বসন্তের একদিন পর্ব -০২

#বসন্তের_একদিন
#পর্বঃ০২
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তৃধা।তার সামনেই তেজবীন দাঁড়িয়ে আছে।ফাতেমা বেগম সোফায় বসে মনের সুখে পান চিবোচ্ছেন।

” তুমি আমাকে মারলে কেন তেজবীন?”

” তুই আমার মাকে না খাইয়ে রাখার প্ল্যান করেছিস তাই না?”

” এসব তুমি কি বলছো?আমি এরকম কিছুই করেনি।”

” তুই কি রান্না করেছিস আজ?মা আজকে রাতের খাবার খেতে পারেনি কেন?নাকি তুই খেতে দিসনি?”

” আমি এরকম কিছুই করিনি তেজবীন।আমি তো ঠিকভাবেই রান্না করেছি।উনি শুটকি ভর্তা খাবেন বলেছেন আমি ওটাও তো করে দিয়েছি।এখন আমার খাবার ওনার পছন্দ না হলে আমি…..”

তৃধার কথা শেষ হওয়ার আগেই তেজবীন তাকে আবারো থাপ্পড় মেরে বসে।

” পছন্দ না হওয়ার মতো রান্না করেছিস কেন?আমার মায়ের যেরকম পছন্দ সেরকম রান্না করবি।”

” আমাকে কি তোমরা চাকর পেয়েছো?মা বলে একরকম রান্না কর,ছেলে বলে একরকম রান্না কর।আমি কি তোমাদের বাড়ির কাজের লোক নাকি যে তোমরা এভাবে আমাকে গাধার খাটুনি খাটাচ্ছো।” আর সহ্য করতে না পেরে তেজবীনের মুখের উপর বলে দেয় তৃধা।

” দেখেছিস বাবু(তেজবীন)মেয়ের তেজ।কেমন করে চিৎকার করে কথা বলছে।এই মেয়ে আমাকে না খাইয়ে মারতে চাইছে।আর দেখেছিস আজ একটু শুটকি ভর্তা চেয়েছি বলে কিরকম খোঁটা দিচ্ছে।”

” এই তোর এতো সমস্যা কেন হয়?আমার মা আমার টাকায় খাচ্ছে,তোর এতে এতো সমস্যা কেন?চাকরি করিস বলে তোর এতো দেমাক তাই না?চাইলেই কিন্তু আমি এখন তোর পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখতে পারি।তারপর চাকরি করার শখ একদম বেরিয়ে যাবে।” তৃধার চুল ধরে বলে তেজবীন।তৃধা তেজবীনের হাতটা নিজের চুল থেকে ছাড়িয়ে নেয়।

” আমার কোন সমস্যা নেই আর না আমি চাকরির দেমাগ দেখাচ্ছি।প্রয়োজন না হলে না আমি চাকরিটা করতাম না।আর তোমরা কি ভেবেছো আমি বুঝিনা আমার চাকরি করা নিয়ে তোমাদের যত সমস্যা।কিন্তু হাজার চেষ্টা করলোও আমি চাকরি ছাড়বোনা।”

তৃধা রেগে নিজের রুমে চলে আসে।মাটিতে একটা কাঁথা বিছিয়ে তৃধা শুয়ে পড়ে তৃধা।এটাই প্রথম নয়,এরআগেও তাদের মধ্যে কোন অশান্তি হলে তৃধা নিচেই শুয়।মাঝরাতে তেজবীন তৃধার কাছে আসতে চাইলে তৃধা তাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়।এতে তেজবীনেও রেগে দূরে সরে যায়।

পরেরদিন সকালে,

আজ শুক্রবার বিদায় তৃধার অফিস বন্ধ।তেজবীন এখনো ঘুমাচ্ছে আর ফাতেমা বেগম বাইরে হাঁটতে গিয়েছেন।ওনার আবার সকালে হাঁটতে বের না হলে বাতের ব্যথা বেড়ে যায়।শুক্রবার হওয়ায় আজকে তৃধার কাজের চাপ আরো বেশি।ফাতেমা বেগম যাওয়ার আগে বলে গিয়েছেন মুরগীর মাংস রান্না করার জন্য।সেই অনুযায়ী তৃধা চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে মাংস কাটতে থাকে।

” তৃধা,তৃধা।”

তেজবীনের চিৎকার শুনে তৃধা তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে রুমে আসে।

” কি হয়েছে?”

” দেখছো না আমি ঘুমাচ্ছি।জানালার পর্দাটা টেনে দাও।একটুও আক্কেল জ্ঞান নেই।”

তৃধা পর্দাটা টেনে দিয়ে আবারো রান্না ঘরে চলে যায়।এরই মধ্যে ফাতেমা বেগম হেঁটে চলে এসেছে।তিনি এসেই সোফা বলে তৃধাকে গলা ছেড়ে ডাকতে থাকেন।

” জ্বি মা বলুন।”

” আমার জন্য এককাপ চা নিয়ে এসো তো।হেঁটে এসে চা খেতে ইচ্ছা করছে।”

” আচ্ছা মা আপনি গোসল করে নিন ততক্ষণে আমি চা নিয়ে আসছি।”

ফাতেমা বেগম সোফা থেকে উঠে নিজের রুমে চলে যান।ভাতের পাত্রটা নামিয়ে রেখে তৃধা চুলোতে চায়ের পানি তুলে দেয়।

আধাঘন্টা পর,

” বউমা,বউমা।” নিজের রুমে বসে তৃধাকে ডাকতে থাকেন ফাতেমা বেগম।

” হ্যাঁ মা বলুন।”

” এটা কি দিয়েছো তুমি?তোমার কাছে চা চেয়েছিলাম,ঠান্ডা শরবত নয়।”

” মা আমি তো গরম চা’ই দিয়েছিলাম।হয়তো আপনি গোসল করে বের হতে হতে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।”

” কি হয়েছে কি?এতো চিৎকার করছো কেন?শুক্রবারের দিনটাও কি আমাকে ঘুমাতে দেবে না নাকি?” তেজবীন ঢলতে ঢলতে তেজবীন বলে।

” দেখ না বাবু,ওকে বলেছি একটু চা দিতে কিন্তু দেখ ও আমাকে ঠান্ডা একদম পানির মতো চা করে দিয়েছে।”

” তৃধা তোমার সমস্যাটাকি বলো তো?তোমার কি ঝামেলা না করলে কি হয়না?”

” আমি তো ওনাকে চা করেই দিয়েছি,তাও গরম।কিন্তু এখন সেটা ঠান্ডা হয়ে গেলে এতে আমার কি দোষ।”

” দেখেছিস বাবু,ও বলতে চাইছে আমার কারণে নাকি চা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।”

” তৃধা তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?যাও মায়ের জন্য আবারো চা করে নিয়ে এসো।” রেগে চিৎকার করে বলে তেজবীন।তৃধা একবার তেজবীন আর ফাতেমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যায়।আবারো চা গরম করে এনে ফাতেমা বেগমকে দেয় তৃধা।

” হুম এখন ঠিক আছে।প্রথমেই যদি বলতে ‘আমার ভুল হয়ে গিয়েছে,আমাকে দিন আমি আবারো গরম করে নিয়ে আসছি ‘ তাহলে তেজবীন থেকে এতো কথা শুনতে হতোনা।এখন আর আমার সামনে শঙের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে রান্নাঘরে যাও তো।” তৃধা একটা নিঃশ্বাস ফেলে রান্না করতে চলে যায়।সে জানে ফাতেমা বেগম এসব ইচ্ছে করেই করেন।খাবার ভালো হলেও উনি এটাওটা খুঁত বের করেন আর তেজবীনকে উল্টোপাল্টা নালিশ করেন তৃধা বিরুদ্ধে।যা শুনে তেজবীনও তৃধার সাথে খারাপ ব্যবহার করে।তবে এমনটাও না যে ফাতেমা বেগমের কথা শুনেই শুধু তেজবীন তৃধার সাথে খারাপ ব্যবহার করে।মাঝেমধ্যে অকারণেও তেজবীন তৃধার সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকে।তবে সবসময় তৃধা প্রতিবাদ করে না আবার চুপও থাকে।যেখানে প্রয়োজন সেখানেই সে প্রতিবাদ করে নয়তো চুপ থাকে।

দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ আগে শুয়েছে তৃধা।চোখে ঘুম এসেছে সেই মূহুর্তেই বেল বেজে উঠে।বিরক্ততে তৃধার চোখ মুখ কুচকে যায়।বিছানা ছেড়ে তৃধা দরজা খুলতে চলে যায়।

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে তৃধার বড় ননদ নন্দিনী আর ছোট ননদ তিথি।বড় ননদের বিয়ে হয়েছে ২ বছর হচ্ছে আর ছোট ননদটা এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে।তৃধার ছোট ননদ কিছুদিনের জন্য নিজের বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল।ননদের দেখা তৃধার মনে মনে বিরক্ত লাগলেও সে হাসি মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

” এভাবে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি আমাদের ঢুকতে দেবে।” মুখ বাঁকা করে বলে তৃধার বড় ননদ নন্দিনী।তৃধা চুপচাপ দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়াই।তৃধা সরে দাঁড়াতেই তারা দুজন ভেতরে ঢুকে পড়ে।তৃধা মনে মনে চিন্তা করছে “এতদিন ছিল না তাতে কিছুটা হলেও শান্তি ছিল।এখন এ দুটোও আমার উপর হুকুম করবে।”
তৃধা নিচে তাকিয়ে দেখে চারপাঁচটা ব্যাগ।তৃধার বোঝা হয়ে গিয়েছে তার বড় ননদ এখন আর সহজে এই বাড়ি ছেড়ে যাবেনা।এরই মধ্যে তৃধার বড় ননদ নন্দিনী ভেতর থেকে চেঁচিয়ে তৃধাকে বলে,

” ওখানেই মরে গেলে নাকি?এতো সময় কেন লাগছে আসতে?তাড়াতাড়ি ব্যাগগুলো নিয়ে ভেতরে এসো।”

তৃধা অনেক কষ্ট করে ব্যাগগুলো নিয়ে তার ননদের রুমে রেখে আসে।ব্যাগ রেখে এসে তৃধা দেখে ফাতেমা বেগম আর নন্দিনী সোফায় বসে গল্প করা শুরু করে দিয়েছে।এটা দেখে তৃধার খুবই খারাপ লাগে।আজ পর্যন্ত তার শাশুড়ী তার সাথে দুদণ্ড বসে ভালোভাবে কথা বলেনি।এমনকি তার বাপের বাড়িতেও যদি ফোন করে তাহলেও ২/১ মিনিটের বেশি তৃধা কথা বলতে পারেনা।আসলে ফাতেমা বেগমই তাকে কথা বলার সুযোগ দেয়না।তৃধা যথাসম্ভব চেষ্টা করে মানিয়ে চলার,সবার মন জয় করার কিন্তু কোন এক অজানা কারণে তৃধা সেটা পেরে উঠছেনা।আরো একবার ফাতেমা বেগম আর নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে রান্নাঘরে চলে যায় তৃধা।এখন আর তার ঘুমালে চলবেনা।এখন থেকেই রাতের খাবার রান্না করা শুরু করে দিতে হবে নয়তো এরা সবাই মিলে তৃধার সাথে খারাপ ব্যবহার করার আরেকটা সুযোগ পেয়ে যাবে।

” বউমা,ও বউমা।কোথাই গিয়ে লুকিয়ে আছো শুনি?আমার মেয়েটা এতোদিন পর এলো,ওকে কিছু খেতে না দিয়ে কোথায় বসে আছো?”

” এইতো মা আমি আপুর জন্যই খাবার আনতে গিয়েছিলাম।” ট্রে করে নাস্তা আনতে আনতে বলে তৃধা।

” এখানো রাখো।খা মা খা কত শুকিয়ে গিয়েছিস তুই।”

তৃধা ট্রেটা টেবিলে রেখে নন্দিনীকে প্রশ্ন করে,”আপু আছেন আপু?”

” ভালো না থাকলে কি আর এখানে আসতাম নাকি।ভালো আছি বলেই তো এসেছি।আর শোন এতদিন অনেক কাজের ফাঁকি দিয়েছো কিন্তু এখন আমি যতদিন আছি তোমাকে কোন কাজে ফাঁকি দিতে দেবোনা।এখন এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে রাতের রান্নার প্রস্তুতি নাও।”

নন্দিনীর কথা শুনে তৃধার অনেক খারাপ লাগে।আর যাইহোক সে কখনো ঘরের কাজে ফাঁকি দেয়না।আর দেবেই বা কেন,এটাতো তারই সংসার।সে যদি কাজগুলো না করে তাহলে কে করবে।তৃধা আর সেখানে না দাঁড়িয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।

চলবে……..
____________________________________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here