প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব -১৬+১৭

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ১৬
__________________________
শুক্রবার দিন সকাল সকাল শাহজাহান বাড়িতে হৈচৈ পড়েছে একপ্রকার! কেউ পূর্ব দিক ছুটছে তো কেউ পশ্চিম দিক৷ কেউবা উত্তর কেউবা দক্ষিণ৷ যেমন সুমিতা বেগম এবং জবেদা বেগম রান্নাঘরে রান্নাবান্নায় মহাব্যস্ত। অনেক দূরের রাস্তা পেরোতে হবে তাদের। মাঝরাস্তায় নিশ্চয়ই বাচ্চাদের খিদে পাবে। সাথে বড়োদের ও। তাই বেশকিছু ডিমান্ড করা আইটেমস রান্না হচ্ছে৷ জয়তুন বেগমের জন্য পুষ্টিকর স্যুপও বাড়িতেই রান্না করছেন৷ মোস্তফা সাহেব কিছুক্ষণ আগে এসে সকলের উদ্দেশ্যে বলে গিয়েছেন, নিজেদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম গুঁছিয়ে নিতে৷ প্রত্যেকজনের একেকটা ল্যাগেজ থাকতে হবে মাস্ট। নাহলে পড়ে দেখা যায়, একজন আরেকজনের ল্যাগেজে নিজেদের জিনিসপত্র ঢুকিয়ে রেখেছে৷ জিনিসপত্র না পেয়ে, হট্টগোল বাঁধিয়ে দিবে তখন৷ তাই আগেই সাবধান করে দিয়েছেন সবাইকে, নিজেদের ল্যাগেজ ব্যবহার করতে৷ এবং সবাই নিজেদের ল্যাগেজ তৈরি করতে ব্যস্ত৷ যেমন রুবি তার সাদা কামিজের ওড়না পাচ্ছে না৷ এটা তার কোন বোনের আলমারিতে চলে গেছে কে জানে! সে দৌড়ে দৌড়ে সকলের রুমের আলমারি চেইক করছে৷ অবশেষে ওড়না খুঁজে পেয়েছে তার মায়ের আলমারিতে৷ ওড়না নিয়ে নিজের রুমে দৌড় লাগিয়েছে। অনেক কাজ আছে! জিরিয়ে নেবার সময় নেই হাতে।
এদিকে দীপ্ত ছোট প্যান্ট পরে মুফতি বেগমের পেছনে দৌড়াচ্ছে ক্যামেরার জন্য৷ ক্যামেরা সে ভেঙে ফেলে বিদায় সেটা দীপ্তর ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখেন মুফতি বেগম৷ দীপ্ত বারবার বলে চলেছে,
–‘ সাবধানে রাখবো৷ ভাঙব না একদম৷ বের করে দাও মা! ‘
–‘ হাতের কাজ শেষ করতে দিবি তো নাকি? ‘
–‘ আগে দিয়ে যাও৷ নাহলে পড়ে ভুলে যাবো৷ ‘
–‘ তুই ভুলে যাবি তাও ক্যামেরার কথা? ‘
মুফতি বেগম চোখ উল্টিয়ে নিজের রুমের দিক রওনা হলেন৷ ক্যামেরা বের করে না দেওয়া অবদি এই ছেলে তাকে শান্তি দিবে না।
ওদিকে আকাশ নিজের পার্সোনাল ডিজাইনিং ক্যাপ খুঁজে পাচ্ছে না৷ জিন্স-প্যান্টের সাথে ক্যাপটা মারাত্মক দেখাবে, তাই না? ভাবতেই আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো ক্যাপের জন্য৷ সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে ক্যাপ পেয়েছে শাবিহার রুমে৷ শাবিহা ধুয়ে শুঁকতে দিয়েছে৷ আকাশ আসমানের আকাশ ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
–‘ এই তুই কি করে ফেললি শাবিহা! আমার ক্যাপটা খেয়ে দিলি? ‘
–‘ আশ্চর্য! আমি কি জানি নাকি এটা রঙ তুলিতে আঁকিবুঁকি করা ক্যাপ! আমিতো ধুয়ে দিয়েছিলাম ভালো মনে। ‘
–‘ ছাতার মাথা! তুই জানিস এটা আমি কতটা সময় নিয়ে এঁকেছিলাম? ‘
–‘ কিভাবে জানব না বললে? ‘
–‘ তোর জানতে হবেও না! ভাগ! ‘
দুঃখ বেদনা নিয়ে আকাশ বেরিয়ে গেল৷ এই ক্যাপ এখন বাদ! আজ, এখনই সে ক্যাপ কিনতে যাবে৷ ক্যাপ ছাড়া গ্রামে যাবেনা, ব্যস্।
জয়া বেগম তন্ময়ের ল্যাগেজ গোছাচ্ছেন। ছেলেটা আর্জেন্ট কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। ফিরতে দেরি হবে৷ তখন আর ল্যাগেজ গোছানোর সময় কই? তাই তিনি নিজেই ছেলের ল্যাগেজ গোছাচ্ছেন। অরু তার পাশেই প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে৷ অল্প একটু গরম ভাতের সাথে আলুভাজি! খাচ্ছে আর জবেদা বেগমকে
বলছে,
–‘ বড়ো মা ওই মেরুন রঙের শার্টটা নাও৷ ‘
–‘ হ্যাঁ এইটা খুব সুন্দর৷ ‘
–‘ জিন্সের প্যান্ট নিবে না? এটা বেশ ইউনিক! ‘
–‘ তন্ময় এটা পরেনা তো! ‘
–‘ তুমি নিলে না পরবে৷ নাও নাও! ‘
অরু নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাপড়চোপড় সাজেস্ট করছে৷ জবেদা বেগম তাই ল্যাগেজে নিচ্ছেন৷ অরু মনে মনে ভীষণ খুশি৷ এগুলো সব তার পছন্দের কাপড়চোপড়৷ গ্রামের সাতদিন তন্ময় শুধু তার পছন্দের কাপড়চোপড় পরবে।

শাবিহা বেশ চিন্তায় পড়েছে৷ সে এখনো সিলেট যাওয়ার কথা অয়নকে বলেনি৷ ছেলেটা কি রিয়েকশন দিবে? রেগে যাবে নাকি অভিমান করবে? চিন্তায় মগ্ন সে ল্যাগেজ গোছাচ্ছে৷ আঁড়চোখে কয়েকবার ফোনের দিক তাকাল৷ এখনো কোনো মেসেজ বা কল করেনি। শাবিহার হৃদয় বিষন্ন হয়ে উঠছে। পরে বিষয়টি জানলে অয়ন খুবই কষ্ট পাবে৷ দ্রুতভাবে সে সেলফোন তুলে সঙ্গে সঙ্গে অয়নকে কল করলো৷ আন রিচেবেল বলছে! অয়নের দ্বিতীয় সিমে কল করলো৷ এটায় কল ঢুকেছে৷ শাবিহা হ্যালো বলতে যাবে পূর্বেই একজন নারীর কন্ঠ ভেসে এলো,
–‘ হ্যালো কে? ‘
শাবিহার শ্বাসপ্রশ্বাস থেমে গেল৷ গলাটা চেনাচেনা লাগছে৷ অয়নের মায়ের কন্ঠ না? ওপাশ থাকে আবারো বলা হলো,
–‘ অয়ন ঘুমিয়ে৷ পরে কল করুন। ‘
কল কেটে গেল৷ শাবিহার হৃদপিণ্ড শান্ত হলো কিছুটা৷ ফোন রেখে গোসল করতে গেল৷ এসে সেলফোনে উঁকি মারল, না কল ব্যাক আসেনি।এখনো ঘুমিয়ে! ছেলেটা না বিজনেস করে? এই বিজনেস করার নমুনা! সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাচ্ছে, অথচ তিনি এখনো ঘুমিয়ে৷ অবশ্য ঘুমাবেই তো৷ সারারাত শাবিহাকে জ্বালাতন করেছে৷ কল কাটবে না তো কাটবে না৷ মধ্যরাত পর্যন্ত শাবিহাকে ফোন কানে রাখতে হয়েছে৷ ভাবতে বসেই অয়নের কল ব্যাক এলো। ঘুমন্ত কন্ঠ৷ যেমন এখনো বিছানায় চোখ বুঝে শুয়ে৷
–‘ ফ্রেশ হয়ে কল ব্যাক করি? ‘
শাবিহা সিলেটের কথা বলতে নিয়ে থেমে গেল৷ আরে পড়ে ব্যাক করবে মানে? মাত্র দু-এক ঘন্টা বাকি৷ তারপর তারা সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হবে৷ শাবিহা ভাবলো ভালোই হয়েছে। পড়ে আর তাকে দোষারোপ করতে পারবে না৷ সে সাফসাফ বলে দিবে, ‘ তোমাকে কল করে বলতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু তুমি শুনতে চাও নি। ‘
কিন্তু মনেমনে শাবিহার খারাপ লাগছে৷ অয়নকে রেখে তার যেতে ইচ্ছে করছে না৷ সপ্তাহ খানের দেখাসাক্ষাৎ হবেনা, বিষয়টি আসলেই বেদনাদায়ক!
শাবিহা কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে একটি মেসেজ পাঠাল অয়নকে, ‘ সিলেট যাচ্ছি পরিবারের সাথে সপ্তাহ খানেকের জন্য। সাবধানে থেকো! ‘
মিনিট পাঁচেক পর অয়নের ছোট্ট জবাব এলো,
‘ ওকে! ‘
শাবিহার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো যেমন। মাত্র ওকে? ব্যস? আর কিছুনা? কোথায় অয়ন হন্তদন্ত ভঙ্গিতে তাকে কল করবে! চিন্তিত সুরে জানতে চাইবে, হঠাৎ সিলেট কেন যাচ্ছে ইত্যাদি! অথচ ছেলেটা শুধু লিখেছে ওকে? শাবিহা ভাবলো অয়ন নিশ্চিত এখনো ঘুমের ঘরে৷ নাহলে এমন রিপ্লাই তার অয়নের হতেই পারেনা৷ একদম না!
___________
তন্ময় ফিরেছে যখন তখন সবাই নিজেদের ল্যাগেজ নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে৷ সকলে তৈরি! এখন তন্ময় রেডি হলেই বেরিয়ে পড়বে! মোস্তফা সাহেব হাত ঘড়িতে নজর বুলিয়ে বললেন,
–‘ তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এসো৷ ল্যাগেজ গাড়িতে তোলা হোক তাবত! ‘
তন্ময় মাথা দুলিয়ে উপরে চলেছে৷ তন্ময়ের পেছন পেছন দীপ্ত ছুটলো৷ সে কালো প্যান্টের সাথে সাদা টি-শার্ট পরেছে৷ গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে মাথায় সানগ্লাস দিয়েছে। আপাতত তন্ময়ের পেছন ছুটছে ঝাকড়া মাথার চুলগুলো স্যাট করতে এবং পারফিউম দিতে। তন্ময় রুমে ঢুকেই ওয়াশরুম ঢুকে গেল৷ সেই মুহুর্তেই অরু উঁকিঝুঁকি মারল৷ সে সম্পুর্ন রেডি৷ আনোয়ার সাহেবের শার্টের সাথে মিলিয়ে, নেভি ব্লু কামিজ পরেছে। ব্লু রঙের সানগ্লাস মাথায় দিয়ে রেখেছে। উঁচু জুতো জোড়া খটখট শব্দ তৈরি করছে। তন্ময়কে চারপাশে দেখতে না পেয়ে রুমে ঢুকে গেল৷ বাথরুম থেকে শব্দ আসছে। নিশ্চয়ই গোসল করছে? অরু আলগোছে সেখানে ওঁৎ পেতে রইলো। পেছন থেকে দীপ্ত পারফিউম শরীরে দিতে নিয়ে বলল,
–‘ এমন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছ যে? ‘
অরু ভয় পেয়ে ধীর স্বরে, ‘ আল্লাহ গো! ‘ বলে কেঁপে উঠলো৷
–‘ তুই কখন এলি?’
–‘ অনেক আগেই৷ কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে পাবেনা কারণ তন্ময় ভাই ছাড়া তোমার চোখে আর কেউ কি আছে? ‘
অরু চোখজোড়া বড়সড় করে বলল,
–‘ কীসব বলছিস? ‘
–‘ আমি সব জানি হি হি! ‘
দীপ্ত চিকন সুরে গান গেয়ে দুলতে দুলতে চলে গেল৷ অরুর ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে এসেছে৷ আঁড়চোখে বাথরুমের দিক তাকিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো৷ আবার উঠে দাঁড়ালো। এভাবে বসে থাকা ভালো দেখায় না বলে বাইরে চলে এলো৷ কিছুক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের রুমে চলে এলো৷ নিজেকে আয়নায় পর্যবেক্ষণ করে নিল! সবকিছু নিয়েছে নাকি চিন্তাভাবনা করলো৷ হ্যাঁ সব নিয়েছে৷ ল্যাগেজ ধরে অরু বেরিয়ে পড়লো। যাওয়ার সময় আবারো উঁকি দিল। তন্ময় শার্ট পরছে৷ তন্ময়ের সুঠাম দেহের কিছু অংশ দেখে লজ্জা পেল৷ দ্রুত পায়ে নিচে চলে এলো। এভাবেও তন্ময়কে চুমু দেবার পর থেকে অরু ভীষণ লজ্জা পেতে শুরু করেছে৷ সে আগের মতো তন্ময়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেনা৷ হৃদয় কাঁপে!

মোট চারটি গাড়ি নেওয়া হয়েছে৷ দুটো বড়ো গাড়ি এবং দুটো ছোট গাড়ি৷ বড়ো গুলোর মধ্যে মুরব্বিরা যাবেন৷ ছোট দুটোর মধ্যে বাচ্চারা। অরু ছোট একটা গাড়ির মধ্যে উঠতে গিয়ে অয়নকে দেখল। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাইকে উঠছে। পরনে জিন্সপ্যান্ট – শার্ট! অরু মুহুর্তেঅ দৌড়ে বাইকের সামনে এসে পৌঁছাল৷ অরুর দেখাদেখি দীপ্তও ছুটে এসেছে। তাদের কিছুটা সামনেই মোস্তফা সাহেব এবং ওহী সাহেব দাঁড়িয়ে৷ অয়ন এখনই হেলমেট পড়ে বাইক স্টার্ট করবে, এমন ভাব। অরু দ্রুত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
–‘ কোথায় যাচ্ছ অয়ন ভাইয়া? ‘
–‘ শহরের বাইরে! আম্মু আব্বু বিজনেস ট্যুরে গেছেন। একলা অনুভব করছিলাম বিদায় ভাবলাম কোথাও থেকে ঘুরে…. । ‘
আনন্দে অরুর চোখজোড়া জ্বলছে করছে। মাঝপথে অয়নকে থামিয়ে বলল,
–‘ আমরা সিলেট যাচ্ছি সবাই মিলে৷ তুমি যাবে আমাদের সাথে? ‘
–‘ এটা কীভাবে হয়? তোমরা পরিবার মিলে যাচ্ছ! আমি বাইরের লোক কেমন দেখাবে? ‘
অরু মোস্তফা সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,
–‘ চাচ্চু দেখ না! তুমি একটু বুঝিয়ে বলো ত! আমরা আমরাই তো তাই না? একা একা অয়ন ভাইয়া কোথায় ঘুরবে? আমাদের সাথেই চলুক। ‘
মোস্তফা সাহেব এগিয়ে এসে অয়নের কাঁধে হাত চেপে হেসে বললেন,
–‘ চলো আমাদের সাথে৷ তুমি এলে ভালো লাগবে৷ ‘
–‘ কিন্তু… ‘
পেছন থেকে আকাশ এসে বলল,
–‘ আরে কীসের কিন্তু ব্যাটা? চল আয় একসাথে
যাবো! ‘
অয়ন লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকে বলল,
–‘ আপনাদের সমস্যায় ফেললাম তাহলে! ‘
–‘ কোনো সমস্যা নেই! ‘

আনোয়ার সাহেব গাড়িতে উঠতে নিচ্ছিলেন। হুট করে মন পড়লো তিনি সেলফোন বিছানায় ফেলে এসেছেন। অরু তার সামনেই দাঁড়িয়ে৷ তাই অরুকেই বললেন,
–‘ আম্মু দৌড়ে সেলফোন আনতে পারবে না? ‘
–‘ খুব পারবো! ‘
বলতে বলতে অরু দৌড় লাগালো৷ ভেতরে ঢুকতেই দেখল তন্ময় নামছে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে৷ অরু আঁড়চোখে তাকিয়ে আনোয়ার সাহেবের রুমের দিক ছুটলো। সেলফোন সহ ফিরতে নিয়ে তন্ময়কে যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে এটা সে মোটেও আশা করেনি। অরু ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে আছে। তন্ময় সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে৷ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে সে যাবে কীভাবে? হুট করে তন্ময় পকেট থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে আসলো৷ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে অরু কিছুটা পিছিয়ে গেল৷ তার মুখশ্রীর থুতনি জুড়ে কালি লেগে আছে৷ হয়তো কাজল! তন্ময় সেখানটাই মুছতে ধরলো৷ অল্প ঘষতেই অরুর মেক-আপ উঠে এলো। রুমালে লেগে থাকা হলদে মেক-আপ দেখে তন্ময় বাকরুদ্ধ! অরু হাসার চেষ্টা করে বলল,
–‘ এভাবে ডলাডলি করলে ফাউন্ডেশন তো
উঠবেই! ‘
–‘ দেখি দাঁড়া সোজা হয়ে! এভাবে নড়চড় করছিস কেন!’
মুখ বেঁকিয়ে অরু সোজাসাপ্টা ভঙ্গিতে দাঁড়ালো৷ মনেমনে আওড়াল, আপনি স্পর্শ করলে আমি আর নিজের মধ্যে থাকিনা৷ আপনি কী বোঝেন কিছু? অভিমান পুষে অরু অন্যদিকে তাকিয়ে। সে আবদার করতে চাইলো গাড়িতে তন্ময়কে তার সাথে বসতে দিতে৷ তারপর ভাবলো থাক কি দরকার! এগুলো কিছুই কখনো লোকটা বুঝবে না৷ হঠাৎ চোখ গেল রান্নাঘরের দিক! মুফতি বেগম দু’হাতে টিফিনবাক্স নিয়ে বেরোচ্ছেন। তন্ময়ও দেখেছে৷ অরুর থুতনি মুছে মুফতি বেগমের দিক এগিয়ে গেল৷ তার থেকে টিফিনবাক্স নিয়ে বেরিয়ে পড়লো৷

শাবিহা বেশ চিন্তিত৷ অয়নের চিন্তায় মাথা ফেটে যাবার জোগাড়৷ বেশ কয়েকবার সেলফোন চেইক করেছে। কোনো মেসেজ নেই৷ চিন্তিত শাবিহা যখন অয়নকে আকাশের সাথে হাসি তামাসা করে গাড়িতে উঠতে দেখল, মুহুর্তেই পাথর বনে গেল। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো৷ অয়ন হুট করে ফিরে চোখ মেরে আবারো ভদ্রলোক সেজে থাকলো। শাবিহা হতভম্ব! দীপ্ত পাশ থেকে খোলাখুলি আলোচনা করছে অয়নের সম্পর্কে। সবকিছু শুনে শাবিহা বুঝতে পারল, তার ঘন্টা খানেকের চিন্তা কোনো কাজেরই না৷ এই ছেলে আগ থেকেই সব জেনেশুনে এই চাল পেতে রেখেছে৷ কতটা সেয়ানা! শাবিহা রাগ করে মুখ ফুলিয়ে রাখল। কথা নেই তার ওই ছেলেটার সঙ্গে!

চারটে গাড়ি একসাথে রওনা হয়েছে সিলেটের উদ্দেশ্যে৷ ঘুরেফিরে সবশেষে অরু নিজেকে তন্ময়ের গাড়িতেই পেল। তন্ময়ের পাশে! খুশি হবে নাকি ব্যথিত, বুঝতে পারলো না! তবে অরু খুব খুশি৷ পরিবারের সাথে ঘুরতে যাওয়া তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি! আর সিলেট ঘুরবে ভেবে তার সর্বাঙ্গ জুড়ে প্রত্যাশা জেগে উঠলো৷ জাফলং, মাদবকুন্ড জলপ্রপাত, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ চায়ের শহর মৌলভীবাজারও অরু ঘুরতে চায়৷ মোট কথা, সিলেটের সব সুন্দর সুন্দর জায়গা সে ঘুরতে চায়৷

চলবে ~~~প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ১৭
__________________________
রাত সাতটার মধ্যে সিলেটের গন্ডি পেরোনোর কথা। সেখানে তাদের গাড়ি এখনো ঢাকার ত্রিসীমায়। জ্যাম দিয়ে ভর্তি ঢাকার রাস্তাঘাট৷ তার উপর মধ্য- রাস্তায় ধর্মঘট পড়েছে৷ সম্পুর্ন রাস্তা পরিবর্তন করতে হয়েছে৷ মধ্যে আবার মোস্তফা সাহেবদের গাড়ি ব্রেকডাউন খেয়েছে। সেটাকে মেরামত করতে তিন ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে৷ এখন সন্ধ্যা নেমেছে! আঁধার হয়েছে পৃথিবী৷ তন্ময়দের গাড়ি নিরবচ্ছিন্ন রাস্তা ধরেছে। রাস্তার দু’পাশে ফেলে যাচ্ছে সারি সারি গাছ, দালানকোঠা! তন্ময়ের গাড়ির পেছনে তিনটা গাড়ি সোজাসাপটা সারি করে আসছে৷ একটি গাড়িও আগপাছ হচ্ছে না। দীপ্ত বসেছে তন্ময়ের গাড়িতে৷ তার দুপাশে অরু এবং শাবিহা! সে তার দু বোনের মধ্যে লেপ্টে আছে। ড্রাইভিংয়ে তন্ময় এবং তার পাশে অয়ন। তন্ময় ড্রাইভ করার পাশাপাশি টুকটাক আলোচনা করছে অয়নের সাথে। দীপ্ত নড়েচড়ে উঠছে একটু পরপর। যেমন তার অস্বস্তি হচ্ছে!
–‘ আমাকে চেপে মেরে ফেলবে নাকি! ‘
–‘ তুই তো বললি আমাদের সাথে লেপ্টে বসতে চাস। ‘
–‘ বলে বড়ো পাপ করে ফেলেছি। আমাকে মুক্তি দাও প্লিজ! ‘
হেসে অরু জানালার দিক চেপে গেল। হঠাৎ দীপ্ত শব্দ করে বায়ু দূষণ করে বসলো। নিস্তব্ধ গাড়ির মধ্যে শুধু তার উচ্চ শব্দের বায়ু দূষণের আওয়াজ শোনা গেল। চমকে উঠেছে অরু, শাবিহা৷ পরপর শব্দ করে হাসতে লাগলো৷ লজ্জায় হতভম্ব ছোট দীপ্ত৷ কিন্তু এখন লজ্জা দেখাবার সময় নেই। পূর্বেই সে পেট দু’হাতে চেপে ধরলো৷ হুট করে ভীষণ পেট ব্যথা করছে৷ দীপ্ত হু হু করে কেঁদে উঠলো,
–‘ আমার আর্জেন্ট দুই ধরেছে তন্ময় ভাইয়া৷ ইট’স ভেরি আর্জেন্ট। পেটের মধ্যে খুটুরমুটুর করছে৷ কিছু একটা করো! আমি বোধহয় প্যান্টেই করে বসব। মানে গাড়িতেই! ‘
তন্ময় অস্পষ্ট স্বরে ‘ শিট! ‘ বলে দ্রুত গাড়ি থামাল।
–‘ একটু অপেক্ষা করতে পারবি না? ‘
–‘ একদম না৷ ‘
–‘ আটকে রাখ, দেখছি! ‘
তন্ময় চারপাশে নজর বোলালো৷ আশপাশে শুনশান নিরবতা। এদিকটায় বাড়িঘর নেই তেমন। তবে কিছুটা দূরে কিছু বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে৷ সে আবারো গাড়ি স্টার্ট করলো, সেখানটায় গাড়ি থামাবে বলে৷ পেছনে দীপ্ত এতটুকু ধৈর্য ধারণ করতে পারছেনা। অরু দীপ্তর মাথা বুলিয়ে দিয়ে বলল,
–‘ ওইতো সামনে বাড়ি৷ আরেকটু অপেক্ষা কর শোনা!’
তন্ময়ের গাড়ি থামতেই পেছনের গাড়িগুলোও থেমে গেল। মোস্তফা সাহেব কাঁচ খুলে মাথা বের করে ছেলের উদ্দেশ্য বললেন,
–‘ কি সমস্যা তন্ময়? ‘
তন্ময় মোস্তফা সাহেবের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল৷ ইশারায় তার গাড়ি দেখিয়ে বলল,
–‘ দীপ্তর বাথরুম পেয়েছে৷ স্যাটেল করে আসছি৷ তোমাদের অপেক্ষা করতে হবেনা! তোমরা যেতে থাক। ‘
–‘ আচ্ছা আসো তাহলে। ‘
মোস্তফা সাহেবদের গাড়ি সহ বাকি দুটো গাড়ি চলে গেল। গাড়ি যেতেই দীপ্ত নড়েচড়ে পেট ধরে দ্রুত পায়ে বেরিয়েছে৷ পেট ব্যথায় তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অয়ন বেরিয়ে দীপ্তকে ধরে রেখেছে ৷ ছেলেটা ব্যথায় ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছে। তন্ময় অরু আর শাবিহার উদ্দেশ্যে বলল,
–‘ তোদের কারো বাথরুম ব্যবহার করতে হবে? এখনই করে নিতে পারিস সামনে বাড়িঘর পাওয়া মুশকিল৷ খুব নিরব অঞ্চলে পড়বে বাকিটা রাস্তা। ‘
শাবিহা অরুর দিক তাকাল৷ অরু মাথা দোলাল। তার বাথরুম ব্যবহার করতে হবেনা৷ শাবিহারও প্রয়োজন নেই৷
–‘ তাহলে গাড়ি লক করে যাচ্ছি ভেতরেই থাক। ‘
গড়ি লক করে দীপ্তকে নিয়ে তন্ময় এবং অয়ন একটি কোয়াটার বাসার সামনে এলো। এই বাড়িটার দরজা খোলা। বাকি দুটোর সদরদরজা আটকে রাখা! সেখানে কড়াঘাত করার থেকে ভালো, খোলা বাড়ি থেকে সাহায্য চাওয়া। একজন বৃদ্ধা দরজার সামনে চেয়ার পেতে বসে আছে৷ হাতে লাঠি। তন্ময় তাকেই জিজ্ঞেসবাদ করলো, বাথরুম ব্যবহার করা যাবে নাকি! বৃদ্ধা ভীষণ সৌখিন প্রজাতির মানুষ৷ তিনি লাঠি হাতে উঠে দাঁড়ালেন৷ হাসিমুখে দীপ্তকে সাথে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। তন্ময় পিছু পিছু গেল। দীপ্তকে বাথরুমে দিয়ে বেরিয়ে আসলো৷ পেছন পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করলো৷ সিগারেট খানা ঠোঁটে গুঁজে ধরলো। আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষন লাইটার ঘুরালো। একসময় সেটা দ্বার সিগারেট ধরিয়ে টান মারল৷ মাথা উঁচু করে আকাশের পানে, নিকষকালো ধোঁয়া ছেড়ে দিল। তার চোখ অয়নের দিক যেতেই, অয়ন কন্ঠে বিষ্ময় নিয়ে বলল,
–‘ ভাই তুমি সিগারেট খাও? ‘
–‘ হু! মাঝেসাঝে৷ ‘
–‘ আমি এসব মোটেও খাইনা। এগুলো খেলে তো ক্যান্সার হয়। হৃদপিন্ড পুড়ে ছারখার হয়ে যায়৷ ‘
তন্ময় হাসলো৷ অয়নের কাঁধ চাপরে বলল,
–‘ আমিতো তোকে প্রায়শই দেখি আলী চাচার দোকানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে৷ ‘
অয়ন ঠোঁট কামড়ে ফেললো৷ ভালো সাজতে গিয়ে খারাপ হয়ে গেল৷ লজ্জিত অয়ন হেসে বলল,
–‘ ভাই ওই আরকি মাঝেমধ্যে.. ‘
–‘ সিগারেট খাওয়া বাবা পছন্দ করেন না৷ তাই কমিয়ে দিয়েছি৷ তবে হুটহাট মাথায় চড়ে বসলে খাই একটু আকটু! ‘
–‘ সেইম ভাই! আমারও৷ ছাড়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনা। ‘
–‘ আছে না দিব? ‘
–‘ আছে দুটো৷ ‘
অয়ন নিজের পকেট থেকে একটা বের করে ঠোঁটে গুঁজল। সিগারেট’টা তন্ময়ের লাইটার দিয়ে ধরালো। দুজন নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে৷ নিরজন পরিবেশ শীতল আবহাওয়া! দু’একজনের যাতায়াত দেখা দিচ্ছে৷ মিনিট খানেক পর দীপ্ত বেরিয়ে আসলো৷ চোখমুখে তৃপ্তির হাসি। তন্ময় শুধালো,
–‘ এখন ভালো লাগছে? ‘
–‘ হ্যাঁ ভীষণ। কি যে খারাপ লাগছিল তখন বলে বোঝানো যাবেনা! ‘
হেসে অয়ন দীপ্তকে নিজের ঘাড়ে তুলে নিল। দীপ্ত ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো৷ পরপর নিজেকে সামলে নিয়ে, আনন্দে পা দোলাচ্ছে৷ কোলে ওঠার যে কি আরাম তা সে মুখে বলবে না৷ পুরুষ মানুষ কোলে চড়ে নাকি? গাড়ির সামনে আসতেই অয়ন নামিয়ে দিল দীপ্তকে। তন্ময় ড্রাইভিংয়ে উঠে বসলো৷ পাশে অয়ন। দীপ্ত সেই দুই বোনের মধ্যে গিয়ে বসেছে৷ চিন্তিত সুরে অরু বলল,
–‘ ব্যথা কমেছে? ‘
–‘ হু৷ খিদে পেয়েছে এখন। প্রচন্ড! ‘
শাবিহা বলল,
–‘ বাবার গাড়িতে খাবার আছে। দাঁড়া গাড়িটা আমরা ধরে নেই। ‘
অরু বলল,
–‘ কিছুক্ষণ পর ডিনারের জন্য নিরিবিলি যায়গায় গাড়ি পার্ক করা হবে৷ তখন খেয়ে নিস! ‘
–‘ অতক্ষণ আমি অপেক্ষা করব?’
–‘ আলবাত করবি। ‘

মোস্তফা সাহেবের গাড়ি ধরতে তন্ময়ের আধঘন্টা লেগেছে মাত্র। চারটি গাড়ি এখন একসাথে চলছে৷ মোস্তফা সাহেবের গাড়ির পাশে গাড়ি নিয়ে তন্ময় শব্দ করে বলল,
–‘ দীপ্তর খিদে পেয়েছে৷ ‘
–‘ রাত আটটা এখন। সিলেটের সীমানা ধরতে কমছে কম আরও দু’তিন ঘন্টা লাগবে৷ অর্ধেক রাস্তাও শেষ করিনি। ‘
–‘ পূর্ব অঞ্চলে গাড়ি থামাব? সেখানটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন! মানুষজনের যাতায়াতও ভীষণ কম। ‘
–‘ তাই করো তাহলে। ‘
তন্ময় একটানে সামনে চলে গেল। মিনিট দশেকের পর গাড়ি থামিয়েছে পর্বতের চুড়ায়৷ এখানে টুকটাক পাথরের মেলা৷ হলদে স্ট্রিট লাইটের খাম্বা গাড়া বড়সড়। চারপাশ উজ্জ্বল। এখান থেকে আকাশের চাঁদ স্পষ্ট ভাবে কাছে দেখায়৷ যেমন হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেওয়া যাবে। গাড়ি থেকে নেমে এসেছে মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব এবং ওহী সাহেব। পরপর আকাশ ও বেরিয়ে এসেছে৷ শুধু বিবাহিত নারীগণ গাড়িতেই৷ অরু, শাবিহা, রুবি মোস্তফা সাহেবদের সঙ্গে৷ তারা বোনেরা মিলে গাড়ি থেকে খাবার এনে বাপ-চাচাদের হাতে দিয়ে যাচ্ছে। অরু তন্ময়ের পছন্দের ডিস প্লেটে নিয়ে, গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সবে৷ তন্ময় গাড়ির বোনাটের উপর বসে আছে। প্লেট তার হাতে ধরিয়ে অরু নিজের খাবার আনতে চলে গেল৷ খাবার নিয়ে এসে অয়নের পাশে দাঁড়ালো৷ তার অয়নের সাথে জমে ভালো৷ কথায় কথায় বলল,
–‘ অয়ন ভাইয়া এখান থেকে চাঁদ দেখতে বেশ স্বচ্ছল লাগছে তাই না? ‘
–‘ হ্যাঁ৷ বিষয়টি এমন আমাদের ওদিকে দালানকোঠা এবং গাছগাছালির মেলা। সেখান থেকে চাঁদ দূর আসমানে দেখায়৷ তবে এখানটা সম্পুর্ন ফকফকা৷ নদীর ঝিলসে যাওয়া পানি বিহীন তৃতীয় কিছু নেই। তাই আমরা সরাসরি দেখতে পাই চাঁদ’টাকে! মনে হয় এইতো কাছে৷ হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবো। ‘
–‘ হ্যাঁ৷ সাথে নদীর দিক লক্ষ্য করো। চাঁদ প্রতিফলিত হয়েছে৷ মনে হচ্ছে নদীর মধ্যে আরেকটি চাঁদের পৃথিবী। ‘
দুজন গল্পে মশগুল৷ এই দুজনকে শাবিহা আঁড়চোখে দেখে তন্ময়ের পাশে এসে দাঁড়ালো৷ দুই ভাইবোন একটু খাচ্ছে তো আরেকটু চাঁদের দিক তাকাচ্ছে, নাহলে গল্পে মশগুল দুই ব্যক্তির দিক। যারা দুনিয়া ভুলে প্রকৃতির প্রেমে ডুবে বসে। পৃথিবীর মানুষগুলো আসলেই নিষ্ঠুর!
__________
সিলেট চারটি জেলা নিয়ে গঠিত৷ সিলেট সদর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ। সিলেট সদর জাফলং নিয়ে বিশ্ব পরিচিত। জাফলং’কে প্রকৃতির কন্যাও বলা হয়। তেমন মৌলভীবাজার বিশ্ব বিখ্যাত মাদবকুন্ড জলপ্রপাতের জন্য। হবিগঞ্জ বিশ্বব্যাপী পরিচিত চায়ের জন্য, অপরদিকে সুনামগঞ্জের নাম উজ্জ্বল করে দেসবন্ধু মিষ্টি এবং পাথর! জবেদা বেগমের পিতৃস্থান সিলেট শহরের মৌলভীবাজার জেলায়। মৌলভীবাজার মনু নদীর তীরে অবস্থিত। শহরটির চা বাগান ও গ্রীষ্মমন্ডলীয় বনগুলির জন্য সুপরিচিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চা বাগান মৌলভীবাজারে অবস্থিত। মৌলভীবাজার উপজেলা শ্রীমঙ্গলে জবেদা বেগমের পিতৃস্থান , খান বাড়ি৷ বেশ সুনামধন্য পরিবার তার মৌলভীবাজার জেলার চেয়ারম্যান নরায়ুন মজুমদারের সাথে, জবেদা বেগমের বাবা হুশিয়ার সাহেবের খুব ভালো বন্ধুত্ব৷ তার উপর মৌলভীবাজারের সুনামধন্য রেস্টুরেন্ট খান বাড়ির মানে হুশিয়ার সাহেবের! এবং সাথে তাদের বেশকিছু মিষ্টিজাতীয় জিনিসের বিজনেস রয়েছে৷ পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন এবং হুশিয়ার সাহেব- জয়তুন বেগমের একমাত্র কন্যা হিসেবে জবেদা বেগম ছোট থেকেই ভালোবাসায় বড়ো হয়েছেন। আদরের মেয়ে জামাই হিসেবে মোস্তফা সাহেব সেই আদরে ভাগ বসিয়েছেন৷ তাকে একপ্রকার মাথায় তুলে রাখা হয়৷ ঠিক তাদের দুজনের ভাগ এসেছে তন্ময়ের কাঁধে৷ সে তার নানাবাড়ির চোখের মনি। তেমনই শাবিহা। তাদের মূল্য সেখানে অপরিসীম৷

গাড়ি মৌলভীবাজার মনু নদীর তীরে এসে পৌঁছেছে। কাঁচ নামিয়ে অরু মাথা বের করে দিয়েছে জানালা দিয়ে৷ হুড়মুড়িয়ে চোখমুখে বাতাস ছুঁয়ে গেল। সম্পুর্ন নিরজন চারপাশ। কাকপক্ষীও নেই কোথাও৷ গাড়ি থেকেই অরু বড়ো নদীর এক ঝলক পেয়েছে৷ রাতের চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে নদীর পানি। নদীটাকে ঘিরে আছে উঁচুনিচু গাছ। অরুর ইচ্ছে করছে গাড়ি থেকে নেমে যেতে। দৌড়ে ছুটে যেতে নদীর সামনে৷ নগ্ন পায়ে চারপাশে হাঁটতে৷ দু’একবার পা ভেজাতেও মন চাইল। কিন্তু এতরাত করে এটা কখনোই সম্ভব নয়৷ এদিকে তন্ময়ের নানাবাড়ি থেকে সমানে কল আসছে৷ এখনো কেন তারা পৌঁছোয়নি৷ পুরো বাড়ি তাদের অপেক্ষায় বসে৷ এমতাবস্থায় মনু নদীর তীর পর্যবেক্ষণ করার সময় কই? মন খারাপ করে অরু তাকিয়ে রইলো৷ গাড়ি চলছে অরু নদীর চারপাশ দেখছে৷ শুনেছে মনু নদী বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার একটি নদী৷ এই নদীর দর্শন করতে বিভিন্ন জেলা, দেশের মানুষ আসে। অরু ভাবছে কাল সকাল সে এখানে চলে আসবে। অরুর বিচলিত চেহারা লক্ষ্য করে শাবিহা বলল,
–‘ ভাই নদীর সামনে যাওয়া যাবেনা? ‘
–‘ না! এতরাত করে যাওয়া ভালো না। এখানে প্রায়শই ডাকাতি হয়। সব যায়গায় খারাপ লোক মিলে৷ রিস্ক না নেওয়াই ভালো৷ ‘
শাবিহা অরুর কানে ফিসফিস করে বলল,
–‘ কাল তুই আর আমি আসবো, হ্যাঁ? ‘
অরু খুশি হয়ে গেল। একটিবার নিজ চোখে চারপাশ না দেখলে তার শান্তি মিলবে না। তাই সে দ্রুত গতিতে মাথা নেড়ে বলল,
–‘ আচ্ছা। ‘
উপজেলা শ্রীমঙ্গলের সীমানায় পৌঁছেছে তাদের গাড়ি। বিশ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করেই পেয়েছে বিশাল জমিন নিয়ে তৈরি খান বাড়ি। সাদা রঙে রাঙানো বাড়ি থেকে সদরদরজা অবদি। বাড়ির চারপাশ বড়বড় দেয়াল দিয়ে আটকে। কারুকার্য করা চারপাশের দেয়ালে৷ দেয়ালের উপরে বড়বড় কাঁটা ব্যবহার করা হয়েছে৷ আর কারণ, রাতবিরেত ডাকাতি, চোরের হামলা হতেই পারে। দেয়ালের বাইর- ভেতর দিয়ে উঠেছে আসমান ছোঁয়া গাছগাছালি। এই রাতের আঁধারে একটি ভুতুড়ে বাড়িও বলা যেতে পারে। ভুতুড়ে বাড়ি বললেও বাড়ির সৌন্দর্য একাংশে ঘাটতি পড়বে না।
সদরদরজার সামনেই একজন সু’সাস্থ্যবান বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে৷ ইনি হুশিয়ার খান। জয়তুন বেগমের স্বামী, জবেদা বেগমের বাবা এবং তন্ময়ের নানা। ঘন্টা ধরে তিনি এখানেই ঘুরঘুর করছেন যেমন বাড়ির ভেতরে মন টিকছে না। গাড়ি দেখে তিনি স্পষ্ট বাংলা ভাষায় আওয়াজ দিলেন ছেলেদের। তবে তাতে সিলেটি টান রয়েই গেল।
–‘ এই আবু বক্কর, শফিক, রাসেল, মোজাহিদ বাইরে আয় তাড়াতাড়ি। ‘
–‘ আব্বা আইসি। ‘
বলতে বলতে মোজাহিদ সাহেব লুঙ্গি পরে বেরিয়ে এলেন। তার পেছনে এসেছে তার বড়ো মেয়ে কলি। উনিশ বছরের যুবতী। অন্যদিন গুলো হলে এসসময় কলি ছেঁড়া কাপড়চোপড় পরেই নিজের ঘরে পড়ে থাকতো। তবে আজকের দিন আর অন্যদিন তো এক নয়। আজকের দিন অন্যদিনের থেকে ভিন্ন। তাই সে সুন্দর ভাবে সেজেগুজে আছে। পরপর শফিক সাহেবও বেরিয়ে এসেছেন। তার সাথে এসেছে স্ত্রী নাজমা। মোস্তফা সাহেব আগে শ্বশুরের কাছে এলেন। জড়িয়ে ধরে বললেন ,
–‘ ভালো আছেন আব্বা? ‘
–‘ আলহামদুলিল্লাহ বাপজান৷ ভালাই আছি। চলো, চলো বাইরে দাঁড়ানোর লাগবো না। ‘
তন্ময়, শাবিহাকে দেখে তাদের বুকে জড়িয়ে নিলেন হুশিয়ার সাহেব। পরপর সালাম জানালেন আনোয়ার সাহেব, ওহী সাহেবকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন অরু, রুবি এবং দীপ্তর। আলাপ-আলোচনার মধ্যে ঢুকছেন ভেতরে। মুজাহিদ সাহেবদের সঙ্গে তন্ময়, অয়ন, আকাশও ল্যাগেজ নিচ্ছে ভেতরে ।

চলবে ~~~~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here