প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব -১৪+১৫

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ১৪
__________________________
মনমেজাজ ভালো না হলে অরুর দিন খারাপ যায়৷ এইযে সকালে ঘুম থেকে উঠতে নিয়ে কাঁথায় পা পেঁচিয়ে শব্দ করে ফ্লোরে পড়ল৷ বাথরুমে ঢুকার সময় দরজার সাথে ধাক্কা লেগে ব্যথা পেল৷ বই ব্যাগে ঢুকাতে নিয়ে পায়ের উপর ফেললো৷ ব্যথায় চিৎকার করে, মরার মতো কিছুক্ষণ শুয়ে রইলো৷ সে’অবস্থায় সেলফোন টিপতে নিয়ে, হাত ফসকে ফোন মুখের উপর পড়েছে। ব্যথায় চোখের কোণ জলে ভিজে উঠলো। ব্রেকফাস্ট করতে নিচে নামার সময় পিছলে পড়তে নিয়ে নিজেকে সামলিয়েছে৷ তবে এখানেও হাতে একটু ব্যথা পেয়েছে৷ ভেজা নয়নে অরু ডাইনিংয়ে এসে বসেছে৷ জবেদা বেগম পরোটা প্লেটে দিতে দিতে বললেন,
–‘ নাকটা এমন লাল হয়ে আছে কেন? ‘
–‘ মোবাইল পড়েছে নাকে৷ ‘
–‘ ইশ! দেখি একটা বরফ ডলে দেই। ‘
–‘ না থাক৷ ‘
খেতে নিয়ে অরু ভুলেও পাশে তাকাচ্ছে না৷ মাথা ঝুকিয়ে খেয়ে চলেছে৷ তবে তার আনচান মন আছে না? এটা চুপচাপ থাকতে নারাজ৷ মন জানতে চাইছে তন্ময়কে কেমন লাগছে এবং সে কী পরেছে! আঁড়চোখে তাকিয়ে দ্রুত দেখে নিলো৷ তন্ময় আজ সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পরেছে৷ অরু খাবার রেখে উঠে গেল টেবিল থেকে৷ লোকটাকে দেখলেই অভিমানে তার গলা ধরে আসে৷ বেরিয়ে পড়লো কলেজের উদ্দেশ্যে৷ সাইকেল বের করতে নিয়ে দেখল, তন্ময়ও বেরিয়েছে৷ অন্যদিন হলে অরু দৌড়ে তন্ময়ের পাশে গিয়ে বসত৷ তবে আজ সে গেল না৷ সাইকেল চড়ে বেরিয়ে পড়লো৷ যার জন্য দুল কিনেছে তাকে নিয়েই গাড়ি চালাক। তাকে পাশে নয়, কোলে বসিয়ে রাখুক৷ অরু উঠবে না ওই গাড়িতে৷ অরু একদম দেখবে না এই লোককে!

তামান্নার হলদে রাত, অ্যাটেন্ড করার জন্য হলুদ শাড়ি এসেছে৷ খুব সুন্দর তাঁতের শাড়ি৷ অরুর খুব পছন্দ হয়েছে৷ শাড়ি তার দেখতে এবং ছুঁয়ে দিতেই ভালো লাগে, কিন্তু পরতে নয়৷ শাড়ি পরতে ভীষণ লজ্জা লাগে, তারউপর শাড়ি হ্যান্ডেল করতে জানে না। কুঁচি ধরে হাঁটতে নিলে হেলেদুলে পড়ে যায়৷ নাহলে কুঁচি খুলে যায়, আঁচল পড়ে যায়৷ এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে ভেবে, এতটুকু জীবনে হাতে গনা কয়েকবার শাড়ি পরেছে অরু৷ তাও মাত্র কিছু সময়ের জন্য। তবে আজ এই সুন্দর শাড়িটা সে পরবে৷ তাদের বাড়িতে মোট দুটো শাড়ি এবং দুটো পাঞ্জাবি এসেছে৷ শাড়ি একটা অরুর এবং অন্যটি শাবিহার৷ পাঞ্জাবি বড়োটা তন্ময়ের এবং ছোটো’টা দীপ্তর।
অরু নিজের শাড়ি নিয়ে জবেদা বেগমের কাছে চলে এসেছে৷ জবেদা বেগম খুব সুন্দর ভাবে শাড়ি পরাতে জানেন৷ তার শাড়ি পরানোর হাত মাশাআল্লাহ! বাড়ির সব নারীগণ জবেদা বেগম হতেই শাড়ি পরে থাকেন৷ অরু তাড়াতাড়ি এসেছে শাড়ি পরতে, নাহলে শাবিহা চলে আসবে নিজের শাড়ি পরতে৷ তারপর অরুর শাড়ি পরতে, তৈরি হতে খুবই দেরি হয়ে যাবে। তারপর দেখা যাবে, তন্ময় থেকে ধমক শুনতে হবে৷ আর সে আজ একদম ধমক শুনতে চায়না৷ শাড়ি পরতে নিয়ে সমানে হেসে চলেছে অরু৷ শরীরে খুব সুড়সুড়ি তার৷ ধরাছোঁয়া মুশকিল মেয়েটাকে৷ সুড়সুড়ির কারণে সে বারবার ছুটে এদিকসেদিক চলে যাচ্ছে৷ জবেদা বেগম হেসে বললেন,
–‘ এতো সুড়সুড়ি কোথা থেকে আসে তোর! ‘
–‘ তোমার নেই যেমন! ‘
এসময় উপস্থিত হয়েছেন মোস্তফা সাহেব। দরজার সামনে কেবলই এসে দাঁড়িয়েছেন৷ তাকে দেখে জবেদা বেগম চুপসে গেলেন৷ ঠোঁটের কোণের লাজুক হাসিও তৎক্ষণাৎ গায়েব হয়ে গিয়েছে৷
অরু আশপাশ কিছুই খেয়াল করেনি তখনো৷ সে খিলখিলিয়ে হেসে ঘুরেফিরে বলল,
–‘ তোমারও নিশ্চয়ই সুড়সুড়ি আছে, তাই না বড়ো মা? দেখি তো… ‘
বলতে বলতে জবেদা বেগমের কোমরে বেসামাল ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দিতে লাগলো৷ লজ্জায় জবেদা বেগম বাকরুদ্ধ৷ মোস্তফা সাহেব দ্রুত পায়ে ফিরে গিয়েছেন। জবেদা বেগম অরুর বেসামাল হাত জোড়া দু’হাতে চেপে নিয়ে বললেন,
–‘ থাম বান্দর! ‘
অরুকে শাড়ি পরাতে গিয়ে জবেদা বেগমকে বেশ হেনস্তা হতে হয়েছে৷ কপালের ভাজে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চোখের সামনে শাড়ি পরনে দাঁড়ানো অরুর সরল মুখশ্রী দু’হাতে নিয়ে বললেন,
–‘ মাশাআল্লাহ৷ আমার হুর-পরী৷ ‘
অরু লাজুক ভঙ্গিতে হাসছে৷ কুঁচি ধরে ঘুরেফিরে জবেদা বেগমকে দেখাচ্ছে৷ দু’একটা ডান্স স্টেপও করে দেখাল৷ জবেদা বেগম বললেন,
–‘ এমন বোয়ালমাছের মতো ছুটাছুটি করলে শাড়ি তো খুলে যাবে৷ ‘
–‘ ওহ্ হ্যাঁ! আচ্ছা এইযে, আর লাফালাফি ছুটাছুটি করবো না৷ ‘

কুঁচি ধরে হেলেদুলে জবেদা বেগমের রুম থেকে বেরিয়ে অরু যাচ্ছে রুবির রুমের দিক৷ সে সাজতে যাচ্ছে রুবির কাছে৷ রুবি খুব সুন্দর সাজাতে জানে৷ সে মেক-আপ কোর্স নিয়েছিল তিনমাসের৷ প্রায়শই বাড়ির মেয়েদের সেই সাজিয়ে দেয়৷ আর অরু বেশিরভাগ সময় তার হাতেই সাজে৷ অবশ্য অরু নিজেও সাজতে জানে৷ কিন্তু ওইযে অলসতা নামক একটা বস্তু আছে না? যেহেতু তার কাছের মানুষ আছে সাজানোর জন্য, তাহলে নিজে কেন কষ্ট করবে? রুবি রেগে ফোনে কথা বলছে৷ কিছু একটা নিয়ে ঝগড়াঝাটি করছে৷ অরুকে ইশারায় বসতে বলে বারান্দায় চলে গেল৷ অরু পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসেছে। মাথাটা বাঁকিয়ে রুবিকে আরেকদফা দেখে নিল৷ তার মনে হয়, রুবি প্রেম করে৷ অবশ্য সে এই বিষয়ে বেশ কয়েকবার প্রশ্ন করেছে রুবিকে৷ কিন্তু কোনো জবাব পায়নি৷ তাই সে আর এসব পার্সোনাল প্রশ্ন করেনা৷ তবে আন্দাজ করতে পারছে রুবির প্রেমিক কে! রুবি কিছুক্ষণ পরই কল কেটে ফিরে আসে৷ অরু আগ্রহ নিয়ে বলল,
–‘ ইব্রাহিম ভাইয়া ছিলো? ‘
রুবি চমকে উঠল৷ পরপর অরুর মাথায় গাট্টি মেরে বলল,
–‘ চুপ ফাজিল! ‘
–‘ আমি সব জানি৷ সামথিং সামথিং! ‘
–‘ নো! নাথিং নাথিং৷ ‘
–‘ চাচ্চুকে বলে দিব৷ ‘
–‘ বলে দেখা! মাইর খাবি, ফ্রি মাইর৷ ‘
সেজেগুজে বেরোতে নিয়ে সামনে পেল আকাশকে৷ সে অরুকে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশংসা করে গেল৷ অরু খুশি মনে আরেকটু সামনে যেতেই আনোয়ার সাহেবের সামনে পড়লো৷ তিনি মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে প্রশংসা করে গেলেন৷ আজ অরুকে সত্যিই আ

অরু নিজের রুমে ফিরেছে৷ এখনো মাগরিবের আজান দেয়নি৷ অথচ সে এখনই সেজেগুজে তৈরি৷ জুতো জোড়া পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালো৷ নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে, কান পেতে শুনল দরজা খোলার শব্দ৷ নিশ্চয়ই তন্ময় এসেছে৷ এখন মহারাজ তৈরি হবে৷ তারপর অরুকে পাগল করে দিবে! মন খারাপ করে অরু ধপ করে বিছানায় বসলো৷ নিত্যদিনই যথাযথ সুন্দর দেখায় তন্ময়কে৷ যখন কোথাও যেতে তৈরি হয় তখন তো নজর ফেরানোই মুশকিল৷ এইযে অরু আজ শপথ করেছে নিজেকে! একদম তন্ময়কে ঘুরেঘুরে দেখবে না৷ পেছন পেছন দৌড়াবে না৷ যার জন্য দুল কিনেছে তাকে নিয়েই সুখী হোক ওই ভদ্রলোক৷ অভিমানী অরুর রুমে হঠাৎ করে দীপ্ত প্রবেশ করেছে৷ দীপ্ত হলুদ পাঞ্জাবি পরেছে৷ নিজের মাথার চুলগুলো দেখিয়ে বলল,
–‘ সুন্দর লাগছেনা? তন্ময় ভাই স্যাট করে দিয়েছে৷ পারফিউমটা কেমন? সুন্দর তাই না? তন্ময় ভাইয়ের পারফিউম এটা৷ ‘
অরু বুক ভরে পারফিউমের ঘ্রাণ শুঁকে নিলো৷ এই পারফিউমের ঘ্রাণ শুঁকলেই তার নিজেকে পাগল পাগল লাগে৷ মুহুর্তেই চোখের পাতায় চোখ ধাঁধানো তন্ময় ভেসে উঠে৷ বুকের বা’পাশে হাত চাপড়ে বলল,
–‘ পারফিউমের ঘ্রাণটা একদম সুন্দর নয়৷ যা অন্য একটা ইউস কর৷ ‘
–‘ কী বলো! এই পারফিউমের মতো সুন্দর ঘ্রাণের পারফিউম আর হতেই পারেনা৷ তোমার নাকে সমস্যা বুঝলে? ‘
হুট করে দীপ্তর চোখ যায় অরুর দিক৷ এতক্ষণ সে অরুকে খেয়াল করে দেখেনি৷ অরুর চারপাশে বিড়ালছানার মতো ঘুরেফিরে বলল,
–‘ বাহ! শাড়িতে তোমাকে চমৎকার লাগছে৷ একদম ডিফারেন্ট! কিন্তু কিছু একটা মিসিং মিসিং দেখাচ্ছে৷ ‘
অরু নিজের চোখমুখ ছুঁয়ে বলল,
–‘ মিসিং? কি মিসিং দেখাচ্ছে?’
–‘ ওহ্ হ্যাঁ! কানের দুল কোথায়? কানের দুল পরছ না কেন? ‘
অরু গম্ভীরমুখে বলল,
–‘ পরব না দুল টুল! কখনোই পরব না৷ ‘
অরু ভেবে রেখেছে সে আর কখনোই কানের দুল পরবে না৷ তার কানে দুল সেদিনই থাকবে যেদিন তন্ময় তার জন্যও দুল কিনে আনবে৷ এর আগপর্যন্ত অরুর জন্য কানের দুল পরা হারাম, হারাম এবং হারাম৷
–‘ আচ্ছা ঠিকাছে৷ তন্ময় ভাইয়া, শাবিহা আপু রেডি৷ তাড়াতাড়ি আসো৷ ‘
–‘ যা আসছি আমি৷ ‘
দীপ্ত যেতেই অরু বিছানায় থাকা বইপত্র গুলো গোছাতে লাগলো। প্রত্যেকটা বই টেবিলে গুছিয়ে রাখছে৷ বইপত্র গুঁছিয়ে বিছানা ঝেড়ে বেরিয়ে পড়লো৷

অরু সোজা গাড়িতে উঠে বসেছে৷ জানালার সাইডে৷ শাবিহা বাইরে দাঁড়িয়ে! হাত ঘড়িতে বারবার নজর বোলাচ্ছে৷ তারা তন্ময়ের অপেক্ষায়৷ একপর্যায়ে শাবিহা অরুকে বলল,
–‘ দেখ তো গিয়ে ভাইয়া কি করছে! ‘
–‘ আমি পারবো না৷ দীপ্তকে পাঠাও৷ ‘
–‘ দীপ্তর ওয়াশরুম পেয়েছে৷ তুই দেখ না গিয়ে.. ‘
অরু বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে বেরোলো৷ হনহনিয়ে হাঁটা ধরলো৷ ড্রয়িংরুমে মুফতি বেগম বসে টিভি দেখছেন৷ অরু ভাবছে চাচিকে বলবে, তন্ময়কে ডেকে আনতে৷ পরক্ষণেই তার মনে পড়লো মুফতি বেগমের কোমরের ব্যথার কথা৷ আশেপাশে আর কাউকে দেখছেও না৷ ভুরু জোড়া কুঁচকে অরু নিজেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে৷ তন্ময়ের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই সকল বিরক্তি হাওয়ায় উড়ে গেছে৷ বুকের ভেতর দিয়ে গেল যন্ত্রণা৷ এখান থেকেই চিরচেনা সেই পারফিউমের ঘ্রাণ শুঁকতে পারছে৷ এবং বুকের ভেতর ধুকপুক করছে৷ নিজেকে সামলে অরু দরজায় টোকা দিল,
–‘ আপনার হয়েছে তন্ময় ভাইয়া? ‘
জবাব নেই৷ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো৷ অন্ধকার! অন্ধকারে ভয় পাওয়া সে মুহুর্তেই বেরোনোর জন্য পা বাড়ালো৷ তখনই অনুভব করলো তার হাত কেউ চেপে ধরেছে৷ মুখমন্ডলের উপর ঘনঘন নিশ্বাস পড়ছে। অরু ভীত স্বরে ডাকল,
–‘ তন্ময় ভাই? ‘
জবাব আসেনি৷ তবে পারফিউমের ঘ্রাণে এবং সুঠাম হাতের স্পর্শে সে নিজের সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে চিনে ফেলল। অন্ধকারে হাতড়ে তন্ময়কে দেখার সামান্য চেষ্টা করলো। কিন্তু দেখতে পেল না। হুট করে কানে স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো৷ শরীরে বিদ্যুৎ প্রবেশ করেছে যেন। থরথর করে কাঁপতে চাইছে শরীর। তন্ময় কিছু একটা করছে৷ কিন্তু কী সেটা অন্ধকারে বুঝে উঠতে পারছেনা। কম্পিত কণ্ঠে শুধালো ,
–‘ কি করছেন? ‘
প্রশ্নটা করেই অরু ডান হাত কানে ছুঁতে নিতেই, তন্ময় তার হাত চেপে ধরলো৷ লোকটার এই দু’এক স্পর্শেই অরুর মরে যাবার মতো অবস্থা৷ গলা দিয়ে শব্দও বেরোতে চাইছে না। অনুভব করছে তার কানের ফুটোয় কিছু একটা প্রবেশ করছে৷ চোখজোড়া বন্ধ করে যতটুকু বুঝতে পেরেছে তা অরুর নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছেনা৷ থমকে দাঁড়িয়ে থাকা সে উপলব্ধি করলো তন্ময় তার হাত ছেড়ে দিয়েছে৷ তাকে একা রেখেই বেরিয়ে গেল৷ কাঁপা কাঁপা হাতে কান ধরলো৷ তার দু’কানে দুল৷

অরুকে চুপচাপ দেখে শাবিহা প্রশ্ন করলো,
–‘ কী হয়েছে আমার টিমটিমের? আয় তুই আমার সাথে বসবি। ‘
অরু পেছনে শাবিহার সাথে বসলো৷ সামনে তন্ময় আর দীপ্ত৷ শাবিহার চোখ আচমকাই অরুর কানে চলে গেল৷ পাথরের দুলটা অরুর কানে ঝলমল করছে৷ দুল জোড়া পর্যবেক্ষণ করে বলল,
–‘ অরু এই কানের দুল কখন কিনেছিস?
কী প্রিটি! আমার জন্যও নিব৷ ‘
দীপ্তও ঘুরে তাকিয়েছে৷
–‘ তুমি না বললে আর কখনোই দুল পরবে না?’
অরু দুটো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে মাথা ঝুকিয়ে রাখল৷
তার কাছে এই প্রশ্নের কোনোপ্রকার জবাব নেই৷ সে আপাতত এখন স্তব্ধ বিমুঢ়৷ তার সঙ্গে যা হয়েছে সবকিছু একটা ইলিউশন মনে হচ্ছে৷ এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা৷ তন্ময়ের ব্যাগে থাকা ওই দুল জোড়া, তন্ময় নিজে হাত তাকে পরিয়েছে! নিজে হাতে! তারমানে কী দুল জোড়া তার জন্যই এনেছিল? ভাবতেই অরুর সর্বাঙ্গ জুড়ে শিহরণ বয়ে গেল৷ আঁড়চোখে সামনে তাকাল৷ তন্ময় শান্তশিষ্ট ভঙ্গিতে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত৷ অরুর অভিমান গুলো ধুয়েমুছে ছাফ হয়ে গিয়েছে৷ বুকের ভেতর ভালোলাগা, ভালোলাগা শুধু ভালোলাগা বিচরণ করছে৷
___________
কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেমেছে গাড়ি৷ ভেতরে তামান্নার বাবা করিম মিয়া দাঁড়িয়েছিল৷ তন্ময়দের দেখতেই এগিয়ে আসলেন আপ্যায়নের জন্য৷ ভেতরে নিতে নিতে কথাবার্তা বলছেন৷ অরু শাবিহার হাত ধরে আছে৷ তাদের নিয়ে বসতে দিয়ে তবেই ফিরেছেন করিম মিয়া৷ তামান্না তখন স্টেজে বসে৷ তাকে হলুদ লাগানো হবে কিছুক্ষণের মধ্যে৷ আপাতত স্টেজের নিচে দলভুক্ত হয়ে নাচছে তামান্নার কাজিনরা৷ সেগুলো ভিডিও করছে ক্যামেরা ম্যান৷ শাবিহা আঁড়চোখে চারপাশে নজর ঘোরাচ্ছে৷ অয়ন কোথায়? ছেলেটা কি আসবে না? একটা কল দিবে? শাবিহার মন আনচান করছে৷ কল দিবে দিবে করে দিচ্ছেনা৷ হুট করে পাশ থেকে চেনাপরিচিত কন্ঠের স্বর শুনতে পেল৷ পাশে ফিরতেই অয়নকে দেখতে পেল৷ তন্ময়ের সাথে কথা বলছে৷ শাবিহার দিক তাকাচ্ছেও না৷ অবশেষে ভেবেচিন্তে অয়নকে একটা ম্যাসেজ করলো,
–‘ রেগে? ‘
ওদিকে স্টেজ থেকে তামান্না ইশারায় শাবিহাকে ডাকছে৷ ম্যাসেজটা করেই সে ওদিকটায় চলে গেল৷ তামান্নার কপালে একটুখানি হলুদ লাগানো৷ সে সেটা টিস্যু দিয়ে মুছতে নিয়ে বলল,
–‘ আমি তো ফেঁসে গেলাম৷ এখন তুই কবে ফাঁসবি? নাকি সিঙ্গেল থেকে আমাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবি?’
শাবিহা হাসার চেষ্টা করে তামান্নার পাশে বসল৷ বিয়েশাদির আলাপ-আলোচনা শুনলেই শরীর কাঁপে আজকাল৷ ভেতরে ভীষণ যন্ত্রণা হয়৷ একরাশ ভয় তাকে ঝেঁকে ধরে৷ অয়ন খুব ভালোভাবে শাবিহাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েছে৷ এখন চাইলেও নিজেকে ছাড়াতে পারছেনা৷ পারবেও না বোধহয়৷ নজর পুনরায় অয়নের দিক গেল৷ ফোনটা মুখের সামনে ধরলো৷ ম্যাসেজের রিপ্লাই এসেছে৷
–‘ রাগলেই বা কি! ‘
শাবিহা মাথা ঝুকিতে হাসল। তড়িৎ গতিতে জবাব দিল,
–‘ আমাকে আর ভালো লাগেনা সেটা বলো!! ‘
অয়নের জবাব এলোনা৷ শাবিহা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছে কিন্তু রেসপন্স আসেনি৷ চারপাশে খুঁজে অয়নকে দেখতে পেল৷ দূরের দেয়ালে হেলান দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পরপর ম্যাসেজ এলো টুং শব্দ করে৷
–‘ এদিকটায় আসুন। ‘
শাবিহা সংকোচ করছে৷ যাবে কী যাবেনা? তন্ময় কথা বলছে তামান্নার বড় ভাইয়ের সাথে৷ অরু আর দীপ্ত ব্যস্ত নাচগান দেখতে। সবাইকে ব্যস্ত দেখে শাবিহা ধীরেসুস্থে গেল নিরিবিলি করিডোরের দিকটায়৷ অয়ন দাঁড়িয়ে আছে পিঠ দেখিয়ে৷ শাবিহা পাশে গিয়ে দাঁড়ালো৷ কি বলবে বা করবে বুঝতে পারছেনা৷ অয়নও আগ বাড়িয়ে কিছু বলছে না৷ তাকে ডেকে এনে এভাবে নিশ্চুপ হয়ে থাকার কোনো মানে আছে? অয়ন চোখজোড়া সামনে নিবদ্ধ রেখেই বলল,
–‘ আপনাকে তুমি করে বললে মাইন্ড করবেন? ‘
–‘ না৷ ‘
আচমকা অয়ন হুড়মুড়িয়ে অপ্রস্তুত শাবিহার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো৷ শাবিহা পিছু আসার সময় অবদি পেল না। দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়লো, নিশ্বাস প্রখর হলো৷
–‘ ভালোলাগা খুব সাধারণ শব্দ শাবিহা৷ আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
শাবিহার হৃদয় কেঁপে উঠলো৷ অয়নের মুখে তুমি শোনাটাই যেন নেশা আর ভালোবাসি শোনাটা যেমন ঔষধ! মারাত্মক ভাবে তার হৃদয় কাঁপছে৷ ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকানো শাবিহার নাকের ডগায় অয়ন হুট করে চুমু খেয়ে বসলো৷ দুষ্টু হেসে শাবিহার কানের কাছটায় মুখ নিল। গভীর স্বরে বলল,
–‘ শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে৷ ইচ্ছে করছে তোমার অদৃশ্যমান পেট ছুঁয়ে দেই৷ সেখানে আমার হাতের ছাপ বসাই। কিন্তু এই ভুল আমি আপাতত করছি না৷ পড়ে দেখা যাবে তুমি কথাই বলছ না! ‘
শাবিহা রেলিংয়ের সাথে লেপ্টে আছে৷ ঘনঘন নিশ্বাস নেওয়া সে চোখজোড়া শক্ত করে বুঝে রয়েছে৷ ভেতরটা অস্থির আচরণ করছে, তোলপাড় করছে সবকিছু।

চলবে ~~~প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ১৫
__________________________
হলুদ প্রোগ্রাম থেকে ধরে অরু কানে দুল পরছে৷ দুদিন হয়ে গিয়েছে। এতো বড়বড় দুল কানে চব্বিশ ঘন্টা পরে থাকা যায় নাকি? কিন্তু তবুও অরু পরে থেকেছে৷ তন্ময়ের পরিয়ে দেওয়া এই দুল সে এই জীবনে আর খুলবে না শপথ করেছে৷ এখন কান ছিঁড়ে পড়ে যাক, নাহলে পচে যাক। সুমিতা বেগম কান টেনে অরুকে রুমে এনেছেন৷ কানের দুল জোড়া খোলার চেষ্টা করেছেন কিন্তু খুলতে পারেননি৷ অরু বোয়ালমাছের মতো নড়েচড়ে পালিয়ে এসেছে৷ পালাতে নিয়ে সামনে পড়লো আনোয়ার সাহেবের। আনোয়ার সাহেবের হাতে তিনটা কামিজ। সেগুলো অরুর হাতে দিয়ে বললেন,
–‘ দুটো আপুদের দিয়ে একটা তুমি নাও৷ ‘
আনোয়ার সাহেব প্রায়শই এটাসেটা নিয়ে আসেন নিজের মেয়েদের জন্য। বলা যায় এই বাড়িতে একজনের জন্য কিছু আনা হয়না৷ সবাইকে নিয়ে কাপড়চোপড়, খাওয়া-দাওয়া ইভেন ঘুরাঘুরিও করা হয়৷ অরু শাবিহার রুমে একটা কামিজ এবং রুবির রুমে একটা কামিজ রেখে তৃতীয়টা সে নিয়ে নিজের রুমে এসেছে৷ কাল সকালেই বানাতে দিয়ে আসবে৷ সিলেটে অরু এই কামিজ পরেই যাবে৷

সন্ধ্যায় তন্ময়ের কাছে পড়তে বসে, অরু বারংবার কানের দুল জোড়া ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে৷ কিন্তু তন্ময়ের কোনো সাড়াশব্দ নেই৷ সাড়াশব্দ কেন করছে না? তন্ময় কী জানে কতটা ব্যথা সহ্য করে রয়েছে এই দুলের জন্য? এইযে ব্যথায় অরু কানে হাত ছোঁয়াতে পারছেনা৷ কার জন্য? তার সামনে গম্ভীরমুখে বসে থাকা, এই মহারাজার জন্য৷ অথচ মহারাজার ধ্যানজ্ঞান কিছুই নেই৷ কলম ফেলে দেবার ভঙ্গিমা করে অরু তন্ময়ের দিক ঝুকে গেল৷ তার কানের দুল ঠিক তন্ময়ের মুখের সামনে। কলম তুলে সোজা হয়ে বসলো৷ না তন্ময়ের কোনো রিয়েকশন নেই।কেন? নিজেকে আর সামলাতে পারছেনা না। অরু এবার সোজাসাপটা প্রশ্ন করলো,
–‘ কানের দুল আমার জন্য কিনেছেন, তাই না? ‘
তন্ময় বইয়ের পৃষ্ঠা উলটপালট করে দেখছে। অরুর প্রশ্নে মাথা তুলে তাকালো না অবদি, প্রশ্নের জবাব দিবে তো দূরের বিষয়! অরু পুনরায় বলল,
–‘ বলেন না! ‘
জবাবে তন্ময় হুট করে পাশে রাখা বেত দিয়ে অরুর হাতে মেরে বসলো৷ ব্যথিত হাত ধরে অরু হাসফাস করতে লাগলো৷ যেখানে লেগেছে বেতের বারি সেখানটায় লাল হয়ে গিয়েছে মুহুর্তেই। চোখজোড়া জলে টলমল করছে তার। হাত ডলতে ডলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো৷ যেমন সে এখনই চলে যাবে৷ কিন্তু তন্ময়ের, ‘ বোস। ‘ শুনে পুনরায় বসে পড়লো নিজ যায়গায়৷ এবার মনোযোগ পড়াশোনায় দেবার চেষ্টা করছিল৷ হঠাৎ তন্ময় হাতের কলম রেখে অপ্রস্তুত অরুর দিক নজর রেখে বলল,
–‘ এসব এখনো পরে আছিস কেন? ‘
–‘ সুন্দর লাগছেনা? ‘
–‘ খোল! ‘
–‘ না খুলবো না৷ ‘
তন্ময় শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো৷ তন্ময়ের শান্ত নজর অনেকটা সাদা ফকফকা আকাশ থেকে হুট করে বজ্রপাত শুরু হয়, ঠিক তেমনটাই লাগছে। অরুর ঘাড়ের পশম দাঁড়িয়ে গিয়েছে৷ এভাবে তাকিয়ে থাকার কী আছে? চোখ নামিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
–‘ আপনি খুলে দিবেন? ‘
অরু ভেবে রেখেছে তন্ময় আকাশ ফাটিয়ে ধমক দিবে৷ নাহলে মুখ ঘুরিয়ে ফেলবে৷ তাকে পাত্তাই দিবেনা৷ কিন্তু আজ তাকে ভড়কে তন্ময় বলল,
–‘ সামনে আয়৷ ‘
অরু উঠে এসে তন্ময়ের সামনে দাঁড়ালো৷ চেয়ারে বসেও তন্ময় তার মাথা সমান। কতো লম্বা! কানে তন্ময়ের আঙুল লাগতেই অরু অস্পষ্ট স্বরে আর্তনাদ করে উঠলো৷ কান দুটো লাল হয়ে গিয়েছে৷ বিষদায়ক যন্ত্রণা এযেন! তন্ময় দাঁতে দাঁত চেপে অরুকে ধমকাতে নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো৷ খুব নরম ভাবে খোলার চেষ্টা করছে। অরু তখন ভ্যাবলার মতো তন্ময়ের গম্ভীর মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত৷ তন্ময়ের ডান গালে একটা লাল তিল৷ খুব আকর্ষণীয় ভাবে ফুটে আছে তার উজ্জ্বল মুখমন্ডলে। অরুর ইচ্ছে করছে সেটা ছুঁয়ে দিতে৷ এবং সে হুট করেই তিল’টা ছুঁয়ে দিল৷ ছুঁয়ে নিজেই কেঁপে উঠলো। তন্ময় কিছুই বললো না৷ সে তখনো সিরিয়াস হয়ে অরুর দুল খুলছে৷ তন্ময় কিছু বলছে না বলে অরু আরও সাহস পেয়ে বসলো। মুহুর্তেই মনে আরেকটি ইচ্ছে জাগলো। এখন ইচ্ছেটাকে পূর্নতা দিবে নাকি না? দোটানায় ভুগতে থাকা তার চোখজোড়া তখনো তন্ময়ের চেহারায়৷ বুকের ধুকপুকানি অগ্রাহ্য করে অরু দ্রত গতিতে তন্ময়ের তিলের যায়গাটিতে চুমু খেয়ে বসলো৷ তন্ময়ের দুল খুলতে থাকা হাতটি কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল৷ পিনপতন নীরবতা চারদিকে৷ শুধু অরুর ঘনঘন নিশ্বাস নেওয়া শোনা যাচ্ছে। বুকের ভেতর তোলপাড় করতে থাকা হৃদয় বিস্ফোরণ ঘটাবে যেমন। কিছুক্ষণের জন্য মস্তিষ্ক হারিয়ে এহেন কাজ করে অরু ভয়ে গুটিয়ে আছে৷ দৌড়ে যে পালাবে তাও অসম্ভব! ভয়ে ভয়ে পুনরায় তাকাল তন্ময়ের দিক৷ তন্ময় তখন তার বাম কানের দুল খুলছে৷ অরুর দিক না তাকিয়েই গম্ভীর স্বরে বলল,
–‘ মাইর খাবি? ‘
–‘ না না! আর করবো না৷ ‘
মুখে এক বললেও অরুর মন বলছে এই সুযোগে তন্ময়ের পুরো মুখ জুড়ে চুমু খেয়ে নিতে৷ এইযে এভাবে গম্ভীরমুখ করে বসে আছে৷ এই গম্ভীরমুখ দেখলেই তার প্রেমপ্রেম পায়৷ ইচ্ছে করে…
–‘ আহ! আস্তে ব্যথা পাই! ‘
অরু এতক্ষণ প্রেমের নদীতে ডুবে ছিলো বলে ব্যথা নামক অস্তিত্ব ভুলে বসেছিল৷ এখন যখন বাস্তবে ফিরেছে তার চোখ ভিজে উঠেছে।
–‘ আপনি ইচ্ছে করে ব্যথা দিচ্ছেন!’
পরপর অনুভব করলো তন্ময়ের শক্ত হাতের সেই নরম স্পর্শ৷ যেমন একটু আগে ব্যথা দেওয়া লোকটা ইনি নন। অরু ভেজা নয়নে তাকিয়ে রইলো। ব্যথিত কন্ঠে ডাকল,
–‘ তন্ময় ভাইয়া! ‘
–‘……… ‘
–‘ এইযে তন্ময় ভাই! ‘
–‘……..’
–‘ কথা বলবেন না? ‘
–‘….. ‘
–‘ আচ্ছা আর এমনটা করবো না৷ আমার কী দোষ বলুন। সব দোষ আপনার গালের তিলটার৷ এটাই আমাকে বারবার ডাকছিল! এই তিলটাকে শাস্তি হিসেবে একটা চিমটি দিয়ে দেই? ‘
অরু চিমটি দেবার সুযোগ পেল না৷ পূর্বেই তন্ময় তার গাল শক্ত করে টেনে ধরেছে৷ গালের ব্যথায় অরু আর্তনাদ করে উঠলো৷ সাদা গাল লাল করে দিয়ে তন্ময় চলে গেল৷ অরু গালে হাত চেপে অশ্রুসিক্ত নয়নে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ আলগোছে ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে দিলো৷ পরপর লজ্জায় গাল দুটো তার লাল হয়ে গেল৷ বোকার মতো হেসে ভাবতে বসলো, এভাবে তন্ময়ও তো তাকে চুমু খেতে পারে ? সে খুব করে চায় তন্ময় তাকে চুমু খাক! আদর করুক! কেন করেনা!

একটি দৈনন্দিন প্রবাদ চারপাশে ঘুরঘুর করে৷ সেটা হলো, আমরা তাদের পাত্তা দেইনা, যারা আমাদের পাত্তা দেয়৷ আমরা তাদেরই পাত্তা দেই, যারা আমাদের পাত্তা দেয়না৷ এই প্রবাদটি আজকাল অরুর মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে যন্ত্রের মতো! তন্ময় তাকে পাত্তা দেয়না অথচ তার তন্ময়কেই চাই। এরজন্য আজ সে কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না৷ চোখ বুঝলেই তন্ময়কে দেখছে৷ চোখ খুললেও তন্ময়কে দেখছে৷ বিরক্তি নিয়ে উঠে বসলো৷ জানালা দিয়ে দমকা বাতাস আসছে৷ আঁধার রাতের আকাশে চাঁদের রাজত্ব চলছে৷ ছোটছোট তারারা যেমন সৌন্দর্যের প্রতিক চাঁদকে পাহারা দিচ্ছে৷ অরু উঠে জানালার সামনে দাঁড়ালো৷ একমনে তাকিয়ে রইলো আকাশের পানে৷ কানে ভেসে আসছে ধীর শব্দের কথাবার্তা৷ অরু নিচে তাকাল। গার্ডেনের লাইটগুলো জ্বলছে৷ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দুটো চেয়ারে কেউ বসে৷ ভালোভাবে দেখতেই চিনতে পারলো তন্ময় এবং মোস্তফা সাহেবকে। অরু দেয়াল ঘড়ির দিক নজর দিলো৷ ঘড়ির কাঁটা রাত একটা পঁয়তাল্লিশে। এই গভীর রাতে তারা কি নিয়ে আলাপ করছে? সেও নিচে যাবে কি-না? চিন্তাভাবনার মধ্যেই অরুর পা জোড়া কাজ করতে শুরু করেছে একান্তই৷ রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো৷ আশ্চর্যজনক ভাবে ড্রয়িংরুমে দীপ্ত বসে৷ এখনো ঘুমোতে যায়নি ছেলেটা? অরু ধমকাতে যাবে পূর্বেই দেখল মুফতি বেগম ট্রে নিয়ে বাইরে যাচ্ছেন। অরু দীপ্তকে ছেড়ে সদরদরজা খুলে বেরিয়ে গেল। সামনেই আনোয়ার সাহেব, ওহী সাহেব দাঁড়িয়ে৷ মুফতি বেগম ট্রে’র থেকে সকলকে একেকটা চায়ের কাপ দিচ্ছেন। অরুকে দেখে আনোয়ার সাহেব বললেন,
–‘ আম্মু এখনো জেগে যে? ‘
–‘ ঘুম আসছেনা বাবা৷ ‘
বলতে বলতে বাবার কোলে ঢুলে পড়লো৷ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সকলের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলো ঠিক কি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে৷ শুক্রবার তারা
সিলেটের উদ্দেশ্যে বেরোবে৷ মাসখানেক থাকা সম্ভব নয়৷ তবে সাতদিন থাকবে৷ মানে এক সপ্তাহ! শুক্রবার আসতে আর মাত্র চারদিন। অরু খুশিতে গদগদ। সে এখনই ভাবতে বসেছে কি কি নিবে। ভাবতে ভাবতে তন্ময়ের দিক তাকাল৷ পায়ের উপর পা রেখে বসে আছে৷ ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরা৷ তন্ময়কে সবসময় ভালো দেখায়৷ সন্ধ্যায় করা নিজের কাজটি মনে করে, অরুর গাল দুটো লাল আভায় রাঙিয়ে গেল৷ বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো চুমু খাওয়ার দৃশ্যটি৷ বলতেই হয় তার ভীষণ সাহস! অবশ্য সাহস রাখতে হয় এমন পুরুষকে পছন্দ করলে৷ আনমনে ভেবে অরু মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। তন্ময় তার দিক তাকাতেই নিজের বত্রিশ দাঁত দেখিয়ে হেসে উঠলো ৷ এখন অরুকে দেখতে লাগছে স্নিগ্ধ আঁধারের প্রেয়সী! চন্দ্রিমা আকাশের আঁধার রাতের স্নিগ্ধ প্রেয়সী।
____________
শাবিহা বড়সড় একটি ভুল করে ফেলেছে৷ ভুলটা হচ্ছে অয়নকে তুমি করে তাকে সম্বোধন করতে দেওয়া৷ আজকাল অয়নের কথার বুলি ফুটেছে৷ তুমি, তুমি, তুমি সারাদিন করতেই থাকে৷ তুমি সম্বোধন করে শাবিহার হৃদয় নিয়ে খেলছে একপ্রকার। তুমি বলে ছেলেটা সাহসী হয়ে গিয়েছে৷ কীসব উদ্ভট কথাবার্তা বলে৷ মুখে লাগাম রাখা যেন ভুলে বসেছে৷ শাবিহা বেশ কয়েকবার ধমক দিয়েছে৷ তবে এখন ধমকে অয়ন একদম ভয় পায়না৷ মাথায় চড়ে বসেছে একপ্রকার৷ তাই শাবিহা একটা ভয়ংকর শাস্তি তৈরি করেছে অয়নের জন্য৷ সেটি হলো টোটালি দুদিন কোনোপ্রকার কথা অয়নের সাথে বলবে না৷ এই দুদিন অয়নকে নিজের মুখও দেখতে দিবেনা৷ এরজন্য লাগলে সে বাড়ির গাড়ি ব্যবহার করবে। এইতো সকাল সকাল আবারো কল করছে৷ এখন সে অফিস যাবে৷ আর অয়ন যাবে ভার্সিটি৷ তাহলে এই সময়টায় কেন কল করছে ছেলেটা? শাবিহা কল ধরলো না৷ তৈরি হয়ে নিবে তখন পুনরায় কল এসেছে অয়নের৷ শাবিহা সেলফোন সাইলেন্ট করে রাখল৷ গাড়ি করে বেরিয়ে পড়লো৷ যেতে নিয়ে অয়নকে রাস্তার মোরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল৷ চা খাচ্ছে, ভার্সিটির ড্রেস পরে৷ অয়নের গলায় ঝুলানো টাই খানা দেখলেই তার ইচ্ছে করে টেনে ধরতে৷ তবে সুযোগ হয়ে উঠেনি কখনো। নিশ্চয়ই তারজন্য দাঁড়িয়ে ছিলো? শাবিহা মুচকি হাসলো৷ ছেলেটা পারেও বটে। কতটুকু পারে এটাই দেখার বিষয়!

সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরোনোর সময় শাবিহা টপ ফ্লোরের জানালা দিয়ে নিচে তাকাল৷ তার অনুমান মতে অয়ন দাঁড়িয়ে আছে! আজ স্টেশনের সামনে নয় তার অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে৷ শাবিহা সেলফোন বের করলো৷ অয়নের শতাংশ মেসেজ৷ মেসেজ গুলো দেখে বুঝতে পারলো খুব ভয় পেয়েছে অয়ন৷ মাত্র দেড় দিন হয়েছে৷ এতটুকু সময়ে এত ভয় পেতে হয় নাকি? শাবিহা উল্টো ভেবেছিল কালও দেখাসাক্ষাৎ, কথা টোটালি ওফ রাখবে৷ কিন্তু এই ছেলে এখনই দিশেহারা অবস্থায় ঘুরছে৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাবিহা বেরিয়ে এলো৷ নিচে নামতেই অয়ন সামনে এসে দাঁড়ালো৷ চোখমুখ ঘামে ভিজে আছে৷ বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে৷ উত্তেজিত কন্ঠে শুধালো,
–‘ কি হয়েছে? ‘
শাবিহা জবাব দিল না৷ নিঃশব্দে ব্যাগ থেকে রুমাল বের করলো৷ খুব যত্নে অয়নের মুখ মুছিয়ে দিল৷ নাকের ডগায় জমে থাকা ঘাম খুব কৌশলে মুছল৷ তারপর বিনয়ী সুরে বলল,
–‘ কি হবে? ‘
–‘ কল, মেসেজের জবাব কেন দিচ্ছিলেন না? ‘
–‘ ব্যস্ত ছিলাম৷ ‘
–‘ ইচ্ছে করে করেছেন তাই না? ‘
শাবিহা একটি জিনিস লক্ষ্য করেছে৷ অয়ন রাগলে ইদানীং আপনি বলে। নাহলে সর্বক্ষণ তুমি, তুমি করে৷ তারমানে এই পিচ্চি এখন রেগেছে। অয়ন হুড়মুড়িয়ে চলে যাচ্ছে৷ হেসে শাবিহা তার পেছন পেছন চলছে৷ হুটহাট ডাকছে তবে সাড়াশব্দ করছে না৷
–‘ ওই পিচ্চি অয়ন! ‘
অয়ন ঘুরে চোখ রাঙাল৷ শাবিহা শব্দ করে হেসে উঠলো৷ হাসতে হাসতে সে অয়নের হাত ধরলো৷ অয়ন মুহুর্তেই নরম হয়ে গেল যেমন৷ সারাদিনের রাগ, অভিমান নিমিষেই শেষ৷ আঁড়চোখে শাবিহার হাসিমুখ দেখে শান্তি অনুভব করলো৷ তবে পিচ্চি ডাক তার মোটেও পছন্দ হলো না।
–‘ একদম পিচ্চি বলবে না৷ ‘
–‘ পিচ্চি একটা ছোট অয়ন! ‘
বলেই শাবিহা উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো৷ অয়ন ভুরু জোড়া কুঁচকে শাবিহার হাসিমুখের দিক তাকিয়ে৷ হঠাৎ দুষ্টু হেসে মাথাটা শাবিহার মুখের সামনে নিয়ে বলল,
–‘ পিচ্চি বললে কিন্তু চুমু খাব৷ ‘
শাবিহার হাসি বিলুপ্ত হয়ে গেল মুহুর্তেই। চোখমুখ শক্ত করে হনহনিয়ে সামনে চলে গেলো৷ এবার অয়নের হাসার পালা৷ পেছন থেকে উচ্চশব্দে হেসে চলেছে সে৷ হাসতে হাসতে শাবিহার উপর পড়ে যাচ্ছে একপ্রকার! শাবিহার একটু অভিমান হলো বটে৷ ছেলেটা কী জানেনা প্রেমিকাদের যে ছাড় দিতে হয়? এভাবে প্রতিশোধ নিতে হয়না ছোট ছোট বিষয়ে৷ শাবিহার প্রেমিক আসলেই পিচ্চি! কিছুই বোঝেনা৷ বোকা, অবুঝ এবং নাদান প্রেমিক!

চলবে ~~~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here