বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব ৩৪

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৩৪.

অনিমা সম্পূর্ণ একটা ঘোরে আছে। এখনও অবাক দৃষ্টিতে দেখছে আদ্রিয়ানকে। আর আগের কথা ভাবছে। ওকে টেনে কাজি অফিসে আনার পর ও দেখল সবকিছুই রেডি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এরপরে সবকিছুই যেনো অনিমার মাথার ওপর দিকে গেল। ওকে যখন ‘কবুল’ বলতে বলা হল তখন শুধু বোকার মত কাজীর দিকে তাকিয়ে ছিল। কয়েকবার বলার পরেও কিছু বলছিল না, কিন্তু আদ্রিয়ান ধমক মারার সাথেসাথেই এমনিতেই মুখ দিয়ে ‘কবুল’ শব্দটা বেড়িয়ে গেছে। এরপর সাইন টাইন যা হয়েছে সবটাই অনিমা অবাক হয়েই করেছে। কী থেকে কী হয়ে গেল নিজেই বুঝে উঠতে পারল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওর বোধগম্য হল ও এখন বিবাহিতা। হ্যাঁ ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ও এখন আদ্রিয়ান আবরার জুহায়েরের বউ। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে অরুমিতা, তীব্র, স্নেহা ওপর পাশে অভ্র, জাবিন, আদিব, আশিস, নাহিদ দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চোখে মুখেও একপ্রকার বিষ্ময় ।আদ্রিয়ান অনিমার দিকে একপলক তাকিয়ে ওর হাত ধরে আবার দাঁড় করালো। তারপর হাত ধরেই বাইরে নিয়ে গেল। বাকিরাও এলো পেছন পেছন। বাইরে এসে অনিমা আরেকদফা অবাক হল। অনেক সাংবাদিকরা অপেক্ষা করছে ওখানে। ওরা ওখানে যেতেই সবাই হুরমুরিয়ে ওদের ঘিরে ধরল। আবার নানারকম প্রশ্ন করে যাচ্ছে। কিন্তু আদ্রিয়ান কোন কথা বলছেনা চুপ করে আছে। একজন বলল,

” মিস্টার জুহায়ের প্লিজ কিছুতো বলুন।”

আদ্রিয়ান এবার সবার উদ্দেশ্যে বলল,

” আপনারা আগে থামবেন তারপর তো আমি বলব তাইনা? সো আমি বলি?”

সবাই এবার চুপ করল এবার। আদ্রিয়ানের কথা শোনার জন্যে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওরা। আদ্রিয়ান একপলক অনিমার দিকে তাকিয়ে পরে আবার সবার দিকে তাকিয়ে বলল,

” আপনাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল আমার কোন আত্মীয় না হয়েও কেন ও আমার বাড়িতে থাকে? আচ্ছা, ও আমার কেউ হয়না সেটা আমি আপনাদের বলেছি?”

সবাই চুপ করে আছে। আসলে প্রশ্নটার উত্তরই নেই ওদের কাছে। আদ্রিয়ান হালকা হেসে বলল,

” যা শোনেন সেটা নিয়ে লাফাতে লাফাতে চলে আসেন? আমার বাড়িতে আমার এসিসটেন্ট অভ্র থাকে, আমার ফ্রেন্ড নাহিদও কিছুদিন হল থাকে। ওরাও আমার অাত্মীয় নয়। তাহলে প্রশ্নটা শুধু এই মেয়েটাকে নিয়েই কেন? মেয়ে বলে? এই লেইম থিংকিং কবে বদলাবেন? এবার উত্তরটা দেই। ও আমার ফিয়ন্সে ছিল। তাই আমার বাড়িতে ছিল। ওর কোন আত্মীয় এই শহরে নেই তাই ও আমার কাছে থাকত! হোয়াটস রং উইথ দ্যাট!”

সবার মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হল। সাথে ক্যামেরায় ফটো তোলার আওয়াজ তো আছেই। আদ্রিয়ান আবার বলল,

” তাছাড়া কাদের কী বলছি? কোন কিছু না জেনে হুটহাট চলে এসে কাউকে হ্যারাস করাইতো আপনাদের প্রধান ডিউটি। কদিন আগে স্মৃতির সাথে আমার নাম জড়িয়ে কীসব লিখে রেখেছিলেন। আরেকটু হলেতো আমার না হওয়া সংসারটা ভেঙ্গে যাচ্ছিল।”

সাংবাদিকরা একে ওপরে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। অরুমিতা, নাহিদ ওর সবাই মুখ টিপে হাসছে। অনিমা শুধু আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর সবটাই মাথার অনেকটা ওপর দিয়ে যাচ্ছে। আদ্রিয়ান সবাইকে থামিয়ে আবার বলল,

” পরের প্রশ্ন ছিল যে, ওর সাথে আমার সম্পর্ক কী? কাল অবধি ও আমার হবু বউ ছিল। কিন্তু আজ এইমুহূর্ত থেকে ও আমার বউ। একটু আগেই আমাদের বিয়ে হয়েছে। ভেবেছিলাম ধুমধাম করে বিয়ে করব এরপর আপনাদেরও ইনভাইট করব। নিজেদের দোষে একটা দাওয়াত থেকে বঞ্চিত হলেন। যাই হোক, কাবিননামা আর সাক্ষী সব এখানেই আছে। অভ্র ওনাদের কপি দিয়ে দাও!”

অভ্র দ্রুত কপি এগিয়ে দিল ওনাদের দিকে। সবটা দেখে শুনে ওনারা সবাই নিশ্চিত হয়ে গেল যে আদ্রিয়ান আর অনিমা বিবাহিত। এখন আবার কী নতুন নিউস হবে সেটা নিয়েই ভাবনায় আছেন ওনারা। সবার মধ্যে চাঁপা গুঞ্জনতো আছেই! আদ্রিয়ান বলল,

” আশা করি আর কোন প্রশ্ন নেই আপনাদের। ওর পরিচয় হল ও আমার বউ। মিসেস আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের। তাই ওর দিকে আঙুল তোলার আগে অবশ্যই ভেবে চিন্তে তুলবেন।”

কথাটা ও অনিমাকে একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখেই বলেছে। সবাইকে সব উত্তর দিয়ে ওরা ওখান থেকে চলে এলো। নাহিদ ওরা সবাই এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। প্রথমে অনিমা আদ্রিয়ানের হঠাৎ বিয়েতে শকড হলেও এখন ওরা সবাই খুব খুশি। এমনিতেও এতদিন ওরা সবাই অনিমাকে আদ্রিয়ানের বউই মনে করত। তবে অনিমা এখনও শক থেকে বেড় হতে পারছেনা। সবকিছুই একটা স্পষ্ট স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। ও জানে সবটা বাস্তব তবুও। এমন কেন হচ্ছে ও নিজেও বুঝে উঠতে পারছেনা।

____________

রিক নিজের রুমে এসে কোনরকম ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে দেখল টি-টেবিলে গ্লাসে জল রাখা আছে। আসার আগে স্নিগ্ধার কাছে জল চেয়ে এসছিল। স্নিগ্ধাই রেখে গেছে হয়ত। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি চলে গেল যে? এসব ভাবা বাদ দিয়ে ও একঢোকে জলটুকু খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। সারাদিন অনেক খাটুনি গেছে ওর। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব কাজ আজ ওর ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়েছে সবাই। দুপুর থেকে ঠিককরে বসার সুযোগ পায়নি। হঠাৎ আজ একসঙ্গে একদিনে এত জায়গার যাওয়ার প্রয়োজন কেনো হল সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা ও। তবে বাইরে আজ কিছু একটা শুনছিল আদ্রিয়াকে নিয়ে। একটা মেয়েকে নিয়ে কিছু। কাজে ব্যস্ত থাকায় তেমন পাত্তা দেয়নি। ওদের নামে এমনিতেও কত নিউজ বেড় হয়। কদিন আগে স্মৃতিকে নিয়ে কীসব হল। ভাবল রাতে কল করে জেনে নেবে। তাছাড়া কালতো যাচ্ছেই আদ্রিয়ানের বাড়িতে। আদ্রিয়ানকে কল করতে নিয়েও করতে পারলনা রিক। দুচোখে ভীষণ ঘুম এসে ভর করেছে। চোখ প্রচন্ড ভারী হয়ে আসছে। সমস্ত শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে ফোন বুকের ওপর রেখেই ঘুমে তলিয়ে গেল ও।

স্নিগ্ধা ওর রুমে গুটিয়ে বসে আছে। চোখ হালকা লাল হয়ে আছে ওর। বোঝাই যাচ্ছে যে কিছুক্ষণ আগে কেঁদেছে ও। অনিমার সাথে আদ্রিয়ানের বিয়ের নিউজটা খবরে দেখে ও চমকে গেছিল। বিশ্বাস হচ্ছিল না। সবার আগে মাথায় এই চিন্তাটাই এসছিল যে রিক জানলে কী হবে? রিক যে এই মেয়েটার জন্যে পাগল। এসব চিন্তা করতে করতেই ওর রুমে এসে কবির শেখ আর রঞ্জিত চৌধুরী দুজনেই ঢোকে। দুজনকে এভাবে একসঙ্গে দেখে অবাক হয়েছিল। নিশ্চয়ই আবার কিছু করবে। হয়েছেও তাই স্নিগ্ধা যাতে এই নিউসের কথা রিককে না জানায় সেটা বলতেই এসছেন ওরা। তারসাথে রিকের খাবার জলের সাথে ঘুমের ঔষধ মেশাতে বলেছে। স্নিগ্ধা প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু আবারও ওকে ওর বাবার ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে কাজটা করতে বাধ্য করেছে। সেসব কথা মনে পরতে আবার কান্না পাচ্ছে ওর। ও কখনও অন্যায়কে মেনে নেয়নি। কিন্তু আজ ওর বাবার কথা ভেবে অন্যায় করতেও হচ্ছে। এই লোকগুলোর কী কোনদিন শাস্তি হবেনা। কেউ কী নেই যে এদের ধ্বংস করতে পারে? রিকের সাথে এটা করেছে ভাবলেই প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে ওর। তবে অনিমার ব্যাপারটা রিক জানার পর কীরকম তান্ডব করবে সেটা অনুমান করতে পারছে ও। তারওপর ছেলেটা আর কেউ নয় আদ্রিয়ান। দুই ভাইয়ের এতো সুন্দর সম্পর্কে ফাটল ধরবে? এরকম কেন হল? তবে অনিমাযে নিরাপদে আছে সেটা ভেবেই শান্তি লাগছে ওর। অন্তত মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু হয়নি। এখন শুধু বাকি সব একটু ভালো হলেই হয়।

____________

আকাশে আজ পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার রাত। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়েছে তাই ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। অনিমা ছাদের দোলনায় বসে সামনের দিকে তাকিয়ে একমনে ভাবছে। আদ্রিয়ানের বউ ও এখন। এইমুহূর্তে আদ্রিয়ান ব্যস্ত আছে। ঐ নিউসের পর অনেক ফোন কলস্ এসছে। অনেক ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে। রাতের দিকে অবশ্য ফ্রি হয়েছে একটু। তখন নাহিদ ওরা সবাই অনেক্ষণ পিঞ্চ করে কথাও বলেছে বিয়েটা নিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ হাসি মজাও হয়েছে। বিশেষ করে নাহিদ বেশ খুঁচিয়েছে আদ্রিয়ানকে। ওরা চেয়েছিল বাসরঘর সাজাতে। কিন্তু কেন জানি আদ্রিয়ান বারণ করে দিল। এটাও বলল যে আপাতত বিয়েটা নিয়ে কিছু না করতে। যা হবার পরে হবে। যদিও এতে অনিমার কোন ভাবান্তর হয়নি বরং স্বস্তিই পেয়েছে। হঠাৎ করেই আদ্রিয়ানের সাথে নরমাল হতে পারতনা ও। তাই ব্যাপারটা ভালোই হয়েছে। তবে মনে অন্যচিন্তাও ঘুরছে ওর। হঠাৎ দোলনায় ভর অনুভব করে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এল অনিমা। পাশে তাকিয়ে দেখে আদ্রিয়ান বসে আছে। ওর দৃষ্টিটাও আকাশের দিকে। হালকা বাতাসে আদ্রিয়ানের কপালের চুলগুলো দুলছে। ভীষণ সুন্দর লাগছে ওকে। কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ান অনিমার হাতে হাত রাখতেই অনিমা ‘আহ’ করে উঠল। আদ্রিয়ান চমকে গেল। অবাক হয়ে অনিমার হাত ধরে দেখল লাল হয়ে গেছে। ও বুঝতে পারল তখন রাগ করে চেপে ধরাতেই এমন হয়েছে। আদ্রিয়ান ওখানে যত্ন করে হাত বুলিয়ে বলল,

” সরি জানপাখি, তখন রেগে গেছিলাম খুব। তাই বুঝতে পারিনি। অনেকটা লেগেছে না? লাল হয়ে আছে তো!”

কথাটা বলে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালো ওর হাতে।অনিমা কিছুক্ষণ আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল,

” আচ্ছা আপনি কী অামাকে মন থেকে মেনে বিয়ে করেছেন? না-কি শুধুই সবার মুখ বন্ধ করে আমার সম্মান বাঁচাতে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছেন?”

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here