বসন্ত এসে গেছে পর্ব ১২

#গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
#লেখাঃনুশরাত জেরিন
#পর্বঃ১২

,

,

দেখতে দেখতে কেটে যায় বেশ কয়েকটা দিন।
অপুর সকালগুলো এখন একই বোরিং নিয়মে শুরু হয় আবার শেষও হয়।
কেমন বিষন্ন নিস্তব্ধ লাগে চারিদিক।
সারাদিন মিসেস রিচির ফরমায়েশ খাটতে খাটতে অপু হাঁপিয়ে ওঠে।
তবু কাজ করে যায়।
অন্য কোন মেয়ে হলে হয়তো এভাবে নাম মাত্র সংসারে টিকে থাকতো না।কিন্তু অপু আছে।
থাকতে বাধ্য সে।
এখানে না থাকলে কোথায় যাবে?ভাই ভাবির কাছে?
তারা তাদের বাড়িতে ঠায় দেবেতো?তারচেয়ে বরং নোমানের ফিরে আসার অপেক্ষা করা যাক।
আচ্ছা উনি অদৌ ফিরবেন তো?
নিজের মনে এই প্রশ্নের উত্তর খোজে অপু।
মনে মনে খুব করে চায় উত্তরটা যেনো হ্যাঁ হয়।

আজকের দিনটাও অন্য দিনের থেকে কোন অংশেই আলাদা মনে হয়না অপুর।
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সুর্যোদয় দেখে সে আপনমনে।
বাড়ির বাইরে বড় ফুলের বাগান আছে, সেখান থেকে নানাধরনের ফুলের মিশ্র মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে।
অপু নাক সিটকায়।
তার ইদানীং কোন কিছুই ভালো লাগেনা।
বাগানের গাছে বসা ওই পাখি,পাখির মিষ্টি স্বরধ্বনি।কিছুই ভালো লাগে না তার।
সবকিছু কেমন অসহ্য লাগে।
এতোসবকিছু ভাবার মাঝে আরমানের খানের গলা ভেসে আসে।
তিনি দরজার বাইরে দাড়িয়ে অপুকে ডাকে,

অপু উত্তর নেয়।ভেতরে আসতে বলে।
আরমান খান ধীরপায়ে এগিয়ে আসেন।
তার শরীর দিনকে দিন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।
এইযে এতটুকু হাটাতেও তার শ্বাস জোরে জোরে উঠানামা করছে।
হাত পা অনবরত কাঁপছে।
আগেকার এতো এতো অনুতাপের মাঝে নতুন করে যুক্ত হয়েছে অপুর ব্যাপারটা।
কোন বিশেষ কারন ছাড়া অপুর সামনে আসেন না আরমান খান।
আসেন না বললে ভুল হবে,সামনে দাঁড়ানোর মুখ পাননা।
কোন মুখে দাড়াবেন অপুর সামনে তিনি?মেয়েটার জিবন যে নিজের হাতে নষ্ট করে ফেললেন আরমান খান।

এরই মাঝে অপু বলে ওঠে,

—আপনি এতো সকাল সকাল উঠলেন যে আজ?কোন দরকার?
আমায় বলতেন,আমি যেতাম আপনার ঘরে,আপনি কেনো কষ্ট করে আসতে গেলেন।

আরমান খান বলেন,

—এদিকে আয় তো মা,আমার পাশে বোস।

অপু খাটের পাশটায় বসে পরে।
আরমানের খানের মুখের দিকে তাকায়।লোকটার দিকে তাকালে তার মায়া হয়।
বৃদ্ধ বয়সে সন্তানকে কাছে পাবার কোন আশা তিনি করতে পারেননা।সন্তানকে ইচ্ছে হলেই বুকে জড়িয়ে নিতে পারেননা।
তার উপর কোন অধিকার খাটাতে পারেননা।
যৌবন বয়সে করা একটা ভুলের জন্য তিনি দিনরাত অনুতাপের আগুনে জ্বলেন। নিজের ভেতরটা তার নিয়মিত দগ্ধ হয়।
বাইরের শাস্তির চেয়ে এই অনুতাপের শাস্তি কি বেশি বড় নয়?

আরমান খান অপুর মাথায় হাত বুলান।
তার শ্বাস প্রশ্বাস কেমন টেনে টেনে চলে।
মনে হয় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

—আমি জিবনে বহু অন্যায় করেছিরে মা।তবে সবচেয়ে শেষ অন্যায়টা হয়তো করলাম তোর সাথে।

—আপনি এভাবে কেনো বলছেন বাবা?

আরমান খান অপুর কথার প্রতুত্তর দেননা।
নিজের মতোই বলেন,

—আমাকে মাফ করে দিস মা।আমি ভেবেছিলাম বিয়ের পর নোমানটা ঠিক হবে,হয়তো তোকে মেনে নেবে।সুখের সংসার হবে তার।
বাবা হিসেবে এই চাওয়াটা কি আমার অন্যায় বল?
আমি তোর সাথে এমনটা হোক তা কোনদিন চায়নি মা।
আমাকে ক্ষমা করে দিস তুই।

বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন আরমান খান।

অপু আরমান খানের হাত ধরে এক হাত দিয়ে।
আরেক হাত দিয়ে তার চোখের বিন্দু বিন্দু পানি মুছে দেয়।বলে,

—বাবারা সন্তানের জন্য কখনো খারাপ চায়?আপনি কেনো ক্ষমা চাইছেন বলুনতো?আমার ভাগ্যে এমনটা লেখা ছিলো তাই হয়েছে।

আরমান খান অপুকে বুকে জড়িয়ে নেন।
মাথায় হাত বুলান।একটু পরে ছেড়ে দিয়ে বলেন,

—তোকে একটা কথা বলবো মা?

—হ্যা,বলুন।

—তুই আবার পড়াশোনা শুরু কর।তোর ভার্সিটি থেকে কাগজপত্র তুলে নিয়ে আয়।এখানে একটা ভালো ভার্সিটিতে তোকে ভর্তি করাবো আমি।

অপু না বলতে যায় তার আগেই আরমান খান বাধা দেন।

—না বলবি না।তোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
নোমানকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
তোর যোগ্যতা দেখে যেন নোমান ফিরে আসতে বাধ্য হয়।
পারবিনা মা?

অপু মুচকি হাসে।
মুখে বলে পারবো।কিন্তু মনে মনে বলে,

—যোগ্যতা দেখিয়ে কি কাউকে ধরে রাখা যায় বাবা?ধরে রাখতে হয় ভালবাসা দিয়ে।

———————

তার পরেরদিনই অপু তার আগের ভার্সিটি থেকে কাগজপত্র তুলে আনে।
আরমান খান নতুন ভালো একটা ভার্সিটিতে অপুকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসে।
অপুর এখানে বেশ কয়েকজনের সাথে পরিচয় হয় তবে সবচেয়ে ভাল বন্ধুত্ব হয় দুজনের সাথে।
পিহু আর রাহুল।
বড়লোক বাবা মায়ের আদুরে ছেলেমেয়ে তারা।
অপু তো ভেবেছিলো এতো হাই লেভেলের ভার্সিটিতে তার মতো মেয়ের কোন বন্ধুই হবেনা।
কিন্তু হয়।
রাহুল আর পিহু অন্য সবার চেয়ে আলাদা।অহংকারের ছিটেফোঁটাও নেই তাদের মাঝে।
অপুর বেশ ভাল লাগে তাদের।
তাদের সাথে হাসিমজায় দিন কাটে অপুর।
নিজের একাকিত্ব কে আড়ালে রেখে পড়াশোনায় ডুবে থাকে সারাবেলা।
তবে মাঝেমাঝে ভেতরের কষ্টটা গুমড়ে ওঠে।
চোখ ঝাপিয়ে বের হয়।

———–

নোমানের দিন কাটে কর্মব্যস্ততায়।
এরমাঝে কয়েকবার ব্যবসার কাজে বিদেশ থেকে ঘুরে আসে নোমান।
এতো এতো ব্যস্ততার মাঝে রাতে যখন ঘুমোতে আসে, অথবা সকালে নিরিবিলি পরিবেশে যখন কফিতে চুমুক দেয় তখন একটা মায়াবী মুখশ্রী চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
মনের ভেতরকার সমস্ত রাগ জেদ ছুড়ে ফেলে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে তার কাছে।
মাঝে মাঝে নিজের মনেই প্রশ্ন করে।আচ্ছা কেমন আছে সেই মায়াবতী?
সে কি সত্যিই মিসেস রিচির মতো লোভী?টাকার জন্য বিয়ে করেছে তাকে?
পরক্ষনে নিজের দাম্ভীক সত্ত্বা কানের কাছে চিৎকার করে বলে,

—হ্যা হ্যা ওই মেয়েটাও রিচির মতো লোভী।নয়তো তার বাবাকে পটিয়ে নিজের ভাইকে এতো এতো টাকা দিতোনা।
বড়লোক বাবাকে দেখে হুটহাট করে বিয়ের জন্য রাজী হতোনা।
নোমানের এতো অপমানজনক কথা শুনেও ওই বাড়িতে টাকার লোভে পরে থাকতোনা।

বিশ্বাস করতে ইচ্ছে না হলেও জোর করে বিশ্বাস করে নোমান।
সব ভাবনা ফেলে কাজে মন দেয় সে।

,

,—————————

,

আজকের দিনটা অপুর একটুও ভাল লাগেনা।
সারারাত ভর বৃষ্টি হয়েছে।চারপাশে এখন কাঁদা জমে আছে।
রাস্তা ঘাট সব ভিজে চুপচুপ।কালো মেঘ এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। মনে হচ্ছে যেকোনসময় আবার বৃষ্টি হবে।কেমন যেনো গুমোট পরিবেশ।

অপুর এইদিনে ভার্সিটি আসার একটুও ইচ্ছে ছিলোনা।
কিন্তু আসতে হলো।পিহু আর রাহুল নাছোড়বান্দা। অপু আসবেনা শুনে তারা ফোনের পর ফোন দিয়ে অপুকে জালিয়ে মারছে।
অপু যেমন তেমন ভাবে তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়।
আরমান খান অপুর যাওয়া আসার জন্য একটা গাড়ি নির্দিষ্ঠ করে রেখে দিয়েছে।তারপরও অপু রিকশায় চলাফেরা করে।
গাড়িতে অপুর দমবন্ধ লাগে।
তারচেয়ে খোলা রিকশায় মোহনীয় বাতাস গায়ে লাগিয়ে আসা যাওয়া করাটাই ভালো।
তবে আজ অপু রিকশাও পায়না।
হাটতে হাটতে রাস্তা দিয়ে এগোয়।
অর্ধেক রাস্তায় এসে অপু রিকশা পায়।
তবু উঠতে ইচ্ছে করেনা।
হাটতেই ভালো লাগে।
আরো খানিকটা পথ পেরোনোর পর অপু পেছন থেকে কারও চিৎকার করে ডাকার আওয়াজ শোনে।
তবে সেটা অন্য কাউকে ডাকছে ভেবে পাত্তা দেয়না।
নিজের মতো করে হাটে।
আরো একটু এগোনোর পর একেবারে খুব কাছ থেকে কেউ বলে ওঠে,

—-রুপা।

অপু থমকায়।পেছন ঘুরে তাকায়।
দেখে তার ভার্সিটির সিনিয়র ভাই।রায়হায় ভাই।কদাচিত দেখা হয়েছিলো তাদের।
কথাও হয়েছে দু’একটা তাও সৌজন্যমুলক কথা।

তাকিয়ে দেখে রায়হান ভাই দুহাত হাটুতে রেখে মাথা নিচু করে হাঁপাচ্ছে।
অপু আশেপাশে তাকায়।
নাহ অন্য কোন মেয়েতো নেই আশেপাশে? তাহলে রুপা বলে কাকে ডাকে উনি?

রায়হায় বলে ওঠে,

—ভার্সিটি যাচ্ছো রুপা?

অপু অবাক হয়ে বলে,

—রুপা কে?

—কেনো তুমি?

—কিন্তু আমার নাম তো রুপা নয়।

রায়হান মাথা নিচু করে হেসে বলে,

—অপরুপা তো নাম।সেখান থেকে অপ টুকু বাদ দিয়ে রুপা বানিয়ে দিয়েছি।
খারাপ হয়েছে নামটা?

অপু হেসে ফেলে।বলে,

—না।

রায়হান হাফ ছাড়ে।

—যাক বাঁচালে, ভাবলাম তোমার নামটা বোধহয় পছন্দ হয়নি।
তো কোথায় যাচ্ছো বললে নাতো?

—ভার্সিটিতে।

—ওহ,আমিও যাচ্ছি।
একসাথেই যাই কি বলো?কোন আপত্তি আছে নাকি?

—না না,আপত্তি কেনো থাকবে।

অপুর ভালোই লাগে হাটতে।
রায়হান খুব মজার মানুষ।হাসির হাসির কথা বলে অপুকে হাসিয়ে মারে।নিজেও হাসে।
অপুর অবাক লাগে,এতো প্রানোচ্ছল মানুষও হয়?

ভার্সিটিতে এসে রায়হান নিজের মতো করে হেটে চলে যায়।অপু তার ডিপার্টমেন্টের দিকে হাটে।
পথিমধ্যে পিহু এসে পথ আগলে দাঁড়ায়।
মুখ ফুলিয়ে বলে,

—এতোক্ষণ কেনো লাগলো তোর?

—হেঁটে এসেছি তাই।কিন্তু ঠিক টাইমেই এসেছি দেখ।

—কোথায় ঠিক টাইম,একঘন্টা লেট করেছিস।

—কিন্তু ক্লাস তো এখনো শুরু হয়নি।

পিহু আরেকটু রেগে বলে,

—গোল্লায় যাক তোর ক্লাস।

অপু অবাক হয়।রাহুল পাশ থেকে বলে,

—কিছু বুঝলি নাতো?

অপু মাথা নাড়ে সে কিচ্ছু বোঝেনি।

রাহুল বলে,

—আরে পিহু তো এখন কলেজ করবেনা,আমাদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাবে।
ট্রিট দেবে আমাদের বুঝলি?

—হঠাৎ ট্রিট কেনো?

—ক্রাশকে দেখার খুশিতে?

—ক্রাশ?

রাহুল এবার যেন অধৈর্য হয়।বলে,

—আরে বাবা সামনের রেস্টুরেন্টে নাকি পিহুর ক্রাশ মিটিং করতে এসেছে।পিহু অনেক কষ্টে খোজ নিয়ে জেনেছে।
তাই সেই রেস্টুরেন্টে যাবে তাকে দেখতে।
সেই সুবাদে আমাদেরও খাওয়াবে।
নয়তো আমরা যাবো কেনো?

পাশ থেকে পিহু তাড়াহুড়ো দেখিয়ে বলে,

—হয়েছে বোঝানো নাকি আরও দেরি আছে?আমার ক্রাশ তো চলে যাবে নাকি?তাড়াতাড়ি চল।

রাহুল আর অপু পিহুর পাগলামি দেখে একযোগে হাসে।
পিহু তা দেখেও কিছু বলেনা।অন্য সময় হলে তাকে নিয়ে হাসার অভিযোগে বিরাট আকারের ঝগড়া বাধাতো সে।
কিন্তু এখন তার একটুও সময় নেই।
তার ক্রাশকে দেখার জন্য সে মরিয়া হয়ে আছে।

,

,

পিহু অপু আর রাহুল রেস্টুরেন্টে পৌছায়।
টেবিল বুক করে তিনজন চেয়ার টেনে বসে।
রাহুল তার মনমতো খাবার দাবার অর্ডার করে।আজ সে পিহুর পকেট খালি করবে এমনটাই যেনো তার ইচ্ছা।
অপু সেদিকে তাকিয়ে আবার হাসে।
দুটো পাগল কিভাবে যে তার বন্ধু হলো সেটা অপু ভেবে পায়না।

পিহু চাপা কন্ঠে বলে ওঠে,
–অপু পেছনে তাকা,ওই যে ওদিকে তাকা ওদিকে।
কালো কোর্ট পরা হ্যান্ডসাম লোকটাকে দেখ।
তুই ও যদি দেখে ক্রাশ না খাইছিস তো বলছি কি।

অপু পিহুর কথামতো পেছনে ঘোরে।
চার পাঁচজন লোকের মাঝে একজনকে দেখে সে স্তব্ধ হয়।
এতোদিনের চেপে রাখা কষ্টগুলো হুড়মুড় করে মাথা চাঁড়া দিয়ে ওঠে।
চোখ ঝাপসা হয়।
মাথাটা ঘুরে ওঠে।

,

,

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here