প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব -১৩+১৪

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ১২
__________________________

জয়তুন বেগমের আসার একটি বড়সড় কারণ রয়েছে৷ কারণটা আজ সকালে ব্রেকফাস্টের পর খোলাসা করবেন ভেবেছেন৷ ব্রেকফাস্ট করতে শাহজাহান পরিবার টেবিলে বসেছে৷ জবেদা বেগম এবং সুমিতা বেগম খাবার সার্ভ করছেন৷ মোস্তফা সাহেবের প্লেটে ব্রেড দিতে নিয়ে থেমে যান জবেদা বেগম৷ আগে সর্বদাই তিনি স্বামীকে ব্রেড দেয়ার পূর্বে জিজ্ঞেস করে নিতেন,
– ব্রেড ভেজে দিব?
জিজ্ঞেস করারও কারণ আছে বটে৷ মোস্তফা সাহেব প্রায়শই ভাজা ব্রেড খেতে পছন্দ করেন ব্রেকফাস্ট হিসেবে৷ সেই সূত্রে আজও জবেদা বেগমের অভ্যাস রয়েই গিয়েছে৷ জিজ্ঞেস না করলে যেমন তিনি শান্তি পাবেন না৷ শেষমেশ ধীরে প্রশ্ন করলেন,
– ব্রেড ভেজে আনব?
মোস্তফা সাহেব হালকা মাথা দোলালেন৷ দ্রুত ভঙ্গিতে জবেদা বেগম রান্নাঘরে ছুটলেন৷ বাকিরা নিজেদের খাবার নিজেই নিয়ে নিচ্ছে৷ যেমন অরু চারটি ব্রেড প্লেটে নিয়েছে৷ একটা ব্রেডে ভাজা ডিম রেখেছে ভালোভাবে৷ ডিমের উপর দিয়েছে সয়া সোশ তারউপর আবারো ডিম, তারপর আবারো সয়া সোষ, তারউপর পিসপিস করে কাটা তিনটি শশা৷ ব্যস, এগুলোর উপরে আরেকটা ব্রেড দিয়ে চেপে নিয়েছে৷ দু’হাতে সেটা মুখে তুলবে তখন অরুর ঘুমঘুম চোখ গেল পাশে৷ তার পাশেই তন্ময় বসে কাটা চামুচ দিয়ে ডিম, ব্রেড খাচ্ছে। এতো সুন্দর হাবভাব নিয়ে ক্লিন ভাবে খাচ্ছে যে অরুর বুকের বাম পাশে ব্যথা করছে৷ এতটা পারফেক্ট হয়ে কী হবে? এতো পারফেক্ট লোকটাকে কি অরুর সাথে মানাবে? মানাবে না! অরুর আজকাল মনে হয় তন্ময়ের পেছনে তার সরল অনুভূতি গুলো বিসর্জন করা, নেহাতি পাগলামি ৷ কোথায় তন্ময় আর কোথায় সে৷ তন্ময় তো তাকে এই জীবনে পছন্দই করবেনা৷ ভাবতে ভাবতে অরু তার বানানো বার্গারে বড়ো একটা কামড় বসালো৷ পরপর আরেকটা৷ মোট চার কামড়ে পুরোটা শেষ করে ফেললো৷ তারপর আরেকটা বার্গার বানানোর জন্য তৈরি হচ্ছে৷ একই ভাবে বার্গার বানিয়ে এটাও চার কামড়ে শেষ করে ফেলেছে৷ ডাইনিং টেবিল হতে সকলের শেষে অরু উঠলো৷ তখন বাড়ির সদস্যরা ড্রয়িংরুমে বসে৷ কারণ জয়তুন বেগম কিছু কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন৷ তন্ময়ের হাতে পানির গ্লাস! সে এটা এক্সাক্টলি কেন নিজের হাতে রেখেছে অজানা৷ তবে হুট করে গ্লাস অরুর হাতে ধরিয়ে দিলো৷ অরু বোকার মতো কিছুক্ষণ গ্লাসের দিক তাকিয়ে থেকে, এক টানে পানিটুকু খেয়ে বসলো৷ মনেই ছিলো না যে সে পানি খায়নি৷ এখন কী সে তন্ময়কে ধন্যবাদ জানিয়ে বকা খাবে নাকি এক গ্লাস পানি দিয়ে বকা খাবে? অবশেষে অরু ডিসিশন নিয়েছে সে কোনো বকাই খাবে না৷ তন্ময়কে সোফায় বসতে দেখে খালি গ্লাস আলগোছে দীপ্তর পেছনে রাখল৷ যদি পানির কথা জিগ্যেস করে, অরু বলবে দীপ্ত খেয়ে নিয়েছে৷
মোস্তফা সাহেব ঘড়ির কাঁটায় চোখজোড়া ঘুরিয়ে বললেন,
– মা আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে৷ যদি তাড়াতাড়ি….
মোস্তফা সাহেবকে কথা শেষ করতে দিলেন না জয়তুন বেগম৷ নিজের ঝুলি হাতাতে হাতাতে বললেন,
– তাড়াতাড়ি? কীসের তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি নাই কোনো৷ কাজকর্ম ফেইলা দিয়া এইহান আইসা বসো৷ এইযে আমার পাশে বসো!
মোস্তফা সাহেব এগিয়ে এসে বসলেন৷ তিনি বসতেই জয়তুন বেগম বলতে শুরু করলেন,
– বয়স তো আমার কম হয় নাই৷ আইজ আছি কাল নাও থাকতে পারি৷ শরীরও এই ভালো এই খারাপ৷ তাই আমি চাই, মরার আগে তোমাদের হক্কলের সাথে বাড়িত সময় কাটাইতে৷ সামনেই রোজার ঈদ৷ মাত্র একটা মাস বাকি৷ আমি খুব করে চাই এইবারের রোজা সহ ঈদ, সিলেট করবা৷ আমার সাথে৷
ড্রয়িংরুম নিঃশব্দ বিরাজমান৷ মোস্তফা সাহেবও চুপ হয়ে আছেন৷ জবেদা বেগম মায়ের হাত চেপে ধরেছেন৷ কিছু বলবেন, কিন্তু কী বলবেন? তন্ময় বললো,
– পরিবারের মাথা বাবা৷ বাবা যা বলবেন তাই হবে৷ আমার ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে৷
বলেই সে বেরিয়ে পড়লো। তন্ময়ের দেখাদেখি ওহী সাহেবও একই কথা বলে কেটে পড়লেন৷ পরপর আনোয়ার সাহেবও৷ শাবিহাও ভাইয়ের মতো, বাবাকে ফাঁসিয়ে কেটে পড়েছে৷ পেছন পেছন অরু এবং দীপ্তও বেরিয়ে এসেছে নিজেদের স্কুল, কলেজের উদ্দেশ্যে। তন্ময় তখন গাড়ি স্টার্ট দিবে৷ অরু দৌড়ে তন্ময়ের পাশে উঠে বসলো বিনাআমন্ত্রণে৷ দীপ্ত পেছনের দিকে উঠে বসেছে৷ এখন তারা কেন উঠে বসেছে তা আর তন্ময়কে অবশ্যই জিজ্ঞেস করতে হবেনা৷ গাড়ি স্টার্ট করেছে৷ অরু, দীপ্তকে কলেজ দিয়ে তারপর অফিস যাবে৷ অরু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তন্ময়কে দেখছে৷ হাত ঘড়িটা কী সুন্দর তন্ময়ের হাতে ফিট হয়ে আছে৷ দেখতেও আকর্ষণীয় লাগছে৷ অরু বললো,
– সিলেট যেতে কী রাজি হবে চাচ্চু?
দীপ্ত বললো,
– রাজি না হয়ে উপায় আছে? যেতে তো হবেই৷
– খুব ভালো হবে দীপ্ত৷ সেই উপলক্ষে ঘুরেফিরে আসা যাবে৷ আমি এবার জাফলং, মাদবকুন্ড জলপ্রপাত ঘুরবোই ঘুরবো৷ আমাকে না নিয়ে গেলে ওখান থেকে ফিরবো না। আর নাহলে আমি একাই যাবো৷ ‘
বলে অরু আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক তাকাল৷ সিলেট দু’একবার গিয়েছে৷ কিন্তু কখনো এই সুন্দর জায়গা গুলোতে ঘুরতে যাবার সুযোগ পায়নি৷ এবার সে যাবেই যাবে। লাগলে একাই যাবে! দীপ্ত দুষ্টু সুরে বললো,
– তুমি পারবে কী? তোমার তো নভেম্বরের দিক ইন্টারের ফাইনাল এক্সাম৷ ঈদের দুমাস পরই পরিক্ষা৷ তোমাকে কি নিবে ঘুরতে, পড়াশোনা নদীতে ভাসিয়ে?
অরু ভয় পেয়ে গেল৷ চোখজোড়া বড়সড় করে ফেললো মুহুর্তেই৷ পরিক্ষার কথা ভুলেই বসেছিলো একপ্রকার৷ তারমানে তাকে নেওয়া হবেনা? কাঁদোকাঁদো নয়নে তাকাল তন্ময়ের দিক৷ তন্ময় তখন গাড়ি চালাতে ব্যস্ত৷ তার দৃষ্টি অবস্থান করছে সামনে৷ অরু বলল,
– আমি বইপত্র নিয়ে গেলে হবেনা? মাত্র কিছুদিনের ব্যাপার! আমাকে নিবেন সঙ্গে তন্ময় ভাই?
– নিব না৷
তন্ময়ের সোজাসাপটা প্রত্যাখ্যান শুনে অরু কষ্ট পেল৷ বুকে হাত চেপে বলল,
– আপনি কে? আমাকে নিবে চাচ্চু! আপনার কোনো অধিকার নেই আমাকে…
তন্ময় ঘুরে চোখ রাঙাতেই অরু চুপ মেরে গেল৷ মুখের উপর আঙুল ঠেকিয়ে সে নিজেকেই নিজে, নিশ্চুপ রেখেছে৷ গাড়ি এসে থেমেছে কলেজের সামনে৷ অরু এবং দীপ্ত নেমে আসলো৷ অরু যেতে নিয়ে আবারো ফিরে আসলো৷ দ্রুত কন্ঠে বলে
গেল,
– আপনার কোনো অধিকার নেই আমাকে নিব না বলার৷ আমি যাবোই যাবো!
এক দৌড়ে অরু কলেজের ভেতর চলে এসেছে৷ উঁকি দিয়ে দেখল গাড়িটা এখনো দাঁড়িয়ে৷ অরুও দাঁড়িয়ে রইলো৷ যখন তন্ময়ের গাড়িটা গিয়েছে সেও সেখানে থেকে চলে এসেছে৷ সামনে নজর পড়তেই দেখল, আজ মারজির সাথে সুমনা দাঁড়িয়ে৷ দাঁড়িয়ে বললে ভুল হবে৷ মারজিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে সুমনা এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা। কেন?
অরু দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল৷ মারজি তাকে দেখেই চোখমুখ অন্ধকার করে ফেলেছে৷ যেমন অভিযোগ করছে৷ ওদের সামনে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
– কী হয়েছে?
মারজি রেগে বললো,
– দেখ এই মেয়ে গুলো কীসব বকছে! একেকটির মাথায় সমস্যা৷
– আজেবাজে বকছে ত? মাথায় সমস্যা নাহলে দাঁতে৷ দাঁতে সমস্যা হলে আকাশ ভাইয়ের ক্লিনিকে ভর্তি করে দিব!
বলেই অরু হাসলো৷ পরপর শব্দ করে হাসতে হাসতে মারজির হাত ধরে চলে যাচ্ছে৷ পেছনে সুমনার চেঁচামেচি সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করলো৷ শুনতেই পায়নি এমন হাবভাব নিয়ে রেখেছে৷ মারজি বিরক্ত স্বরে বললো,
– মেয়েটা প্রচন্ড নষ্ট!
——
বিকেলে অফিস থেকে ওয়ান আওর ছুটি নিয়ে বেরিয়েছে শাবিহা৷ ক্লোজ ফ্রেন্ড তামান্না এসেছে দেখা করতে৷ আর্জেন্ট কথা আছে নাকি৷ শাবিহা রেস্টুরেন্ট ঢুকে দেখল তামান্না বসে কফি খাচ্ছে৷ সে ওপর পাশে গিয়ে বসলো৷ তামান্না হেসে শুধালো,
– সমস্যা হয়নি তো কোনো?
– না না৷ তুই বল, কী অবস্থা?
– এইতো আলহামদুলিল্লাহ৷ তোকে সুসংবাদ দেওয়ার আছে৷
– কীসের?
তামান্না ব্যাগ থেকে লাল রঙের একটা কার্ড বের করে এগিয়ে দিলো৷ বিয়ের কার্ড৷ শাবিহার চোখজোড়া বড়বড় হয়ে গিয়েছে৷ চমকে তাকাল তামান্নার দিক৷ তামান্না লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
– দোস্ত, বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে৷
– কংগ্রাচুলেশনস!
– থ্যাংকস৷ তোর কিন্তু আসতেই হবে হলুদে৷ এবং নাচতেও হবে৷
– না না প্লিজ! আমি খুব ব্যস্ত৷ এগু…
– এসব শুনবো না৷ ব্যস্ত ট্যস্ত সাইডে রাখ৷ আর তন্ময় ভাই, অরু, দীপ্ত ওদের সঙ্গে আনতে একদম ভুলবি না৷
শাবিহা চিন্তায় পড়ে গেল৷ এভাবেই কিছুদিন আগে ছুটি নিয়েছিল পরিক্ষার জন্য৷ এখন আবার?
হুট করে তার নজর গেল সামনে৷ দেখল অয়ন আসছে এদিকেই৷ শাবিহা নড়েচড়ে বসলো৷ এই ছেলে এখানে কী করছে? তামান্না অয়নকে দেখে হেসে বললো,
– আরে তুই এখানে?
– এইতো এককাপ কফি খেতে এলাম৷
– আয় আমাদের সাথে বোস৷ দিনদিন বড় হয়ে যাচ্ছিস! লম্বাচওড়া আর কতো হবি? কেউ বলবে তুই আমাদের ছোট্ট ভাই?
অয়ন স্বাভাবিক ভাবে ঠিক শাবিহার সাথে বসেছে ছুঁয়ে ছুঁয়ে৷ শাবিহা কিছুটা চেপে গেল৷ অয়ন ফাজলামো সুরে বলল,
– তাহলে ভেবে নেক তোমাদের প্রেমিক আমি৷ আপত্তি আছে কী শাবিহা আপু?
শাবিহার চোখমুখ অন্ধকার হয়ে থাকলেও তামান্না ভীষণ খুশি৷ সে হাসতে হাসতে বলল,
– প্রেমিক বললে বিশ্বাস করতেই পারে৷ তোকে দেখে তো ছোট ভাই লাগেনা, তাই না শাবিহা? অয়ন চোখের পলকে কেমন বড় হয়ে গেল। এইতো কিছুদিন আগে খেলতে দেখেছি৷ আর এখন ছেলে বিজনেস করে৷ তা প্রেম-ট্রেম করিস নাকি?
– না। মেয়ে পাই না তো! তোমার চোখে ভালো মেয়ে থাকলে বলতে পারো৷ একটা প্রেম করা দরকার৷ তোমার চোখে না থাকলে শাবিহা আপুর চেনাজানা নিশ্চয়ই ভালো মেয়ে আছে৷ আছে না শাবিহা আপু?
তামান্না বলল,
– মজা করছিস? তোকে মেয়ে খুঁজে দিতে হবে আমাদের? সুন্দরী মেয়েরা তোর জন্য লাইন পেতে বসে৷
অয়ন হেসে বলল,
– অর্ডার দাও কী খাবে৷
– তুই খাওয়াবি?
– হু৷
– আচ্ছা তাহলে অর্ডার দিলাম কিন্তু৷
– হু৷
অয়ন শাবিহার দিক তাকাল৷ যে আপাতত চোখমুখ অন্ধকার করে বসে৷ অয়ন কন্ঠ নরম করে ধীর গলায় বলল,
– আপনার জন্য কী অর্ডার দিব? মিল্কসেক?
শাবিহা অভিমানী চোখে তাকাল৷ এতক্ষণের অভিমান মুহুর্তেই ধুয়েমুছে গেল তার৷ বুকের উপর ধামাচাপা দেওয়া পাথরটাও উঠে গেল৷
– খাব না৷
– মাইর খাবেন?
শাবিহা বড়বড় চোখ করে তাকাল। যেমন সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা৷ অয়ন আবেদনময়ী কন্ঠে বলল,
– কথা না শুনলে মাইর দিব আপনাকে৷ আদুরে মাইর৷
লজ্জায় শাবিহার কান গরম হয়ে গিয়েছে৷ কোনোমতে নিজেকে সামলে তামান্নার দিক তাকিয়ে রইলো৷ অয়নের দিক আর তাকানোর সাহস পেলো না৷ বুকের ভেতর সবকিছু উলটপালট হয়ে আছে৷ অয়ন নিজে থেকে শাবিহার জন্য অর্ডার করেছে৷ অর্ডার আসতে দশ মিনিট সময় নিয়েছে৷ খেতে খেতে তামান্না বলল,
– তোদের বাড়িতে কার্ড চলে গিয়েছে৷ হলুদে সুন্দর মতো চলে আসবি৷
– আসলে কী দিবে?
– কি চাই?
– একটা গার্লফ্রেন্ড!
বলেই উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো৷ তামান্নাও হাসছে৷ দুজনের কথোপকথনের মধ্যে শাবিহা চুপচাপ খাচ্ছে৷ একপর্যায়ে তামান্নাকে যেতে হবে৷ সে বেশিক্ষণ থাকতে পারবেনা বিদায় এখনই চলে যেতে হবে৷ অয়ন বললো,
– আমি দিয়ে আসবো?
– না না, গাড়ি আছে সাথে৷ তুই বরং শাবিহাকে দিয়ে আয়৷
তামান্না চলে যেতেই অয়ন এবার পুরোপুরি শাবিহার দিক ঘুরে বসলো৷ শাবিহা উঠতে উঠতে বলল,
– আমি একাই যেতে পারব৷
অয়ন শাবিহার হাত টেনে পুনরায় বসিয়ে দিলো৷ শাবিহার চোখমুখ ভালোভাবে দেখে খাবারের প্লেট সামনে দিয়ে বলল,
– খেয়ে শেষ করুন তারপর৷
– তুমি এভাবে তাকিয়ে থাকলে খাবো কীভাবে?
– অভ্যাস করে নিন৷
শাবিহা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে খেতে লাগলো৷ খাওয়া শেষ করে বসে রইলো৷ অয়ন উঠে গিয়েছে৷ টাকা পরিশোধ করে এসে দেখে শাবিহা নেই৷ একাই বেরিয়ে৷ এখনো রেগে নিশ্চয়ই৷ অয়ন দৌড়ে বেরোলো৷ শাবিহা রিকশা ডাকছে৷ অয়ন তার হাত চেপে ধরলো৷ টেনে বাইকের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলল,
– এখনো রেগে আছেন? আমি মজা করেছি তখন৷ আমার গার্লফ্রেন্ড কেন লাগবে! আপনি আছেন তো?
শাবিহার খুব রাগ হলো অয়নের প্রতি৷ একটু আগে স্বেচ্ছায় কতগুলো কথা বলে তাকে কষ্ট দিলো৷ এখন আবার কী সুন্দর করে কষ্ট গুলো ধুয়েমুছে সরিয়ে দিলো৷ কেন এমনটা করবে! শাবিহা কী তার হাতের পুতুল নাকি।
—-
অরু জয়তুন বেগমের রুমে৷ ঘুরঘুর করছে৷ একসময় সেখান থেকে সুমিতা বেগমের পিছু গেল, সেখানে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে ড্রয়িংরুমে বসলো৷ কিছুক্ষণ টিভি দেখে উঠে দাঁড়ালো৷ কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছেনা৷ চলে এলো বারান্দায়৷ গালে হাত চেপে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো৷ নয়টা বেজে গিয়েছে৷ এখনো তন্ময় ফেরেনি৷ ফিরতে ফিরতে সাড়ে নয়টা বাজবে হয়তো৷ অরুর এখনই ঘুম ধরেছে৷ ঘুমালে আজ আর উঠতে পারবেনা৷ তন্ময়কে কীভাবে দেখবে? অরু বইপত্র বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করছে তো খুলছে৷ একসময় দুলে পড়ে যেতে নিচ্ছিলো৷ নিজেকে কোনোরকমে সামলে তন্ময়ের রুমের দরজা খুলল৷ টেবিলে নিজের বইপত্র রেখে চেয়ারে বসলো৷ দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ তন্ময় যখন রুমে ঢুকেছে ঘুড়ির কাটা তখন দশটা পনেরোতে৷ অরুকে দেখে কিছুক্ষণ ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো৷ যেমন ঘুমন্ত অরুকে দেখছে৷ তারপর শব্দহীন ভাবে ওয়াশরুম ফ্রেশ হতে চলে গিয়েছে৷ বেরিয়ে তাওয়াল বিছানায় ফেলে টেবিলের কাছে গেল৷ আলগোছে অরুকে পাজাকোলে তুলে নিলো৷ অরু কিছুটা নড়েচড়ে উঠেছে৷ তন্ময়ের বুকে কিছু একটা খোঁজাখুঁজি করে, মাথাটা আরামসে হেলিয়ে রাখল৷ সেভাবেই তাকে নিয়ে তন্ময় অরুর রুমে গিয়েছে৷ বিছানায় শুইয়ে উঠতে নিয়ে খেয়াল করলো অরু তার টি-শার্ট খামচে ধরে আছে৷ ছাড়াতে চাইলেই ছাড়ছে না৷ একপর্যায়ে ঘুমের মধ্যে অরু বিরক্ত হয়ে চোখজোড়া আধোআধো খুলেছে৷ তন্ময়ের দিক তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো,
– এমন কেন করেন! আমার থেকে শুধু পালিয়ে যান কেন! আমাকে কেন সবসময় এড়িয়ে চলেন৷
– তাহলে কী করবো?
– আমার সাথে থাকবেন৷ সবসময়৷
– থাকব৷
অরু হাসলো৷ তন্ময়ের হাত জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো৷ অস্পষ্ট স্বরে আরো কিছু কথা বলল, তবে তা শোনা গেল না৷ তন্ময় চেয়ার টেনে পাশেই বসে রইলো৷

চলবেপ্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ১৩
__________________________

অরু কিছুদিন ধরে খুব রোমান্টিক মুভি দেখছে৷ আগে সবসময় অ্যাকশন মুভি দেখেছে৷ বলা যায় সে অ্যাকশন মুভি লাভার৷ কিন্তু হুট করে তার মুড পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে৷ অ্যাকশন মুভি ছেড়ে আকর্ষণ গিয়েছে রোমান্টিক মুভিতে৷ নায়ক-নায়িকাদের রোমান্টিক মুহুর্তগুলো উপভোগ করতে গিয়ে লালনীল, গোলাপি হয়ে উঠছে প্রায়শই৷ বারবার নায়কের যায়গায় তন্ময়কে ভাবছে এবং নায়িকার যায়গায় নিজেকে। ভাবতেই শরীর অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠছে৷ শিহরণ বয়ে চলেছে মনে৷ কিন্তু পরপরই সব অনুভূতি গুলো হারিয়ে যাচ্ছে মনে পড়তেই, যে তার তন্ময় ফিল্মের নায়কদের মতো মোটেও নয়৷ ফিল্মের নায়ক রোমাঞ্চকর আবহাওয়া সৃষ্টি করে, নায়িকার সাথে রোমান্স করে৷ আর তন্ময় ভয়ের আবহাওয়া সৃষ্টি করে তাকে শুধু ধমকায়৷ অরু ভেবেচিন্তে খুঁজে পেয়েছে দোষ তার মধ্যেই৷ সে ফিল্মের নায়িকাদের মতো মোটেও না৷ তাহলে রোমান্স কীভাবে হবে? ফিল্মের নায়িকারা লাজুক, সরলতম হাবাগোবা এবং ভীষণ মায়াবী, দরদী, কোমলতম প্রেয়সী৷ কিন্তু সে তো চটচটে, চঞ্চল, বাঁচাল, এলোমেলো, উষ্কখুষ্ক এবং বৈরাগী স্বভাবের৷ এমন একটা মানুষের সাথে রোমান্স কীভাবে করবে? তাই অরু বেশকিছু রোমান্টিক মুভি শেষ করার পর, আদর্শ নায়িকা হবার টিপস পেয়েছে৷
প্রথম টিপস – লাজুক হতে হবে। ভীষণ লাজুক৷
দ্বিতীয় টিপস – হাবাগোবা ভঙ্গিমা অনুসরণ করতে হবে৷
তৃতীয় টিপস – মায়াবী নয়নের চাহনি দিয়ে তন্ময়কে ঘায়েল করতে হবে৷
চতুর্থ টিপস – নিজের কোমল হৃদয় তুলে ধরতে হবে তন্ময়ের আঁখিদুটির সামনে৷
এই চারটি টিপস অরু রাত থেকেই ফলো করার চেষ্টায় মাতোয়ারা৷ যেমন প্রতিদিন সকালে সে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে নিচে নামে ব্রেকফাস্ট করতে৷ আজও একই কাহিনি করতে নিয়ে নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়েছে৷ চঞ্চলতা ছেড়ে কোমলতা নিয়ে ধীরেধীরে নেমে এসেছে। ডাইনিংয়ে তন্ময় অলরেডি বসে ব্রেকফাস্ট করছে৷ অরু ধীরে তন্ময়ের পাশেই বসলো৷ প্লেট ছুঁয়ে দিলেই ভেঙে যাবে এমন হাবভাব নিয়ে একটা প্লেট সামনে রেখেছে। সামান্য একটা ব্রেড আলগোছে নিয়ে সেটা কাঁটাচামচ দিয়ে ধীরেসুস্থে খাচ্ছে৷ সুমিতা বেগম মেয়ের কান্ডকারখানা সকাল থেকেই দেখছে৷ এবার নিজেকে আর সংযত করতে পারলেন না৷ টেবিলের সামনে এসে চেঁচিয়ে উঠলেন,
– এই হয়েছি কী তোর? এমন করছিস কেন!
মনেমনে অরু বিরক্ত হলো বটে৷ আরে তন্ময়ের সামনেই কেন জিজ্ঞেস করতে হবে তার মায়ের? পরে জিজ্ঞেস করলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হতো? পিটপিট করা নাকটাকে সামলে বললো,
– স্কুলে যাচ্ছি মা৷ তাড়াতাড়ি ফিরবো৷ তুমি চিন্তা করো না৷
সুন্দর সাবলীল ভাষায় বলে আঁড়চোখে তন্ময়ের মুখের দিক তাকাল৷ ব্যাটার চোখমুখের কোনো পরিবর্তন নেই৷ আরে কানাটা কী দেখছে না অরুর এই সুন্দর পরিবর্তন? পরপর ভাবলো মাত্রই দু’ঘন্টা ধরে নিজেকে পরিবর্তন করতে নেমেছে৷ একটা দিন যাক, তারপর নাহয় তন্ময়ের চোখে লাগবে৷ তন্ময়ের চোখে না লাগলেও বাড়ির বাকি সদস্যদের চোখে লেগেছে। তারা সবাই অরুকে নিয়ে বেশ চিন্তিত৷ মুফতি বেগম রুটি ভাজতে নিয়ে বললেন,
– মাইয়াডার হঠাৎ হইলো কী? সকাল থেকে কেমন শান্ত হয়ে আছে৷
সুমিতা বেগম থালাবাসন ধুতে ধুতে জবাব দিলেন,
– ঘূর্নিঝড়ের পূর্বের আভাস। ও শান্ত মানে কিছু একটা পাকাচ্ছে৷
জয়া বেগম বললেন,
– এতো বেশি বলিস না সুমিতা! মেয়েটার নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে৷ স্কুল থেকে ফিরলে কথা বলবি।
– ভাবী ও তোমাদের কারণেই এমন বিগড়েছে৷
যাকে নিয়ে পরিবার আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত, সে আপাতত স্কুলের বাথরুমে নাক পরিষ্কার করছে৷ সারা রাস্তায় নাক পিটপিট দমন করে রেখেছিল৷ নিজেকে নায়িকাদের মতো পারফেক্ট করা, সহজ বিষয় নয়৷ একদমই নয়৷ চার-পাঁচ ঘন্টায় অরু হয়রান হয়ে গিয়েছে অভিনয় করতে করতে৷ তাই সে নিজের ডিসিশন পরিবর্তন করলো৷ এখন থেকে অরু শুধু তন্ময়ের সামনে টিপস গুলো ফলো করবে৷ তন্ময় সেগুলো দেখে আকর্ষণ অনুভব করবে৷ তারপর অরুর পেছন পেছন ঘুরবে৷ মধুময় গল্পসল্প করবে৷ আদর সোহাগ দিবে! তার প্রেমে হাবুডুবু খাবে৷ ভেবেই অরু খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলো৷ সেদিন খুশি মনে স্কুল শেষ করে বাড়ি ফিরেছে৷ লাফিয়ে লাফিয়ে নিজের রুমে গিয়ে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রেকটিস করতে আরম্ভ করেছে৷ ঠিক কীভাবে লাজুক অভিনয় করলে ভালো দেখাবে? অভিনয় করার এক ফাঁকে দীপ্ত উঁকি দিল রুমে৷ অরুর এসব কর্মকাণ্ড দেখে ফিক করে হেসে উঠলো৷
– পাগল ছাগলের মতো কীসব করছ?
অরু দৌড়ানি দিতেই দীপ্ত চলে গেল৷ এবার অরু দরজা লাগিয়ে রাখল৷ দুপুরে খেয়ে আবারো রুমে চলে এসেছে৷ ঠিক সন্ধ্যায় দরজা খুলে বেরিয়েছে৷ সুন্দর একটা কামিজ পরেছে৷ পিঠ সমান চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে৷ ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক দিয়েছে৷ নিজেকে পরিপাটি করে তন্ময়ের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে বইপত্র নিয়ে৷ আজ একদম তাড়াহুড়ো করবে না৷ ধীরেসুস্থে তন্ময় আসলেই রুমে ঢুকবে৷ তন্ময় এসেছে ঘন্টাখানেক পর৷ তাকে দেখে অরু নিজের রুমে ঢুকে গেল৷ তারপর আচমকা বেরিয়ে আসার অভিনয় করল৷ তন্ময়ের দিক লাজুক ভাবে তাকাল৷ পরমুহূর্তেই চোখ নিচে নামিয়ে রাখল৷ অথচ তন্ময় সেখানে নজরই দেয়নি যেমন৷ অফিস ব্যাগ নিয়ে রুমে ঢুকে গেল৷ লোকটা কী কানা? নাহলে অরুর পরিবর্তন দেখে কিছু বলছে না কেন? কিছু বলুক, অরু শুনতে চায়৷ মনের বিষাক্ততা দমিয়ে অরু রুমে ঢুকতেই চুলে টান অনুভব করলো৷ তন্ময় পেছন থেকে তার লম্বা চুলগুলো ডানহাতে পেঁচিয়ে নিয়েছে৷ ব্যথায় অরু আর্তনাদ করে উঠলো,
– এ্যাহ! ছাড়ুন, ছাড়ুন ব্যথা পাই! লাগছে তো!
– আর যদি দেখি আমার আশেপাশে এসব করে বেরিয়েছিস, চড় দিয়ে দাঁত সবকয়টা ফেলে দিব!
অরুর আর বুঝতে বাকি নয় কিসবের কথা বলছে৷ মাথা বেঁকিয়ে বলল,
– করবো না৷ ছাড়ুন!
তন্ময় ছেড়ে দিল৷ অরু চোখের কোণায় জল নিয়ে অভিমানী চোখে তাকাল৷ চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই শুনতে পেল তন্ময়ের গম্ভীর স্বর,
– চুপচাপ পড়তে বোস৷
অন্ধকার চোখমুখ নিয়ে অরু টেবিলে বসেছে৷ তন্ময় তাওয়াল হাতে ওয়াশরুম গিয়েছে৷ বইপত্র মেলে অরু ভাবতে বসলো৷ তার রোমান্টিক ফিল্মের নায়িকা হবার স্বপ্ন বাদ দিতে হবে৷ তাহলে কী অন্যকিছু ট্রায় করবে? তন্ময়কে তার প্রেমের জালে ফাঁসাতে কি করতে হবে? কই নায়িকাদের দেখলেই তো নায়ক পাগল হয়ে নিজেই প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়ে৷ তাহলে তন্ময় কেন তার প্রেমের জালে পড়ে না? হুট করে অরুর নজর গেল তন্ময়ের অফিস ব্যাগে৷ ওয়াশরুমের দিক আঁড়চোখে তাকিয়ে দ্রুত ব্যাগটা খুলল৷ ভেতর থেকে তখন টুংটাং শব্দ পেয়েছিল৷ কীসের শব্দ হতে পারে সেটাই দেখবে৷ সম্পুর্ন ব্যাগে উঁকিঝুঁকি দিয়েও কিছু পাচ্ছে না৷ তন্ময়ও বেরিয়ে আসবে যেকোনো সময়৷ ব্যাগের ভেতরে ছোট সাইড পকেটের চেইন খুলতেই অরু, খুব সুন্দর বড়ো একজোড়া পাথরের কানের দুল পেলো। এতটাই সুন্দর দুল জোড়া যে অরু তাকিয়েই রইলো৷ কানের দুল আর টিকলি তার ভীষণ প্রিয়৷ এতো সুন্দর দুল তন্ময় কার জন্য এনেছে? নাকি অন্যকারো সে নিজের কাছে রেখেছে? ওয়াশরুম থেকে শব্দ আসছে৷ তন্ময় বেরোবে মনে হয়৷ অরু দ্রুত ব্যাগ আটকে যেখানকার ব্যাগ যেখানটায় রেখে দিল৷ কিছুক্ষণ পর দীপ্ত এসে কফি দিয়ে গেছে তন্ময়কে৷ সেই কফিতে চুমুক দিতে দিতে তন্ময় অরুকে পড়াচ্ছে৷ কিন্তু পড়াতে অরুর একটুও মন নেই৷ মন আনচান করছে দুল জোড়া দেখার পর থেকে৷ তন্ময় কার জন্য কিনেছে? তন্ময়ের কী প্রেমিকা আছে? সে কি প্রেম করে? আশঙ্কায় অরুর বুক ধুকপুক করছে৷ নিজেকে কোনোমতেই আটকাতে পারলো না৷ হুট করে প্রশ্ন করে বসলো,
– আপনি কি প্রেম করেন তন্ময় ভাইয়া?
– চাচ্চুকে ডাকবো?
– না না৷ এইতো পড়ছি!
অরু আবারো পড়ায় মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলো৷ না পারছেনা৷ আঁড়চোখে তন্ময়কে কয়েকবার দেখে নিল৷ মনের ভেতরে থাকা প্রশ্নটার উত্তর না পেলে অরু মরেই যাবে৷ মরার আগে উত্তর জেনে নিবে৷ বই বন্ধ করে অরু তন্ময়ের দিক তাকিয়ে বলল,
– আপনার ব্যাগের কানের দুল জোড়া কার?
– হবে একজনের৷
তন্ময়ের সরলতম জবাবে অরু বাকরুদ্ধ হয়ে গেল৷ চোখজোড়া লাল হয়ে উঠছে তার,
– কার? আপনি কিনেছেন অন্যকারো জন্য?
– তাইতো মনে হচ্ছে৷
অরুর নাক ফুলে উঠছে। কেঁদে দিবে, দিবে ভাব৷
– আপনি..
সম্পুর্ন কথা বলতে পারলো না, পূর্বেই অরু দৌড়ে বেরিয়ে আসলো তন্ময়ের রুম থেকে৷ নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো৷ কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় শুয়ে পড়লো৷ একসময় নাকের পানির জ্বালায় উঠে টিস্যু নিয়ে বসলো৷ আমতাআমতা করে বলল,
– কান্না করেও শান্তি নেই৷
—-
আজকের আকাশের চাঁদ খুবই সুন্দর৷ শাবিহা ছাঁদের এককোণে দাঁড়িয়েছে৷ এক ধ্যানে চাঁদের দিক তাকিয়ে আছে। ঘনঘন বাতাস বইছে৷ তার চুলগুলো উড়ছে৷ রাতের আকাশ শাবিহার ভীষণ পছন্দের৷ আকাশের পানে তাকিয়ে থাকতে মায়া লাগে৷ তেমনই ভালোও লাগে৷ অস্পষ্ট আওয়াজ শুনে পাশে তাকাল৷ পাশের ছাঁদে অয়ন এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে বোতল৷ কিছু একটা খাচ্ছে৷ শাবিহা চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
– মাত্র ফিরেছ?
– হু! কাজের চাপে কাঁধ ব্যথা করছে৷ শাবিহা একটু টিপে দিবেন?
শাবিহা কথা উল্টে বলল,
– খেয়েছ?
– মাত্রই ফিরেছি৷ আপনাকে নিচ থেকে ছাঁদে দেখে ডিরেক্ট চলে এসেছি৷ ফ্রেশ হয়নি এখনো৷
– ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও৷
– পড়ে৷ আপনি বলুন, কাল তামান্নার হলুদে আসবেন না?
– জানি না!
– আসবেন৷ আমি অপেক্ষায় থাকব আপনার৷
শাবিহা জবাব দিচ্ছে না দেখে অয়ন ছাঁদ টপকে চলে এলো৷ শাবিহা প্রথমে ঘাবড়েছে৷ পরপর নিজেকে সামলে দাঁড়িয়ে রইলো৷ অয়ন তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ শাবিহা আঁড়চোখে দেখেছে অয়নকে৷ শার্ট-প্যান্ট পরে৷ কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম৷ চুলগুলো সুন্দর ভাবে উল্টে দেওয়া৷ বেশ বড়বড় ভাব৷ কানে সুড়সুড়ি পেয়ে সরে যাবার চেষ্টা করলো৷ অয়ন দুপাশে হাত দিয়ে আটকে ধরলো তাকে৷
– আজ মা বলছিল আমি বড়ো হয়ে গেছি৷ বুঝদার হয়েছি৷ আমাকে বিয়ে দিতে হবে৷ বাড়িতে বউ লাগবে৷ ভাবছি তাদের আপনার কথা বলবো৷
শাবিহা মুহুর্তেই আৎকে উঠলো৷ বিষ্ময়কর নয়নে ফিরে তাকাল৷
– এসব কী বলছ!
– কি বলছি? একদিন না একদিন তো বলতে হবে। আগেই বলে দেওয়া ভালো না?
– কয়েক বছর যাক৷ তুমি ঠিক কী চাও বুঝে নাও আগে!
অয়নের চোখমুখ কুঁচকে এসেছে৷ শাবিহাকে নিজের দিক ফিরিয়ে বলল,
– শাবিহা আপনি কী কোনোভাবে আমাকে ডাউট করছেন? আমার ভালোবাসাকে নিতান্তই মজা ভাবছেন নাকি?
– সেটা নয় কিন্তু অয়ন তুমি এখনো খুব ছোটো৷ তোমার পরিবার বা আমার পরিবার এটা একদম ভালো চোখে দেখবে না৷ বরং তুমি খুব চাপে পড়ে যাবে৷ কতটা ঝামেলা আসবে বুঝতে পারছ না।
– আপনি এখানো হেজিট্যাট করছেন!
শাবিহা নিশ্চুপ৷ অয়ন চলে যাচ্ছে। একটিবার ফিরে তাকাল না৷ শাবিহা ভেজা নয়নে তাকিয়ে রইলো৷ আজকাল সে খুব ভয়ে থাকে৷ পরশুদিনও বাড়িতে তারজন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে৷ মোস্তফা সাহেব মেয়ের মুখের দিক তাকিয়ে প্রস্তাব একটির পর একটি ফিরিয়ে দিচ্ছেন৷ প্রতিবেশীদের কানাঘুঁষা তো চলছেই, শাবিহার বিয়ে নিয়ে৷ বয়স হয়েছে এখনো বিয়ে করছে না কেন! মাস্টার্স শেষের পথে প্রায়৷ অথচ শাবিহা এখনো কোনো ডিসিশন নিতে পারছেনা৷ মোস্তফা সাহেব জানিয়েছেন, বিয়ে নিয়ে শাবিহাকে চিন্তাভাবনা করতে৷ মেয়ে মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছে, আজ বাদে কাল বিয়ে তো করতেই হবে৷ এতসব সে অয়নকে কীভাবে বোঝাবে? তার বিয়ের বয়স প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ অয়নের বিয়ের বয়স হয়নি এখনো৷ আজকাল নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ছেলেরা বিয়ে করে৷ সেদিকে অয়ন মাত্র অনার্সে পড়ছে৷ কীভাবে কি করবে শাবিহা বুঝতে পারছেনা৷ নিজেকে ভীষণ হেল্পল্যাস লাগছে৷ কার সাথে এগুলো শেয়ার করে নিজেকে উদ্ধার করবে? কাকে বলবে এসব কথা? কে তাকে রাস্তা দেখাবে?
– শাবিহা!
তন্ময়ের ডাকে ফিরে তাকাল শাবিহা৷ তন্ময় দুটো কফি হাতে ছাঁদে উঠে এসেছে৷ একটা কফি শাবিহার হাতে দিয়ে অন্যটায় সে চুমুক বসিয়েছে৷ গরম গরম কফি! এখনো ধোঁয়া উড়ছে৷ শাবিহা কিছুক্ষণ ভাইয়ের দিক তাকিয়ে থেকে কফিতে চুমুক বসালো৷ তন্ময় দূরে চাহনি নিবদ্ধ করেই প্রশ্ন করলো,
– কি হয়েছে?
শাবিহা নিশ্চুপ হয়ে আছে৷ তন্ময়ও তাকে তাড়া দিচ্ছে না৷ ধীরেসুস্থে জবাব দেওয়ার সময় দিয়েছে৷ শাবিহা কিছুক্ষণ পর বলল,
– ভাইয়া বয়সের ব্যবধান কী খুব ম্যাটার করে?
আমি যদি বলি, আমার কমবয়সী এক ছেলেকে পছন্দ তুমি কী আমার উপর নিরাশ হবে?
– উঁহু একদম না৷
– তাহলে কী করবো? আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা!
– সময় আছে বুঝে নে৷ এতো প্রেসার নিতে হবেনা৷ তোর যাকে পছন্দ হবে, আমারও তাকেই পছন্দ৷
শাবিহার মাথাটা তন্ময়ের বুকে হেলে গিয়েছে৷ চোখজোড়া বুঝে বলল,
– ও আমার খুব ছোট! আমার সাথে ওর মানায় না৷ তার উপর…
– সবকিছু বাদ! তুই কী চাস? তুই যেটা চাস তাই হবে৷
– সবসময় নিজের চাওয়াকে পূরণ করতে নেই৷
তন্ময় হাসলো৷ শাবিহাকে নিজের সঙ্গে নিতে নিতে বলল,
– সর্বপ্রথম নিজের চাওয়াকেই পূরণ করতে হয়৷ বাই হুক ওর বায় ক্রুক!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here