ফাগুন চেয়েছে মন পর্ব -০৩

‘ফাগুন চেয়েছে মন’
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৩

সেদিনের ঘটনার পর থেকে সৃজনের প্রতি বিদ্বেষ ভাব অনেকটা ম্রিয়মাণ হয়ে গেলো ফাগুনের। আপাতদৃষ্টিতে গুরুগম্ভীর মনে হলেও সৃজন প্রকৃতপক্ষে শান্তিপ্রিয়, নির্ভেজাল প্রকৃতির। ভালাবাসাহীন,অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কাছে আসার ঘটনাটা ফাগুনের চাইতে বেশি আলোড়িত করেছে তাঁকে। তাইতো ফাগুন সে একা ছেড়ে দিয়েছে!
আরেকটু গভীরভাবে বোধহয় সৃজনকে জানা হয়ে যেতো ফাগুনের যদি না আকস্মিক ভাবে আবার আবির্ভাব ঘটতো আসাদের। নিজের মনকে গুছিয়ে নেওয়ার সময় পেলো না ফাগুন। ভালোভাবে নজর দেওয়া হলো না সৃজনের প্রতি। এর মাঝেই হাজির হলো আসাদ।

চাকরি পেয়ে ঢাকা থেকে ছুটে এলো ফাগুনের সঙ্গে দেখা করার জন্য। আদর্শ প্রেমিকের মত অঙ্গীকার জানালো ফাগুনকে সে জয় করে নেবে।
ফের অগোছালো হয়ে গেলো ফাগুন!
কোমল হৃদয় সবেগে ধাবিত হলো আসাদের প্রতি!

হবে নাই বা কেন? এমন নিখুঁত ভালোবাসার অভিনয় যেই পুরুষ করতে পারে তাঁকে ভালো না বেসে কি থাকা যায়? মেয়েরা ভালোবাসা ছাড়া আর কিই বা চায়? প্রেমিক পুরষটির চোখের নিজের জন্য আকুলতা দেখবে এই তো চায়! তাঁকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে দিশেহারা প্রেমিকের কতশত বাধা পেরিয়ে ফেলবে। এর চাইতে বেশি স্বার্থকতার আর কি হতে পারে!

রোজ এভাবেই ঠকে যায় প্রেমিকের প্রতি অন্ধবিশ্বাস রাখা কতগুলো অসহায় মেয়ে! চরমভাবে শিকার হয় ভালোবাসা নামক প্রতারণার। যারা ধোঁকা দেয় তারা প্রচন্ড রকমভাবে ভালোবাসার অভিনয় করেই ধোঁকা দেয়। এদের ভালোবাসায় খাদ থাকলেও অভিনয়ে কোনো খাদ নেই! একেবারে নিখুঁত, নিখাদ অভিনয়! এরা যখন আবার মেয়ের বাবা হয় তখন আর পরের ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারে না! কি অদ্ভুত গোলমেলে চিন্তাধারা এদের!

আসাদের বাবা একজন ফল বিক্রেতা। মা গৃহিণী। চারভাই বোন সহ মোট সাত সদস্যের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার ওদের। অর্থনৈতিক দুরবস্থা আর সাংসারিক টানাপোড়নের মাঝে ওদের একমাত্র ভরসা ছিলো আসাদ। ছেলে শিক্ষিত হয়ে বড় চাকরি করবে এই ভাবনায় পড়াশোনার ক্ষেত্রে চেষ্টার কোনো কমতি রাখেন নি আসাদের বাবা। স্থানীয় এক সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করার পর মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার জন্য ঢাকায় গেলো আসাদ। সবাই ভাবলো এবার বুঝি অসহায় দরিদ্র পিতার স্বপ্নপূরণ হবে।

কিন্তু আসাদের অন্য চিন্তাধারা! সে চায় কম পরিশ্রমে বেশি লাভ! এই বাজারে মেধা এবং পরিশ্রম দুটোরই কোনো দাম নেই! চাকরীর বাজারে এখন মেধার চাইতে বেশি মামা চাচার জোর চলে।
তাই নিজের মেধাকে সে অন্যকাজে লাগালো।
ফাগুনকে নিয়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলো। ধনী পিতার আদরের দুলালী ফাগুন। একসঙ্গে রাজকন্যা এবং রাজত্ব দুটোই মিলবে।

কিন্তু খালেদ তালুকার ওর সেই আশায় জল ঢেলে দিলেন। মেয়ের সঙ্গে আসাদের সম্পর্কের কথা জানার পর গোপনে ওর ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য লোক লাগিয়ে দিলেন। তাতে করেই তিনি জানতে পেরে গেলেন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছেলেটির সুস্থ চিন্তাভাবনায় ভয়াবহ রকমের পচন ধরেছে। ঢাকায় আসাদ যেই মেসে ভাড়া থাকতো সেই একই মেসেই ওর সঙ্গে বন্ধুর মত চলাফেরা করেছিলো খালেদ তালুকদারের কর্মচারী গুপ্তচর ছেলেটি।অতএব সন্দেহের কোনো অবকাশ রইলো না।

দ্রুত মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলেন খালেদ তালুকদার। কিন্তু বিয়ের পরেও হাল ছাড়লো না আসাদ। ফাগুনকে নিয়ে পালানোর ভূত কিছুতেই ওর মাথা থেকে নামলো না। গ্রামে ফিরে ঠিক করলো যেভাবেই হোক ফাগুনকে নিয়ে পালাবে। একবার পালিয়ে বিয়ে করে নিতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে। খালেদ তালুকদার মেয়ের ওপর বেশিদিন রাগ ধরে রাখতে পারবেন না। একমাত্র মেয়ে। একসময়ই ঠিকই কাছে টেনে নেবেন। তাছাড়া মাঝবয়সী একটা বুড়োর সঙ্গে ফাগুনের বিয়ে হয়েছে। মোটেও সুখে নেই ফাগুন। অতএব যাই ঘটুক না কেন নিজের মেয়ে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন না খালেদ তালুকদার। এই ভরসায় ফাগুনের সাথে নতুন করে আবার যোগাযোগ শুরু দিলো সে।

প্রথম দেখায় ভালোলাগার বিষয়টা হয়তো মিথ্যে ছিলো না আসাদের! ফাগুন নামের সুন্দরী, রূপবতী তরুনীটি সত্যিই প্রথম দেখাতে ওর হৃদয়ে দাগ কেটেছিলো! কিন্তু সেই ভালোলাগা আর ভালোবাসা অব্দি গড়াতে পারে নি। তার পূর্বেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় আসাদের লোভ আর অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা! ফাগুনকে ভালোবাসার কথা যেন বেমালুম ভুলে গেলো সে!


বারান্দায় বসে বই পড়ছে সৃজন। রাত বেশি হয় নি! সবে সাড়ে নয়টা! ফাগুন পর্দা সরিয়ে দরজায় টোকা দিলো। ঘরের ভেতরে সামান্য উঁকি দিয়ে বললো,

‘আসতে পারি?’

সৃজন বই থেকে মুখ তুলে সম্মুখে চাইলো। ফাগুনকে দেখে খানিকটা অবাক হলেও শান্ত কন্ঠে বললো,

‘এসো।’

ফাগুন ইতস্তত করে ভিতরে ঢুকলো। এই প্রথম সৃজনের ঘরে ঢুকেছে সে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে ঘরের ভেতরটা দেখলো। সৃজনকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে বললো,

‘আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিলো।’

‘বলো।’

‘আসাদ। ওর কথা বলেছিলাম আমি আপনাকে। গ্রামে এসেছে। আপনার সঙ্গে দেখা কর‍তে চায়।’

ফাগুনের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝলো না সৃজন। চুপ করে রইলো। ফাগুন ইতস্তত করে বললো,

‘আমাদের বাড়িতে আমি যাবো না। তাই এখানে আসতে বলেছি। কিন্তু ও লজ্জা পাচ্ছে।’

সৃজন নির্ভেজাল, শান্ত প্রকৃতির মানুষ বলেই হয়তো ফাগুন এমন সাহস দেখাতে পেরেছে। কিংবা ও জানে মুখ ফুটে কোনো প্রতিবাদ করবে না সৃজন। নইলে স্বামীর বাড়িতে নিজের পুরোনো প্রেমিককে ডেকে আনার কথা বলা কোনো স্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হতো না। অথবা সৃজন অতিরিক্ত নরম, নমনীয় বলেই ওর অপমান বোধের কথা ফাগুন ভাবে নি!

সৃজন প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে বসে রইলো। একমূহূর্তেই যেন ফাগুনের প্রতি সমস্ত টান, ভালোবাসা হারিয়ে গেছে! ভুলে গেলো এই মেয়েটি ওর বিবাহিতা স্ত্রী! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো গেলে ওর চলে গেলে যাক! সৃজন বাধা দেবে না!

সৃজনের সাড়াশব্দ না পেয়ে ফাগুন বললো,

‘আপনি কিছু বলছেন না যে? আপনার অনুমতি না পেলে ও আসবে না।’

সৃজনের পূর্বের ন্যায় চুপচাপ বসে রইলো। ফাগুন ফের ওর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে বললো,

‘ও আপনাদের আত্মীয় হয়। তাই দেখা করতে লজ্জা পাচ্ছে।’

এবারে বেশ অবাক হলো সৃজন। সৃজনের আত্মীয়! তাহলে নিশ্চয়ই এই গ্রামেরই ছেলে! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পরিচয় বললো,

‘পরিচয়?’

‘নাম আসাদ উল হক। বাবা সামিউল হক। মায়ের নাম জাহানারা খাতুন। বাড়ির নাম কাজী বাড়ি। এর বেশি কিছু জানি না।’

নাম শুনে সৃজন বুঝতে পারলো ওর মাতৃপক্ষের আত্মীয় হয় আসাদ। ওর মায়ের দুরসম্পর্কের ফুপাতো বোন জাহানারা খাতুন। পাশের গ্রামেই বাড়ি। ছোটবেলাই মায়ের সঙ্গে এই বাড়িতে বেশ কয়েকবার এই বাড়িতে এসেছে আসাদ। সেই সুবাদে খানিকটা হলেও চেহারা মনে আছে সৃজনের। বললো,

‘কিন্তু ওর তো পড়াশোনা শেষ শুনেছি।’

‘হ্যাঁ। চাকরি হয়েছে। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’

‘আমার সঙ্গে দেখা করার কি প্রয়োজন?’

সৃজনের অবাক করা চাহনি ফাগুনকে বেশ লজ্জা দিলো। সত্যিই তো সৃজনের সঙ্গে দেখা করার কি প্রয়োজন আসাদের? এই কথাটা তো আসাদকে জিজ্ঞেস করতে একদমই ভুলে গেছে সে! নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলো ফাগুন।

সৃজন হাতের বই রেখে উঠে দাঁড়ালো। বারান্দা থেকে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

‘কবে আসবে?’

‘আগামীকাল।’

‘ঠিক আছে। বিকেলে আমার কারখানায় দেখা করতে বলো।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সৃজন। ফাগুন চিন্তিত মুখে ওর চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো। এই লোকটার কি তবে সত্যিই ওকে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই? এত নির্লিপ্ত কি করে হতে পারে সে! কি করে এত শান্ত থাকতে পারে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here