ফাগুন চেয়েছে মন পর্ব -০৮

#ফাগুন_চেয়েছে_মন
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৮

ফাগুন সারাদিন অলসভাবে কাটিয়ে দিলো। সৃজনের ওপর সুধার সীমাহীন অধিকার বোধ ওকে অসহ্য যন্ত্রণা দেয়! এই অধিকার সবাই চাইতে বেশি ওর থাকার কথা ছিলো! অথচ স্বেচ্ছায় নিজেকে অধিকার বঞ্চিত করেছে ফাগুন।

নিজের ওপর আক্ষেপ হয়। আগের মতন আসাদের প্রতি আবেগ কাজ করে না। এমনকি আসাদ ফোন করলে ঠিক মত কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। অস্বস্তি লাগে! এই অস্বস্তির কারণটা তলিয়ে দেখতে গেলে ভয় হয় ফাগুনের। লজ্জা হয়! মন বলে যদি সৃজন মনের মধ্যে ঘাঁটি গেড়ে বসে!

আবার কোনো এক নিশিরাতে মনে হয় বসলে বসুক। ক্ষতি কি! যা হয় হবে! একবার সৃজনের সঙ্গে কথা বলে দেখবে। ফাগুনের জন্য ওর মনের মধ্যে কোনো অনুভূতি আছে কিনা জানার চেষ্টা করবে!

এভাবেই ফাগুনের মনের মধ্যে যখন সৃজন নামক পাখিটা একটু একটু করে ডানা ঝাপটাতে শুরু করেছিলো ঠিক তখনই আবার একটা ঝড় এসে সব এলোমেলো করে দিলো। নিজেকে সংশোধন করে নেওয়ার সময় পেলো না ফাগুন। তার আগেই মস্তবড় অঘটন ঘটে গেলো।

কথায় আছে মন্দ খবর বাতাসের আগে ছড়ায়। হঠাৎ করেই সৃজনের সঙ্গে ওর ডিভোর্সের খবরটা চারদিকে জানাজানি হয়ে গেলো। আইনী প্রক্রিয়া তখনো শুরুই হয় নি। তথাপি সবার কানে খবর পৌঁছে গেলো। যদিও এসবের মূলে আসাদ রয়েছে। কিন্তু ফাগুন কিচ্ছু টের পেলো না।

এদিকে খবরটা জানাজানি হতেই চারদিকে সুধাকে নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো।
বিয়ের পাঁচ মাসে ফাগুন আর সৃজনের মধ্যে কোনো রকম সমস্যা হলো না। অথচ সুধা বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই ডিভোর্সের খবর! অতএব সবাই নিশ্চিত ভাবে ধারণা করে নিলো সৃজনের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক চলছে সুধার। সব দোষ গিয়ে পড়লো নিরপরাধ মেয়েটার ওপর!

মাত্র দেড় মাস বয়সে মায়ের সঙ্গে এই বাড়িতে প্রথম এসেছিলো সুধা। সুধার বাবা মারা যাওয়ার পর সৃজনের বাবা ওদের এই বাড়িতে এনে আশ্রয় দেন। সম্পর্কে সুধার মা উনার আপন বোন না হলে স্নেহ যত্নের কোনো কমতি রাখেন নি। সুধাকেও নিজের মেয়ের মত মানুষ করেছেন। ঠিক সেই কারণেই এই বাড়ির সঙ্গে সুধার একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

কিন্তু বছর তিনেক আগে যখন সৃজনের বিয়ে নিয়ে ঝামেলা হলো তখন মেয়েকে নিয়ে পুনরায় শ্বশুর বাড়িতে ফিরে গেলেন সুধার মা সাবেরা বানু। ভেবেছিলেন সৃজনের বিয়ে হয়ে গেলে তারপর ফিরবেন।

কিন্তু সৃজন আর ফাগুনের ডিভোর্সের কথা জানাজানি হতেই আরো একবার প্রশ্ন উঠলো সুধার চরিত্র নিয়ে! গ্রামের মানুষ ছিছি শুরু করলো।

বখাটে ছেলে ছোকরারা রাতের অন্ধকারে সুধার নামে নানারকম বাজে কথা লিখতে শুরু করল বাড়ির দেওয়ালে। রাত হলেই ঘরে ঢিল ছুঁড়ে মারে। সুধাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করার হুমকি দেয়। সুধার মা সাবেরা বানু মেয়ের খবর শুনে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সৃজনের কাছে চিঠি দিলেন সুধাকে শীঘ্রই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য।

গ্রামের মুরুব্বীরা সৃজনকে ডেকে পরামর্শ দিলেন ডিভোর্সের আগ পর্যন্ত সুধাকে ওর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রয়োজনে ফাগুনের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেলে তারপর সুধাকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে পারবে সৃজন। কিন্তু বিয়ের আগে কোনো অবৈধ সম্পর্ক রাখা চলবে না!

সৃজন লজ্জায় বিবর্ণ হয়ে গেলো! এতকিছুর নিজের মনের কথা গুলো খুলে বলার সাহস কিংবা সুযোগ কোনোটাই হলো না ফাগুনের।


সুধাকে যেদিন ওদের গ্রামের বাড়িতে দিয়ে আসবে তার আগের দিন ঠিক রাত বারোটায় বাড়ি ফিরলো সৃজন।

এই কয়দিনে সুধার সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা হয় নি। সকালে বেরোবার সময় তাহেরাকে দিয়ে সৃজনের ঘরে নাশতা পাঠিয়ে দিতো সুধা। দুপুরে খাবার সময়ও দূরে দূরে থাকতো। সৃজনও ওর কথা জিজ্ঞেস করতো না।

যাওয়ার দিন আগে রাতের খাবার নিয়ে ওর আসার অপেক্ষায় বসে রইলো সুধা। সৃজনকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে খাবার গরম করার জন্য রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। কিন্তু ফিরে এসে দেখলো সৃজন খাবার টেবিলে আসে নি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় খাবারগুলো ঢেকে রেখে দিলো।

বসার ঘরে বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে বসে রইলো সৃজন! ঘড়িতে রাত দেড়টা! অথচ চোখে এক ফোঁটাও ঘুম নেই! বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে! নিজেকে বড্ড অসহায় অস্থির লাগছে!

সুধা যেন আগে থেকেই জানতো সৃজন এখানে থাকবে। নিঃশব্দে ওর পায়ের কাছে এসে বসলো। সৃজনের হাটুতে মাথা রেখে ক্ষীণ স্বরে ডাক দিলো,

‘ভাইয়া!’

সৃজন কোনো প্রতিউত্তর করলো না! একধ্যানে সামনের দিকে চেয়ে রইলো। সুধা ফের ডাক দিলো,

‘ভাইয়া!’

মৃদু কান্নার আওয়াজ শুনে সৃজনের হুশ ফিরলো। পায়ের কাছে সুধাকে বসা দেখে যন্ত্রণায় মলিন হয়ে গেলো মুখ। সুধা ওর হাটুতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সুধার মাথায় নিজের ডান হাতটা রেখে কোমল স্বরে বললো,

‘কাঁদছিস কেন সুধা?’

‘সবাই এসব কি বলছে ভাইয়া। আমার সঙ্গে কি তোমার তেমন সম্পর্ক? তুমি তো সত্যিটা জানো ভাইয়া।’

‘জানি তো। সত্যিটা হলো তুই আমার বোন!’

‘তাহলে কেন আমার সঙ্গে কথা বলো না?’

কি নিষ্পাপ স্নেহমাখা অভিযোগ! বিন্দুমাত্র অশুচি নেই এই স্নেহের মধ্যে! মাটি থেকে তুলে সুধাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলো সৃজন। ছোটবেলায় সুধা কোনকিছু নিয়ে বায়না ধরে কান্না করলে ঠিক এমনি করে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতো সৃজন। কিন্তু আজকে আর সুধা শান্ত হলো না। শক্ত, কঠিন ধাঁচের মেয়েটা অপমানে অসম্মানে সৃজনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। সৃজন মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,

‘কাঁদে না লক্ষ্মী বোন আমার। তুই কাঁদলে আমার সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়।’

সুধার কান্না আরো বাড়লো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,

‘তুমি কেন আমার মায়ের পেটের ভাই হলে না ভাইয়া?’

‘সেই আফসোস আজ আমারও হচ্ছে!’

নিচতলায় সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখলো ফাগুন! চোখের পানিতে ওর গাল ভিজে গেছে! সুধার অপমান যে সৃজনের ঠিক কোথায় আঘাত করেছে সেটা বুঝতে ওর আর বাকি রইলো না। আর কেউ না জানুক ফাগুন তো জানে সুধার সঙ্গে সৃজনের কি সম্পর্ক! কতটা পবিত্রতা আর স্নেহ দিয়ে ঘেরা এই দুজনের বন্ধন!

সারারাত ফাগুনের ঘুম হলো না। সৃজনের অসহায় মুখটা মনে পড়তেই অসহ্য বেদনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হলো। এত কষ্ট এত বেদনা বিয়ের দিন আসাদকে হারিয়ে ফেলার কথা ভেবেও হয় নি।


পরেরদিন সকাল বেলা ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিচে নেমে এলো সুধা। ফাগুন ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে রইলো। কাছে যাওয়ার সাহস হলো না। তাহেরা কাঁদছে। সুধা কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখতেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো।

‘আপনি গেলে এই বাড়ি খালি হইয়া যায় আপা। মরা বাড়ি লাগে। আপনার মত কেউ ভাইজানের যত্ন নিতে পারবে না।’

সুধা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘ভাইয়াকে আমি তোর ভরসায় রেখে যাচ্ছি। তুই ছাড়া ভাইয়ার আর কেউ নেই।’

সৃজন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সুধার জন্য অপেক্ষা করছিলো। মুখের ভাব অস্বাভাবিক গম্ভীর। চোখের দৃষ্টি বিষণ্ণ।
সুধা বেরিয়ে এসে বললো,

‘চলো ভাইয়া।’

ওর ব্যাগটা হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো সৃজন। সুধাও শেষবারের মতন তাহেরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেটের দিকে পা বাড়ালো। দুজনের একজনও ফিরে তাকালো না ফাগুনের দিকে। তাকালে হয়ত দেখতে পেতো মুখে হাত চেপে ধরে আকুলভাবে কাঁদছে ফাগুন!


সেদিন সুধা চলে যাওয়ার পর সৃজনের যত্ন নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করলো ফাগুন। খাবার সময় টেবিলে সৃজনের সামনে বসে থাকতো। সকাল বেলা সৃজন কারখানার জন্য বেরোবার পূর্বে ওর জিনিসপত্র গুছিতে দিতো। দুপুরের খাবার সময় কোনদিন সৃজনের আসতে দেরী হলে তাহেরাকে দিয়ে খোঁজ খবর জানার চেষ্টা করতো। কিন্তু সৃজন যেন পূর্বের চাইতেও বেশি গম্ভীর হয়ে গেছে। ফাগুনের কোনো কিছুই ওকে আকৃষ্ট করলো না।

একমাস যাবত চেষ্টা করতে গিয়ে ফাগুন বুঝতে পারলো সৃজন মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ওকে অসম্ভব রকমের ঘৃণা করে। বুকের ভেতর বেদনার বাজনা বাজতে শুরু করলো ফাগুনের।

এতকিছুর মাঝে আসাদ নামক কালো অধ্যায়টা কোনমতেই বিদায় নেয় নি ফাগুনের জীবন থেকে। মাস দেড়েক বাদে হঠাৎ একদিন ফাগুনকে মেসেজ দিয়ে জানালো রাত দশটা দিকে রেডি হয়ে থাকার জন্য! ফাগুনকে নিয়ে পালাবে ও। এই দেড়মাসে ফাগুনের মনের মধ্যে কি চলেছে সেকথা আসাদ জানে না। ও শুধু জানে সুধা চলে যাওয়ার পর সৃজনের সঙ্গে ফাগুনের সম্পর্কটা আরো খারাপ হয়েছে। সেই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাইলো।

ফাগুন অবশ্য মেসেজটা দেখে নি। সকাল থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হওয়ার কারণে কারেন্ট ছিলো না। ব্যাটারি ডাউন হয়ে ফোন বন্ধ করে গেছে।

কারেন্ট ফিরলো সন্ধ্যার একটু আগে। ফাগুন ফোন চার্জে লাগিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলো। গোটাবাড়িতে ও একা। তাহেরাও নেই। বিকেল বেলা আচানক ওর বাবার অসুস্থতার খবর শুনে দেশের বাড়ি চলে গেছে। দারোয়ানও ছুটিতে।

এদিকে রাত নয়টার দিকে বৃষ্টির বেগ বাড়লো। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো বাইরে। সৃজন কারখানা থেকে ফেরে নি।
দরজা জানালা বন্ধ করে বিছানায় গুটিসুটি হয়ে বসে রইলো ফাগুন। ভয়ে শরীর কাঁপছে। ঘন ঘন বজ্রপাতের কারণে আবার বিদ্যুৎ চলে গেলো। অন্ধকারে হাতড়ে নিজের ফোনটা খুঁজে বের করলো ফাগুন। অন করে সবে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাবে এমন সময় আসাদের মেসেজটা স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। মেসেজ পড়ে অবাক হয়ে গেলো ফাগুন। ফিরতি মেসেজ দেওয়ার সময় পেলো না।

তখনই দরজায় খটখট আওয়াজ হলো। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো ফাগুনের। সৃজন দশটার আগে ফিরবে না। তাহলে এই ঝড় বৃষ্টির রাতে কে এসেছে? আসাদ নয়তো? একা বাড়িতে ওকে পেয়ে যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে? হঠাৎ করেই মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেলো। নানারকম চিন্তাভাবনা উঁকি দিলো। আড়ষ্ট গলায় জবাব দিলো,

‘ক্কে…কে?

ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় আওয়াজ এলো,

‘আমি।’

ফাগুন একছুটে দরজা খুলে দিলো। কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সৃজন। ওকে দেখে প্রাণ ফিরে পেলো ফাগুন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘আরেকটু হলে আমি ভয়ে মরেই যেতাম।’

সৃজন টলমলে পায়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। যেন ফাগুনের কথা শুনতে পায় নি। মুখটা সেই আগের মতনই গম্ভীর। আসার পথে সারারাস্তা ভিজে এসেছে। গায়ে জ্বর চলে এসেছে।
ওর গায়ের পানিতে বিছানা বালিশ ভিজে গেলো। ভেজা শরীর নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়েছে সৃজন।
ফাগুন কিছুক্ষণ ইতস্তত করে ধীর পায়ে কাছে এগিয়ে গেলো। ফ্ল্যাশ লাইয়ের আলোয় সৃজনের ভেজা মুখটা চোখে পড়তেই শিউরে উঠলো। চোখজোড়া টকটকে লাল হয়ে আছে।

ফাগুন কপালে হাত দিয়ে উষ্ণতা পরীক্ষা করে দেখলো। ভেজা শরীরেও আগুনের মতন উত্তাপ ছড়াচ্ছে। আলনা থেকে তোয়ালে নিয়ে মাথা মুছে দিলো। ভেজা পাঞ্জাবিটা বদলে নতুন একটা জামা পরিয়ে দিলো। জ্বরের ঘোরে ইতোমধ্যে সংজ্ঞা হারিয়েছে সৃজন।

অনেকক্ষণ যাবত সৃজনের মাথায় জলপট্টি দিলো ফাগুন। জলপট্টি দিতে দিতে নানারকম চিন্তাভাবনা উদয় হলো মাথার ভেতর।
অন্ধকার রাতে একা আসাদকে ভেবে এত ভয় কেন হলো ওর? এই আসাদকেই তো একসময় নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষ বলে ভাবতো ফাগুন! কিন্তু তবুও কেন ভয় হলো? কেন সৃজনকে দেখে এতটা স্বস্তি হলো?

মন বললো সৃজন নামের মানুষটা ওর স্বামী! ওর কাছে যাওয়ার অধিকার একমাত্র সৃজনেরই আছে!
ফের নিজেকে প্রশ্ন করলো ফাগুন, কিন্তু ভালোবাসা? ভালোবাসার তবে কি হবে?

এবারে যেন ভেতরে থেকে সত্যিটা মুচকি হেসে বেরিয়ে এলো। ভেতরের সত্তাটা মৃদু হেসে বললো, বোকা মেয়ে! ভালোবাসা না থাকলে কি কাউকে অধিকার দেওয়ার কথা ভাবা যায়!

ঘুমন্ত সৃজনের মুখের দিকে তাকাতেই হঠাৎ অন্যরকম এক মায়া অনুভব করলো ফাগুন। এই মায়া কি কখনো আসাদের জন্য হয়েছে? হয় নি! কোনদিন হবেও না।

এসব ভাবতে ভাবতে কখনো ঘুমিয়ে পড়লো ফাগুনের মনে নেই। হঠাৎ দরজার খটখট আওয়াজ শুনে সচেতন হলো। ফাগুন উঠে গিয়ে সন্তর্পণে দরজা খুললো যাতে সৃজনের ঘুম না ভাঙ্গে।

দরজার বাইরে আপাদমস্তক ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আসাদ। দরজা খুলতেই ওর হাত চেপে ধরে বললো,

‘ফোন ধরছিলে না কেন? ব্যাগ গোছানো শেষ?’

ফাগুন জবাব দিলো না। আসাদ ঘরের ভেতরে একবার উঁকি দিলো। বিছানায় ঘুমন্ত সৃজনকে দেখে বললো,

‘ঘুমাচ্ছে নাকি? ভালোই হলো। এই সুযোগ আর পাবো না। চলো এক্ষুণি পালাতে হবে।’

ফাগুন হাত ছাড়িয়ে নিলো। আসাদকে অবাক করে দ্বিধাহীন, অবিচল কন্ঠে বললো,

‘আমি যাবো না আসাদ। ওর অনেক জ্বর!’

বিষয়টা বোধগম্য হলো না আসাদের। সন্দিগ্ধ চেহারা নিয়ে ফাগুনের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। ফাগুন পুনরায় একই কথা বললো,

‘ওকে ছেড়ে আমি কোত্থাও যাবো না।’

‘এই জ্বর এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার সময় নেই। বোঝার চেষ্টা করো আমাদের হাতে সময় খুব কম।’

‘আমি যাবো না।’

আসাদ বিস্মিত হতবিহ্বল কণ্ঠে বললো,

‘যাবে না মানে?’

‘আমাকে তুমি ভুলে যাও আসাদ। মানুষ চাইলে সব পারে। তুমিও পারবে।’

‘কি বলছো কি তুমি? আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। এখান থেকে গিয়ে সোজা ঢাকার বাস ধরবো।

‘বললাম তো আমি যাবো না।’

‘একটা মাঝবয়সী, আধবুড়ো লোকের জন্য তুমি আমার সঙ্গে প্রতারণা করছো?’

‘আমি তোমার সঙ্গে কোনো প্রতারণা করছি না। আমি শুধু তোমাকে সত্যিটা জানাতে চাইছি।’

ফাগুন না থেমেই পূর্বের ন্যায় দ্বিধাহীন অবিচল কন্ঠে বললো,

‘বিয়ের আগে তোমার সঙ্গে আমার দুইমাসের প্রেম ছিলো কিন্তু ওর জন্য আমার জনম জনমের ভালোবাসা তৈরী হয়ে গেছে! আমি ওকে ভালোবাসি আসাদ।’

জনম জনমের ভালোবাসা! আহা! কি শক্তিশালী স্বীকৃতি! ঘুমন্ত সৃজন যদি একবার দেখতো! এতদিনের লুকায়িত মায়া, অধিকারবোধ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সব একসঙ্গে ঢেলে দিয়েছে ফাগুন। নিজের কাছে নিজে আজকে পরিষ্কার, স্বচ্ছ ও। এতদিন পর বুঝতে পেরেছে সৃজনকে ও ভালোবেসে ফেলেছে।

প্রেমের সঙ্গে আবেগের খানিকটা সম্পর্ক থাকলেও বিয়ের সঙ্গে কেবল ভালোবাসার সম্পর্ক। ফাগুন পূর্ববৎ স্থির, অবিচল, তেজস্বী কন্ঠে বললো,

‘ওকে আমি নিজের সত্য বলে গ্রহণ করে নিয়েছি। এই সত্যের বিচ্যুতি আমি কিছুতেই ঘটতে দেবো না।

আসাদ বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে গেলো। আজকের এই ফাগুনকে সম্পূর্ণ অপরিচিত,অচেনা লাগছে। আবেগে গা ভাসিয়ে দেওয়া, ফাগুনের সঙ্গে এই ফাগুনের কোনো মিল নেই।

ফাগুন ঘুমন্ত সৃজনের মুখের দিকে একঝলক চাইলো। একরাশ অভিমানে ছেয়ে আছে মুখ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘আমার ওপর ওর অনেক অভিমান। অনেক অভিযোগ। ওর জীবনের সমস্ত অসম্মান, অপবাদের জন্য আমি দায়ী। ওকে আমি আর কোনো অসম্মানের বোঝা বইতে দেবো না। তুমি আমাকে ভুলে যাও।’

এইমুহূর্তে কোনো বাড়াবাড়ি করে কোনো লাভ হবে না। জোর করলে ফাগুন চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারে। প্রচণ্ড রাগ আর ক্ষোভ নিয়ে বেরিয়ে গেলো আসাদ। যাওয়ার সময় অগ্নিস্ফুলিঙ্গের জ্বলজ্বল করতে থাকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গেলো ফাগুনের প্রতি।
ফাগুন ক্লান্ত নিশ্বাস ছেড়ে বিছানায় শুয়ে থাকা ঘুমন্ত সৃজনের দিকে এগিয়ে গেলো। চোখভর্তি টলমল করা পানি নিয়ে বললো,

‘সত্যি করে বলুন তো আমার প্রতি কি আসলেই আপনার কোনো অনুভূতি নেই?’

সেই প্রথম কাছে আসার দিনটার কথা মনে পড়ে গেলো ফাগুনের! নিজের ভীষণ কাছে টেনে নিয়েছিলো সৃজন ওকে! আক্ষেপে যন্ত্রণায় ফের ব্যাকুলভাবে কেঁদে ফেললো ফাগুন! ভালোবাসা ছাড়া কি করে কেউ কাউকে এমন করে কাছে টেনে নিতে পারে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here