। ঘোরাফেরার জন্য কি বিয়েটা করে ফেলব? ‘
কলির জবাব পেলো না তবে তন্ময়ের চোখ রাঙানো দেখল অরু। ভারী গলায় তন্ময় কলিকে বলল,
–‘ যাও আসছি! ‘
সাধারণত মামাতো বোনদের সাথে তন্ময়ের দেখাসাক্ষাৎ হয়না। তাই সে সর্বদাই তুমি ব্যবহার করে এসেছে। সচরাচর তুই ছোট সকলের ক্ষেত্রে সে ব্যবহার করেনা। তুমি বা আপনি’তে সীমাবদ্ধ। কলিকে দ্বিধায় পড়তে দেখা গেল। এইযে একটু গিয়ে আবার ফিরে তাকাচ্ছে। অরু কলির যাওয়ার পানে তাকিয়ে একান্ত ভাবনায় বিভোর। এই কলির হাবভাব সুবিধার লাগছে না! তার মন বলছে মেয়েটির মধ্যে বেশ ঘাপলা রয়েছে।

অরুকে এখনো পা ভিজিয়ে বসে থাকতে দেখে তন্ময়কে বিরক্ত দেখা গেল। যেতে নিয়ে পুনরায় ফিরে এসে বলল,
–‘ উঠে আয়৷ ‘
অরু যেমন তন্ময়ের ‘ উঠে আয় ‘ বলার অপেক্ষাতে ছিলো। মুহুর্তেই দ্রত গতিতে উঠতে নিতেই, বেসামাল ভঙ্গিতে পুকুরে পড়ে গেল। পুকুরের পরিষ্কার পানি তন্ময়ের চোখমুখে ছিঁটকে এসেছে। শার্টের কিছু কিছু যায়গায় ফোটা ফোটা পানি স্পষ্ট। অরুর নাকমুখে পানি ঢুকেছে। ভেজা চুলগুলো সর্বাঙ্গে লেপ্টে আছে। মুখের সামনে থেকে কিছু চুল সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কোমর সমান পানি। কামিজ শরীরের সাথে মিশে আছে। পেটের দিকটা দৃশ্যমান। প্রত্যেকটি অঙ্গের ভাজ বোঝা যাচ্ছে। তন্ময়ের কপালে বিন্দু ঘাম জমেছে। আপাতত সে অরুর দিক ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই, সে রেগে নাকি না! অরু ভেবে নিয়েছে তন্ময় রেগে। তাই আগেই ভয়ার্ত গলায় বলল,
–‘ ধমকাবেন না। আমি ইচ্ছে করে পড়িনি। পা পিছলে পড়েছি। এখানটা পিচ্ছিল হয়ে ছিলো, তা কি আমি জানতাম? ‘
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তন্ময় এগিয়ে আসলো। হাত বাড়িয়ে দিল অরুর দিক৷ অরু হাত ধরে দুষ্টু হাসলো! সে না উঠে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তন্ময়কে টান মারল। আচমকা টানে তন্ময় কিছুটা ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে৷ এক পা পুকুরে পড়ে যায়। অন্য পা সিঁড়িতে থেকে যায়। লম্বা পা জোড়ার ফলে নিজেকে সামলে নিতে পেরেছে। কিন্তু অদ্ভুত এক যায়গায় হাত ছুয়ে দিয়েছে। তন্ময়ের বাম হাত অরুর কোমর ধরে। তার লম্বা আঙুল গুলো অরুর পাতলা কোমর অনায়াসে জাপ্টে আছে। অরু নিজেও পাথরের ন্যায়ে দাঁড়িয়ে। এমতাবস্থার সম্মুখীনে পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে, বলা যায়। তন্ময়ের দেহ তার সাথে ছুঁই ছুঁই প্রায়। গরম শ্বাসপ্রশ্বাস মুখে থুবড়ে পড়ছে। বুকের উঠানামার গতি গুনে ফেলা যাবে। হৃদয়ের অস্বাভাবিক গতি কমাতে অরু পিছু যেতে নিয়ে অনুভব করলো কোমরে থাকা তন্ময়ের আঙুল নড়ছে। যেমন চারপাশ স্পর্শ করছে। অরু থরথর করে কেঁপে উঠলো। তার গাল থেকে ঘাড় অবদি লাল আভায় রাঙিয়ে গিয়েছে। লজ্জায় সেভাবেই ডুবে গেল পুকুরে। তন্ময় পুকুরে পড়া পা উঠিয়ে নিয়েছে। ডুবে থাকা অরুর দিক আঁড়চোখে তাকিয়ে, দ্রুত পায়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর রুবি ওড়না হাতে পুকুর পাড়ে হাজির হলো।
–‘ ভাই বললো তুই পুকুরে পড়ে গেছিস নাকি! ‘
বলেই অরুকে ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে নিয়েছে। হাত ধরে উঠাতে উঠাতে বলল,
–‘ তোর কবে হেলদোল হবে! কীভাবে পড়ে গেলি বলত? ‘
–‘ আরেকবার পড়ে দেখাব? ‘
–‘ আজ্ঞে না! ‘
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নিয়ে অরু খেয়াল করলো তার জুতো জোড়া সিঁড়ির মাথায় গুঁছিয়ে রাখা। সে তো গাছের কাছটায় রেখেছিল। এখানে কীভাবে চলে এলো?
________
অয়ন উপর তোলার রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। হাতে চায়ের কাপ। তার হাতে চা দিয়ে গিয়েছে একটি যুবতী মেয়ে। বয়স আঠারো উনিশ হবে। নাম রুবাইয়াত। আবু বক্কর সাহেবের মেয়ে। অয়নকে দেখেই লজ্জায় লালনীল হয়ে পড়ছে। বিষয়টি অয়ন শুধু একা লক্ষ্য করেনি। শাবিহাও করেছে কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। প্রতিক্রিয়া না দেখানো শাবিহাকে খেয়াল করে অয়ন আনমনে হেসেছে। এবং এখনো হেসে যাচ্ছে। আঁড়চোখে দেখল শাবিহা আসছে। অয়ন দৃষ্টি দূর আসমানে নিবদ্ধ করে চায়ের কাপে চুমুক বসালো। শাবিহাকে দেখেও না দেখার ভান করে রয়েছে। শাবিহা এসে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো,
–‘ তুমি সিলেট আগে এসেছ? ‘
–‘ হু বহুবার। ‘
–‘ সবকিছু ঘুরেছ? ‘
–‘ টুকটাক। ট্যুরে এসেছিলাম বন্ধুবান্ধব তাদের ভাই ব্রাদার এবং তাদের গার্লফ্রেন্ডস নিয়ে। বড়সড় ট্যুর দিয়েছিলাম বলা যায়। ‘
শাবিহার চোখমুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তবে তা লুকায়িত। ইনিয়েবিনিয়ে প্রশ্ন করলো,
–‘ তোমার? ‘
অয়ন উদাসীন ভঙ্গিতে বলল,
–‘ গার্লফ্রেন্ড? উঁহু ছিলো না৷ আমিতো তখন একতরফা তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম।’
শাবিহা লজ্জা পেলো। সাথে বিষন্ন অনুভব করলো। টপিক পরিবর্তন করার জন্য বলল,
–‘ তোমার কাজকর্ম নেই? এভাবে হুট করে এসেছ বাড়ির সবাই জানে? ‘
–‘ তোমার শ্বশুর শ্বাশুড়ির কথা বলছ তো? তারা জানেন। তবে এটা নয় যে তাদের পুত্র বঁধুর সাথে এসেছি। জানেন বন্ধুবান্ধবদের সাথে ট্যুরে
গিয়েছি। ‘
–‘ বেশি বেশি বকবে না৷ ‘
–‘ ওকে! ‘
মুহুর্তেই দুজনের চারপাশে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। অয়ন আর কথা বলছে না। শাবিহা চোখমুখ অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে। ছেলেটা কি পাজি! কথা বলতে কি নিষেধ করেছে নাকি? বেশি বকবক করতে নিষেধ করেছে। এভাবে তো কোনো কথাই শাবিহার শোনেনা৷ আজ শুনে উদ্ধার করে ফেলছে একদম৷ শাবিহা বিড়বিড় করে চলে যেতে পা বাড়ালো। অয়ন পিছু ডাকল,
–‘ শাবিহা! ‘
অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
–‘ হু? ‘
–‘ আমি তোমাকে ছাড়া অন্যকারো কথা ভাবতেই পারিনা। অন্য মেয়েদের দিকে তাকানো তো দূরের বিষয়। ‘
–‘ মানে? ‘
অয়ন রহস্যময় ভাবে হাসলো। চা শেষ করে কাপ শাবিহার হাতে ধরিয়ে দিল। পাশ কেটে যাওয়ার সময় ছুঁই ছুঁই হয়ে গেল। শাবিহা কিছুক্ষণ অবুঝের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। অয়নের বলা কথাগুলো আবারো ভাবতে বসলো। অয়ন কি ভেবেছে সে জেলাস? রুবাইয়াত কে নিয়ে? হু কখনোই না! মনে মনে এক বললেও শাবিহার ব্যথিত হৃদয়, ঔষধ পেয়ে গেল।
——-
অরু জিন্সের সাথে একটা ফতুয়া পরেছে। গলায় স্কার্ফ ঝুলিয়েছে। চুলগুলো উঁচু করে ঝুটি করে নিয়েছে। মাথায় সানগ্লাস লাগিয়েছে। আপাতত ভালো মানের গ্রিপের জুতো পরছে। তন্ময় বলে গিয়েছে গ্রিপের জুতো পরতে। হয়তো সে আগে থেকেই সন্দেহ করেছে অরু উঁচু হিল পরে বেরোবে। তাই ওয়ার্নিং দিয়ে গিয়েছে। শাবিহাও গ্রিপের জুতো পরে তৈরি হয়ে নিয়েছে। জলপ্রপাতে যাওয়ার রাস্তা বেশ দুর্গম এবং পিচ্ছিল তাই সতর্ক হয়ে পথ চলতে হবে তাদের।
হুশিয়ার সাহেব বৈঠক খানায় বসে। হাতে পান। মুখে দিবেন দিবেন ভাব৷ তবে দিলেন না। চুন আঙুলে নিয়ে বললেন,
–‘ সাবধানে যাইবা সক্কলে। সময় কইরা ফিরা আসবা। সমস্যা হইলে কল দিবা। আমি আইজ বাসায় আছি! ‘
সবাই মাথা নাড়াল, বুঝেছে যেমন। তারা মোট আটজন রওনা হবে৷ তন্ময় অরু, অয়ন শাবিহা, দীপ্ত, আকাশ, রুবি এবং কলি৷ সবাই তৈরি হয়ে চলে এসেছে। জবেদা বেগম টিফিনবাক্স ধরিয়ে দিয়েছেন গাড়িতে রাখার জন্য। বেশকিছু পানির বোতল এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। তাদের সাথে বিশ্বস্ত ড্রাইভার যাবে। হুশিয়ার সাহেব তাদের একা ছাড়তে চাইছেন না। বাড়ির সামনে বড়ো মাইক্রো গাড়ি দাঁড় করানো। অরু জানালার সিট বেছে নিয়েছে। এবং সে সর্বপ্রথম উঠে বসেছে। এক্সাইটম্যান্টে তার গলা ধরে আসছে। কখন পৌছাবে?

চলবেপ্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ১৯
_________________________
কিছুক্ষণ আগের হৈ-হুল্লোড় আপাতত নিস্তব্ধতায় পরিনত হয়েছে। বৈঠক খানায় মুরব্বিদের সভা বসেছে। মোস্তফা সাহেবের পাশে জবেদা বেগম। দুজন পাশাপাশি বসে আছেন। উল্টো পাশে হুশিয়ার সাহেব। বাম পাশে আনোয়ার সাহেব, ওহী সাহেব ও রয়েছেন। আবু বক্কর সাহেব, মোজাহিদ সাহেব এবং বাকিরাও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। হুশিয়ার সাহেব এবার হাতের পান মুখে গুঁজে দিলেন। আঙুলের মাথায় থাকা চুন থেকে কিছুটা মুখে দিয়ে, মোস্তফা সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
–‘ জয়া তোমারে বলছে নিশ্চয়ই? ‘
মোস্তফা সাহেবের মুখের ভঙ্গিমা জানাচ্ছে, তাকে কিছুই বলা হয়নি। জবেদা বেগম বললেন,
–‘ আমি কিছু বলিনি। ‘
— ‘ আচ্ছা। আমি বলি তাইলে। ‘
–‘ আব্বা.. ‘
হুশিয়ার সাহেব হাতের ইশারায় মেয়েকে চুপ থাকতে বললেন। আয়েস করে বসে ধীরেসুস্থে বললেন,
–‘ কলির জন্য পাত্র খুঁজতাছি। মেয়ে বড়ো হইছে। বিয়া তো দিতে হইবো। ‘
মোস্তফা সাহেব বুঝে ফেললেন নদীর পানি কোথায় গড়াচ্ছে। তিনি এমন কিছুর প্রত্যাশা মোটেও করেননি। উপস্থিত সকলের সামনে নিশ্চুপ রইলেন। হুশিয়ার সাহেব আবারো বলতে লাগলেন,
–‘ মোজাহিদ তন্ময়কে পছন্দ করছে কলির জন্য। শুধু ওয় না সবাই কলির জন্য তন্ময়কে পছন্দ করছে। আমারও মনে হয় তন্ময়ের থেকে ভালো আর কেউ হইতে পারেনা। এখন তোমাদের মতামত আশা করতেছি। পুত্র বঁধু হিসেবে কলিকে কেমন লাগে? তাড়াহুড়ো নাই। ধীরেসুস্থে ভাইবা জবাব দিবা। ‘
মোস্তফা সাহেব মাথা নিচু করে বসে৷ জবেদা বেগমকে ভীষণ ব্যাকুল দেখাচ্ছে। তিনি স্বামীর হাত ধরতে চেয়েও ধরছেন না৷ অস্থির চোখে তাকিয়ে। মোস্তফা সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন,
–‘ বাবা আমি আপনার সাথে আলাদা কথা বলতে চাই। ‘
মোজাহিদ সাহেবের চোখমুখ কুঁচকে গেল সামান্য। তিনি চেহারায় ভদ্রতা বজায় রেখে বললেন,
–‘ আলাদা কথা বলার কি আছে? সামনাসামনি বলেন। মেয়ে আমার, আমি শুনতে চাই যা বলার আছে আপনার। তন্ময়ের জন্য আমার মেয়ের থেকে ভালো মেয়ে আর পাবেন নাকি? ‘
হুশিয়ার সাহেব চোখ রাঙালেন,
–‘ রক্ত এতো গরম কেন? ঠান্ডা হও। নিজের রুমে যাও। ‘
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। মোস্তফা সাহেবও সঙ্গে সঙ্গে উঠলেন। হুশিয়ার সাহেবকে সাহায্য করে এগিয়ে নিচ্ছেন ডান পাশে।
_______
এদিকটায় হুশিয়ার সাহেবের নিজ কক্ষ। কক্ষে উপস্থিত আছেন জয়তুন বেগম। তিনি বিছানায় বসে জিকির করছেন। হুশিয়ার সাহেব চেয়ারে বসলেন। দরজা লাগিয়ে অপর পাশের চেয়ার টেনে মোস্তফা সাহেব বসলেন।
মনেপ্রাণে নিজেকে প্রস্তুত করছেন। মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো তিনি আজ বলতে যাচ্ছেন। এ’তে কিছুটা নার্ভাস অনুভব করছেন। হুশিয়ার সাহেবের রিয়েকশনের চিন্তা ও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে! হুশিয়ার সাহেব স্বান্তনা দিয়ে বললেন,
–‘ যা মনে আছে বলে দাও। বেশি চাপ নিও না। ‘
–‘ বাবা তন্ময়কে তো আপনি জানেন। কেমন ধরনের ছেলে ও সেটার সাথে পরিচিত। খুব ইন্ট্রোভার্টেড। অনুভূতি ব্যক্ত করতে জানেনা। ছোট থেকেই একঘেয়ে স্বভাবের। আপনজন ছাড়া কাউকে চিনেনা। ‘
–‘ তুমি যদি এগুলা নিয়া চিন্তা করো, তাইলে এসব চিন্তা বাদ দাও৷ তন্ময় কেমন সবাই জানে। যেমন আছে তেমনই পছন্দ হক্কলের! ‘
বিছানায় বসা জয়তুন বেগম বললেন,
–‘ তুমি বাঁধা না দিয়ে শোনো পোলাডা কী কইবার চায়! পুরো কথা না শুইনা কথা কও কেন! ‘
হুশিয়ার সাহেব চোখ উল্টিয়ে তাকালেন স্ত্রীর অয়ানে। তারপর মোস্তফা সাহেবকে কথা বলতে ইশারা করলেন। মোস্তফা সাহেব পুনরায় বলতে লাগলেন,
–‘ যতই নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখুক না কেন! বাবা হয়ে আমি ওর আচার-আচরণ, মুখ দেখেই সব বুঝতে পারি। ‘
হুশিয়ার সাহেব হেলদোল ছেড়ে, এবার শক্তপোক্ত হয়ে বসলেন। মন দিলেন কথা শোনায়। তার মনে হচ্ছে কাহিনি গভীরে যেতে চলেছে। মোস্তফা সাহেব একটু থেমে আবারো বলতে লাগলেন,
–‘ দু-তিন বছর আগের কথা। একদিন হুট করে গভীর রাতে তন্ময় আসে আমার রুমে। কোনো দ্বিধাবোধ ছাড়াই বলে ফেলে সে অরুকে বিয়ে করতে চায়! অরুকে চিনেছেন তো? আমার ছোট ভাই আনোয়ারের একমাত্র মেয়ে। তখন অরু মাত্র দশম শ্রেনীতে পড়ছে। ওকে খাওয়াতে, পড়াতে, শোয়াতেও সবাইকে কাঠখড় পোহাতে হতো, এতটাই ছোট ছিলো সে। বাড়ির আদরের রাজকন্যা। সেই মেয়েকে আমার দামড়া ছেলে হুট করে এসে বলছে বিয়ে করবে! আমি তখন কি বলবো বা করবো বুঝতে পারিনি। আমি খুব আগে থেকেই লক্ষ্য করেছি তন্ময়ের বিহেভিয়ার। ও সবসময় বেশ প্রটেক্টিভ ছিলো অরুর ক্ষেত্রে। অরুর সবকিছু নিজেই হ্যান্ডেল করতো। তবে আমি এতটা সিরিয়াস হয়ে ভেবে দেখিনি । অরু আমার নিজের মেয়ের মতো। আমার দ্বিতীয় মেয়ে। আদরের মেয়ে। ওর জন্য খারাপ চাইব না। নিজের ছেলের প্রয়োজনেও না। তন্ময়কে বোঝাই এটা অসম্ভব। অরু খুব ছোট তার জন্য। বা বিয়েটা এখন একদমই সম্ভব না। কিন্তু আমার ছেলের মাথায় তখন জেদ ভর করেছে। সে বিয়ে করবেই করবে। আমি তখন ভীষণ রেগে যাই! মাথা গরম করে চড় দিয়ে বসি। বলি, অরুর আশেপাশে ঘেঁষতে না। ছেলের জেদের সামনে একটা প্রমিজও করে বসি। যদি অরু নিজে এসে আমাকে বলে সে তন্ময়কে বিয়ে করতে চায়, তাহলে আমি সবকিছু পেছনে ফেলে তাদের বিয়ে দিব। এসব বিষয় নিয়ে আমার আর আপনার মেয়ের মধ্যে বড়সড় একটা ঝগড়াবিবাদ হয়। মাথা গরম করে আমি খুব খারাপ ব্যবহার করে বসি। তার চরিত্র নিয়ে কথা তুলি। এই কারণ বসত তখনই আপনার নাতি আর মেয়ে বাড়ি ছাড়ে। সেই থেকে তারা এই পর্যন্ত মানে তিনটা বছর ধরে, অন্য ফ্ল্যাটে ভাড়া ছিলো। মা হুট করে গিয়েছে দেখে ফেরত আসতে বাধ্য হয়। ‘
জয়তুন বেগমের চোখজোড়া বড়ো হয়ে আছে। তিনি বিষ্ময় নিয়ে বললেন,
–‘ এই ব্যাপার। আমারও একটু সন্দেহ সন্দেহ লাগতেছিল বাবা! ‘
হুশিয়ার সাহেব ধমকালেন,
–‘ রাখো তোমার বাবা! তোমার বাবা যে আমার মাইয়ার চরিত্র নিয়া কথা তুলছে শোনো না? এর একটা বিচার হোক আগে, পড়ে সব! ‘
–‘ কী আমার ভালা মানুষটা। তুমিও তো কম গালিগালাজ অপবাদ করো নাই আমারে! সেই ক্ষেত্রে ইহা কিছুই না। ‘
জয়তুন বেগম স্বামীকে চুপ করিয়ে মেয়ে জামাইয়ের দিক দৃষ্টিপাত করলেন,
–‘ আমার নাতি তো লাখে একটা! ওরে অরুর জন্য কেন মানতেছ না? ‘
–‘ মা আমি মানছি না তা নয়। আমার সমস্যা’টা অরুকে নিয়ে। আমি ভেবেছি এটা তন্ময়ের এক তরফ থেকে পছন্দ। ছোট থেকে তারা আপন ভাইবোনের মতো বড়ো হয়েছে। হুট করে সেখানে বিয়েটা তাও আবার বয়সের এতটা গ্যাপ, আমার কাছে মানানসই লাগেনি। তার উপর পরিবার! আমার যত্নশীল পরিবার হয়তো দুভাগ হতে পারে। আমি জানি তন্ময়ের জন্য অরুকে চাইলে, আমার ভাই এক পায়ে রাজি হবে। সে তন্ময়কে খুব পছন্দ করে। কিন্তু তার স্ত্রী সুমিতা রাজি হবেনা বোধহয়। সুমিতার মেজো ভাইয়ের একটা ছেলে আছে। সেই ছেলের জন্য অরুকে চেয়েছে। সেখানে সুমিতা তার মেয়ে দিতে রাজি। আমি বুঝিয়েছি, তবুও মনে হয়না কোনো কাজ হবে। কারণ সুমিতা ছোট থেকে অবহেলায় বড়ো হয়েছে। আমাদের বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর, ভাইদের দেখানো ভালোবাসা দেখে, সেটাকে সবকিছু ভেবে বসেছে। যতদিন তার ভুল না ভাঙে বিয়ে অসম্ভব। ‘
হুশিয়ার সাহেব বললেন,
–‘ আনোয়ার জানে? মানে বাড়ির সবাই জানে? ‘
–‘ না! আমি আপনার মেয়ে আর তন্ময় ব্যস! আর কেউ জানেনা। আমি জানতে দেইনি। আমার ভাই গুলো পাগল। বিশেষ করে আনোয়ার। সে যদি এগুলো জানে, এই বিয়ে সম্পন্ন করেই ছাড়বে। তাতে স্ত্রীর সম্মতির অপেক্ষা করবেনা। সংসার ভেঙে যাবে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করবেনা। কিন্তু তার বড়ো ভাই, তার একমাত্র গার্ডিয়ান হিসেবে আমি এমনটা একদম চাই না। ‘
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন হুশিয়ার সাহেব। কাহিনি খুব জটিল এবং বড়ো। মাথাটা ধরে গিয়েছে তার। তিনি জয়তুন বেগমকে বললেন,
–‘ এক কাপ চা বানাই দিতে বলো ত! ‘
জয়তুন বেগম চলে গেলেন। হুশিয়ার সাহেব শুধালেন,
–‘ কি করতে চাও এখন? ‘
–‘ বুঝতে পারছেনা। ‘
–‘ মোজাহিদ খুব আগ থেকেই তন্ময়কে মেয়ে জামাই করার আশায় ছিলো। গতকাল শুনলাম কলি খুব পছন্দ করে তন্ময়কে! ‘
মোস্তফা সাহেবের মাথাটা বেশ ঝুকে গেল। এই ছেলেকে নিয়ে তিনি আর কতো যন্ত্রনায় ভুগবেন। কিছু না করেও পরিবারের মধ্যে কূটনীতি করে চলছে।
–‘ বাবা আমি জানি মোজাহিদ ভাই রেগে যাবেন। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। কলি একটা অসাধারণ মেয়ে। আমার কোনো আপত্তি থাকতো না ওকে ছেলে বউ করে ঘরে আনতে, যদি সবকিছু নর্মাল থাকতো। ‘
–‘ আমার মনে হয় এই বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলা দরকার মুজাহিদের সাথে। কিন্তু এখন নয়। তোমরা ঢাকা ফিরলে কথা বলবো। নাহলে ঝগড়াবিবাদ হতে পারে। ‘
–‘ আপনার যা ভালো মনে হয় বাবা। ‘
–‘ ঠিকাছে। কিন্তু মনে রেখো, তোমারে আমি ছাড়ছি না। হাতপা ধরে মেয়ে নিছো আমার মেয়েকে হেনস্তা করার জন্য নাকি? মিটমাট কইরা নাও নইলে মাইয়া আমার আমি বাড়িতে রাইখা দিম। ‘
–‘ জি বাবা! ‘
মোস্তফা সাহেব উঠে বেরিয়ে পড়লেন। মাথায় জবেদা বেগম চিন্তিত চেহারায় দাঁড়িয়ে। দ্বিধার দেয়াল টপকে কিছু বলতে পারছেন না। আবার চুপও রইতে পারছেন না। স্বামীর পাশে দাঁড়াতে না পেরে তিনি খুব ব্যথিত অনুভব করছেন। এবার মোস্তফা সাহেব এগিয়ে গেলেন। নরম সুরে আবদার করলেন,
–‘ এক কাপ চা হবে? ‘
জবেদা বেগম ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। কথার।মানে বুঝে মাথা দোলালেন। দ্রুত কন্ঠে বললেন,
–‘ আনছি এক্ষুনি। ‘
–‘ নিয়ে রুমে এসো। আমি অপেক্ষায় তোমার। ‘
__________
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় কাঁঠালতলিতে অবস্থিত একটি ইকোপার্কে। পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে অন্যতম বিখ্যাত ইকোপার্ক। এই স্থানটিতে বর্তমানে রেস্টহাউজ ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এই ইকোপার্কের অন্যতম আকর্ষণ হলো, মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, পরিকুন্ড জলপ্রপাত, শ্রী শ্রী মাধবেশ্বরের তীর্থস্থান এবং চা বাগান। ইকোপার্কে চলে গেলে বেশকিছু সুন্দর সুন্দর জায়গা অনায়াসে ঘুরা যাবে। এই স্বপ্নে বিভোর অরু। সে পারলে সবকয়টি জায়গা ঘুরত। কিন্তু তা কি আদৌও সম্ভব?

মৌলভীবাজার জেলায় ঢুকেছে গাড়ি। আজ ড্রাইভিং করছে আকাশ। তন্ময় কপালে আঙুল চেপে বসে। ভুরু জোড়া কুঁচকে আছে সামান্য। হুট করে তার মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। ভীষণ মাথা ব্যথা। অরু নিজের কাঁধ ব্যাগে দুটো ফ্ল্যাক্স এনেছে। একটা কফি আর একটা চায়ের। এখন সে তন্ময়কে সাধবে নাকি না? পুকুর পাড়ের ঘটে যাওয়া ঘটনার পর থেকে বেশ লজ্জায় পড়েছে সে। মুখ ফুটে কথা বলতেও দ্বিধাবোধ করছে। সে তো শুধু তন্ময়কে পুকুরে ফেলতে চেয়েছিল! অথচ কি থেকে কি হয়ে গেলো তখন! শাবিহার পাশে কলি বসেছে।
পেছনে রুবি, দীপ্ত এবং অয়ন। সামনে তন্ময় এবং আকাশ। কলি চিন্তিত ভাবে সামনের তন্ময়ের দিক তাকাচ্ছে আঁড়চোখে। অবশেষে লাজুক গলায় বলল,
–‘ কপাল মালিশ করে দিব একটু? ‘
গাড়ির মধ্যে নিস্তব্ধতা বয়ে গেল। সকলেই ঘুরেফিরে আঁড়চোখে তন্ময় এবং কলির দিক তাকাল। কলি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলেছে। মুখ তুলে তাকাতে অবদি পারছেনা। তার ঠোঁট জুড়ে লাজুক হাসি।কিন্তু অরুর মোটেও পছন্দ হলোনা বিষয়টা। পড়ে ভাবলো কলি তার মতো তন্ময়ের ও আপনজন। বোন হিসেবে বলতেই পারে, তাতে নেগেটিভ ভাবার কিছু নেই! নিজেকে বুঝিয়েও কেন যেন মন বুঝতে নারাজ। পরপর তন্ময়ের প্রত্যাখ্যান শোনা গেল। তার মালিশ লাগবেনা। এবার শাবিহা অরুর হয়ে বলল,
–‘ অরু কফি এবং চা দুটোই এনেছে। খাবি? গরম গরম কফি খেয়ে দেখ, ভালো লাগবে। ‘
তন্ময় কিছুক্ষণ চুপ রইলো। তবে সময় নিয়ে মাথা দোলালো। একটু কফি খেলে মাথা ব্যথা কমতে পারে। অয়ন হাসি মুখে বলল,
–‘ অরু আমার জন্যও প্লিজ। ‘
অরু হেসে উঠলো,
–‘ ঠিকাছে৷ ‘
আকাশ বলল,
–‘ আমার জন্যে ও! ‘
অরু শব্দ করে হাসলো,
–‘ আচ্ছা। ‘
এবার দীপ্ত, রুবিও খাবে বলছে। শুধু কলি কিছু বলছে না৷ চুপচাপ এক কোণায় বসে। লক্ষি মেয়েদের মতো। অরু তাকে জিজ্ঞেস করলো,
–‘ আপু খাবে? ‘
–‘ না। আমি ঠিকাছি। ‘
শাবিহা বলল,
–‘ কেন? খা কলি। ভালো লাগবে। ‘
–‘ আচ্ছা। ‘
অরু অবাক হলো বটে! সে জিজ্ঞেস করতেই খাবে না বলে দিলো। শাবিহা জিজ্ঞেস করতেই হ্যাঁ বলে দিলো! বিষয়টি কী? তবে অরু গুরুত্ব দিলো না। সবাই পর্যাপ্ত পরিমাণের কফি পেলো। অরু নিজের কফি শেষ করে বাহিরে নজর দিলো। জানালা ভেদ করে দেখতে লাগলো সবুজের সমাহার। মনে হচ্ছে সে সবুজের পৃথিবীতে চলে এসেছে। চারপাশের সবকিছু সবুজ আবডালে সাজানো। বড়বড় সবুজ গাছ গুলোকে লাগছে সবুজ পাহাড়। উঁচু উঁচু পর্বতে সবুজ ঘাষের মেলা। অরুর ইচ্ছে করলো ছুটে যেতে সেই সবুজের দেশে। নগ্ন পায়ে হাঁটতে ইচ্ছে করলো। সবকিছু ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।

উপজেলা বড়লেখার কাঁঠালতলিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে চারটা বেজে গিয়েছে। আর বেশি দেরি নয়। সামনেই ইকোপার্ক। কিছু মুহুর্তের অপেক্ষা এখন। শাবিহা নিজের ছোট ব্যাগ কাঁধে নিয়েছে। সেটা দেখে অরুও নিজের ব্যাগ কাঁধে নিয়েছে। যেমন এখন থেকেই তৈরি হচ্ছে বেরোনোর জন্য।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here